Friday, October 9, 2009

লালন অনুসারী ছয়জন শিল্পী

0 comments
ফকির লালন শাহ্র মৃতুদিবসকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় ১ কার্তিক শুরু হবে তিন দিনের লালন স্মরণোত্সব। এ উপলক্ষে লালন সাঁই ফকিরের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে যেসব শিল্পী-সাধক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং লালন ঘরানার শিল্পী হিসেবে লোকসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তেমন কয়েকজন সাধকের কথা লিখেছেন ম. মনিরউজ্জামান

নিজের পরিবেশনা আর অদম্য উত্সাহে সাধক কবি লালন সাঁই ফকিরের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে এককালে যাঁরা ত্যাগী সাধক ও বাণীশিল্পী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং লালন ঘরানার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে লোকসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তাঁদের কথা আজ বিস্মৃতপ্রায়। লালনচর্চার ইতিবৃত্তে তাঁরা কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। লালন অনুসারী কযেকজন সাধক কবি-শিল্পী হলেন অমূল্য শাহ, শাহ কলিমউদ্দিন ওরফে কালু শাহ, বেহাল শাহ, মহিন শাহ, খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর) ও মকছেদ আলী সাঁই।
অমূল্য শাহ
ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার নওগা-গা গ্রামে ১২৮৬ (১৮৭৯) সনের ১৭ অগ্রহায়ণ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবার নাম মুহম্মদ খোশতোন আলী ও মায়ের নাম রাহাতন নেছা। পিতৃ-প্রদত্ত নাম আমির আলী। অমূল্য শাহ নামটি দীক্ষাগুরু জহুর শাহ দিয়েছিলেন। বাল্যকালে পাঠশালায় লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে সময় এলাকার বিশিষ্ট সংগীত-শিক্ষক হরিদাশ বৈরাগীর কাছে সংগীতে হাতেখড়ি পান। ১৯-২০ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় গিয়ে তালিম নেন নামকরা ওস্তাদের কাছে। উচ্চাঙ্গসংগীত ছাড়াও সেতার, এসরাজ, তবলা ইত্যাদি যন্ত্রসংগীতে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। বাদ্যযন্ত্র শিখতে তিনি উত্তর প্রদেশ ও দিল্লিতে দীর্ঘদিন বসবাস করে সেখানকার লৌকিক ভক্তিগান ও ভজনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ঘোষপাড়ার ‘কর্তাভজা’ সম্প্রদায়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। গ্রামে এসে বিয়ে করেন নদীয়া জেলার আলমডাঙ্গা থানার (বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা) বণ্ডবিল গ্রামের জরিতন নেছাকে। জরিতন ভালো বীণা বাজাতে জানতেন, অমূল্য শাহের জীবন জরিতনের প্রভাবে হয়ে ওঠে আরও সংগীতময়। এরপর এক সময় তাঁর পরিচয় ঘটে লালনশিষ্য মনিরুদ্দীন শাহের দীক্ষিত শিষ্য হরিয়ারঘাটের খ্যাতনামা সাধক-শিল্পী খোদা বকেসর সঙ্গে। তাঁর কাছেই লালনের গান শেখেন তিনি। তখন সাধারণত মরমি-ভাবগান ও লালনের গান শিল্পীরা গাইতেন হাতে একতারা নিয়ে। অমূল্য শাহ বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চলের বাউলদের অনুসরণে ডান হাতে একতারা এবং বাঁ হাতে বায়া বাজিয়ে গাইতে শুরু করলে লালনগীতি পরিবেশনের একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। ছেঁউড়িয়ার লালনশিষ্য ভোলাই শাহের শিষ্য-অনুসারীরা এ রীতির বিরোধিতা করলেও শুকচাঁদ শাহ, খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর), বেহাল শাহ, নিমাই শাহ প্রমুখ সুকণ্ঠ শিল্পী অমূল্য শাহকে অনুসরণ করায় তাঁর ধারা লোকপ্রিয়তা লাভ করে। ধারাটি এখনো বজায় রেখেছেন অনেক প্রতিষ্ঠিত লালনগীতি কণ্ঠশিল্পী। জানা যায়, অমূল্য শাহ নিজেও গান লিখেছেন। কিন্তু সেসব গান ও তাঁর সুর দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। অমূল্য শাহের মৃত্যু হয় ১৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৯ (১৯৫২) সালে।
