Thursday, December 3, 2009

আজম খান এর সাক্ষাতকার

0 comments

লিখেছেন কবির বকুল
এখন তাঁর বয়স ৬০ বছর। ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পা দেবেন ৬১তে। সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটি বড় ভালোবাসেন তাঁর দেশকে। তাই দেশের জন্য ১৯৭১-এ হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। দেশ স্বাধীন করে ফিরেছেন ঘরে। তারপর নিবেদিত হয়েছেন সংগীতে। গানের জগতের অনেকেই তাঁকে ডাকেন ‘গুরু’ বলে। শুধু ডাকেনই না, গুরু বলে মানেনও। বিজয়ের মাসে সেই গুরুর কাহিনীই শুনি।

কমলাপুর জসীমউদ্দীন রোডে তাঁর বাড়ি। সামনে যেতেই চোখ চলে যায় একতলা বাড়ির ছাদে। ভরদুপুরে ছাদে হাঁটছেন তিনি। পরনে লুঙ্গি আর গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই হাঁটা থামালেন। নিয়ে গেলেন দোতলার ছোট বাড়িতে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানেই থাকেন। ঢুকতেই সরু একটা ঘর। ঘরে এক সেট সোফা আর একটি খাট। দেখেই বোঝা যায়, বড় সাধারণ জীবনযাপন তাঁর। এই ঘরেই আমাদের বসালেন।
কেমন আছেন আপনি?
‘আছি মোটামুটি।’ কথায় সেই চেনা সরলতা।
রাতে কখন ঘুমান, সকালে কখন ওঠেন?
‘রাত সাড়ে আটটার মধ্যে ঘুমাতে যাই আর সকালে উঠি সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। ব্যায়াম করি। এরপর প্রথম আলো পড়ি। ছোলাটোলা খাই। ঘরের টুকটাক কাজ করে বাজারে চলে যাই।’
প্রতিদিন?
‘হ্যাঁ, মাসের ৩০ দিনই। এমনকি ঈদের দিনও। কিছু না কিনলেও ওই দিক থেকে ঘুরে আসি।’
তাঁর নিয়মিত এমন অভ্যাসের তালিকাটা বেশ লম্বা। প্রতিদিনই সুইমিং পুলে যাওয়া, বাচ্চাদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনির মাঠে গিয়ে ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলও খেলেন কখনো কখনো। ১৯৯১—২০০০ সালে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে। তাঁর অধিকাংশ সময় কেটেছে ব্যাংক কলোনি আর মতিঝিল কলোনিতে।
‘আমার জন্ম আজিমপুরে। থাকতাম আজিমপুর ১০ নম্বর কলোনির পাশে। ওখানে গাবগাছে তক্ষক ছিল। রাতে ডাকত, আমার ভয় লাগত। ৫০ বছর পর এখনো ওই গাছটা তেমনই আছে। ছোটবেলা কেটেছে মতিঝিলে। তারপর ব্যাংক কলোনি। ১৯৫৬তে বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান, তার পর থেকে এখানেই। এখানে বন্ধুবান্ধব বেশি আরকি! তবে পবিত্র দিনগুলোতে আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবর জিয়ারত করি। আমার জন্মস্থানটা দেখে আসি।’
কবি জসীমউদ্দীনের বাড়িতেও তাঁর ছোটবেলার অনেক সময় কেটেছে। বললেন, ‘ওই বাড়িতে আপেল আর আঙুর ছাড়া সব গাছ আছে। প্রায় সাড়ে চার বিঘার ওপর বাড়িটা। কামরাঙা, পেয়ারা, লিচু ছিল। পেড়ে খেতাম। কোনো সময় ফল কিনে খাইনি, ওই ফল খেয়ে বড় হয়েছি।’
তাঁর বন্ধুবান্ধবের তালিকাটাও দীর্ঘ। বললেন, ‘ফুয়াদ, নিলু, রানা, বুলু, শাহজাহান, জাহাঙ্গীর আরও অনেকে ছিল। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। দেখা হয় মাঝেমধ্যে।’
স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসে তাঁকে। বলেন, ‘আমাদের বাড়িটা কমলাপুর রেলস্টেশনের খুব কাছে। তবে এখানে আগে রেলস্টেশন ছিল না। পুকুর, বিল-ঝিল ছিল। আমরা সেখানে গোসল করতাম। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। খুব মজা করতাম। রাজা রাজা খেলতাম, অনেক ঢিবি ছিল। ওখানে সাঁতার কাটতে যাইতাম। যে ওখানে উঠতে পারত আগে, সে-ই রাজা। এরপর নৌকায় চড়তাম। ছোট ছোট কাঁঠাল এক আনায় কিনে সবাই মিলে খেতাম। এখন তো সেই কাঁঠাল ১০০ টাকা!’
ফিরে যাই তাঁর ছোটবেলায়। জানতে চাই ছোটবেলার ঈদের মজার কোনো স্মৃতি।
