Thursday, December 3, 2009

জাপানের সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো

0 comments

সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো
জাপানের রাজভবন দেখে মনে হয় বহুতল ভবন আর কংক্রিট-আসফাল্টের যত্রতত্র উপস্থিতির মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মরূদ্যান। রাজধানী টোকিওর প্রাণকেন্দ্র মারুনোউচির লাগোয়া এই রাজপ্রাসাদ। এর বিস্তৃত এলাকা নগরে কেবল মনোরম প্রকৃতিকেই ফিরিয়ে আনেনি, দেশের সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাসকেও তা নানাভাবে ধরে রেখেছে।
আড়াই হাজার বছরের নিরবচ্ছিন্ন বংশানুক্রমিক ধারা অনুসরণ করে সিংহাসনাধীন জাপানের বর্তমান সম্রাট আকিহিতো হচ্ছেন ইতিহাসের জীবন্ত এক সাক্ষী।
সেই ইতিহাসকে ধরে রাখার সযত্ন প্রয়াস হিসেবে টোকিওর রাজপ্রাসাদের আকার এবং গঠনের মধ্যেও ফুটে উঠেছে জাপানের সমৃদ্ধ অতীতের ধারা। রাজপ্রাসাদের বিশাল চত্বরের অধিকাংশ ভবনই জাপানি রীতি অনুসরণ করে তৈরি। এ কারণে এসব ভবন রাজধানীর আকাশচুম্বী দালানকোঠার তুলনায় আকারে খুবই ছোট। তা সত্ত্বেও রাজকীয় গাম্ভীর্য আর চমত্কার সৌন্দর্যের কোনো রকম ঘাটতি এসব ভবনের কোনোটিতেই নেই।
আর এ রকম সব ভবনকে ঘিরে তৈরি করা অসম্ভব সুন্দর নানা রকম বাগান ও যত্নের মধ্যে বেড়ে ওঠা গাছপালা সেই সৌন্দর্যে নিয়ে এসেছে সত্যিকার অর্থে রাজকীয় মহিমা। রাতের বেলায় নেই সেখানে আলোর কোনো রকম বাড়াবাড়ি। মারুনোউচি এলাকার উঁচু যেকোনো ভবন থেকে রাতের রাজপ্রাসাদের দিকে তাকালে রাজধানীর নিয়ন ঝলমলে আলোর বন্যার মাঝখানে দাঁড়ানো অন্ধকারে ডুবে থাকা এই বিশাল এলাকা দেখে অবাক হতে হয়।
জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সযত্নে ধরে রাখা এই রাজপ্রাসাদের অধিবাসীদের নিয়ে জনগণের মধ্যে কৌতূহল থাকলেও তাতে কোনো রকম বাড়াবাড়ি নেই। এ কারণেই যেন জাপানের সম্রাট ও রাজপরিবারের সদস্যরা সার্বিকভাবে হয়ে উঠেছেন শ্রদ্ধার পাত্র—দূর থেকে যাঁদের সাক্ষাত্ পাওয়াকেই অনেকে খুব ভাগ্যবান মনে করে থাকেন।
শ্রদ্ধাভাজন সেই সম্রাট ও রাজপরিবারের অন্য সব সদস্যের সাক্ষাত্ লাভের এক দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল ১৩ নভেম্বর। সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের ২০তম বার্ষিকী উপলক্ষে রাজপ্রাসাদে আয়োজিত বিশেষ এক স্মারক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করেছিলাম।
নির্বাচিত অতিথিদের মধ্যে মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংসদ, ব্যবসা-শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-ক্রীড়াসহ নানা ক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিরা ছিলেন। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের নেতাদেরও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিনিধি হিসেবে জাপানে বিদেশি সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি আমি। সেই সুবাদে আমন্ত্রিতদের দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ হলো আমারও।
ফলে দূর থেকেই কেবল সম্রাটের দেখা পাওয়া নয়, সম্রাটের সঙ্গে হাত মেলানো ও তাঁর সঙ্গে একান্তে কিছু সময় কথা বলার সুযোগের দুয়ারও সেদিন খুলে গিয়েছিল।
ভাঙা জাপানি ভাষার জ্ঞান নিয়ে নিজের দুটি পরিচয়—প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বাংলাদেশি নাগরিকত্ব—তুলে ধরতেই পরম স্নেহে আমার হাত ধরে সম্রাট বললেন অতীতে দুবার তাঁর আমাদের দেশ ভ্রমণের কথা।
আমাকে যেটা অবাক করে দিয়েছিল তা হলো, বয়স সত্তরের ঘরের শেষ দিকে পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও তার প্রখর স্মৃতিশক্তি। যে শক্তি দিয়ে তাত্ক্ষণিক আমাদের ইতিহাসসংক্রান্ত কিছু কথা বললেন সম্রাট। বললেন, তাঁর প্রথম সফরের সময় আমাদের দেশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল।
আমার অবাক হওয়ার পালা তখনো অবশ্য শেষ হয়নি।
এর পরই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের নেতা মুজিবুর রহমানকে আমার এখনো মনে আছে।’ জাপানের সম্রাট প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নেতা ও নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত্ করছেন। ফলে তাঁর স্মৃতিতে হাজার হাজার নাম নিশ্চয় স্তরের পর স্তর জুড়ে জমা হয়ে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কর্ণধারদের প্রায় সবাই অন্ততপক্ষে একবার হলেও জাপানের সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে গেছেন। এত নামের মধ্যে থেকে আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তেই শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জাপান সম্রাটের মুখ থেকে শোনা আমার জন্য যেন ছিল এক অসাধারণ পাওয়া।
