Sunday, October 4, 2009

মুক্তিযুদ্ধের অন্য রকম দলিল

0 comments
লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন । প্রকাশিত হয়েছে "দৈনিক প্রথম আলো
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কর্নেল তাহের তাঁর মাকে চিঠি লিখলেন। ১৯৭১ সালের কথা। চিঠিতে মাস-তারিখের উল্লেখ নেই। তবে পঁচিশে মার্চের পর নিশ্চয়। আমার ধারণা, এপ্রিল কিংবা মে মাসের প্রথম দিক। কারণ চিঠিতে ‘ধান পাকতে শুরু হয়েছে’ এমন একটা লাইন আছে। তখনকার দিনে বাংলাদেশে সাধারণত দুই প্রকারের ধান জন্মাত। আমন, আউশ। আউশ ধানটা বর্ষাকালে পাকত, বর্ষাকালেই কেটে বাড়িতে তুলতে হতো। আমন ধান কাটা হতো কার্তিকের শেষ কিংবা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকে। তখনো বাংলাদেশে ইরি ধান আসেনি। ‘বেরো’ ধানের চাষ হতো কোনো কোনো অঞ্চলে। সেই ধান পাকতে শুরু করত চৈত্রের শেষ দিকে। কেটে গোলায় তুলতে তুলতে বৈশাখ মাস এসে যেত। আমার ধারণা, বোরো ধান পাকার কথা লিখেছিলেন কর্নেল তাহের। তাঁদের অঞ্চলে ওই ধান খুব জন্মাত।
কর্নেল তাহের জুলাই মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
তাঁর লেখা চিঠিটি ছিল এ রকম!
আম্মা,
অনেক দিন পর আপনার ও লুত্ফার চিঠি পেলাম। গত পহেলা তারিখে ঈশ্বরগঞ্জ থেকে আব্বার প্রথম চিঠি পাই ও সবার কথা জানতে পারি। এই অবস্থায় আপনারা সবাই ভালো আছেন জেনে অনেক নিশ্চিন্ত হয়েছি। গ্রামে যা আছে তা নিয়েই আপনাদের বাঁচতে হবে। আশা করি সে মতোই আপনারা ভেবে চলবেন। কবে পর্যন্ত যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলা যায় না। আজকাল অবশ্য আপনাদের বিশেষ কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নেই। মাছ পাওয়া যায়। ধান পাকতে শুরু হয়েছে। আজকাল গ্রামে অনেকে এসেছে। ছোটদের পড়াশোনা কবে শুরু হবে লিখেছেন। গ্রামে এখন এত শিক্ষিত লোক। আপনার এক বৌ ইউনিভার্সিটি পড়া, স্কুল-কলেজ বাড়িতে শুরু করে দেন। খাওয়া-দাওয়া ও পানির প্রতি খেয়াল রাখবেন। আজকাল তো আবার ডাক্তার-ওষুধ পাওয়া মুস্কিল হবে।
সৌদি আরব থেকে ভাইজানের চিঠি পেয়েছি, লন্ডন থেকে রফির চিঠি পাই, শেলী ইসলাম ও দিবা ভালো। ইসলামাবাদে ভাইজানের কাছে প্রতি সপ্তাহে যাই। ভাইজান ভালো আছেন। শেরপুর থেকে ভাবীর চিঠি পেয়েছেন। ভালো আছেন।
আব্বা কেমন আছেন? আমাদের জন্য আপনারা ভাববেন না। ভেবে কী লাভ হবে। যখনই সম্ভব হবে আমি আপনাদের কাছে পৌঁছব। খোকা, মনু, বাহার, বেলাল, ডলি-জলিকে লিখতে বলবেন। আপনারা সাহস হারাবেন না।
আব্বা ও আপনি আমার সালাম নেবেন। নীলু কেমন আছে? ওকে লিখতে বলবেন।
ইতি,
আপনার স্নেহের
তাহের