শাহ কলিমদ্দীন ওরফে কালু শাহ
কুষ্টিয়া শহরের কুঠিপাড়ায় আনুমানিক ১৮৯৫ সালে জন্ম। পৈতৃক নিবাস ছেঁউড়িয়া। বাবার নাম আমিনউদ্দিন। জীবনের অনেকটা সময় বসবাস করেছেন রাজশাহী শহরের ঘোড়ামারায়। কালু শাহ ছিলেন প্রধানত লালনগীতির কণ্ঠশিল্পী। লালনপন্থী হলেও তিনি কখনো দীক্ষা গ্রহণ করেননি। তবে ঈশ্বরদীর এক পীরের কাছে মুরিদ হয়েছিলেন। লালনগীতি ছাড়াও গাইতেন অন্যান্য সাধকের গান। লালনগীতিসহ অন্যান্য মরমি সাধকের রচিত গান ও গম্ভীরা, জারি ইত্যাদি বহুসংখ্যক পদ তিনি সংগ্রহ করে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনকে দিয়েছিলেন। শাহ কলিমদ্দীনের কাছ থেকে প্রাপ্ত গান বাছাই করে মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন হারামণি ষষ্ঠ খণ্ডে (১৩৭৪) ছেপেছেন।
কলিমদ্দীন শাহ নিজেও গান লিখেছেন। তাঁর রচিত একটি গানের শেষ স্তবকের কিছু অংশ এমন: ‘কত পীর ওলি আউলিয়া সেই ফুলের জন্য/ হইতেছে হয়রান/ সে ফুল যে দেখেছে/ সেই মজেছে কহে সাঁই কলিমদ্দীন \’
বেলাল শাহ
চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার নাগদা বলেনপুর গ্রামে ১৩০৭ সনের ২৫ চৈত্রে জন্ম। বাবা-মায়ের নাম বাহাদুর শাহ ও ময়না নেছা বিবি। মাইনর পর্যন্ত তাঁর লেখাপড়া। পৈতৃক পোড়াদহ রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী খর্দ আইলচারা গ্রামে নিবাস। প্রথম জীবনে লেটো দলে ছিলেন। পরে উজ্জ্বল চৌধুরী দেলবার শাহ ঘরানার ছমির চাঁদের কাছে দীক্ষা নেন। অমূল্য শাহ, শুকচাঁদ, খোদা বক্স প্রমুখের কাছে লালনগীতি শিখে এ গানের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। আলমডাঙ্গার ফরিদপুর গ্রামে অবস্থিত বেহাল শাহের মাজার দীর্ঘদিন অরক্ষিত রয়েছে। বেহাল শাহের দ্বিতীয় স্ত্রী দৌলতুন্নেছার এক কন্যাসন্তানের নাম আয়েশা খাতুন। তিনি মঞ্চে আপেক্ষিক ও উদ্ভব প্রসঙ্গ নিয়ে গান বাঁধতে পারতেন। তাঁর লেখা গানের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে রচনাকৃত খুব অল্পসংখ্যক গানই সংরক্ষিত হয়েছে। ১৩৮৮ সনের ১৮ ভাদ্র [৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮১] বেহাল শাহের তিরোধান ঘটে।
মহিন শাহ
প্রকৃত নাম মহিউদ্দীন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার হরিহরদিয়া গ্রামে ২৭ আশ্বিন, ১৩১০ [১৪ অক্টোবর, ১৯০৩] সনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মঙ্গল শাহ। মরমি-বাউলগান রচয়িতা ও কণ্ঠশিল্পী। গত শতকের আশির দশক থেকে কুষ্টিয়ায় বসবাস শুরু করেন। লালন অনুসারী। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাড়ুলিয়া গ্রামে তাঁর শিষ্য-ভক্তদের নিয়ে একটি আখড়া তৈরি করেছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন এবং এ দুই কবির জীবনের অনেক ঘটনার তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষকারী। তাঁর নিজের রচিত গানের সংখ্যা হাজারের বেশি হবে বলে মনে হয়। সমকালীন ঘটনা ও পরিস্থিতি নিয়ে তিনি গান লিখেছেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরের পরিস্থিতি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। ভাষা আন্দোলনের সময় কবি জসীমউদ্দীনের অনুরোধে একটি গান লিখেছিলেন তিনি। সেই গানের প্রথম দুটি ছত্রে তিনি লেখেন, ‘আমরি বাংলা ভাষা মা বলা ডাক মধুর লাগে।/মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মা মা বোলে পুলুক জাগে \’ (নিজস্ব সংগ্রহ)
দেশবন্দনামূলক বেশ কিছু গানও তিনি লিখেছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমী মহিন শাহের পদাবলী নামে (আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত) ১৫০টি গানের একটি সংকলন প্রকাশ করেছে। মহিন শাহের তিরোধান দিবস, ৫ আশ্বিন, ১৪০৩ [১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬]। মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়া লালনের মাজার প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর)
