Friday, October 16, 2009

সোনার মানুষ ভাসছে রসে

0 comments
লিখেছেন..ফখরুল আবেদীন, প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো'য়
লম্বা ইঞ্জিন-নৌকাটির দুই ধার ধরে বসে থাকা ৪০-৪৫ জন নারী-পুরুষ। কারও মুখেই টু শব্দটি নেই। থাকলেও তা পাশের জনের কানে পৌঁছানোর কথা নয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটানা ঠাঁ ঠাঁ শব্দ করতে করতে কচুরিপানার ঘর-সংসার তছনছ করে এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকা। ইছামতীর টলটলে জল কেটে এদিক-ওদিক হেলেদুলে এগিয়ে চলেছে একদল রাতজাগা লালন সাঁইয়ের ভক্তকে নিয়ে। গন্তব্য মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের গ্রাম দোসরপাড়া, যেখানে আগের দিন ৫ অক্টোবর থেকে চলছে লালন সাধকদের লালনবন্দনা। চলছে ‘লালন শাহ বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ ১৪১৬’। ৫ ও ৬ অক্টোবর দুদিনজুড়ে এ আয়োজনে এবার জাপান ও ভারত থেকেও এসেছিলেন লালনসাধকেরা।

মেঘের হাতে বন্দী চাঁদ সেই সন্ধে থেকেই। মেঘ চুইয়ে নেমে আসা জ্যোত্স্না পথ দেখায় নৌকার মাঝিকে। দূরে মিটিমিটি আলো দেখা যেতেই খানিকটা চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল যাত্রীদের মধ্যে। দাঁড়িয়ে পড়লেন দু-একজন। নৌকোর মাঝিকে আরও গতি বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করলেন কয়েকজন। তর যেন সইছে না। দোসরপাড়া গ্রামের টেকেরহাটের নরম মাটিতে যখন নৌকা তার মাথা সেঁধিয়ে দিল, তখন রাত প্রায় আটটা। জ্বলজ্বলে আলোর মতো মানুষের কলকাকলিতে মুখর এক হাট। একসঙ্গে এতগুলো হাসিখুশি মানুষ দেখিনি বহু দিন। লালনের গানের প্রেমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন নানা পেশার মানুষ। গ্রামের মানুষের খাতিরদারি শুরু হলো হাটে ঢোকার পর থেকেই। ধোঁয়া ওঠা সবজি-খিচুড়ি যেন অমৃত।
মূল অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছুটা সময় তখনো বাকি। চায়ের কেটলির গরম জলে পড়ছে নতুন পাতা। দারুচিনি আর এলাচ দেওয়া চায়ের স্বাদ মনে থাকবে বহুদিন। ওদিকে পাকোড়াগুলোও ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এর মধ্যে চমকে উঠলাম তিন ভিনদেশি সাধু দেখে। মাকি কাজুনি, ফোকাওযাওয়া আর শুকো নিশিমুরা এসেছেন সুদূর জাপান থেকে এই সাধুসঙ্গে, লালনের গান শুনতে, গান শোনাতে। তিনজনেরই এই প্রথম বাংলাদেশে আসা। এর মধ্যে মাকি কাজুনি লালন ও দরবেশ সাধন ফকিরের গানের সাধনা করেছেন দীর্ঘদিন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের লালনসাধক দরবেশ সাধন ফকিরের কাছে সংগীত শিখছেন বহুদিন ধরে। শিষ্যের মতো দরবেশ সাধন ফকিরও প্রথমবারের মতো এসেছেন তার দলবল নিয়ে এই সাধুসঙ্গে। সাধুসঙ্গের অন্যতম উদ্যোক্তা কবির হোসেনের আমন্ত্রণে এসে দরবেশ সাধন ফকির রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। বললেন তাঁর মুগ্ধতার কথা, ‘এখানে এসে সত্যি আমি মুগ্ধ হয়েছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে লালনসংগীত পরিবেশন করার মধ্যে অন্য রকম এক মজা আছে।’ জানালেন আবারও আসতে চান। বললেন এই সাধুসঙ্গকে দুই বাংলার লালনসাধকদের মিলনমেলায় পরিণত করার স্বপ্নের কথা। শোনালেন নিজের ‘সাঁইয়ের লীলা বুঝবি ক্ষ্যাপা কেমন করে’সহ কয়েকটি লালনসংগীত। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। একে একে গান শোনালেন পশ্চিমবঙ্গের স্বপন অধিকারী, সুমন্ত বাউল, ভজন দাস বৈরাগীর সঙ্গে এ দেশের দরবেশ নহির শাহ, রাজ্জাক বাউল, টুনটুন বাউল, তকবির হোসেন শাহসহ আরও অনেক বাউলসাধু। এঁদের মধ্যে জাপানি নারী মাকি কাজুনি ও ফোকাওযাওয়া লালন গান পরিবেশন করে মুগ্ধ করে দেন উপস্থিত ভক্ত-অনুসারীদের।
লালন শাহ বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ ১৪১৬ চতুর্থবারের আয়োজনে সাধুসঙ্গে লালনজীবনী ও সাধনাবিষয়ক বয়ান এবং লালনগীতি পরিবেশন করেন কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলের লালন সাধক ও ভক্ত-অনুসারীরা। লালন শাহ বটতলা মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গ ও ধামের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘লালনসংগীত বিদ্যালয়’। ৫ অক্টোবরে স্কুলটির উদ্বোধন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লালন-গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী, দরবেশ নহির শাহ এবং ড. ফজলুল আলম। ওই দিনই বিকেল সাড়ে চারটায় সাধুগুরুদের আসন গ্রহণ ও অধিবাস। এরপর পর্যায়ক্রমে মধুপূর্ণিমা সাধুসঙ্গের নামকরণ কার্যাবলি ও বিধিবিধান জ্ঞাপন, ফকির লালন সাঁইজির জীবনলীলা স্মরণ, গুরুকর্ম, সমবেত কণ্ঠে গুরুদৈন্য ও দৈন্য গানের পর রাত সাড়ে আটটায় শুরু হয় লালনগীতির মূল আসর। চলে ভোররাত পর্যন্ত। ৬ অক্টোবরও গোষ্ঠ গান, গুরুকর্ম, বাল্যসেবা, পূর্ণসেবার পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় রাতের লালনগীতির মূল আসর চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লালন সাধক দরবেশ সাধন ফকিরের নিজের গাওয়া গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তবলা বাজিয়ে চলেছেন সুকুমার মালিক আর রমজান ফকির।
তাঁদের এই যুগলবন্দী ঘুম কেড়ে নিয়েছে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার। অসহায় ঘুমের পরিরা বেছে নিয়েছে দু-একটা ছোট্ট শিশুকে। খানিকক্ষণ আগেও বাবার কোলে বসে গান শোনা শিশুটি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাবার কোলে বসে লালনসংগীত শোনার এই রাতের কথাই হয়তো বলে বেড়াবে কোনো এক যান্ত্রিক জীবনে।
রাত বাড়তে থাকে, বাউলের কণ্ঠ ভারী হয়। একতারা আর বাঁশির সুর এখনো নবীন। ফিরে আসার পালা। চুপি চুপি পা বাড়াই ঘাটের দিকে। কানে বাজতে থাকে মাকি কাজুনির গাওয়া সাঁইজির ‘সোনার মানুষ ভাসছে রসে’ আর আমি সোনার মানুষ হতে পারিনি তাই ভেসে পড়ি ইছামতীর জলে। মেঘের কবল থেকে চাঁদ এখন মুক্ত। অপার্থিব জ্যোত্স্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ইছামতীর নিস্তরঙ্গ জল কেটে এগিয়ে চলেছে নৌকা। তাকিয়ে রই ফেলে আসা হাটের পানে। হাটের উজ্জ্বল আলোগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

Free Website Hosting

0 comments:

Post a Comment