Sunday, October 4, 2009

এক ব্যতিক্রমী মাওবাদী বিপ্লবী

0 comments
বাবা বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চবেতনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কলেজপড়ুয়া ছেলে কোবাদের জন্য তিনি একদিন শখ করে সোনার চেইনওয়ালা একটি ঘড়ি কিনে দেন। ঘড়িটি বাবার দেওয়া শখের উপহারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পছন্দের ছিল তার। তাই ঘড়িটি সারাক্ষণ আগলে রাখত ছেলেটি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পরিবারের সদস্যরা লক্ষ করল, কোবাদের হাতে ঘড়িটি নেই। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘড়িটি কি হারিয়ে ফেলেছ?’ কোবাদ শান্ত গলায় জবাব দিল, ‘ঘড়িটি আমি পাশের বাসার কাজের ছেলেটাকে দিয়ে দিয়েছি। ওর ওটা খুব পছন্দ হয়েছিল।’ ওই দিন কোবাদের এমন জবাব শুনে পরিবারের সবাই আকাশ থেকে পড়ে। তাদের আশঙ্কা, ছেলেটা হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছে! অথচ তারা জানত না গরিবের জন্য দরদি এই ছেলেটার মনে রয়েছে একজন মহান বিপ্লবী।
এতক্ষণ কোবাদ নামের যে ছেলেটার কথা বলা হলো, আসলে তিনি হলেন ভারতের নকশালপন্থী বিপ্লবী নেতা কোবাদ ঘেন্দি (৫৮)। ছেলে পাগল হয়ে যাচ্ছে—পরিবারের এমন আশঙ্কা অবশ্য শেষ পর্যন্ত সত্য হয়নি। তবে সেই কোবাদ মহাপাগল হয়েছিলেন। কোবাদের বন্ধুদের মতে, ওই মহাপাগল হতদরিদ্রদের অধিকার আদায়ে বিপ্লবের পথে নেমেছিলেন। ঘুণে ধরা সমাজে তিনি দেখেছেন কীভাবে ভূমিহীন আর দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ দিন দিন আরও দরিদ্র হচ্ছে, বিপরীতে ধনীরা কীভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। তিনি দেখেছেন বঞ্চিত কৃষক কীভাবে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে, কীভাবে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সমাজের ওই উঁচুতলার মানুষজনই নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রকে। তারা শুধু গরিবের অধিকার আদায়ের কথা বলে, কিন্তু কাজ করে অভিজাত শ্রেণীর জন্যই। কোবাদ নিজেও ছিলেন উঁচুতলার মানুষ। তাই হয়তো হতদরিদ্রদের নিপীড়নের চিত্র খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। বিলাসী সুখের জীবন ত্যাগ করে তাই একদিন নাম লেখান ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে। কোবাদ চেয়েছিলেন, মহা ঝড় তুলে সমাজকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেবেন। এরপর সেখানে আবার গড়া হবে নতুন এক সমাজ, যেখানে থাকবে সাম্য আর ন্যায়বিচার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না তিনি। ৩০ বছর গোপনে (আন্ডারগ্রাউন্ড) বিপ্লবের বীজ বুনে ২০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন এই বিপ্লবী। নকশালদের কাছে যে কোবাদ এক আদর্শের নাম!
কোবাদদের পারসি পরিবারে অভাব বলতে কিছু ছিল না। সমাজের উঁচুতলার মানুষ বলতে যা বোঝায়, কোবাদরা তাই-ই। কোবাদের এক ভাই প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব সুনীল শনবাগ। সুনীল বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কোবাদের প্রভাব স্পষ্ট। মাওবাদী রাজনীতিতে জড়ানোর পরও তাঁর জন্য আমাদের পরিবারের সমর্থনে কখনো ভাটা পড়েনি। কারণ আমরা ভালো করেই জানি, কোবাদ গণমানুষের জন্য মুক্তির সংগ্রামে নেমেছে।’
কোবাদ পড়ালেখা করেছেন অভিজাত দুন স্কুল এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। এরপর উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন লন্ডনে। সেখানে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাস করেছেন ভালো ফল নিয়ে।
কোবাদের এক বন্ধু রাজনীতিক পি এ সেবাস্তিয়ান বলেন, মূলত ইংল্যান্ডে পড়ালেখার সময়ই তিনি দেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৫-৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ওই সময় তিনি গড়ে তোলেন কমিটি ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইট (সিপিডিআর) নামের সংগঠন। আসগর আলী ইঞ্জিনিয়ারের মতো আরও অনেক রাজনীতিক তখন এই সিপিডিআরে নাম লেখান।
আরেক বিপ্লবী এবং কোবাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু সুসান সেবাস্তিয়ান বলেন, ‘সমাজের অভিজাত শ্রেণী থেকে আসার পরও কোবাদের মধ্যে কখনো আভিজাত্যের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। সদাহাস্য মানুষটি সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তাঁর স্ত্রী অনুরাধা শনবাগও ছিলেন যোগ্য সহযোদ্ধা। স্বামীর সঙ্গে তিনিও বেছে নিয়েছিলেন বিপ্লবের পথ। জঙ্গলে জঙ্গলে আর বনবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে শরীরে ম্যালেরিয়া বাসা বেঁধেছিল তাঁর। এ অবস্থায় গত বছর মারা গেছেন তিনি। গত বছর বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে কোবাদ বলেছিলেন, ‘ভারতে এখনকার সমাজব্যবস্থাটা হলো আধাসামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক। এ সমাজকে খাঁটি গণতান্ত্রিক পথে আনতে হবে। তাই আমাদের সংগ্রাম হলো ভূমিগ্রাসী আর গরিব-দুঃখীদের ব্যবহার করে যারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তাদের বিরুদ্ধে। গ্রামের হতদরিদ্রদের অধিকার আদায়ের আগ পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবেই।’