বাংলাদেশকে এতটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখার জন্য সম্রাটকে আমি তখন ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম, ‘আমাদের দেশের লোকজন আরও একবার তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ পেলে যথার্থই আনন্দিত হবে।’
এখানে বলে নেওয়া দরকার যে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার মতো তৃতীয় কোনো ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। যেহেতু এটা রাজপ্রাসাদের আমন্ত্রণে যোগ দেওয়ার অনুষ্ঠান, তাই সম্রাট ও রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা নিজেরাই আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে সেখানে কথা বলেন।
সম্রাটের সঙ্গে কথা বলার পর বিশাল সেই রাজকীয় হলঘরের আরেক দিকে সম্রাজ্ঞীর সঙ্গেও আমার দেখা হয়ে যায়। সম্রাজ্ঞী মিচিকোও হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন এবং খুবই স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন তাঁর বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা।
সম্রাটের পরিবারের আরও যাঁরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন—যুবরাজ নোরিহিতো, যুবরাজ্ঞী মাসাকো, রাজপুত্র আকিশিনো ও তাঁর স্ত্রী প্রিন্সেস কিকো, সম্রাটের কাকা প্রিন্স মিকাসা ও পরিবারের আরও কয়েকজন নিকটাত্মীয়।
তাঁদের মধ্য যুবরাজ্ঞী মাসাকো নানা কারণে সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়ে আসছেন। পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম তাঁকে লেডি ডায়ানার প্রাচ্য-সংস্করণ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। তবে সেই তুলনা অনেকটাই অতিরঞ্জিত—পশ্চিমের রঙিন চশমা চোখে চাপিয়ে নিয়ে প্রাচ্যের দিকে আলোকপাত করার মতো। ফলে যুবরাজ্ঞী মাসাকো ব্যক্তি হিসেবে কেমন, তা জানার উত্সাহ সব সময়ই আমার মধ্যে ছিল। সেই চমত্কার সুযোগও সেদিন আমার মিলে যায়।
বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণে যে প্রশ্ন শুরুতে আমাকে তিনি করেছিলেন তা হলো, জাপান আমার কেমন লাগছে? আমি তাঁকে বলেছিলাম, ‘যে দেশের সম্রাজ্ঞী তিনি হতে যাচ্ছেন সে দেশটিকে আমার ভালো লাগারই কথা।’ সেই সঙ্গে তাঁকে বলতে ভুলিনি যে, বাংলাদেশের লোকজনের কাছে তাঁর নামটি খুবই পরিচিত এবং দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ তিনি করে নিতে পারলে আমরা তাতে আনন্দিত হব।
তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে সে চেষ্টা তিনি অবশ্যই করবেন। যুবরাজ্ঞীর সেই হাসিভরা মুখ কাছ থেকে দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগল, আমরা যা শুনছি তার মধ্যে কতটা বাস্তব, আর কতটাই বা অতিরঞ্জন?
আমন্ত্রিত অতিথিদের দলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়ুকিও হাতোইয়ামাসহ অন্তত আরও পাঁচজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সংসদের নেতারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁদের সবার সঙ্গেই কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছিল। বিদেশি সাংবাদিকদের ক্লাবের সভাপতি হিসেবে ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রসঙ্গেও কারও কারও সঙ্গে আমি সেদিন কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী হাতোইয়ামা একদিন তাঁর সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাত্রার উল্লেখ করে বলেছিলেন, সেই একই সফরে এশিয়ার পাঁচটি দেশে তিনি যাবেন। সময় ও সুযোগমতো বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিও যে তাঁর ভবিষ্যত্ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে, সেটা তিনি জানালেন।
অন্যদিকে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী তারো আসো বলেছিলেন, ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোয় জাপান-বাংলাদেশ সংসদীয় লিগের সভাপতি হিসেবে তেমন কার্যকর অবদান রাখা তাঁর পক্ষে এখন আর হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।
ইদানীং দ্বিতীয় যে জাপানি রমণীকে নিয়ে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম কিছুটা বাড়াবাড়ি রকমের খবরাখবর প্রচার করে আসছে, তিনি হলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী মিইয়ুকি হাতোইয়ামা। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে সেই অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, প্রেসক্লাবের বিশেষ কোনো আয়োজনে উপস্থিত হয়ে সংবাদমাধ্যমের কৌতূহল নিরসনে তিনি যেন এগিয়ে আসেন। তিনি কথা দিয়েছেন, সময়মতো একদিন তিনি ক্লাবে অবশ্যই যাবেন। আমরা সেই অপেক্ষায় থাকব।
মনজুরুল হক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।
টোকিও, ১৪ নভেম্বর ২০০৯
প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো'য়

0 comments:

Post a Comment