Tuesday, December 28, 2010

সংবিধান

0 comments
সংবিধান কি?
সংবিধান হলো কোন দেশের সর্বোচ্চ আইন। এটা লিখিত বা অলিখিত হতে পারে। লিখিত হলে তাকে দুষ্পরিবর্তণীয় সংবিধান বলে। কারণ, এখানে সংসদ সদস্যদের নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটের দরকার পড়ে। অলিখিত হলে সেটি সুপরিবর্তণীয় সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত এবং এটি দুষ্পরিবর্তণীয়।

বাংলাদেশের সংবিধানঃ
বাংলাদেশের সংবিধানে ১১ টি বিভাগ ও ১৫৩ টি ধারা আছে। কিছু কিছু ধারার সাথে উপধারা যুক্ত আছে। সংবিধানের দ্বিতীয় বিভাগের নাম 'মূলনীতি'। পঞ্চম সংশোধনীতে এই বিভাগে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। যে ধারা সমূহে পরিবর্তন আনা হয় তা হলো, ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮ ও ১৪২ নং ধারা। এছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। (প্রস্তাবনা হলো সংবিধানের ভূমিকা)

পরিবর্তন সমূহঃ
১) প্রস্তাবনায় আনীত পরিবর্তনঃ
-সংবিধানের শুরুতে ' বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম' কথাটা যুক্ত করা হয়।
-প্রস্তাবনায় 'মুক্তি সংগ্রাম' কথাটার স্থলে 'স্বাধীনতা যুদ্ধ' শব্দদ্বয় যোগ করা হয়।

২) ধারাসমূহে আনীত পরিবর্তনঃ
- ৬ নং ধারাঃ ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের জনগণ 'বাঙালি' নামে পরিচিত হবে। আর সংশোধনীতে বলা হয় যে বাংলাদেশের জনগণ 'বাংলাদেশী' হিসেবে পরিচিত হবে।
- ৮ নং ধারাঃ ১৯৭২ সালের সংবিধানে লেখা ছিলো, বাংলাদেশের চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে- ক) ধর্মনিরপেক্ষতা খ) সমাজতন্ত্র গ) জাতীয়তাবাদ ঘ) গণতন্ত্র।
পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মরিরপেক্ষতার স্থলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সন্নিবেশিত হয়। সমাজতন্ত্রের স্থলে 'অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র' যুক্ত করা হয়। এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ যুক্ত করা হয়। এছাড়া ১(ক) উপধারা যুক্ত করে 'আল্লাহ্‌র উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাসই হবে সকল কার্যাবলির ভিত্তি কথাটা যুক্ত করা হয়।
- ৯ নং ধারায় পরিবর্তন এনে লিখা হয়, " রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্টান সমূহে উৎসাহ দান করবেন এবং এই সকল প্রতিষ্ঠান সমূহে কৃষোক শ্রমিক এবং মহিলাদিগকে যাথাসম্ভব প্রতিনিধিত্ব দেয়া হবে"
-১০ নং ধারায় পরিবর্তন এনে লিখা হয় যে, "রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহন নিশ্চিত ক্লরা হবে।
-২৫ নং ধারায় নতুন একটা উপধারা যুক্ত করা হয়, তা হলো, ''রাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে"

- ৩৮ নং ধারা থেকে ধর্মিভিত্তিক রাজনীতি থাকবে না অংশটুকু বিলুপ্ত করা হয়।
-১৪২ নং ধারায় পরিবর্তন করে সংবিধানের ৮, ৪৮ ও ৫৬ নং ধারা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দুই তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থনের পাশাপাশি গণভোটের বিধান করা হয়। [ ৪৮ নং ধারায় বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির বিধান রাখা আছে এবং ৫৬ নং ধারায় প্রধানমন্ত্রীর বিধান রাখা আছে।]

শেষ পর্যায়ঃ
২০০৫ সালে মুন সিনামা হল নিয়ে মামলার এক পর্যায়ে হাইকোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেন। পরে আপিলের মাধ্যমে এ আদেশ স্থগিত করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের বিপক্ষে করা লিভ টু আপিল ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তা বাতিল করে দেয়। কিন্তু ৬ নং ধারায় আনীত সংশোধনী বহাল রাখার আদেশ দেয়া হয়। এবং ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল আনীত পঞ্চম সংশোধনী পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়।

