Monday, October 12, 2009

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী'র কিছু সংগ্রহীত Artical

0 comments
পাকিস্থান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ববঙ্গ সরকারের দাসসুলভ মনোবৃত্তির কারণে করাচিতে অবস্থিত পাকিসত্দানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গকে আর্থিকভাবে বঞ্চিত করতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গের ওপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ব্রিটিশ আমলে মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মৰেত্র ছিল ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশে। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উলেস্নখ যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিসত্দান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ৰমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর রম্নষ্ট হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রম্নটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মিসম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিসত্দান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ গু-া দিয়ে সভা বানচাল করার চেষ্টা করে। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ফলে ১৩ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ওই সালের ২৪ ডিসেম্বর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। সভায় যেসব প্রসত্দাব গৃহীত হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল_ ১) পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসন, ২) রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ইত্যাদি।
১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রম্নয়ারি নুরম্নল আমিন সরকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেৰিতে গুলি করে হত্যা করে কয়েকজন ছাত্রকে এবং ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন বা সমর্থক ছিলেন তাদের গ্রেফতার করে। মওলানা ভাসানীও গ্রেফতার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৫৩ সালে অসুস্থ শামসুল হকের স্থলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলৰে ৰমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন_ ১) মওলানা ভাসানী, ২) একে ফজলুল হক ও ৩) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল_ ১) লাহোর প্রসত্দাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১শে ফেব্রম্নয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রৰার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক গঠিত যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। ৰমতাসীন মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়। তারা শুধু ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ 'মুসলিম' শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পাকিসত্দান পূর্ববঙ্গকে কব্জায় রাখার জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরম্ন করে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাকলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। ওইদিকে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারীতে একটি বিরাট সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ১০ ফেব্রম্নয়ারি পর্যনত্দ অনুষ্ঠিত হয়। এরূপ সাংস্কৃতিক সম্মেলন যা অত্যনত্দ সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন হয়েছিল সেরূপ সাংস্কৃতিক সম্মেলন আর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ৮ ফেব্রম্নয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিসত্দানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী পাকিসত্দানকে সালামু আলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। আসলে এই উক্তির অনত্দরালে স্বাধীনতার দাবি উহ্য অবস্থায় ছিল।
এর মধ্যে পাকিসত্দানের শাসকশ্রেণীর মধ্যে নানা বিভেদ-বিভাজন চলতে থাকে। সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় পাকিসত্দান সোহরাওয়ার্দীকে দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করেছিল। কার্যসিদ্ধি হয়ে গেলে তারা তাকে পরিত্যাগ করে।
১৯৫৮ সালে প্রধান সেনাপতি আয়ুব খান ২৭ অক্টোবর ৰমতা দখল করে এবং গণতন্ত্রকে অবরম্নদ্ধ রেখে ১০ বছর পাকিসত্দান শাসন করে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ছয়দফা দাবি পেশ করলে আয়ুব খান হুমকি দিয়ে বলেন যে, এর জবাব অস্ত্রের ভাষায় দেয়া হবে। ছয় দফা দাবি পেশ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে অনেক নির্যাতন সইতে হয় এবং কারারম্নদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে আরও ৩৪ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরম্নদ্ধে পূর্ব পাকিসত্দানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল দ্বারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিচার কার্য আরম্ভ হয়। এই মামলাটিকে সরকার 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' হিসেবে বর্ণনা করতে থাকে।
পাকিসত্দানের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন দমন করা। এই মামলার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলাতে পারলেই বাঙালির সব আন্দোলন থেমে যাবে কারণ তিনিই তাদের একচ্ছত্র নেতা। এ প্রসঙ্গে এডভোকেট সাহিদা বেগম লিখেছেন_ 'মামলার অগ্রগতি এবং ট্রাইব্যুনালের প্রতিদিনের কার্যবিবরণী দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে প্রকাশিত হওয়ায় মামলাটির ব্যাপারে জনমনে প্রচ- আলোড়ন জেগে উঠতে শুরম্ন করে। মামলার বিরম্নদ্ধে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। বাইরের আন্দোলন আরও বেগবান ও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য রাজনৈতিক শক্তির ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মামলার প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি ১নং আসামি শেখ মুজিবুর রহমান তখন কাগমারীতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানীকে বাইরের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের আহ্বান জানিয়ে অনুরোধ পাঠান। শেখ মুজিব জানতেন, জনবরেণ্য কোন নেতা এই আন্দোলনে অগ্রগামী ভূমিকা না নিলে বাইরের আন্দোলন আগুনমুখী হয়ে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হবে না। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতাদর্শী হলেও শেখ মুজিবকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। সংবাদ পেয়ে মওলানা ভাসানী সেই সংবাদদাতার সম্মুখেই উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন 'শেখ মুজিব বলেছে। আমাকে যেতে হবো সরকার এদের সবাইকে ফাঁসি দেবার ষড়যন্ত্র করছে।' পরদিন থেকে মওলানা ভাসানী ঢাকার রাজপথে। পল্টনের বিশাল জনসমুদ্রের সভায় উত্তাল মানুষগুলোকে তিনি অগি্নময় কণ্ঠে আহ্বান জানালেন সরকারবিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে।'' সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হবার ফলে এবং পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণহীন না হয়ে পড়ে সেই কথা বিবেচনা করে পাকিসত্দান সরকার ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রম্নয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্ত নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেন। যে দুর্বার গণআন্দোলনের ফলে শেখ মুজিব বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেন তার সূচনা করেছিলেন মওলানা ভাসানী।
