Friday, October 30, 2009

শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ

0 comments
পল্লীগীতির কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্মদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর মেয়ে বিখ্যাত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান

আব্বাকে তো সবাই একজন শিল্পী হিসেবেই জানে। আমি জানি বাবা হিসেবে। আদর্শ বাবা। কিন্তু তিনি কেমন স্বামী ছিলেন—কথাটা মা বেঁচে থাকলে ভালো বলতে পারতেন। হয়তো কোনো সময় বলেছেনও। আমি সন্তান হিসেবে যতটুকু দেখেছি, আব্বা সত্যিই ভালো স্বামী ছিলেন। মাকে তিনি আলাদা সম্মান করতেন।
মার আসল নাম লুত্ফুন্নেছা। আব্বা আদর করে আলেয়া ডাকতেন।
প্রায় সব সময়ই দেখা যেত, যেকোনো ব্যাপারে আব্বার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিয়েছে। কিন্তু একটিবারের জন্য হলেও তিনি মাকে জিজ্ঞেস করতেন, আলেয়া তুমি কী বলো?
এটা আমার খুব ভালো লাগত। এখানে আব্বার একটা রোমান্টিকতা প্রকাশ পেত। আব্বার মতো প্রেমিক স্বামী পাওয়া যেকোনো নারী জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।
ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে আব্বা সব সময় মার সহযোগিতা নিতেন। মা যে খুব শিক্ষিত নারী ছিলেন, তা কিন্তু নয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরের বছর আমার বড় ভাই মোস্তফা কামালের জন্ম।
মার সঙ্গে বাবার একেবারে ঝগড়া হয়নি, এটা ঠিক না। কিন্তু আমরা টের পেতাম না। উঁচু কণ্ঠে চিত্কার কখনো শুনিনি। মাঝেমধ্যে দেখতাম, মা হয়তো কোনো কারণে অভিমান করেছেন। আব্বা সেটা বুঝতেন। তারপর মাকে নিয়ে রিকশায় করে কোথাও ঘুরতে চলে যেতেন। কিংবা সিনেমা দেখে আসতেন। যাওয়ার আগে বলতেন, ‘মাগো তোমরা পড়ো। আমরা একটু ঘুরে আসছি।’
আব্বা ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। নামাজের ব্যাপারে বেশ তাগিদ দিতেন। প্রতিদিন মাগরিবের নামাজটা আমরা এক সঙ্গে আদায় করেছি। তাই যেখানেই থাকতাম, মাগরিবের সময় বাসায় ফিরতাম।
পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার পর আমার চাচা-চাচিরাও চলে এলেন। আব্বা নিজের বাড়িতে তাঁদের রেখেছেন। আমাদের পুরানা পল্টনের বাড়িটা একটা মেলার মতো ছিল। খুব আত্মীয়স্বজন আসত। বছরের বেশির ভাগ সময় আমরা নিজেদের বিছানায় ঘুমানোর সুযোগ পেতাম না। যেখানে পড়েছি, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। কেউ ছুটি কাটাতে, কেউ চিকিত্সার জন্য, কেউ ভর্তি হতে কিংবা চাকরির জন্য আসত। এসব কাজে আব্বার কোনো কার্পণ্য ছিল না।
আব্বা কাউকে হেয় করে কথা বলতেন না। বেদারউদ্দিন চাচা, সোহরাব চাচা, শামসুদ্দিন চাচা, লতিফ চাচা, শেখ লুত্ফর রহমান—এঁদের যে কী স্নেহ করতেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সামনে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা আর পেছনে হিংসা, সমালোচনা—এটা কিন্তু তখন দেখিনি। আব্বা বলতেন, কেউ কারও জায়গা নিতে পারবে না। প্রত্যেকের জায়গা আলাদা।
আব্বা খুব আমুদে ছিলেন। লায়লা আপা—লায়লা আরজুমান্দ বানু—খুব তাড়াতাড়ি কণ্ঠে গান তুলতে পারতেন। আব্বার সেটা খুব ভালো লাগত। তিনি বলতেন, ‘ওর মতো হওয়ার চেষ্টা করো। একটা গান একবার শুনলেই মেয়েটার হয়ে যায়। ও একটা ব্লটিং পেপার।’ লায়লা আপাকে তিনি ডাকতেন ‘ব্লটিং পেপার’। তাঁরা এক সঙ্গে দেশের বাইরে অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছেন।