লিখেছেণ: সসসসসসসসসস

Monday, December 27, 2010

ভেষজ চিকিত্সা

0 comments
হাঁপানির জন্য কাঁচা হলুদ শুকিয়ে গুঁড়ো করে আখের গুড় ও সামান্য সরিষার তেল মিশিয়ে চেটে খাবেন।

দাঁতের মাড়িতে ঘা হলে হাতিশুডো গাছের পাতার রস সকালে-রাতে শোবার সময় আক্রান্ত স্থানে লাগালে দ্রুত ভালো হয়।

হঠাৎ কেউ অজ্ঞান হলে, পুদিনা গাছের ফল রোগীর নাকের কাছে ধরলে তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে আসে।

কেটে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি হলে থানকুনি পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে ওই জায়গা ধুলে ভালো হবে।

চিকেন পক্স হলে ৫/৬ গ্রাম মেথি ও ৩ কাপ পানিতে ১০/১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। সারাদিন অল্প অল্প করে সেই পানি পান করলে ব্যথা/ চুলকানি কমবে।

চুলকানি জাতীয় চর্মরোগে নিমপাতা ও কাঁচা হলুদ বেটে গোসলের আধাঘণ্টা আগে লাগালে ভালো হবে।

রক্ত-আমাশয়ে ডুমুর গাছের শিকড়ের রস দিনে ২ বার খান

দাঁতের গোড়ায় ব্যথা হলে আক্রান্ত স্থানে সামান্য হলুদ লাগিয়ে দিন।

ফোঁড়া হলে তা অনেক সময় না পেকে শক্ত দলার মতো হয়ে যায়। কলমি শাকের কচি ডগা ও শিকড় একসঙ্গে বেটে, ফোঁড়ায় লেপে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিন। ফোঁড়া পেকে যাবে।

মচকে গিয়ে ব্যথা পেলে, চালতা গাছের পাতা ও মূলের ছাল সমপরিমাণ একসঙ্গে বেটে হালকা গরম করে ব্যথার জায়গায় লাগালে উপকার পাওয়া যায়।

ঠোঁটের দু'পাশে এবং মুখের ভেতরে অনেক সময় ঘায়ের মতো হয়। গাব ফলের রসের সঙ্গে অল্প পানি মিশিয়ে কয়েকদিন মুখ ধুলে ঘা সেরে যায়।

-স্বাস্থ্য ডেস্ক

সীতাকোট, দিনাজপুর

0 comments
সীতাকোট। বাংলাদেশের প্রাচীনতম বৌদ্ধবিহার। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে নবাবগঞ্জ উপজেলায় এ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিটির অবস্থান। কলিঙ্গের যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক-বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ এবং প্রসারে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। ওই সময় থেকে শুরু করে ৬ষ্ঠ শতক পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে বহু বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। যার একটি আলোচিত 'সীতাকোট বৌদ্ধবিহার' বলে মনে করা হয়।

স্থানীয় লোকজন এটিকে 'সীতার কুঠরি' বলে মনে করেন। তাদের বিশ্বাস, হিন্দুদের দেবতা রাম ও সীতাকে পার্শ্ববর্তী শালবনে বনবাসে দেওয়া হয়েছিল এবং রাম ও সীতা এ কুঠরিতেই বাস করত। কিন্তু ১৯৬৮ এবং ১৯৭২ সালে ২ দফা খননের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় এটি একটি বৌদ্ধবিহার।