খোদা বক্স শাহের পিতামহ মিয়াজান বিশ্বাসের নিবাস ছিল ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানার বিজলেমনহরপুর গ্রামে। তিন কড়ি ও কফিলউদ্দিন—এ দুই ছেলের মধ্যে খোদা বকেসর বাবা কফিলউদ্দীন আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সে তাঁর ফুফুর বাড়ি বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার জাঁহাপুর গ্রামে চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানেই ৩০ চৈত্র, ১৩৩৪ (১৯২৮) সনে খোদা বক্স জন্মগ্রহণ করেন। কফিলউদ্দীনের স্ত্রীর নাম ব্যাশোরণ নেছা। খোদা বক্স লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। স্ত্রীর নাম রাহেলা খাতুন ওরফে লাইলি বেগম। প্রথম জীবনে খোদা বক্স ছিলেন যাত্রাদলে। সেখানেই সূচনা তাঁর সংগীতজীবনের। পরবর্তী সময়ে শুকচাঁদ শাহের কাছে ফকিরি মতে দীক্ষা নিয়ে লালন প্রশিষ্যের সংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হন। খেলাফত (ফকিরি পোশাক ধারণ) নিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে ‘গুরুমাতা’ বানু নেছার (শুকচাঁদ শাহের স্ত্রী) কাছে। খোদা বক্স তাঁর গুরু শুকচাঁদ বাদেও গানে দাশ সংগ্রহ করে ২৫টির স্বরলিপি করেন। এ স্বরলিপি লালন সংগীত স্বরলিপি (১৯৮৬) নামে গ্রন্থে প্রকাশ করেছে লালন কেন্দ্রীয় সংসদ, ঢাকা।
১৪ জানুয়ারি, ১৯৯০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ দিনকে স্মরণ করে প্রতিবছর তাঁর বাস্তুভিটায় অনুষ্ঠিত হয় স্মরণোত্সব বা ‘সাধুসঙ্গ’। এখানেই খোদা বক্স শাহ জীবদ্দশায় তাঁর গুরু শুকচাঁদ শাহের মৃত্যুদিবস ১০ বৈশাখে আয়োজন করতেন ‘সাধুসঙ্গ’ উত্সব। ১৯৯১ সালে খোদা বক্সকে দেওয়া হয়েছে মরণোত্তর একুশে পদক। খোদা বক্স শাহের ছেলে আবদুল লতিফ শাহের ভাষ্য, তাঁর বাবা প্রায় ৯৫০ গান রচনা করেছেন। বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯৭ সালে তাঁর ১৪৮টি গান মুদ্রিত হয়েছে মরমী কবি খোদা বক্স শাহ (খোন্দকার রিয়াজুল হক সম্পাদিত) গ্রন্থে। খোদা বকসের অপ্রকাশিত একটি গানে উল্লেখ দেখি: ‘ওগো দয়াময় দাওগো মোর পদাশ্রয়/ তোমা ভিন্ন তবে কে আছে আমার।’
মকছেদ আলী সাঁই
নানা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে লালনগীতি পরিবেশনার যে ধারা স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গসহ আন্তর্জাতিকভাবে প্রসারিত হয়েছে, তার পেছনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মকছেদ আলী সাঁইয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। কুষ্টিয়া শহরের হরিশঙ্করপুর গ্রামের চাঁদগাড়াপাড়ায় ১৯৩৩ (মতান্তরে ১৯৩৫) সালে মকছেদ আলী সাঁই জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃ-পদবি ‘খান’, ‘সাঁই’ তাঁর নিজের আরোপিত। বাবার নাম আবদুর রশিদ খান। মা নিকারি বেগম।
প্রথম জীবনে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি অনুশীলন করতেন নজরুলগীতি, লোকগীতি ও আধুনিক বাংলা গান। এ ব্যাপারে অনুশীলনে তাঁর প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন ওস্তাদ ওসমান গনি। যাত্রাদলেও ছিলেন কিছুকাল। ষাটের দশকে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লালনগীতির চর্চা শুরু করেন। দীক্ষা নেন কুষ্টিয়া সদর থানার শঙ্কারদিয়া গ্রাম নিবাসী নিমাই শাহের কাছে।