এই চিঠির সূত্র ধরে আমার মন চলে যায় ঈশ্বরগঞ্জে। আমার এক বন্ধুর বাড়ি ছিল ওই এলাকায়। ঈশ্বরগঞ্জ বাজারের কাছাকাছি। ’৭১ সালে সে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাজারের সঙ্গেই তাদের স্কুল। সেই স্কুলে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্প করেছে। আমার বন্ধুটি অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করেনি কিন্তু সে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার। তাকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখেছি। উপন্যাসের নাম জীবনপুর। সেই বন্ধুর মুখে কর্নেল তাহেরের শ্বশুরের কথা আমি শুনেছি, তাঁর স্ত্রী লুত্ফা তাহের, শ্যালিকা নীলুফারের কথা শুনেছি। কর্নেল তাহেরের শ্বশুর ছিলেন খুবই নামকরা চিকিত্সক। সেই হূদয়বান বিশাল মাপের মানুষটিকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ, তাদের ধারণা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কর্নেল তাহের তাঁর শ্বশুরবাড়ির এলাকায় পালিয়ে আছেন। পুরো এলাকার মানুষজন, যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে একটা পুকুরপারে একত্র করেছিল পাকিস্তানি শূকরগুলো। আমার বন্ধুটিকেও ধরেছিল। তার সেই সময়কার অনুভূতির কথা একটু বলি...
‘আমরা যে পুকুরপারে বসে আছি, তার পাশেই রেললাইন। হঠাত্ রেলগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া গেল। তাকিয়ে দেখি, স্টেশনের দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটা মালগাড়ি। আমরা সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। সবাই বুঝে গেছে আমাদের এখন এই মালগাড়িতে তোলা হবে। বগি ভরে নিয়ে যাওয়া হবে ময়মনসিংহের দিকে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের কাছে নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার লাইন করে দাঁড় করাবে। সামনে ব্রহ্মপুত্র নদ, পিছনে পাকিস্তান আর্মি। ট্যা ট্যা করে গুলি ছুড়বে আর আমরা একেকজন লুটিয়ে পড়ব ব্রহ্মপুত্রের জলে। পরদিন আমাদের লাশ ভাসতে থাকবে নদীর এদিক ওদিক। পানি সাঁতরে কুকুরেরা যাবে না সেই লাশ খেতে। ক্ষুধার্ত কাকগুলো উড়ে উড়ে গিয়ে বসবে আমাদের লাশের ওপর। আকাশ থেকে নেমে আসবে শকুন। ঠুকরে ঠুকরে খাবে আমাদের চোখ নাক ঠোঁট।’
কর্নেল তাহেরের মায়ের নাম আশরাফুন্নেসা। সেই মায়ের কথা আমার বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম এভাবে—পরের দিন কর্নেল তাহেরের মা এলেন আমাদের এলাকায়। তিনি খবর পেয়েছিলেন তাঁর বিয়াই আর বিয়াইয়ের মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। তাঁদের বাড়ি হচ্ছে শম্ভুগঞ্জের ওদিককার এক গ্রামে। সাত ছেলের জননী তিনি। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে এমন একজন মানুষ। তিনি এসেছেন শুনে গ্রামের মানুষজন একত্র হয়েছে। সেই মানুষজনের সামনে দাঁড়িয়ে অসাধারণ কিছু কথা বললেন তিনি। আমার সাত ছেলে, সাতজনকেই যুদ্ধে পাঠিয়েছি। এ দেশের প্রতিটি যুবক আমার ছেলে। এ দেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আমার ছেলে। যদি আমার সাত ছেলের সাতজনই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়, যদি সাতজনই প্রাণ দেয় দেশের স্বাধীনতার জন্য, আমার একটুও দুঃখ হবে না। আপনাদের এলাকার যাঁর যেটুকু সামর্থ্য আছে, তা-ই নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করুন। একজনও বসে থাকবেন না। আপনারা কী করছেন? বসে আছেন কেন? যুদ্ধে যাচ্ছেন না কেন?
মানুষজন সব উদ্দীপ্ত হয়ে গেল।
তিনি বললেন, মানুষের যেমন মা-বাবার প্রতি দায় থাকে, মা-বাবার কাছে যেমন ঋণী থাকে সন্তান, দেশের কাছেও ঠিক সেই রকম ঋণ থাকে মানুষের। মনে রাখতে হবে, এই দেশের কাছে, এই মাটির কাছে আপনারা সবাই ঋণী। এই এক সুযোগ, আপনারা যুদ্ধে চলে যান। দেশ স্বাধীন করে দেশ এবং মাটির ঋণ শোধ করুন।
একজন সত্যিকার মায়ের চেহারা কেমন হয়, কর্নেল তাহেরের মাকে দেখে আমি সেদিন বুঝেছিলাম।
