Friday, December 11, 2009

গায়েবি মসজিদ

0 comments
খন্দকার মাহমুদুল হাসান ৎ প্রথম আলো
চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি খুঁজতে লেগে গেলাম গায়েবি মসজিদ। অবশ্য খুব একটা দেরিও হলো না। কারণ, সঙ্গে ছিলেন বন্ধু আহমদ মমতাজ।
দেখলাম, মসজিটি পুরোনো হলেও মসজিদ আর রাস্তাকে আড়াল করার মতো বিস্তর দালানকোঠা বানানো হয়েছে। এত পুরোনো একটি মসজিদ, অথচ রাস্তা থেকে দেখাই যায় না প্রায়। শুধু সাদা গম্বুজের চূড়া দেখে বুঝতে হয়, এখানে একটি মসজিদ আছে। গায়েবি মসজিদ ছাড়াও এর অন্য একটা নাম আছে। তা হলো মাহমুদ খান জামে মসজিদ। পাহাড়তলীর জোলারপাড় এলাকায় এর অবস্থান।
মূল মসজিদের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে এভাবে সম্প্রসারিত করা হয়েছে, আসল মসজিদকে প্রায় চেনাই যায় না। মূল মসজিদটি মেপে দেখা গেল, উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমের দেয়াল প্রায় চার দশমিক পাঁচ ফুট অর্থাত্ এক দশমিক ৩৭ মিটার চওড়া। তবে পূর্ব দিকের দেয়াল দরজার কাছে ছয় দশমিক ৭৫ ফুট অর্থাত্ প্রায় ২০৩ মিটার চওড়া। পূর্ব দেয়ালে তিনটি, উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে।
যদিও পশ্চিম পাশের দেয়ালে একটি মেহরাব দেখা গেল এবং ভেতরটা পুরোপুরি আধুনিক টাইলসে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু লোকমুখে জানা গেল, আদতে পশ্চিম দেয়ালে মেহরাব ছিল তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের প্রবেশপথ দুটোর আকৃতি আগে অনেক ছোট ছিল।
ভেতরের দিক থেকে মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট অর্থাত্ প্রায় সাত দশমিক ৬২ মিটার ও প্রস্থ ১৪ ফুট অর্থাত্ প্রায় চার দশমিক ২৭ মিটার।
জনশ্রুতি আছে, মসজিদটি ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরে জন্মগ্রহণকারী সুবেদার মাহমুদ খান নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদের গম্বুজের কাছাকাছি উচ্চতায় দেয়ালের গায়ে বসানো শিলার লেখায় এসব কথার বিবরণ আছে বলেও শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম ওপরে। দেখলাম, একটা পাথরের খণ্ডে এক লাইন লেখা থাকলেও এমনভাবে এর ওপর রং লেপ্টে দেওয়া হয়েছে, সেটির পাঠোদ্ধার দুষ্কর। এতে কোনো সালের উল্লেখ আছে কি না, তা ভালোভাবে খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো সাল বা তারিখের বর্ণনা পেলাম না। তাই চেষ্টা করলাম বৈশিষ্ট্য সন্ধান করে এর সময়কাল সম্পর্কে ধারণা লাভের।
মসজিদের ভেতর থেকে একটি বড় গম্বুজের অবস্থান খুব ভালোভাবে লক্ষ করা যায়। খিলানের সাহায্যে যে এটি নির্মিত হয়েছিল, তা-ও বোঝা যায়। ভেতরের দিক থেকে গম্বুজের শীর্ষভাগে প্রস্ফুটিত ফুলের নকশা দেখা যায়। বড় গম্বুজের নিম্নভাগে দুই পাশের দুটি ছোট গম্বুজের সূচনা স্থানেও যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে প্রায় একই রকমের ফুলের পাপড়ির নকশা আছে, তবে তা সম্পূর্ণ ফুলের নয়, বরং অংশবিশেষের।
