Thursday, December 3, 2009

রেমা-কালেঙ্গায় নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে-বনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে

0 comments
প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলো'য়

কালেঙ্গা এলাকায় এখনো টিকে আছে কিছু প্রাকৃতিক গাছ।
তবে খাদ্যশৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নতুন গাছ গজাচ্ছে না। জন্ম নিচ্ছে লতা আর ঝোপ
ছবি: প্রথম আলো
সুন্দরবনের পর দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাকৃতিক বন রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। শুকনো ও মিশ্র চিরহরিত্ এই বন জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা। কিন্তু গাছ চুরি আর বনের গাছ কেটে অবৈধভাবে কৃষিজমি বৃদ্ধির কারণে ইতিমধ্যে বনের চারটি বিটের (অংশ) মধ্যে রশিদপুর বিট প্রায় বিরান হয়ে গেছে। বাকি বনও হুমকির মুখে। এ অবস্থায় মাটির গঠনগত কারণে এ বনের খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে।
রেমা-কালেঙ্গার অবস্থান হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায়। সাম্প্রতিক গণনা অনুযায়ী, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা, লতাগুল্ম রেমা-কালেঙ্গাকে সাজিয়ে তুলেছে। দেশের সবচেয়ে বড় বন সুন্দরবনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য মাত্র ৩৩০ প্রজাতিতে সীমাবদ্ধ।
এখানকার বানরজাতীয় প্রাণীর বৈচিত্র্য এ বনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বনের ছনবাড়ি, রেমা ও কালেঙ্গার কিছু অংশে গেলেই রিসাস বানর, কুলু বানর, লাজুক বানর, চশমাপরা হনুমান, লালচে হনুমানের দেখা মেলে। আছে আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন পাখি লালমাথা ট্রগন, রাজ ধনেশ, ইমপেরিয়াল পিজিয়ন। বিপন্ন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে কাঁকড়াখেকো বেজি, উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি, রামকোটা কাঠবিড়ালিও দেখা গেছে বনের ভেতরে দুই দিনের অবস্থানে।
গত ১২ ও ১৩ নভেম্বর বনে গিয়ে চোখ আটকে যায় এক-দেড় শ বছরের পুরোনো প্রাকৃতিক মহীরুহ চাপালিশ, গর্জন, বনক, জারুল, ভূতি আওয়াল, পাহাড়ি আওয়াল, লোহা, হরগোজা, বোলো, বট, শ্যাওড়া, ডুমুর, গামার, বৈলাম, বনমালী, শাল গাছে। সঙ্গে আছে বন বিভাগের বোনা সেগুন, আগর, বহেড়া, কাঁঠাল, আমলকী, হরীতকী, ডেউয়া ও চালিতা গাছ। কিন্তু চোরদের হাত থেকে কোনো গাছই রেহাই পাচ্ছে না। বনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতি রাতেই বনের কোনো না কোনো অংশে কাটা হচ্ছে গাছ। এতে একসময়ের আঁটোসাঁটো এই প্রাকৃতিক বন এখন লতা-ঝোপের জঙ্গল হতে চলেছে।
বনের আশপাশেই বসবাস করছে কিছু সাঁওতাল, ওঁরাও, মণিপুরিসহ সত্তর-আশির দশকে পুনর্বাসিত নোয়াখালীর নদীভাঙা মানুষজন। সংখ্যায় পুনর্বাসিতরা এখন আদিবাসীদের ছাড়িয়ে গেছে।
অভয়ারণ্যটি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৬ সালে একে সম্প্রসারিত করায় বর্তমান আয়তন এক হাজার ৭৯৫ হেক্টর। এই অভয়ারণ্যের উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ২০০১-০২ সালের মধ্যে রশিদপুর বিটের অধিকাংশ প্রাকৃতিক গাছ রাজনৈতিক প্রভাবপুষ্ট গাছকাটা দস্যুদের হাতে উজাড় হয়ে যায়।
বনের পথে পথে: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল হয়ে চা-বাগান দিয়ে সংরক্ষিত বনের কালেঙ্গা এলাকায় ঢুকে চোখে পড়ল পাহাড়ি ছড়ার ওপর কাঠের গুঁড়ি। বন বিভাগের গাড়ি চলাচলের জন্য এ ব্যবস্থা। জানা গেল, সব সময় এ ব্যবস্থা থাকে না। না রাখার কারণ, জঙ্গলে যখন-তখন ঊর্ধ্বতন বন কর্মকর্তা, ইকো ট্যুরিস্ট ও সাংবাদিকদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ।
কালেঙ্গায় বনের কোল ঘেঁষে প্রায়ই ধানক্ষেত চোখে পড়ল। আধ ঘণ্টা হাঁটার পর চোখে পড়ল কাটা গাছের গোড়া, গাছ নেই। একটু এগিয়ে গিয়ে আরও পাঁচটা এমন ‘মোথা’ পাওয়া গেল। এক জায়গায় কাটা গাছটিও পড়ে থাকতে দেখা গেল। পাশের লক্ষ্মীছড়ার পানি কমে যাওয়ায় চোরেরা গাছটি নিতে পারেনি বলে জানালেন স্থানীয় পথপ্রদর্শক।