আভা আলম বলে একটি মেয়ে খুব ভালো গান করতেন। আব্বা তাঁর গানের খুব প্রশংসা করতেন। কোনো শিল্পীকে তুলে আনার ব্যাপারে আব্বার কোনো জুড়ি ছিল না। একবার যদি তিনি বুঝতে পারতেন, একে দিয়ে কিছু হবে, তাহলেই হলো। আব্বা নিজে তো ভাওয়াইয়া গান করতেন। তিনি কিন্তু একা রেকর্ড করে ক্ষান্ত হননি। সেই বলরামপুর, তুফানগঞ্জ, কোচবিহারের গ্রামগঞ্জ থেকে শিল্পীদের কলকাতায় এনে গান রেকর্ড করিয়েছেন। তিনি বলতেন, একা আব্বাসউদ্দীন থাকলে হবে না। আরও শিল্পী তৈরি করতে হবে।
আব্বা আমাকে পল্টন ময়দানে ঈদের নামাজে নিয়ে যেতেন। যতটুকু মনে পড়ে, সেই ছোট বয়সে চার-পাঁচবার অন্য দুই ভাইয়ের সঙ্গে আমাকেও ঈদের নামাজে নিয়ে গেছেন। ঈদটা তো এক দিনের। কিন্তু ঈদ পুনর্মিলনী ছিল একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। এর রেশ থেকে যেত আরও অনেক দিন। এটা আমাদের কাছে খুব আনন্দের ছিল।
তুখোড় ছাত্র ছিলেন আব্বা। সব সময় প্রথম, কখনো দ্বিতীয় হননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল, তাঁর ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনায় খুব ভালো হবে। আমার বড় ভাই আব্বার মতো তুখোড় ছাত্র ছিলেন। পরের ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসীও সমান তালে ভালো করেছেন। আমিও করেছি মোটামুটি।
আমি পড়তাম কনভেন্ট স্কুলে। সেখানে ক্লাসে সব সময় প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতাম। আব্বা সব সময় বলতেন, মাগো পড়ো। তাঁর খুব শখ ছিল, আমি গড়গড় করে বিলেতি মেম সাহেবদের মতো ইংরেজি বলব।
তখন অন্য স্কুলের তুলনায় কনভেন্ট স্কুলের পড়াশোনাটা একটু ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। এর পরও তিনি আমাকে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে আর আব্বাসী ভাইকে পাশের সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই, তখন আমার বয়স ছয়-সাত বছর। প্রথম দিন পড়তে হয়েছিল, ‘আই ক্যান সিং, মাদার ক্যান সিং, ক্যান ইউ সিং।’ আমার এখনো মনে আছে, আব্বা একটা বড় খাতা তৈরি করে পুরো ইংরেজি বইয়ের প্রতিটা শব্দের অর্থ আলাদা করে নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘মাগো মানেগুলো মুখস্থ করো।’
সত্যি বলতে, প্রথম তিন মাসের মধ্যে আমি ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠলাম। এমনভাবে আব্বা আমাকে পড়ালেন, আমার ইংরেজি খুব ভালো হয়ে গেল। আমি গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারলাম। আব্বার স্বপ্ন পূরণ হলো।
আমি পরীক্ষায় প্রথম কী দ্বিতীয় হলাম, তাতে আমার চেয়ে বেশি আনন্দ হতো আব্বার। সবার কাছে তা বলতেন। তবে একটা ব্যাপার দেখেছি, তিনি আমাদের সামনে কখনো প্রশংসা করতেন না। বলতেন, ছেলেমেয়েদের সামনে যদি প্রশংসা করো, তাহলে তারা মাথায় উঠে যাবে। আরও ভালো করার চেষ্টাটা তখন থাকবে না।
আমাকে কনভেন্ট থেকে বলা হলো, তোমার তো বয়স হয়নি। আরও দুই বছর পর সিনিয়র ক্যামব্রিজ দিতে হবে। তখনো আমার ১৫ বছর হয়নি। আব্বা বললেন, তুমি বাংলা স্কুলে ভর্তি হও। ছয় মাসের মধ্যে মেট্রিক পরীক্ষা দাও। পড়াশোনার সঙ্গে যেন বয়সের মিল থাকে।
তিনি আমাকে কনভেন্ট স্কুল থেকে ছাড়িয়ে বাংলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলের নাম ছিল বাংলাবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। ওখানে ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম, মেট্রিক পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস বাকি।
