Friday, October 16, 2009

কয়েকজন গান্ধী-দ্রষ্টার গল্প

0 comments
খাঁ খাঁ রোদ্দুরে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর। আগুনের হলকা এসে লাগছে গাছতলায় বসে থাকা বৃদ্ধের শরীরে। কিন্তু উত্তাপ যেন স্পর্শ করে না নব্বইয়ের দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে।

থরথর করে কাঁপতে থাকা হাত বাড়িয়ে দেন, অদৃশ্য একটা রাস্তা দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘উই যে রাস্তা দেখা যায়। ওই রাস্তা দিয়ে বাপু হেঁটে যেতেন। হাতে লাঠি, এত্তোটুক একটা ধুতি পরা, চোখে গোল চশমা। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম...’।
বিশ্বাস হতে চায় না যেন বর্ণনাটা। একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে ফিরে তাকাতেই জ্বলে ওঠে বৃদ্ধের চোখ। আহত গলায় বলে ওঠেন, ‘আমি গান্ধীজিরে নিয়ে কি মিথ্যে কথা বলব! গান্ধীজি নিজে আমাগো রামধুন শিখিয়েছেন। শুনবেন?’
উত্তরের অপেক্ষা না করে ভাঙা, বেসুরো গলায় গেয়ে ওঠেন মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় ভজন—
‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম।
পতিত পাবন সীতারাম \’
মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর স্পর্শ পেয়েছেন আবদুস সাত্তার, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমরাও যেন দেখতে পাই, ‘এত্তোটুক একটা ধুতি পরা, চোখে গোল চশমা’, গান্ধীজি হেঁটে যাচ্ছেন।
আবদুস সাত্তারের বাড়ি নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ উপজেলায়। সেই রামগঞ্জ, ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত ভারতবর্ষের আরও অনেক গ্রামের মতো একটি লোকালয়। এখনো দাঙ্গার সাক্ষী মেলে এখানে-ওখানে খুঁজলে। কিন্তু আমরা হানাহানির সাক্ষী খুঁজি না, শান্তির প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান করি। তাঁর সন্ধান দেন আবদুস সাত্তার, রাখাল রাজদত্ত ও আবদুর রাজ্জাক পাটোয়ারীর মতো গান্ধীদর্শীরা। যাঁরা সেই সময়ে কাছ থেকে দেখেছেন সেই মানুষটিকে।


 
 
 
 
 
 
 
মানুষটি এখানে এসেছিলেন ১৯৪৬ সালে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি এবং ভারতের দ্বিখণ্ডিত হওয়া তখন অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সময়ে জ্বলে উঠল ভারতীয় ইতিহাসের ঘৃণ্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন। আগুনের সূত্রপাত কলকাতায়। অনেক জায়গার মতো সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল এই নোয়াখালীতেও।