কয়েকটি টিলা পেরিয়ে আসামিলতায় ঢাকা ঝোপড়ানো জঙ্গল। কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। কোনো ছাল-বাকল নেই। ডালপালাও ছাঁটা। এটি হারগোজা গাছ। এই ছাল স্থানীয়ভাবে মশা তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এক মণ হারগোজার ছালের দাম ৬০ টাকা। এক একটি গাছ থেকে প্রায় পাঁচ মণ ছাল পাওয়া যায়। কিছুদিনের মধ্যে গাছটিও চুরি হবে বলে জানায় বনবাসীরা।
মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের অর্থায়নে এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা নিসর্গসহায়ক প্রকল্পের গড়া নজর মিনারের (ওয়াচ টাওয়ার) কাছে কয়েকটি চাপালিশ গাছে পাঁচটা লালচে হনুমান (কেপড লেঙ্গুর) চোখে পড়ল। বিডিআর ক্যাম্পের কাছে একটি অশ্বত্থগাছে জড়ানো ফলবান বৈলামের গাছে গোটা পঞ্চাশেক হরিয়াল ছিল। হলুদ পা হরিয়াল ও চকোলেট পিঠের পম্পিডু হরিয়াল। গাছে আরও বসে ছিল বসন্ত বাউরি, ভীমরাজ, কাঠশালিক, হলুদ ঝুঁটির কাঠঠোকরা।
বনের ভেতরে নিসর্গের করা বনবাংলোয় ফিরতে ফিরতে বোঝা গেল এই অভয়ারণ্যটি নির্ভয়ে টিকে থাকতে পারছে না। বিকেল, সন্ধ্যা, পরদিন সকালে বিভিন্ন পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ত্রিপুরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বনের অবস্থা আরও খারাপ।
চুরির ইতিবৃত্ত: বন দপ্তরসহ বিভিন্ন সূত্র জানায়, ২০০১ ও ২০০২ সালে স্থানীয় প্রভাবশালী মন্ত্রিপুত্র রশিদপুর থেকে ব্যাপক হারে সেগুনকাঠ কাটিয়ে নেন। তত্কালীন বিট কর্মকর্তা বাধা দিলে তাঁকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। পরে তাঁকে বদলিও করে দেওয়া হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ ছয় মাস ও বর্তমান সরকারের প্রথম ছয় মাসেও এ এলাকায় নির্বিচারে গাছ কাটা হয়।
সূত্রগুলো জানায়, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ছুরুক মেম্বার, বড়জুষের খায়ের মিয়া ও ছোট আলাই মিয়া বনদস্যুদের সংগঠক। তাঁদের সহায়তা করেন শাহাদত, তাজু, আলাউদ্দিন, জিয়ন, ছিদ্দিক, হোসেন, বেলাল প্রমুখ।
সাধারণত গাছ কেটে এসব নেতাকে নির্দিষ্ট এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য গাছপ্রতি কর্মীরা পান ১০০ টাকা করে। দলপতি পান ২০০ টাকা। গাছ আনা হয় বড়জুষ। এখানে চুনারুঘাট, রানীগঞ্জের মহালদারদের দালালেরা সিএফটি হিসাবে কাঠ কেনেন। এরপর ঠেলাগাড়িতে কাঠ চানুরুঘাট-রানীগঞ্জের করাতকলে আনা হয়।
কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে চোরাই কাঠের মধ্যে সেগুন কাঠ বিক্রি হয় প্রতি সিএফটি ৮০০ টাকা, কাঁঠাল ৬০০, আওয়াল কাঠ ৬০০, চাপালিশ ও জারুল কমবেশি ৫০০ টাকা হারে। এখন সবচেয়ে বেশি কাটা হচ্ছে কাঁঠালগাছ। আর প্রতিদিন অন্তত ১০টি গাছ করাতকলে পৌঁছায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
বেড়ায় ক্ষেত খায়: বন পাহারা ও ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসীকে নিয়ে ১৫৫ সদস্যের নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প কো-ম্যানেজমেন্ট (সহব্যবস্থাপনা) কমিটি আছে কালেঙ্গা বন অফিসের সহায়তার জন্য। এরা পালা করে রাতে বনরক্ষীর সঙ্গে টহলে বের হতো। তবে এখন এদের কাজ বন্ধ। আর বন বিভাগের নেতৃত্বে প্রকল্প যুব প্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, গণ্যমান্য ব্যক্তি, বন ব্যবহারকারী দলগুলোকে নিয়ে ৫৫ জনের একটি কমিটি করে দিয়েছিল নিসর্গ। এদের দায়িত্ব ছিল প্রতি মাসে বনের অবস্থা পর্যালোচনা করে উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করেন, বর্তমানে বন বিভাগের বিশেষ করে কালেঙ্গা বিট কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানের অনীহার কারণে কোনো সভা হয় না। গাছচোরদের সহায়তাকারী হিসেবে অনেকেই এই বিট কর্মকর্তার নামও বলেছেন। তবে এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্য জানা যায়নি।