এখানে বিষয়গুলো সব আলাদা। সিনিয়র ক্যামব্রিজে যা পড়েছিলাম, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। যেমন: ইতিহাস। এটা কখনো পড়িনি। এ রকম অনেক বিষয় ছিল। তবে আমার পড়াশোনার মানটা ছিল সেই কনভেন্ট স্কুলের মতো। তাই পরীক্ষায় সব কটি বিষয়েই স্টার মার্কস পেলাম। সংগীতে পেলাম ৯৫। ওটা ছিল সে বছর সর্বোচ্চ নম্বর। আব্বার ভয় ছিল, মেয়ে তো ইতিহাসে গোল্লা খাবে। কিন্তু এই বিষয়ে আমি লেটার নম্বর পেয়েছিলাম। আমি সারা দেশে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় সপ্তম হয়েছিলাম। আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল ২৬ জুন। ১৯৫৬ সাল। দুই দিন পর ২৮ জুন, আমার জন্মদিন। আব্বা বেশ ঘটা করে জন্মদিন উদ্যাপন করার আয়োজন করলেন। অনেক শিল্পী এলেন। সেই অনুষ্ঠানের কথা আমি আজও ভুলিনি। এর আগে আমার কোনো জন্মদিন পালন করা হয়নি।
খুব মজা করতেন আব্বা। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আব্বার খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমরা চাচা ডাকতাম। তাঁর পুরো পরিবারের সঙ্গেই ছিল আমাদের দারুণ সম্পর্ক। তখন আমরা খুব ছোট। এক দিনের ঘটনা—সবাই ঘুমিয়েছে। আব্বা লুঙ্গিটা ওপরে টেনে মালকোচা দিলেন। গায়ে সরিষার তেল মাখলেন। মুখটা অন্য কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন। তিনি চোরের মতো করে সাজলেন। ওই সাজে তিনি মোস্তফা চাচার ঘরে ঢুকে গেলেন। সেখানে ট্রাংক নিয়ে টানাহেঁচড়া করার সময় আওয়াজ হলো। মোস্তফা চাচা টের পেয়ে দিলেন বেদম মার। সেই গল্প যতবারই আব্বা কিংবা গোলাম মোস্তফা চাচা বলতেন, ততবারই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার জোগাড় হতো।
আব্বার সঙ্গে কবি জসীমউদ্দীন চাচার একটা টক্কর থাকত। গল্প করতে করতেই লেগে যেত ঝগড়া। আব্বা তাঁকে খ্যাপাতে পছন্দ করতেন। কিছুক্ষণ রাগারাগির পর আবার গলাগলি, বন্ধুত্ব। এরপর মাকে ডেকে বলতেন, ‘আলেয়া মুড়ি মাখা দাও।’ এটা তাঁরা খুব পছন্দ করতেন। পেঁয়াজ, আদা, কাঁচা মরিচ আর বেশ সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে দিতেন মা। যত ভালো খাবারই থাক না কেন, ওই মুড়ি মাখা থাকলে তাঁদের আর কোনো খাবার লাগত না।
আব্বা খুব স্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করতেন। লাউটা ছিল খুব পছন্দ। আব্বা বলতেন, এটা যতই খাও, ক্ষতি নেই। ফল কেনার বেলায় আব্বা ছিলেন ওস্তাদ। আম, কমলা, কলা যাই কিনুক, কিনেছেন শ ধরে।

আমাদের জন্য তখন একটা কষ্টকর খাবার ছিল খাসির পায়ার স্যুপ। চার আনায় খাসির ৮-১০টা পায়া পাওয়া যেত। বাসায় রোজ পায়া আসত। সকালে সবার নাস্তা হয়ে যাওয়ার পর মা এক হাড়ি পানিতে সেই পায়াগুলো গোলমরিচ আর লবণ দিয়ে কয়লার চুলায় বসিয়ে রাখতেন। বিকেলে ওটা বেশ ঘন হয়ে যেত। সেটা আমাদের অবশ্যই খেতে হতো। প্রতিদিন সেই খাবারটা খাওয়া আমাদের জন্য যে কী কষ্টকর ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। আব্বার মতে, জিনিসটা শরীরের জন্য খুব উপকারী। তাই যত কষ্টই হোক, খেতে হবে।
মাছ ছিল তাঁর খুব প্রিয়। বাজারে গেলে কয়েক পদের মাছ কিনে আনতেন। শিলং, পাঙাস, চিতল, ইলিশ—এগুলো ছিল তাঁর পছন্দ। একদিন তো সবগুলো পদের মাছই তিনি কিনে আনলেন। তখন তো আর ফ্রিজ ছিল না। মাকে তিনি বললেন, ‘আলেয়া যতটুকু পারো রান্না করো।’ তাঁর বন্ধুদের খবর দিলেন। তাঁরা সবাই পরিবার নিয়ে চলে এলেন। রান্না হচ্ছে, আড্ডা হচ্ছে, শেষে খুব হইহুল্লোড় করে খাওয়া হলো। এগুলো আব্বা খুব উপভোগ করতেন।
খাবারের মধ্যে বড় মুরগি ছোট ছোট টুকরা করে টকটকে লাল রান্না খুব পছন্দ করতেন। এ ছাড়া খুব পছন্দের মধ্যে ছিল ইলিশ মাছ আর লাউ-চিংড়ির তরকারি। আব্বা নিজে খুব ভালো রান্না করতেন। কোথাও হয়তো কিছু খেয়ে ভালো লাগলো। বাসায় এসে সেটা আবার আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন।