এক একর ভূমির ওপর বিহারটি অবস্থিত। এটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ২১৪ ফুট এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ ২১২ ফুট। শৌচাগার ব্যতীত ছোট-বড় ৪১টি কক্ষ রয়েছে। বেষ্টনী প্রাচীর সাড়ে ৮ ফুট, সামনের প্রাচীর ৫ ফুট, বারান্দা ৮ ফুট প্রশস্ত। ভেতরে আঙ্গিনা ১৩৯ূ১৩৫.৫ ফুট আয়তনের। মূল প্রবেশপথ উত্তর দিকে। প্রবেশ পথের ২ পাশে ২টি করে মোট ৪টি কক্ষ রয়েছে। বিহারের দক্ষিণ-পূর্বে ১টি কূপ ছিল, যা বর্তমানে ভরাট হয়ে গেছে। বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাশাপাশি ৫টি কুঠরি দেখা যায়। সম্ভবত এগুলো শৌচাগার হিসাবে ব্যবহার হতো। মূল মন্দির ছিল দক্ষিণ দিকের মাঝের স্থানে। প্রত্যেক কক্ষের সামনের দেয়াল ব্যতীত বাকি তিন দিকের দেয়ালে তাক ও কুলঙ্গি লক্ষ্য করা যায়।

কক্ষে প্রবেশের পথ ১টি। বিহারের ৪ কোণার ৪টি কক্ষ বেশ লম্বা। পশ্চিম দিকের মাঝের অংশে একটি বড় কক্ষ লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণের কক্ষটির কোনো প্রবেশ পথ নেই। সম্ভবত এটি ছিল গুপ্ত কক্ষ। মাঝের আঙ্গিনায় কোনো কেন্দ্রীয় মন্দির লক্ষ্য করা যায় না। সমগ্র ইমারতের গাঁথুনি চুন, সুরকি দ্বারা তৈরি। তিন ধরনের ইটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়_ লম্বা, মধ্যম ও ছোট। নির্মাণশৈলী দেখে গবেষকরা অনুমান করেন এ বিহার ষষ্ঠ শতাব্দী কিংবা তার কিছু আগে নির্মিত হয়েছিল। বিহারের পূর্ব দিকে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে। যা স্থানীয়ভাবে 'শালদীঘি' বলে পরিচিত। বর্তমানে সেখানে সরকারি দুস্থ আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। প্রাচীন পালি, বোদড়া ও জম্মু নদীর পূর্ব দিকের বিস্তৃত অঞ্চলের বৌদ্ধ কীর্তিসমূহ, রাজনৈতিক আগ্রাসন, যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হয়। বিশেষ করে রাজা শশাংকের বৌদ্ধ বিদ্বেষী আচরণের প্রেক্ষিতে এ অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ কীর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। সীতাকোট বিহারের ভাগ্যেও এমন বৈরী আচরণের প্রভাব পড়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