ছাদে উঠে মসজিদের বহিরায়বের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম। মসজিদের ছাদের মাঝখানে একটি ও এর প্রতি পাশে একটি করে দুটি অর্থাত্ মোট তিনটি গম্বুজ আছে। মসজিদের চার কোনায় চারটি আট কোণাকার মিনার আছে। এ ছাড়া পশ্চিম পাশে দুটি ও পূর্ব পাশে একটি ছোট মিনার আছে। প্রতিটি মিনারের শীর্ষভাগ শেষ হয়েছে কারুকার্যময় ছোট ছোট গম্বুজে। এ ধরনের মসজিদের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ও উত্তরাঞ্চলের একটি মুঘল যুগের মসজিদের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ করলাম। এ দুটির একটি হলো, কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া মসজিদ, অন্যটি গাইবান্ধার ফুলহারের মসজিদ।
মসজিদের বাইরে চার কোনায় চারটি বেলেপাথরের স্তম্ভ দেখলাম। এগুলোর ওপর এখন চুনের পুরু প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। তবুও স্তম্ভগুলোর সঙ্গে মিরসরাইয়ের ছুটি খাঁ মসজিদের সামনের স্তম্ভের বেশ মিল দেখলাম। এ স্তম্ভগুলোর উচ্চতা প্রায় তিন ফুট। স্তম্ভগুলোকে মসজিদের অনুচ্চ সীমানাপ্রাচীরের প্রান্তভাগ নির্দেশক বলে মনে হলো। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর দিকে টিকে থাকা সেই সীমানাপ্রাচীর পর্যবেক্ষণেরও সুযোগ হলো। অনুচ্চ এই প্রাচীরের বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে। এর গায়ে চুনের পুরু প্রলেপ দেওয়া হলেও পুরোনো ইট কোথাও কোথাও বেশ দেখা গেল। সে ইট সুস্পষ্টভাবে মুঘল বৈশিষ্ট্যের এবং ছোট ছোট। প্রাচীরের শীর্ষভাগ অনেকটা দোচালা আকারের। ঠিক একই রকমের, দোচালা ধারার প্রাচীর দেখেছি ঢাকার ধামরাইয়ের মুঘল যুগের একটি মাজারের পাশে।
মসজিদকে ঘিরে নানা কাহিনীর কথা শোনালেন জোলাপাড়ার (অন্য নাম নোয়াপাড়া) মরহুম শেখ আরবের রহমানের ছেলে শেখ ফরিদুর রহমান। তিনি জানালেন, এই মসজিদের পাশেই রয়েছে নোয়াপাড়া, ফকির তালুক, পাঠানপাড়া, ফৌজদারপাড়া, কুলালপাড়া, শহীদনগর ও কাজীপাড়াসহ আটটি মহল্লার কবরস্থান। তাঁর কাছেই জানা গেল, এ মসজিদের পূর্ব দিকের প্রায় মজে যাওয়া একটি পুকুরের ভেতর পুরোনো পাথরখণ্ড আছে। পুকুরের পাড়ে গেলাম। কিন্তু পাথরের দেখা মিলল না। তিনি জানালেন, এ মসজিদের উত্তর পাশের রুমে মোয়াজ্জিন একা থাকতে পারেন না। রাতে শুতে পারেন না। কেউ তাঁকে টেনে তোলে। আগে এখানে জিন নামাজ পড়ত।
মসজিদের মোয়াজ্জিনের নাম মো. নূরুল হক। তাঁর বয়স ২৮ বছর। বাবার নাম মরহুম আবদুস ছত্তর। বাড়ি আনোয়ারা উপজেলায়। তিনিও মাথা নেড়ে এ কথায় সায় দিলেন। তবে এ বিষয়ে আর বিশেষ কথা হলো না।
সবকিছু বিবেচনায় মসজিদটিকে মুঘল যুগের বলে স্বীকৃতি দেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি। তবে তারও আগে এখানে মসজিদের কাঠামো নির্মিত হওয়া অসম্ভব নয়।
২০০৯ সালের ২৮ মে এখানে আসার আগে এ মসজিদের কথা কোথাও পড়িনি এবং তেমন একটা জানাও ছিল না এ সম্পর্কে। তাই মসজিদটি দেখে বেশ তৃপ্তিই পেলাম, যদিও এটি যথাযথ যত্নের সঙ্গে পুরোনো দিনের কীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত হয়নি।

0 comments:

Post a Comment