ছোটবেলায় আমরা খুব ক্যারম খেলতাম। আব্বাও খেলতেন। খেলতে বসে তিনি অন্য কোনো ঘুঁটির দিকে তাকাতেন না। কখন লালটা ফেলবেন, সেটাই ছিল একমাত্র চেষ্টা। ওদিকে আমরা সব ঘুঁটি ফেলে দিলাম। আব্বার খেয়ালই নেই, তিনি সেই লাল নিয়েই আছেন। বড় হওয়ার পর বাড়ির সামনের উঠানে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। হঠাত্ তিনি আমাদের খেলতে বলে রান্নাঘরে চলে যেতেন। সেখানে আলু, ফুলকপিসহ আরও অনেক কিছু সিদ্ধ করে তার সঙ্গে কিছু মশলা দিয়ে চটপটির মতো তৈরি করতেন। খেলা শেষ হওয়ার পর তা খেতে দিতেন।
আব্বা কিন্তু খুব সিনেমা দেখতেন। আমরা যখন বড় হলাম, তখন ছিল উত্তম-সুচিত্রার যুগ। তাঁদের সব ছবিই দেখতেন। যে ছবির গান কিংবা গল্প খুব ভালো লাগত, সেটি কয়েকবার দেখতেন। প্রথম তিনি মাকে নিয়ে দেখে আসতেন। এরপর আমাকে আর আব্বাসী ভাইকে পাঠিয়ে দিতেন দেখে আসার জন্য। কোনো গান যদি খুব ভালো লাগত, তাহলে সেটা আমাকে কয়েকবার দেখাতেন। তখন তো গানপ্রধান ছবি বেশি হতো। যেসব ছবির গান পছন্দ হতো, সেই গানের রেকর্ড কিনে আনতেন। গানটা কণ্ঠে তুলে নেওয়ার জন্য বলতেন। ইংরেজি ছবিও দেখতেন, উর্দু ছবি তত না।
ঢাকায় আসার পর রূপমহল, আজাদ প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে যেতাম। পল্টনে আসার পর গুলিস্তান সিনেমা হল তো আমাদের চোখের সামনে হলো। রূপমহলেই বেশি ছবি দেখা হয়েছে। ওখানে বাংলা ছবিই বেশি দেখানো হতো। আর মেয়েদের জন্য ছিল আলাদা বসার ব্যবস্থা। এখানে মায়ের সঙ্গে ছবি দেখতে যেতাম। টিকিটের দাম ছিল চার আনা কী আট আনা। আসলে তখন তো বিনোদন বলতে শুধু সিনেমা। তাই সিনেমাটাই বেশি দেখা হতো।
আব্বা আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতেন। সেই ছোটবেলায় তিনি আমাদের দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর অনেকবার বিভিন্ন দেশে গিয়েছি। দার্জিলিংয়েও গিয়েছি। কিন্তু আব্বার সঙ্গে সেই প্রথম যাওয়ার অনুভূতিটা এখনো ভুলতে পারি না।
আমাদের বেড়ানোটা হতো সাধারণত শীতকালে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর, ডিসেম্বরে। নিজে যখন নিয়ে যেতে পারেননি, আমাদের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিতেন পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে। অসম্ভব সুন্দর জায়গা। ওখানে আমার চাচা থাকতেন। সেখানে ১৫-২০ দিন বেড়িয়ে আসতাম। আবার নানা বাড়িতেও যেতাম। এই বেড়ানোটা আব্বার নিয়মের মধ্যে ছিল। তাঁর মতে, ছেলেমেয়েরা একটু বেড়িয়ে এলে জানুয়ারি থেকে আবার নতুন উদ্যমে পড়াশোনা করতে পারবে।
আব্বার ডায়েরির একটা লেখা আমার ভালো লাগে। তিনি বেঁচে থাকতে কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাননি। এ ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, ‘এতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি যা পেয়েছি, তা হলো মানুষের ভালোবাসা। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার। আমি জানি, কোনো না কোনো সময় সরকার আমার কাজের মূল্যায়ন করবে।’ হয়েছেও তাই, মৃত্যুর পর তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।
আসলে আব্বা যা বলে গেছেন, তার প্রায় সবই আমার নিজের জীবনে ফলতে দেখেছি। তাঁর মতো দূরদর্শী মানুষ আর দেখি না।
প্রায় পিঠাপিঠি চারটি সিনেমা হল। চারটিতেই একযোগে নাইট শো ভাঙলে সাতমাথার মোড়টা অনেকক্ষণ গমগম করতে থাকে মানুষের ভিড়ে। যে যেদিকেই যাক, সাতমাথায় আসতেই হয়। তারা আসে খেলাশেষে স্টেডিয়াম থেকে বেরুনো মানুষের মতো। একটু আগে দেখা সিনেমাটি গরম চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে না খেলে তাদের আশ মেটে না। সেটা মেটাতে আর দিনের শেষ আড্ডাবাজি সারতে বড়জোর আরও পনেরো মিনিট। রাত তখন বারোটা পেরোয়।