আগেই বলা হয়েছে, একসময়ের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী অমূল্য শাহ বিভিন্ন আসরে দাঁড়িয়ে গান পরিবেশনকালে একতারার সঙ্গে বায়া বাজানোর রীতি প্রচলন করে লালনগীতিকে লোকসমাজের গভীরে পৌঁছে দিয়ে প্রবর্তন করেন একটি নতুন ধারা। পরবর্তী সময়ে এ ধারাটি কমবেশি বজায় ছিল সুকণ্ঠের অধিকারী বেহাল শাহ, নিমাই শাহ, খোদা বক্স শাহ (জাঁহাপুর) প্রমুখের মাধ্যমে। মকছেদ আলী সাঁইয়ের সুযোগ হয়েছিল শেষোক্ত তিনজনের কাছে লালনগীতি শিক্ষা গ্রহণ করার। এর ফলে অমূল্য শাহের গায়কি ঢংটি অপ্রত্যক্ষভাবে তাঁর ওপর প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে লালনশিষ্য ভোলাই শাহের মাধ্যমে প্রচলনকৃত ইসমাইল ফকির, ফকির গোলাম ইয়াছিন, মোতাহার খন্দকার প্রমুখ, যাঁরা মূলত পরিচিত ‘ছেঁউড়িয়া ঘরানা’ বলে, তাঁদের গায়কির ধরন-ধারণ সম্পর্কে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন তিনি। এঁদের কাছেও মকছেদ আলী সাঁই লালনগীতির তালিম নেন। লালনের গানে রাগ-রাগিণী, রামপ্রসাদী, কীর্তন, ধুয়া গানের সুর প্রভৃতির সন্ধান তিনিই প্রথম করেন।
মননের পারিপার্শ্বিক এসব প্রভাব ও সংগীত জগতের পরিশীলিত কণ্ঠশিল্পী মকছেদ আলী সাঁই যখন নিজস্ব ভঙ্গিতে নানা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে লালনগীতি গাওয়া শুরু করলেন এবং পাশাপাশি আরো অনেক শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর পরিবেশিত ভঙ্গির লালনের গান তুলে দিলেন তখন সহজে এ ধারা জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে অনেকে অনুসরণ করছেন মকছেদ সাঁইয়ের ধরন-ভঙ্গি। ফরিদা পারভীন, চন্দনা মজুমদার প্রমুখ এ ধারার সার্থক উত্তরসূরি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মে মাস নাগাদ ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের, শ্মশান করেছে কে?’ গানটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। সেই সময় কলকাতার ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্ট লিমিটেড’ রেকর্ড কোম্পানি তাঁর দুটি লালনগীতি (১. গৌর প্রেম করবি যদি, ২. আপন ঘরের নে না) প্রকাশ করে গ্রামোফোন রেকর্ডে।
পেশা হিসেবে মকছেদ আলী সাঁই কুষ্টিয়া তহশিল অফিসে এসএ জরিপকালে (১৯৬২) অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাকার পরে আনসার কমান্ডার হিসেবে চাকরি করেছেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতার কেন্দ্রে চালু হয়েছিল ‘ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস’ নামে একটি বিভাগ। এ বিভাগে সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি কয়েক বছর নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় দেশের বহু অবহেলিত ও অখ্যাত শিল্পী সংগ্রহ করে তাদের কণ্ঠের গান টেপ রেকর্ডারে ধারণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মনে রাখা দরকার, মকছেদ আলী সাঁই লালনমতে দীক্ষা নিলেও খেলাফত গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার তালবাড়িয়া ইউনিয়নের রানাকোট গ্রামের শেখ সুফি খলিলউদ্দীন মুন্সীর মুরিদ। তাঁর মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় স্ত্রী (প্রথম স্ত্রী মনোয়ারা বেগম) হাছিনা বেগম (ভানি) দীক্ষা ও খেলাফত দুই-ই গ্রহণ করেছেন।
তাঁর লেখা গান নানা সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া রচিত অধিকাংশ গানই রয়েছে এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত। তাঁর একটি মরমি গান: ‘বুকের মানিক হারালো যে পথিক।/ সারা জনম মরে সে কান্দিয়ারে \’ (নিজস্ব সংগ্রহ)
সেদিনের এই দিন (মার্চ ১৯৮১) নামে লালনবিষয়ক একটি পুস্তিকা মকছেদ আলী সাঁই মৃত্যুর কয়েক মাস আগে প্রকাশ করেছিলেন গোলাম ইয়াছিন শাহের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায়। ১৭ জুন, ১৯৮১ সালে হঠাত্ তাঁর মৃত্যু ঘটে হরিশঙ্করপুর গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে।

0 comments:

Post a Comment