বনের ছনবাড়ি অংশে গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে। বনের ভেতরের ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় গাছটি নিতে পারেনি চোরের দল
বন কেটে ক্ষেত: বন বিভাগের পাহারায় সহায়তাকারী গ্রামবাসীকে অভয়ারণ্য লাগোয়া সমতলে ফসল বোনার জন্য পরিবারপ্রতি এক কেয়ার (৩৫ শতাংশ) করে জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসী বন বিভাগের অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় বন কেটে এই জমি বাড়িয়েছে। ৩০ থেকে ৫০ কেয়ার জমির মালিকও এখন আছেন সেখানে।
সংরক্ষণ কেন জরুরি: শুধু বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের বনে বৃষ্টিপাত হয়। প্রায় পাঁচ মাস শুকনো থাকে বলে এ ধরনের বনভূমিকে বলা হয় শুকনো রেইন ফরেস্ট। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন ও পশ্চিম-মধ্য আফ্রিকার জঙ্গল হচ্ছে ভেজা রেইন ফরেস্ট। ওই সব অঞ্চলে প্রায় প্রতিদিন কিছু মাত্রায় বৃষ্টিপাত হয়।
এ ধরনের বনে গাছপালা অনেক লম্বা হয়। বন হয় তিন স্তরবিশিষ্ট। মাটি থেকে ২৫ ফুট উঁচু এলাকার আবহাওয়া থাকে ভেজা আর গরম। মাটিতে গাছের ডালপাতার পুরু স্তর জমে পচে সার হয়। সেখান থেকেই গাছগুলো খাদ্য পায়। তবে বালু মাটির কারণে এমন বনে মাটির নিচে গাছের খাদ্য তেমন থাকে না।
ওপরের দিকে পরবর্তী ২৫ ফুট এলাকায় কিছুটা বাতাস বয়। এখানে বানর, কাঠবিড়ালি, গেছো ব্যাঙ, উড়ুক্কু সাপ আর গাঢ় রঙের পাখিদের রাজত্ব। গানের পাখি, শিকারি পাখি ও প্যাঁচা এদিকটায় থাকে।
সবচেয়ে ওপরের স্তরে ধনেশ, পাহাড়ি ময়না, ট্রগন প্রভৃতি বসবাস করে।
মূল মাটি অনুর্বর বলে এ ধরনের বনের গাছ কাটা পড়লে বৃষ্টির কারণে বনের প্রথম স্তরের সারযুক্ত মাটি ধুয়ে যায়। সেখানে দ্রুত লতা, ঝোপজাতীয় গাছ গজিয়ে ওঠে বটে কিন্তু মূল গাছ আর ফিরে আসে না।
শত শত বছরে গড়ে ওঠা এ ধরনের বনভূমি যে খাদ্য-শৃঙ্খল তৈরি করে টিকে ছিল, তার অনেকটাই রেমা-কালেঙ্গার বনে ভেঙে পড়েছে। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে বনের কিছু টিলা ন্যাড়া হয়ে যেতে পারে।
বনের অবস্থা জানিয়ে কথা বলতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) আবদুল মোতালেব জানান, রেমা-কালেঙ্গার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একজন বন সংরক্ষকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতিমধ্যে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছে। তাদের প্রতিবেদন দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

0 comments:

Post a Comment