সাতটি রাস্তা যেখানে মিলেছে সেখানটায় চা-লাড্ডু-বনরুটি-পান-সিগারেটের দোকানগুলো ঘিরে কিছু লোক তার পরও খামোখা থেকে যায়। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের ধরবে বলে পনেরো-বিশটা রিকশাও মোটামুটি জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চালকেরা সাধারণত বগুড়ার পুবের যমুনার নদীভাঙা এলাকার কৃষক। লোকে বলে ‘পুবা’। বাদবাকিদের বেশির ভাগই রংপুর-কুড়িগ্রামের আধিয়ার। তখনো ঢাকার লোকেরা ‘মফিজ’ বলে এদের নাম ফাটায়নি। তবে তারা পরস্পরের ‘বাহে’, মানে ‘বাবা হে’। তাদের দেশ-গ্রামের পরিচয়ও নাকি ‘বাহের দেশ’।
যাত্রী না আসা পর্যন্ত এই বাহেরা রিকশার হ্যান্ডেলে পা, পিঁড়ির মতো সিট আর যাত্রীর আসনে শরীরটা এলিয়ে সটান শুয়ে জিরোয়। থানার দিকে যে রাস্তাটা গেছে তার গোড়ার ফ্রেন্ডস অডিওতে তখনই ফুল ভলিউমে বাজতে শুরু করবে বাবুল কিশোরের বিচ্ছেদী গান, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখি গো’, কিংবা ফেরদৌসী রহমান কি আর কারও কণ্ঠে ভাওয়াইয়া, ‘ওকি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’। এই মধ্যরাতে বিক্রিবাট্টার আশা না থাকলেও কী আশায় দোকান খুলে রেখে গানে গানে পত্র লেখা বা কাজল ভোমরার কথা বলে বোঝা ভার। হয়তো আমারই মনের খেয়াল, কিন্তু মনে হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে আছে বলেই ওরা এমন উতলা। ওদিকে ফেরদৌসী তাঁর পরমা গলায় গাইতে শুরু করেন—
‘ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে\
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর বুরিয়া রয় রে\
ও কি গাড়িয়াল ভাই
কত কাঁদিম মুই নিধুয়া-পাথারে।
ও কি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে।’
তারা কি তবে নিধুয়া-পাথারে হাহাকার করে বেড়ানো কোনো নারীর জন্য পথে পথে বাওকুংটা বাতাসের মতো ‘ঘুরিয়া ঘুরিয়া মরে’? যখন আর সে মৈষাল নয়, নয় গাড়িয়াল বন্ধু; সে যখন ওই গরু বা মহিষের ঢংয়েই দুই উরু আর পাছা নাচিয়ে রিকশা চালায়, তখন তার চ্যাংড়া মনে কিসের ফাপর গুমরে মরে কে জানে?
‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধু রে
বন্ধু কোন বা চরের মাঝে
এলা কেনে ঘণ্টির বাজন
না শোনেঙ মুই কানে মইষাল রে।’
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে নয়, গাড়িয়ালের গরুর গলার ঘণ্টি শুনে আকুল হয়ে বাড়ির বাহির হয় ভাওয়াইয়া রাধা। কিন্তু গাড়িয়ালের গাড়ি কি আর এ পথে আসে? মৈষাল গেছে সেই চেংড়িদের দেশে, যারা ‘জানে ধুলা পড়া’, যারা ‘ছল করিয়া কাড়িয়া নিবে/হাতের দোতরা মইষাল রে।’ এবং ‘সেই না দেশে পুরুষ বান্ধা/থাকে নারীর কেশে রে।’ কিন্তু আমাদের রাধাও কম যায় না। ওঝা যেমন সাপের বিষ ঝেড়ে নামায়, তেমনি ‘মুই অভাগী ঝারেঙ বন্ধুক/ক্যাশের আগাল দিয়া রে।’
বাহেদের পূর্বপুরুষ ছিল কৃষিসমাজের সবচেয়ে তলাকার মৈষাল-গাড়িয়াল—মূলত রাখাল। ভাওয়াইয়া গানের মর্মে যে বিরহ-বেদনার গল্প, তার নায়ক এই মৈষাল আর নায়িকা তার ‘যুবা নারী’। এরাই বাহের দেশের রাধা-কৃষ্ণ। তিস্তা বা ধরলা এদের যমুনা। নিধুয়া-পাথার এদের বৃন্দাবন, শিমিলা বৃক্ষ (শিমুল) এদের কদম, বগাবগি কিংবা ডাহুকডাহুকি এদের শুকসারি। আর চিলমারীর বন্দর এদের মথুরা। কৃষ্ণ যেমন মথুরায় গিয়ে আর ফেরে না, ভাওয়াইয়া নারী তার গাড়িয়াল বন্ধুকেও তেমনি হারায় চিলমারীর বন্দরে বা আরও ওপরে কোচবিহারের গোয়ালপাড়ায় কিংবা আসামের কামাখ্যা পাহাড়ে। কিংবা সে বান্ধা পড়ে ব্রহ্মপুত্র কি তিস্তার কোনো চরে জোতদারের বাথানে—
‘বাথান বাথান করেন মৈষালরে
মৈষাল, বাথান কইরচেন বাড়ি—
যুবা নারী ঘরে থুইয়া,
কায় করেন চাকিরি মৈষাল রে।...