দাঙ্গার ভয়াবহতায় সেদিন কেঁপে উঠেছিল ভারতবর্ষ। নোয়াখালীর সেই দাঙ্গা থামাতে এক বুক বিশ্বাস নিয়ে ছুটে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তখন তাঁর বয়স ৭৭। গান্ধী আসবেন—এই একটা কথাই বদলে দিল পরিস্থিতি। আজও সেই সময়টা দিব্যি মনে করতে পারেন সাত্তার সাহেব, ‘কী ভয়ের একটা সময় ছিল! হিন্দুরা মুসলমানদের, মুসলমানেরা হিন্দুদের একটুও বিশ্বাস করতে পারত না। আমরা তো তখন ছোট ছোট ছিলাম। এর পরও বুঝতাম, কী একটা ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে। এখানে-ওখানে মানুষের ঘরে আগুন জ্বলছে, মানুষ খুন হচ্ছে। হঠাত্ একদিন শুনি, গান্ধী আসবেন। গান্ধী আসলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। গান্ধী কে! কিছুই বুঝি না, গান্ধীর নামও শুনি নাই। কিন্তু দেখলাম, গান্ধী আসবেন শুনেই কেমন যেন বদলে যেতে থাকল সবকিছু।’
গান্ধী এলেন। ট্রেনে করে নোয়াখালী এলেন। এসেই ঢুকে পড়লেন নোয়াখালীর গ্রামগঞ্জে। শ্রীরামপুর, চণ্ডীপুর, ফতেপুর—একের পর এক গ্রাম ঘুরে চলেছেন। এই করতে করতে একদিন গান্ধীর পদচিহ্ন পড়ল রামগঞ্জে। আবদুস সাত্তার, আবদুর রাজ্জাক—এরা তখন ছোট, দেখলেন গান্ধীর আগমন, তাঁর হেঁটে চলা।
আবদুর রাজ্জাক পাটোয়ারী বর্ণনা করে চলেন গান্ধীর সেই অভিযাত্রা, ‘অনেক দিন ছিলেন রামগঞ্জে। রোজ সকালে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আমাদের হাইস্কুলের মাঠে আসতেন। পথে সাঁকো ছিল। কোনো দিন একা একা পার হতেন। শরীর খারাপ থাকলে আবার কেউ হাত ধরত। একদিন ঝোলায় করেও পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। স্কুলমাঠে এসে প্রথমেই প্রার্থনা করতেন সবাইকে নিয়ে।’
সেই প্রার্থনার সময় খুব কাছ থেকে গান্ধীকে দেখার সুযোগ হয়েছে রাজ্জাক সাহেবের। চোখ দুটি শূন্যে ভাসিয়ে গান্ধীর মুখের বর্ণনা দেন, ‘মনে হতো উনি যেন ধ্যান করছেন। কাছ থেকে চশমার দিকে তাকালে মনে হতো ভেতরে বড় বড় দুটি চোখ। প্রার্থনা শেষ করে সবাইকে বারবার বোঝাতেন, মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি হিংসা করা অন্যায়।’
এতটুকু বিশ্রাম ছিল না তখন গান্ধীর। এই নোয়াখালীতে বসেই খবর পেয়েছিলেন, ভারত ভাগ হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে গর্জে উঠেছিলেন, ‘আগে আমার শরীর দু টুকরো করো, তারপর ভারত ভাগ করো।’ শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন ব্যাপারটা। মেনে নিয়েছেন নিজের নিয়তি, মানুষের জন্য কাজ করা। কী সেই কাজ?
কাজের খানিকটা বর্ণনা করলেন রাখাল রাজদত্ত, ‘বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখতেন, কার কী অবস্থা। এলাকার পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নিয়েও। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন শান্তি নিয়ে।’
ওই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুবকদের বলতেন লাঠি খেলা, দৌড়-ঝাঁপে মন দিতে। সমাজের সেবা করতে। কীভাবে সেগুলো শেখাতেন, বললেন সাত্তার সাহেব, “অনেকগুলো লাঠি নিয়ে একটা করে সবার হাতে দিয়ে তা ভাঙতে বলতেন। পরে আবার অনেকগুলো লাঠি একসঙ্গে বেঁধে বলতেন ভাঙার জন্য। সেটা কেউ পারত না। তখন বলতেন, ‘ধর্মই আমাদের শিখিয়েছে এমন এক হয়ে থাকতে। হিন্দু-মুসলমান সবাই এক হয়ে থাকলে কেউ ভাঙতে পারবে না’।’’
এই শিক্ষা চলত গ্রামে, গ্রামান্তরে। স্বপ্ন ছিল বদলে দেওয়ার। গান্ধীর সেই বদলে দেওয়ার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যান বৃদ্ধ রাখাল, ‘‘আমি তখন এখানে থাকতাম না। একদিন গ্রামে ফিরেছি। দেখলাম, স্কুলমাঠে সবার উদ্দেশে কথা বলছেন গান্ধীজি। বলছেন, ‘লাঠি নয়, তরবারি নয়, বন্দুক নয়; একটু হাসি দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায়।’ এখনো আমার কানে বাজে গান্ধীজির সেই কণ্ঠ—ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম।
সব কো সুমতি দে ভগবান \’’
এই প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান

0 comments:

Post a Comment