-রাশেদুর রহমান

ব্লু-হাউস

0 comments
ব্লু-হাউস হলো গণপ্রজাতন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ও প্রধান কার্যালয়। দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের কাছে এ বাসভবনটির নাম চিওয়াংওয়াজ। সে দেশের স্বনামধন্য রাজা সুকজং ১০৯৫ সালে ভবনটি নির্মাণ করেন। ১৩৯২ খ্রিস্টাব্দে জোছিয়ান ডাইনেসটি নামক একজন বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ভবনটি সংস্কার করেন। শুরুর দিকে এর নাম ছিল_ জিওয়াংবগ প্রাসাদ। ১৩৯৫ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কিংটাজিও প্রাসাদ। ১৩৯৮ সালে প্রাসাদটি সিভিল সার্ভিস ও সৈন্যদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার ১৯১০ সালে ভবনটির সামনে বিশাল আকারের সবুজ মাঠ, জাপান-কোরিয়া যৌথ মিলনায়তন নির্মাণ করেন। ১৯৩৯ সালে দক্ষিণ কোরীয় সরকার ভবনটিকে চিওয়াংওয়াজ নামে রূপান্তর করে সরকারি বাসভবন ও কার্যালয় হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। তিনতলাবিশিষ্ট মূল ভবনটি ছাড়াও এর আশপাশে রয়েছে একই রং ও ধরনের চারটি ভবন। প্রধান ভবনটিকে ব্লু-হাউস বলা হলেও আসলে এর রং নীল নয়। তবে কেন এটিকে ব্লু-হাউস বলে? এর কারণ হিসেবে বলা হয়, দিনের বেলা সূর্যের আলো ভবনটির উপরে পড়লে ভবনটি নীল রূপ ধারণ করে এবং তাই একে ব্লু-হাউস বলা হয়। দক্ষিণ কোরীয় সরকারের যাবতীয় কার্যাবলী এই ভবনেই সম্পন্ন হয়। এদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি শতবর্ষ ধরে এই ভবনটিতেই সু-সম্পন্ন হচ্ছে। ব্লু-হাউসকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য রয়েছে প্রায় ৫০ জন পরিচ্ছন্নকর্মী। প্রধান ফটকে রয়েছে ৫ জন নিরাপত্তাকর্মী। দূর থেকে ভবনটি দেখতে আকর্ষণীয়, মনোরম ও অত্যন্ত পরিপাটি মনে হয়। অতি চমৎকার এই ভবনটিকে কেন্দ্র করে অন্য যে তিনটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে পর্যায়ক্রমে সরকারের উচ্চ-পর্যায়ের মন্ত্রী ও সচিবরা বসবাস করেন। ব্লু-হাউস দেখতে যতটা সুন্দর তার চেয়ে অধিক সুন্দর এর পারিপাশ্বর্িকতা। সুনসান নীরবতা সবসময় বিরাজ করে-ব্লু-হাউসে। প্রায় ৩০০ একর জায়গাজুড়ে ব্লু-হাউস ও এর সীমানা নির্ধারিত। দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ নাগরিক সপ্তাহে একবার ব্লু-হাউস ও এর আশপাশ দেখার সুযোগ পায়। তবে বিদেশি নাগরিক ও অতিথিদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে ব্লু-হাউসের দূরত্ব ৫ কি.মি.। মজার ব্যাপার হলো_ পীত সাগর নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া- উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল তার ঘোষণা এসেছিল এই ব্লু-হাউস থেকেই। ব্লু-হাউসকে আরও মাধুর্যপূর্ণ করেছে এর পেছনের সুউচ্চ পর্বত। যে পর্বত থেকে ব্লু-হাউস দেখতে অত্যন্ত চমৎকার। যাই হোক, নানা কারণেই ব্লু-হাউস দক্ষিণ কোরীয় সরকার ও জনগণের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

-মো. রিয়াজুল ইসলাম

Sunday, December 26, 2010

মেনোপজ

42 comments
দুরন্ত কৈশোর পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠতে শরীর ও মনে, দেহের ভেতরে-বাইরে নানা রকম পরিবর্তন হয়। ভেতরে এ পরিবর্তনের অন্যতম হলো রজঃস্রাব বা মাসিক। এটা সাধারণত ১২ থেকে ১৪ বছরের মেয়ের শুরু হয় যদিও পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, স্বাস্থ্য ও ভিন্ন পরিবেশে এর কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আবার ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়সে পূর্ণাঙ্গ নারীর জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন, সেটাও শরীরের ভেতরে ও বাইরে। এর মধ্যে অন্যতম হলো রজঃনিবৃত্তি বা মেনোপজ। এটা হয় মেয়েলি হরমোনগুলোর নিঃসরণ কমে যাওয়ার জন্য।

সাধারণত ৪৫ থেকে ৫২ বছর বয়সে আবার এর উল্টোটা ঘটে, যেমন­ কারো ৪০-এর পর, আবার কারো ৫৪ বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক হতে পারে।

এ সময়ে এ হরমোন (ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরোন) কমার জন্য মহিলাদের জীবনে শারীরিক ও মানসিক, পরিবর্তন হয় যা তাকে প্রচন্ড চাপের মধ্যে ফেলে।

শারীরিকঃ ত্বক মোটা ও রুক্ষ হতে থাকে। স্থূলতা বা ওজন বাড়ে। স্তন শুকিয়ে যেতে থাকে।

মানসিকঃ যারা একা, ছেলেমেয়ে ছাড়া অসুখী জীবনযাপন করেন তাদের পরিবর্তন বেশি হয়। অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা জন্মে যে, মেনোপজ হওয়া মানেই তাদের জীবন শেষ ও নারীত্ব শেষ। এমনকি স্বামীর ভালোবাসা শেষ।