বাথান ছারেক, বাথান ছারেক রে
ও মৈষাল ঘুরিয়া আইসেক বাড়ি,
গলার হার বেচেয়া দিম মুঞি
ঐ চাকিরির কড়ি মৈষাল রে।’
মৈষাল আর তার যুবা নারীর প্রেম-দাম্পত্য মিলনহীন। তারা যেন চিরবিরহী ডাহুক-ডাহুকি। সামন্ত সমাজে মৈষালের স্বাধীন কোনো ভূমিকা নেই। বাপ-ভাই আর স্বামীর শাসনে নারীটি অবরুদ্ধ। তার প্রেমিক পেটের টানে দূরের দেশে ঘোরে কিংবা আটকে যায় চাকরির ফাঁদে। এই করুণ জীবনের মর্মব্যথা ফুটে ওঠে আব্বাসউদ্দীনের গলায়—
‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে।
উড়িয়া যায়রে চকোয়া পঙ্খি
বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধর্লা নদীর পারে।
এই কথা শুনিয়া বগী দুই পাখা মেলিল—
ওরে ধর্লা নদীর পাড়ে যায়া দরশন দিলরে;
বগাক দেখিয়া বগী কান্দেরে
বগীক দেখিয়া বগা কান্দেরে।’
ভাওয়াইয়া নারী-পুরুষ এভাবে তাদের সমাজের বন্ধন আর জমিদারি শোষণের ফাঁদে বন্দী হয়ে পরস্পরের জন্য কাঁদে। কিংবদন্তির গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘এইসব ছবি কালিদাসের বা রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে কোনো দিনই আসতে পারে না।’ কারণ, ‘প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও মিলনের সম্পর্ক যে জনসমাজের, তাদের কণ্ঠেই এই ধরনের গান জাগতে পারে।’ (গানের বাহিরানা) তাই ভাওয়াইয়া উত্তরের জনসমাজের জাতীয় গীত।
জনসমাজ বললে আসলে তেমন কিছু বোঝায় কি? আঠারো/উনিশ শতক পর্যন্ত বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর-কোচবিহার অঞ্চলে ব্যাপক আকারে নতুন জনবসতি ও আবাদের পত্তন হতে থাকে। বন কেটে পতিত জমি হাসিল করতে গিয়ে কোচ ও রাজবংশী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বাঙালি কৃষিজীবীরা একাকার হয়ে যায়। এদের বিরাট অংশ মুসলমানও হয় (রিচার্ড ই ইটন, রাইজ অব ইসলাম ইন বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার)। রাজবংশী ও কোচ সমাজের কৌম জীবনের ছাপ তাই ভাওয়াইয়া গানের পরতে পরতে। সংস্কৃতির ভেতর সমন্বয়ের মধ্যে সংঘাতের লক্ষণগুলো চামড়ায় বসন্ত দাগের মতো এখনো ধরা পড়ে। মৈষাল, গাড়িয়াল বা মাহুতের স্বাধীন বিচরণের আকাঙ্ক্ষা আর দরিদ্র কৃষক-কন্যার প্রণয়-প্রতিবাদ সেই ইশারাই করে।
এক নদীতে কয়েকটি স্রোতের মধ্যে একটি যেমন প্রধান, ভাওয়াইয়ার আবহে নারী-মনের বাসনা-বেদনা-বিদ্রোহ তেমনই এক প্রধান স্বর। নারীর এই নিরন্তর আকুলতাই ভাওয়াইয়া গানের প্রাণভোমরা। তাদের মনে তখনো কৌম সমাজের সাম্য ও প্রকৃতিবাসের টান ফুরায়নি। গণনাট্য সংঘের অন্যতম প্রাণপুরুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস মনে করেন, নারীর স্বাধীন প্রেমকে রক্ষণশলীতার নিগড়ে বাঁধার চেষ্টা হলে ভাওয়াইয়া নারী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বাপ-ভাই যখন তাকে বাল্য বয়সে স্বামী নামক এক অচেনা লোকের কাছে টাকা নিয়ে বিয়ে দেয়, সেই অভাগিনী তখন বাবা-ভাই ও সেই স্বামীকে ক্ষমা করে না। মন পোড়ে তার বগার জন্য, মৈষাল বা গাড়িয়াল বন্ধু বা প্রেমিক কাজল ভোমরার জন্য। মদাসক্ত স্বামীর অত্যাচারে জর্জরিত এই নারীর আশ্রয় তখন চ্যাংড়া দেবর।