মহারাষ্ট্র পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, নাগপুর ও চন্দ্রপুরে কোবাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ মেলেনি।
এরই মধ্যে কোবাদ ঘেন্দির মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন প্রচার শুরু করেছে। তারা বলেছে, কিছু কিছু গণমাধ্যম কোবাদ ঘেন্দিকে ভুলভাবে তুলে ধরছে। এমন একটি সংগঠনের এক নেতা বলেন, কোবাদ কোনো রক্তলোলুপ সন্ত্রাসী নন। তিনি একজন শান্তিকামী বিপ্লবী। অথচ অনেকে তাঁকে ভুলভাবে তুলে ধরার অপচেষ্টা করে। এটা বড় হতাশাজনক।
সমাজকর্মী ও লেখক জ্যোতি পুণ্যানী বলেন, ‘আমরা যখন দুন স্কুলে একসঙ্গে পড়তাম, তখন জানতামই না যে, কোবাদেরা এত বড়লোক। ওরলি এলাকায় তাঁদের বিশাল বাড়ি ছিল। পরে যখন বিদেশে পড়ালেখা করে দেশে আসে, তখন তাঁর কাঁধে থাকত কাপড়ের একটি ঝোলা। তাতে থাকত নানা ধরনের বই। একেবারে সাধারণ একজন মানুষ। অথচ ওই সাধারণ মানুষটাই সবার সঙ্গে করতেন অসাধারণ আচরণ। সবার মাঝে মিশে যেতেন তিনি অবলীলায়। করতেন হাসি-তামাশা। সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর স্ত্রীও গোটা জীবনটাই দিয়ে গেলেন হতদরিদ্র মানুষের মুক্তির সংগ্রামের পেছনে। কোবাদ সম্পর্কে এ মুহূর্তে শুধু একটি কথাই বলতে চাই, তিনি কোনো মনীষী নন, বরং একজন বড় মাপের ভাবাদর্শী। গ্রেপ্তার হলেও তাঁর ওই আদর্শের মৃত্যু হবে না। এতে অনুপ্রাণিত হবে পরিবর্তনপ্রত্যাশী ভারতের লাখো বিপ্লবী।’

0 comments:

Post a Comment