পাকিসত্দানের সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানকে সরিয়ে দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ৰমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেন এবং পাকিসত্দানের প্রেসিডেন্ট রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। নীতিনির্ধারণী ভাষণে তিনি পশ্চিম পাকিসত্দানের এক ইউনিট পদ্ধতি বাতিল করেন। সংখ্যা-সাম্যনীতি বাতিল করে এক মানুষ এক ভোট পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে এই রূপ ঘোষণা দেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই প্রতিশ্রম্নতি ইয়াহিয়া খান প্রদান করেন।
নানা পারিপাশ্বর্িক অবস্থা থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর যাতে সুবিধা হয় সেজন্য মওলানা ভাসানী তার দল ভাসানী ন্যাপকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেননি। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালে মওলানা ভাসানী একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন। যার ফলশ্রম্নতিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিসত্দানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে ফলাফল ঘোষিত হবার পর মওলানা ভাসানী সবার আগে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং মনত্দব্য করেন যে বাঙালি জনসাধারণ বাঙালির স্বার্থ রৰার জন্য সঠিক কাজটি করেছে।
অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়েও পূর্ববঙ্গের জন্য তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। পাকিসত্দান বাঙালিকে ৰমতা দেবার জন্য কখনই ইচ্ছুক ছিল না। তাই তারা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পাকিসত্দান থেকে তারা দুই ডিভিশন সৈন্য আমদানি করে।
জাহাজে করে অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে থাকে। অবশেষে পাকিসত্দান দখলদার বাহিনী ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর ঢাকার নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে বহু শিৰক, ছাত্র ও ছাত্রীকে হত্যা করে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করলে পাকিসত্দানি সৈন্যরা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় তবে রাত শেষে পুলিশের প্রতিরোধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হানাদার বাহিনী ইপিআর বাহিনী সদও দপ্তর পিলখানাতেও হামলা চালায়। সারা পূর্ববঙ্গে তারা হত্যাকা- আরম্ভ করে। তবে বহুস্থানেই পাকিসত্দান বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সনত্দোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। এই সময় তিনি বিবিসি ও আকাশ বাণীর সংবাদ শুনতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর তিনি জানতে পারেন যে বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ ও জনগণ পাকিসত্দান বাহিনীর সঙ্গে প্রত্যৰ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তবে এই প্রতিরোধ স্বল্পদিন স্থায়ী হয়েছিল।
এদিকে পাকিসত্দান বাহিনী হন্যে হয়ে মওলানা ভাসানীকে খোঁজাখুঁজি করছিল। কিন্তু তিনি তাদের দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিসত্দান বাহিনী তার সনত্দোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানত্দ অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ সীমানত্দ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে পেস্ননে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাটে দুটি কৰ তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পৰে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যেন পূর্ববঙ্গে পাকিসত্দান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিসত্দানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদগোর্নির কাছে পাকিসত্দানি সৈন্যরা বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরম্নদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাকিসত্দানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রৰার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তমস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু'বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
এর মধ্যে ভাসানী ন্যাপের মহাসচিব মসিউর রহমান যাদু মিয়া পাকিসত্দানি সামরিক চক্রের ষড়যন্ত্র মোতাবেক মওলানা ভাসানীকে অধিকৃত বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কলকাতায় এসে টাওয়ারলজ নামক হোটেলে আসত্দানা নিয়েছে। কিন্তু সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী যাদু মিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন না। তখন ভগ্ন হৃদয়ে যাদু মিয়া অধিকৃত পূর্ববঙ্গে ফিলে গেলেন এবং হানাদার বাহিনীর তাঁবেদারি করতে লাগলেন। এর জন্য যাদু মিয়াকে মুক্তি সংগ্রাম চলাকালেই ভাসানী ন্যাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। উপদেষ্টা কমিটির প্রথম সভায় মওলানা ভাসানী সবাইকে এই মর্মে সাবধান করে দেন যে, মুক্তি সংগ্রাম অপ্রতিহত গতিতে চলবে। কোনরূপ আপসকামিতাকে বরদাসত্দ করা হবে না। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন_ ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিং, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিলিস্ন ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম নেতা হিসেবে ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে অতুলনীয় আতিথেয়তা ও সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেন। ভারতে থাকাকালীন তার জীবন রৰার্থে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করলেও বাসত্দবে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার গুরম্নতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিলিস্নর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করে ভারত সরকার তাকে সুস্থ করে তোলেন।