‘ও মোর ভাবের দেওরা
থুইয়া আয় মোক বাপ ভাইয়ার দেশে রে
বাপ ভাই মোর দুরাচার
বেচেয়া খাইছে মোক দুরান্তর রে
বেচেয়া খাইছে মোক মদকিয়ার ঘরেরে।’
তার কাছে, ‘স্বামী আমার যেমন তেমন/দ্যাওরা আমার মনের মতোন/দ্যাওরা মরলে হবো পাগল, হবো দেশান্তরী রে’। তার এমন প্রণয়ই তার প্রতিবাদ। সমাজপতিদের চাপে তার আপনকীয়া প্রেম যেখানে অবরুদ্ধ, সেখান থেকেই তা পাহাড়ের তলার ঝরনার মতো পরকীয়া প্রেমের খাতে বইতে শুরু করে। তার আপনকার প্রেমের কথাই সে বলে রাধা-কৃষ্ণের বরাতে। কিন্তু তার এই প্রেম রাধা-কৃষ্ণের লীলা নয়, এ তার ব্যক্তিগত ‘সোনার চান্দ’কে পাওয়ার বাসনা। আমরা দেখব, কৌম সমাজের আপনকীয়া প্রেম যখন নিয়ম ও শাস্ত্রের চাপে আর প্রকাশিত হতে পারছে না তখন তার প্রেমিক কালা হয়ে যায় কৃষ্ণ, আরও পরে প্রেমিক কৃষ্ণ প্রভু কৃষ্ণে রূপান্তরিত হন। কিন্তু ভাওয়াইয়া নারীর প্রেম নিজেকে বদলাতে অস্বীকার করে। তার মৈষাল তার আপনকীয়াই, পরকীয়া নয়। কীর্তন-পদাবলি ইত্যাদির সঙ্গে এখানেই তার তফাত। এ পার্থক্য কেবল সুরে বা ভাষায় নয়, এখানেই ভাওয়াইয়া নারীর নিজস্ব স্বর ও আবেগের বিশিষ্ট গড়নটিকে প্রেমের অন্যান্য আখ্যান থেকে আলাদা করা যায়।
দুই.
ভাওয়াইয়ার সুর-কাঠামো আধুনিক গান তো বটেই ‘লোকগীতি’র অন্য অন্য ধারা থেকেও আলাদা। অনেকে একে আর্য ঘরানার বাইরে অনার্য বাহিরানা হিসেবে চিনতে চান। লালনের গান বাউলে গাইলে এক রকম, ভাটিয়ালির ঢংয়ে গাইলে এক রকম আর রাবীন্দ্রিক ভঙ্গিতে গাইলে আরেক রকম। মনের ভাব প্রকাশেও পার্থক্যটা স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ যদি বলেন, ‘আমার মন কেমন করে’, ভাওয়াইয়া নারী বলবে, ‘সোনা বন্ধু বাদে রে কেমন করে গাও রে’। প্রেয়সীর বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ হলে ভাওয়াইয়া বলবে, ‘তুই কালা যেমন দান্তাল হাতি/মুঞিও নারী তেমন ভর যুবতীরে।’ এমন জীবন্ত আর মন-দেহের সপ্রাণ প্রকাশে কীর্তন বা বৈষ্ণব গানের কৃষ্ণের দেহজ কামের বর্ণনাকেও পানসে মনে হতে পারে। ভাব প্রকাশের সকল উপাদান ও রূপক কর্মের আর চারপাশের দেখা জগত্ থেকে নেওয়া। বিমূর্ততার কোনো সুযোগ সেখানে নেই।
বাহের দেশের প্রকৃতি চড়া সুরে বাজে। এই গান মানব-মানবীর ভাবাবেগকে প্রকৃতির উচ্ছ্বাস দিয়েই বোঝে। নিধুয়া-পাথারের রুক্ষতা আর তিস্তা বা ধরলার খরস্রোতের মতোই তাদের জীবন। প্রকৃতির লীলার মধ্যেই তারা তাদের জীবনের অর্থ ও মনের ভাষা খুঁজে পায়। মানবশরীর আর প্রকৃতিশরীরের আলোড়ন-বিলোড়ন ছাড়া কিছুই প্রকাশ হতে পারে না সেখানে। হয়তো তাদের মধ্যে তখনো শরীর আর মনের ভেদ জাগেনি। এ দুয়ের টানাপোড়েনে ভোগা বা এদের শাসন করার ধাত তাদের নয়।
তিন.