এ সময়ে বিষণ্নতা, অকারণে উত্তেজনা, নার্ভাসনেস, রুক্ষ ও খিটখিটে মেজাজ, অমনোযোগিতা, মাথা ধরা ইত্যাদি থাকে। খাবারে প্রচন্ড অরুচি, অনেক সময় বদহজম হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা, হট ফ্ল্যাশ বা নাকে বা মুখে হঠাৎ গরম ভাপ লেগেছে মনে হয়। একে মেনোপজের প্রথম বা প্রধান লক্ষণও বলা যেতে পারে। এটি দিনে দুই-তিনবার বা রাতে যেকোনো সময় হতে পারে, যা তাকে ঘুমের মধ্যে প্রচণ্ড রকম ঘামিয়ে দিতে পারে।

মহিলা জননাঙ্গ শুকিয়ে যেতে থাকে। তা ছাড়া ঘন ঘন প্রস্রাব, স্তনে ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা, হাড় নরম হয়ে যাওয়া ও ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বেশি হয়।

চিকিৎসাঃ প্রথম ধাপঃ এ সময়ে সহানুভূতির সাথে তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। বুঝাতে হবে এটা জীবনের একটা ধাপ বা পরিবর্তন মাত্র, জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। যাদের হট ফ্ল্যাশ বা ঘাম বেশি হয় তাদের চা, কফি, বিছানায় গরম কাপড় ব্যবহার বাদ দিতে হবে। নিয়মিত বা পরিমিত ব্যায়াম, ঠাণ্ডা পানীয় তাদের স্বস্তি দিতে পারে অনেকটা।

দ্বিতীয় ধাপঃ প্রয়োজনে ঘুমের ওষুধ, প্রেসার বা ডায়াবেটিস বেশি হলে এর ওষুধ, নার্ভাসনেস কমানোর জন্য ট্রাংকোলাইজার ও বিটা ব্লকার ভালো কাজ করে থাকে।

তৃতীয় ধাপঃ যখন সমস্যা এতটাই প্রকট হয় অথবা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে চিকিৎসায় সমাধান হচ্ছে না তখন হরমোন বা এইচআরটি’র প্রয়োজন হতে পারে। এটা দিতে হবে তখনই যখন হরমোন প্রয়োগে নিষেধ নেই এবং যিনি এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে জেনে নিতে রাজি হন ও সময় মতো ফলোআপে রাজি হন। জরায়ু না থাকলে সর্বাপেক্ষা কম ডোজ ইস্ট্রোজেন এবং জরায়ু থাকলে সাথে শেষ ১০ দিন প্রজেস্টেরোন দিতে হবে। অনেক সময় লোকাল ক্রিম হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে। যাদের হাড় দুর্বলতা বা হাড় ক্ষয়ে যাওয়া বা ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা আছে তাদের সার্ম (সিলেক্টিভ ইস্ট্রোজেন রিসেপটর মডুলেটর) খেয়ে উপকার পেতে পারেন। তা ছাড়া ভিটামিন ই, ডি, ক্যালসিয়াম, ছোট মাছ, শাকসবজি, ফলমূল খুব উপকারে আসবে। তেল ও চর্বিজাতীয় খাবার বাদ দেয়া সব দিক থেকেই মঙ্গলজনক। যেহেতু একজন মহিলার জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় মেনোপজের পরে পার হয় এবং এ সময়ই যাবতীয় উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ সময় তাই তাকে এ সময় সব দিক থেকে সর্বসেরা কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা দেয়া বাঞ্ছনীয়।

**************************
ডা. হামিদা বেগম
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রন্থনাঃ ডা. শামীমা ইয়াসমীন
দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১১ মে ২০০৮

মানসিক রোগ

56 comments
মানসিক রোগ এমনই একটি সমস্যা যে রোগে জীবনের কোন না কোন সময়ে আমরা যে কেউ আক্রান্ত হতে পারি। তাই বিভিন্ন মানসিক রোগ সর্ম্পকে আমদের প্রত্যেকেরই ধারণা থাকা উচিত।
মানসিক রোগ মূলত দুই প্রকার: যেমন

(১) নিউরোসিস এবং
(২) সাইকোসিস।

নিউরোসিস
নিউরোসিস রোগটি মৃদু ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগির আচার-আচরণ বা ব্যবহারে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। এই নিউরোসিস জাতীয় রোগে রোগী নিজে রোগটিতে ভূগতে থাকে ও কষ্ট পেতে থাকে এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে অনেক রোগীই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান না।