‘তখন আমার বয়স সাত কি আট। মনে আছে, ওই বয়সে কোরবানির ঈদে হাটে হাটে বেড়াতে যেতাম। দেখতাম কোনটা বড় গরু। দাম কত। এটা একটা আনন্দ। তবে রোজার ঈদটা বেশি আনন্দের। ঈদে নতুন কাপড় কিনতাম, কাউকে দেখাতাম না। ঈদের জন্য আমরা আগে পয়সা জমাতাম। আব্বা পয়সা দিতেন। ঈদের দিন সেটা খরচ করতাম। চাঁদ রাতে পাড়ায় ফাটাফাটি আনন্দ হতো। মানুষ কম ছিল। সবাই সবাইকে চিনত। মায়াদয়া ছিল। এক অন্য রকম আনন্দ! চাঁদ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতাম ভোরে ওঠার জন্য। নামাজে যেতে হবে। আমাদের পাড়ায় এক অবাঙালি থাকতেন। নাম এ কে খান। তাঁর কাছে গেলে বখশিশ পেতাম। দল বেঁধে যেতাম। ওই আমলে পাঁচ টাকা সালামি দিতেন। তাতে সারা দিনের খরচ চলে যেত। আত্মীয়স্বজনকে সালাম করতাম। বন্ধুবান্ধব মিলে ঠিক করতাম, কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। ট্রেনে চড়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দেখতাম। লঞ্চে উঠতাম। নৌকায় চড়তাম। এয়ারপোর্ট যেতাম, তখন এটা তেজগাঁওয়ে ছিল।
‘একবার ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে গিয়েছিলাম। সেটি ছিল আমের মৌসুম। আমগাছে ঢিল মারলাম। একজন সেনাসদস্য দেখে ধমক দিল। আমরা দিলাম দৌড়। ধরতে পারে নাই। সেই দৌড়ের কথা এখনো ভুলিনি। সন্ধ্যা হলে স্টেডিয়ামের হোটেলে গিয়ে মোগলাই খেতাম। তখন মোগলাই ছিল আট আনা। ভাগাভাগি করে খেতাম। রাতে বাসায় ফিরে আসতাম। আর ভাবতাম, প্রতিদিন যদি ঈদের দিন হতো, তবে কত না মজা হতো।’
প্রসঙ্গ পাল্টাই। বলি, আপনি গানের দিকে ঝুঁকলেন কীভাবে?
‘আমি কোনো দিন তবলা, গিটার, কি-বোর্ড বাজিয়ে গান শিখিনি। কোনো ওস্তাদের কাছেও যাইনি। আমাদের বংশে গান আছে। মাও ভালো গান গাইতেন। বাবা ও আত্মীয়রাও গান গাইতেন। আমাদের বংশে কমবেশি সবাই গান করতেন। ছোটবেলায় গান করতাম। হেমন্ত, মান্না দে, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্রের গান হুবহু পারতাম। তাঁদের অনুকরণ করতাম। ছোটবেলায় পাড়ায় ফেরিওয়ালা, ফকির যেভাবে ডাকত, তা হুবহু করতে পারতাম। বন্ধুরা মজা পেত। বন্ধুরা ছিল হুজুগে। সবাই মিলে পুরান ঢাকায় চলে যেতাম। এক আনা দিয়ে চা ভাগ করে খেতাম। হোটেলটা ছিল নিশাত সিনেমা হলের পাশে। ওইটার নাম এখন মানসী। ম্যানেজার হিট গান ছাড়তেন। ওগুলো শুনতাম, পরে গাইতাম। আবার চলে যেতাম মুন্সিগঞ্জে, নরসিংদীতে, টঙ্গিতে ট্রেনে করে। ট্রেনে গান করতাম। ছাত্রজীবনে এলাকার মেনন ভাই, রনো ভাই বাম রাজনীতি করতেন। তাঁদের প্রভাব ছিল। তাঁদের একটা শিল্পীগোষ্ঠী ছিল। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী। ওই দলে গান করতাম। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইয়ুব খান। বুঝতাম, তাঁরা আমাদের ঠকায়; চাকরিতে, সেনাবাহিনীতে তাঁদের প্রাধান্য ছিল বেশি। আমরা বিপ্লবী হয়ে উঠি। সবাই ঠিক করলাম, গণসংগীত গাইব। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় গান গাইতে যেতাম। ফকির আলমগীর ছিল আমাদের দলে। একবার পুলিশ ধাওয়া করল। পালিয়ে গেলাম। সারা রাত নৌকায় ছিলাম।
‘মহল্লায় একটু একটু মাস্তানিও করতাম। পাড়ায় পাড়ায় মারামারিও করতাম। সে সময় মারামারির কায়দা ছিল ভিন্ন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ার্নিং দিতাম। রাতবিরাতে আড্ডার কারণে গ্রেপ্তারও হয়েছিলাম। পরে ছেড়ে দিয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধের গল্পও উঠে আসে। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “একাত্তরে ২৫ মার্চের পর সারা শহরে কারফিউ। আর্মিদের জ্বালায় থাকতে পারতাম না। পালিয়ে থাকতাম। বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, এভাবে নয়। মরলে যুদ্ধ করেই মরব। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং করব। যুদ্ধ করব। যে যার মতো চলে গেল। আমি যেদিন গেলাম, সেদিন আমার সঙ্গে ছিল দুই বন্ধু শাফি আর কচি। বেলা সাড়ে ১১টা। মা প্রয়াত জোবেদা খানমকে (এই সাক্ষাত্কার নেওয়ার পরদিন মারা যান) গিয়ে বললাম, ‘মা, যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোর বাবাকে বল।’ বাবা প্রয়াত আফতাব উদ্দীন খান ছিলেন কলকাতার প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কাঁপতে কাঁপতে গেলাম বাবার সামনে। মাথা নিচু করে বললাম, আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। চিন্তা করলাম, এই বুঝি লাথি বা থাপড় দেবেন। বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, যুদ্ধে যাইবা ভালো কথা। দেশ স্বাধীন না কইরা ঘরে ফিরতে পারবা না।’ আমার ছোট ভাই খোকাও মুক্তিযোদ্ধা ছিল। যাই হোক, ট্রেনিং নিতে চলে গেলাম। ট্রেনিং নিয়ে ফিরে প্রথম ফাইট করলাম কুমিল্লার সালদা ক্যাম্পে। সম্মুখযুদ্ধ। আমাদের বলা হলো, যারা ঢাকায় যুদ্ধ করবে, তাদের সরাসরি যুদ্ধ করে পোক্ত হতে হবে। তা না হলে যুদ্ধ করব কীভাবে? পরে জাকির নামের একটা ছেলে যুদ্ধে মারা গেলে আমাদের ওখান থেকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। তখন প্রথম ভারতীয় ৭৫ টাকা করে বেতন পেলাম। সেই টাকায় আগরতলায় গিয়ে বিরানি খাই, সিনেমা দেখি, ঘোরাঘুরি করি। এর কিছুদিন পর ঢাকায় ফিরে আসি। আমি সেকশন কমান্ডার ছিলাম। ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে পাঠিয়ে দিত। আমার নাম আর্মিরা জানত। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অনেকবার বাড়িতে এসে খুঁজে গেছে। ঢাকার আশপাশে অনেকগুলো যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। একবার গ্রামবাসী খবর দিল, মাদারটেকের ত্রিমোহনীতে সকাল ১০টার দিকে নাকি পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে। শুনে যে যার মতো ছুটে গেছি সেখানে। গুলশান হয়ে বালু নদ শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। চাঁদের মতো নদী। ওরা যখন রাস্তা দিয়ে আসছে, আমরা চারদিক থেকে ওদের ঘিরে ফেলি। ওরা ফাঁদে পড়ে যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। অনেকে পালিয়ে যায়। অনেক অস্ত্র উদ্ধার করি। কয়েক দিন পর ওদের লাশ পচে পানিতে ভেসে ওঠে। মানুষ লাশকেও গালি দেয়।”
প্রশ্ন করি, আপনাদের ওই জেদটা কি এখনো আছে?
‘ওই জেদটা এখন নেই। আমরা জেদটা ধরে রাখতে পারি নাই। এ জন্যই তো এ অবস্থা।’
কী অবস্থা?
‘আমরা যুদ্ধ করেছি ভালো থাকার জন্য, স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন দেশটা ভালোই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পৃথিবীর সব দেশের করুণা হলো আমাদের ওপর। অনেক সাহায্য এল। কিন্তু সেগুলো পাচার হয়ে যেতে থাকল ট্রাকে ট্রাকে। সেই যে শুরু হলো, এখনো তা চলছে, তাই তো আমরা দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হলাম।’
এটা আপনাকে পীড়া দেয়?
‘হ্যাঁ, পীড়া দেয়। আমরা যে জন্য দেশ স্বাধীন করেছি, তা পূরণ হয়নি। এ দেশ এত দিনে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত হতো। আমাদের নেতারা তা নষ্ট করেছেন।’
মুক্তিযোদ্ধা আজম খান সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন। এ দেশের সাধারণ মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখেন। মনে করেন, সাধারণ মানুষই একদিন ইতিবাচকভাবে বদলে দেবে দেশের ভাগ্য।
স্বপ্ন দেখেন?
দেখি।
কোনো অজপাড়াগাঁয়ে একটি স্কুল গড়ার।
ঘণ্টা বাজছে। ক্ষেতের আল বেয়ে বই-খাতা হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। তাদের মায়া মায়া চোখে আমি দেখছি একটি নতুন বাংলাদেশ।

0 comments:

Post a Comment