একটি প্রশ্ন তার পরও উঠতে পারে: গানের কল্পনা আর জীবনের বাস্তবতার মধ্যে কি কোনো যোগাযোগ ধরতে পারা সম্ভব? জীবনের কোন অভিজ্ঞতা থেকে আসে এই আবেগ, কীসে গড়া হয় ভাবনার ভুবন? দিগন্তে যেভাবে আকাশ আর মাটিকে মিলতে দেখেও সেই মিলন অধরা রয়ে যায়, শিল্প আর জীবনের সম্পর্কের সুতাটিও কি তেমনই অধরা? গীতিকার সুরকার আব্দুল লতিফের আত্মজীবনীতে বলা একটি ঘটনায় সেই সুতার একটা প্রান্ত যেন সহসা মিলে যায়। সেই গল্প দিয়েই শেষ করি: ভাষা আন্দোলনের পরে আব্দুল লতিফ হুলিয়া মাথায় পালিয়ে গিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের এক গ্রামে, বন্ধুর বাড়িতে। গ্রামের সম্পন্ন কৃষক পরিবার। আদর-যত্নের কমতি নেই। কিন্তু বিড়ম্বনা শুরু হলো সেই বাড়ির পরিচারিকা মেয়েটিকে নিয়ে। চৌদ্দ-পনেরো হবে বয়স। দিনের বেলা সেবা-যত্ন যা করার করে, কিন্তু রাতে সে তাঁর ঘরে শুতে আসে। হাত-পা টিপে দিতে চায় ইত্যাদি। এহেন দশায় পড়ে তিনি ধরলেন শিল্পী বন্ধুকে। বন্ধু ততোধিক বিব্রত হয়ে যে ব্যাখ্যা দেন তা অনেকটা এ রকম। ওই অঞ্চলের রীতি হলো, অতিথি এলে বাড়ির ‘দাসী-বাঁদীদের’ দিয়ে তাঁকে খুশি রাখতে হয়। লতিফ সাহেব তারপর মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেন এবং জানতে পারেন তার বাড়ি রংপুরে। খুবই গরিব তারা। বাপ-ভাই তাকে এক রকম বেচেই দিয়েছে এদের কাছে। বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাওয়াইয়া গানের সংকলন ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি বইয়ে একটি গান দেখে চমকে উঠি। মনে হয় এটি যেন সেই মেয়েটিরই দুর্বিষহ জীবনের কথা—যা কাউকে বলা যায় না, এমনকি মাকেও না। গানটিতে এক অভাগিনী নারী বলছে—ও কাক তোমার হাতে আমি এই চিঠি তুলে দিলাম। তুমি এই চিঠি মাকে দিও। কিন্তু মা যখন জলের ধারে যাবে, তখন এ চিঠি দিয়ো না, মা জলে ঝাঁপ দিয়ে মরবে। মা যখন ভাত রাঁধে তখনো দিয়ো না, তাহলে মা অনলে ঝাঁপ দেবে। যখন মা শাড়ি পরবে, তখনো না, মা তাহলে সেই শাড়ি দিয়ে গলায় ফাঁস নেবে। গানটির শেষে মেয়েটি বলছে—
‘যখন মাও মোর নিদ্রারে যাইবে
পত্র থুইবেন কাগা সিথানের পরে
ওকি কাগা দেইখবে মাও মোর সকালে উঠিয়ারে।’
গানের সুরে ও ভাষায় এক বিষাদসিন্ধুর কলকল ধ্বনি কি আমরা শুনতে পাচ্ছি? আব্দুল লতিফের বর্ণিত কাহিনীর মেয়েটিই যেন লিখেছে ওই চিঠি?
শিল্প ও জীবন হয়তো কোথাও মিলে আছে আমাদের অগোচরে; এমনকি ইতিহাসও। বাংলার লোকগীতি আসলে বাংলার পল্লী পরিবেশে বয়ে যাওয়া কৃষক জীবনের আখ্যান, আঞ্চলিকতার খোপে খোপে বেড়ে ওঠা এই ভূখণ্ডের মানবিক ইতিহাস। সেই মানুষের আদমসুরত ওখান থেকেই এঁকে নেওয়া সম্ভব। আমাদের নিম্নবর্গীয় সমাজের লিখিত সাহিত্য নেই বললেই চলে। যা আছে তা তাদের নিজস্ব লিখন নয়। একমাত্র লোকগান-লোকসাহিত্যই সেই আধার, সেখানে তাদের আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-ভালোবাসার খাঁটি বয়ান আমরা শুনতে পারব। পাব সেই দেশজ মনের খোঁজ যা হয়তো বিদেশি শাসনে, নানান বিপরীত সাংস্কৃতিক চাপে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি, বিকৃত হয়নি। আমাদের যৌথ মনের শৈশব জানতে তার কাছে তাই ফিরতেই হয়।
বাহের দেশ দূরের কোনো অঞ্চল নয়, কুড়িগ্রামের সীমান্তে তিস্তা, ধরলা আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে আড়াই হাজার বছর পুরোনো চিলমারীর বন্দর আজও আছে। সেই বন্দরে এখনো অজস্র দেশি নৌকা ভেড়ে। তার পরও চিলমারীর পথে-বন্দরে পা রেখে মনে হয় সেটা যেন অন্য কোনো জগত্, অন্য কোনো সময়। তার বাস যতটা বাস্তবে মনের গভীরেও ততটাই। গাড়িয়াল-মৈষাল-মাহুত বন্ধুরা সেখান থেকে আর ফিরতে পারে না। ভাওয়াইয়া নারী তার কাছে কিরা কাটে, ‘কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যান কয়া যান রে’। কিন্তু সে ফেরে না। কারণ, ‘মইষের চাকরির ভীষণ দায়, মনের বাঘ মইষালক ধরিয়া খায় রে’।
পিছুডাক মৈষালকে ছাড়ে না। সময়ের খাদ থেকেও কে যেন ফের জিজ্ঞেস করে, ‘ও তোমরা গেলে কি আসিবেন, আমার মাহুত বন্ধুরে।’

0 comments:

Post a Comment