দিলিস্নতে থাকাকালীন সময়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার সরকারি বাসভবনে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারত সরকার সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে এই আশ্বাস তিনি মওলানা ভাসানীকে প্রদান করেন। এই আশ্বাসের পরিপ্রেৰিতে মওলানা ভাসানী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আনত্দরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যনত্দ মওলানা ভাসানী ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে দিলিস্নতে অবস্থান করেন এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথম বিরোধী দল গঠন করা, ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিসত্দানের উদ্দেশ্যে সালায়মালায়কুম উচ্চারণ করা, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সূচনা করে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্তভাবে সামরিক কারাগার থেকে মুক্ত করা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণ না করা ও মুক্তি সংগ্রামে দ্বিধাহীনভাবে অংশগ্রহণ করায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তার পশ্চাৎমুখী বিতর্কিত ভূমিকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের ইতিহাসে তার সে আসন থেকে তিনি কখনই বিচ্যুত হবেন না।
*******************************************************************************
উপরের লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক সংবাদ
*******************************************************************************
আবদুল হামিদ খান ভাসানী
আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬) বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। দেশের মানুষের কাছে 'মজলুম জননেতা' হিসাবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় বামপন্থী মাওধারার রাজনীতির সাথে জড়িয়ে ছিলেন। তার অনুসারীদের অনেকে এজন্য তাকে "লাল মাওলানা " নামেও ডাকতেন।তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং ষাটের দশকের শুরুতেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো।
জীবনী
১৮৮০-১৯২৯
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। মক্তব হতে শিক্ষাগ্রহন করে কিছুদিন মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম যান। ১৯০৩ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহন করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৬-এ আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন।এখান থেকে তার নাম রাখা হয় " ভাসানীর মাওলানা "।  এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
 ১৯৩০-১৯৫৯
১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে 'লাইন প্রথা' চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন।এসময় তিনি " আসাম চাষী মজুর সমিতি" গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে "বাঙ্গাল খেদাও" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটি সহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উলেস্নখ যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ৰমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মিসম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্ম যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। কাগমারী সম্মেলনে১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে।এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতিএর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন।  ১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।
১৯৬০-১৯৬৯
বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই 'সম্মিলিত বিরোধী দল' (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।  ১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।
১৯৭০-১৯৭৬
১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন।অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রান ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারী ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন।২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িযে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তান বাহিনী তার সনত্দোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাট তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পৰে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যেন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রৰার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু'বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন_ ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিং, ৩) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪) মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মওলানা ভাসানী কলকাতা ছাড়াও দেরাদুন, দিল্লী ও অন্যান্য স্থানে অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে অনেকে অভিযোগ করেন যে ভারতে থাকাকালীন তিনি নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতে অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী দুইবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে দিল্লী অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সে ভর্তি করা হয়েছিল।  বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। ১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬-এর ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চে নেতৃত্ব দেন। একই বছর ২ অক্টোবর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
 মৃত্যু
১৯৭৬ খৃস্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করে।
সমাজ সংস্কার
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। আসামে ৩০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কারিগরী শিক্ষা কলেজ, শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। এছড়াও তিনি কাগমারিতে মাওলানা মোহাম্মস আলী কলেজ এবং পঞ্চবিবিতে নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
 প্রকাশিত গ্রন্থ
দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)

0 comments:

Post a Comment