এসব কথা মনে পড়ছে একাত্তরের চিঠি পড়ে।
একাত্তরের চিঠি বইটির বেশির ভাগ চিঠিই মাকে লেখা। চিঠিগুলো পড়ে মনে হয়, ‘মা’ ও ‘স্বদেশ’ যেন একই শব্দ, সমার্থক। ১৯ নভেম্বর, ১৯৭১ ‘যুদ্ধখানা হইতে তোমার পোলা’ নুরুল হক ‘মা’কে লেখেন, “আমার মা, আশা করি ভালোই আছ। কিন্তু আমি ভালো নাই। তোমায় ছাড়া কীভাবে থাকি! তোমার কথা শুধু মনে হয়। আমরা ১৭ জন। ৬ জন মারা গেছে, তবু যুদ্ধ চালাচ্ছি। শুধু তোমার কথা মনে হয়, তুমি বলেছিলে, ‘খোকা মোরে দেশটা স্বাধীন আইনা দে’ তাই আমি পিছপা হই নাই, হবো না, দেশটাকে স্বাধীন করবই। রাত শেষে সকাল হইব, নতুন সূর্য উঠব, নতুন একটা বাংলাদেশ হইব...” (সবিনয় নিবেদন, রশীদ হায়দার, সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে)
একাত্তরের চিঠির সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন, সালাহউদ্দীন আহমদ। সদস্যা চারজন। আমিন আহম্মেদ চৌধুরী, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ। প্রকাশক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন। ১০০ গ্রাম আর্ট পেপারে ছাপা ১২৭ পৃষ্ঠার রয়েল সাইজের বইটির মূল্য ২৫০ টাকা। জহির রায়হানের লেখা চিঠির ওপর কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ ধরিয়ে শ্রদ্ধেয় শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বইটির প্রচ্ছদ তাত্পর্যময় করে তুলেছেন। সবকিছু মিলিয়ে বইটি দেখলেই বুকের কাছে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে। যেন ওভাবে জড়িয়ে ধরে রাখলেই এই বইয়ের প্রতিটি শব্দ থেকে ভেসে আসবে ১৯৭১-এর সেই গৌরবময় দিনগুলো, সেই বেদনাময় দিনগুলো। আমরা উদ্দীপ্ত হব, আমরা চোখের জলে ভাসব।
একাত্তরের চিঠি পড়তে পড়তে দু-তিনটি অতি ছোট ছোট বিষয় আমার মনে হয়েছে।
১. বইটিতে কতটি চিঠি আছে এক কথায় বলা যাবে না। গুনে দেখতে হবে। এ কারণে চিঠিগুলোর নম্বর থাকলে ভালো হতো। যেমন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর চিঠিটা কত নম্বর পাতায় কিংবা চিঠির নম্বর কত? শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দীন হোসেনের চিঠিটা আছে কোথায়? চাইলেই পাঠক চট করে বের করতে পারবেন না। পুরো বই ঘাঁটতে হবে।
২. বেশির ভাগ চিঠির শেষে একটা চিকন দাগ দিয়ে তার নিচে লেখা হয়েছে, চিঠির লেখক, চিঠির প্রাপক এবং ‘চিঠিটি পাঠিয়েছেন’। পদ্ধতিটা আমার একঘেয়ে লেগেছে। এটা সহজ করে লেখা যেত, লেখক, প্রাপক, প্রেরক।
কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদের মতো রশীদ হায়দারের ভূমিকাও বইটিকে তাত্পর্যময় করেছে। ছাপা বাঁধাই নিখুঁত। ভুল বানান আমার চোখেই পড়েনি। আর বইয়ের প্রাণ, চিঠিগুলো পড়ে পাঠক নতুন করে উপলব্ধি করবেন সেই উত্তাল সময়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো। কারা জীবন বাজি রেখে, বুকের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা! কেমন ছিলেন সেই বীরেরা, কোন অনুভূতি কোন মন্ত্রবলে তাঁরা পেরেছিলেন দেশের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে! এই বই মুক্তিযুদ্ধের এক অন্য রকম দলিল। এই বই আমাদের চোখের জলে ভাসায়, এই বই আমাদের দেশপ্রেমের মহান উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়। এই বই আমাদের মাথা নত করতে শেখায়, এই বই আমাদের বলে দেয়, দেশের মাটিতে প্রতিটি পা ফেলার সময়, প্রতিটি পা তোলার সময় আমরা যেন মনে করি সেই বীর সন্তানদের কথা, যাঁদের রক্তে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যাঁদের রক্তের বিনিময়ে এই মাটিতে আমরা সগৌরবে বসবাস করছি, জীবনযাপন করছি তাঁদের যেন দিনে একবার আমরা অন্তত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
প্রথম আলো ও গ্রামীণফোনকে কৃতজ্ঞতা একাত্তরের চিঠি প্রকাশের জন্য।

একাত্তরের চিঠি—প্রথমা প্রকাশন, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার ঢাকা-১২১৫; মার্চ ২০০৯।

0 comments:

Post a Comment