সাইকোসিস
সাইকোসিস রোগটি হচ্ছে জটিল ধরনের মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর আচার-আচরণ বা ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কুসংস্কার এবং মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে এক্ষেত্রেও অধিকাংশ রোগীর অভিভাবক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান না। এরা একে পরী ধরা, জ্বিনের আছর, ভূতে ধরা, বাতাস লাগা, প্রভৃতি মনে করে পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদির জন্য পীর, ফকির, দরবেশের কাছে ছুঁটে যান। এতে করে রোগীর তো কোন উপশম হয়ই না বরং বিভিন্ন অপচিকিৎসায় রোগীর অবস্থা আরো জটিল আকার ধারণ করে।

বিভিন্ন নিউরোসিস মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছেঃ

টেনশন বা উদ্বেগ আধিক্য রোগ


মানুষ মাত্রই টেনশন থাকে। কিন্তু টেশনের এই স্বাভাবিক মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যায় তখনই এ রোগ হয়। এ রোগে একটা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে রোগী এবং কাজে কর্মে মন বসাতে পারে না।

অবসেশল বা শুচিবায়ু রোগ

এ রোগটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি একই কাজ বার বার করে। যেমন-হাত ধোয়া, ঘরের তালা লাগানো ঠিক মতো হলো কিনা সেটা বার বার চেক করা, একটা চিন্তা মাথায় ঢুকলে সে চিন্তাই বার বার করা। বার বার একই কাজ করতে রোগী নিজেকে বাধা দিতে চায়। কিন্তু পারে না।

হিস্টিরিয়া

মহিলারা এ রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হয়। দুশ্চিন্তাই এ রোগের মূল কারণ। রোগী যখন তার দুশ্চিন্তার কথা মুখে প্রকাশ করতে পারে না তখন শারীরিক বা মানসিক উপসর্গের মাধ্যমে এ রোগ প্রকাশ পায়।

ফোবিয়া বা অহেতুক ভীতি রোগ

অহেতুক ভীতি বা ফোবিয়া সেটাই যেখানে যতটুকু ভয় পাওয়ার প্রায়োজন তার অত্যন্ত বেশি ভীত হয়ে পড়া। উদাহরণ স্বরুপ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষ করে কেউ মারা গেছে শুনলে, বেতার বা টিভিতে খুন জখমের কথা শুনলে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। এছাড়া নিউরোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে ধাতুগত রোগ, শরীর নিয়ে রোগ (হাইপো-কনড্রিয়াসিস) ইত্যাদি।

বিভিন্ন সাইকোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে।

ডিপ্রেমন বা বিণ্নতা রোগ


বিষণ্নতা বোধ এবং বিষণ্নতা রোগ দুটি আলাদা জিনিস, সত্যিকার বিষন্নতা রোগে মন খারাপ ভাব দীর্ঘমেয়াদী ভাবে থাকবে যা রোগী ইচ্ছা শক্তি দিয়েও দূর করতে পারে না এবং তার কাজ-কর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। যেমন- দীর্ঘমেয়াদী অশান্তি বোধ, আনন্দদায়ক কাজে আনন্দ না পাওয়া, আত্নহত্যার চিন্তা করা প্রভৃতি।

সিজোফ্রেনিয়া

সিজোফ্রেনিয়া মানসিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল ব্যাধি। এ রোগের বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে পরিবেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা অসংলগ্ন এলোমেলো ও হেঁয়ালি পূর্ণ কথাবার্তা বলে, কানে গায়েবী আওয়াজ শোনা ইত্যাদি। আরো সাইকোসিস রোগের মধ্যে রয়েছে ম্যানিয়া, প্রসবোত্তর মানসিক ব্যাধি। ম্যানিক ডিপ্রেসিভ রোগ প্রভৃতি।
সিজোফ্রেনিয়া রোগের একটি উদাহরন।

শনিবার বেলা ২টা। চাকুরিয়া ষ্টেশনের পাশে ৩-৪ হাত দুরে উচু ছোট্ট একটি কালীমন্দির। মন্দিরের মাথায় চক্র ও ত্রিশয়ল। মন্দিরটির নাম "জয় মা রাঠের কালী"। মন্দিরের সামনে সিমেন্ট বাধান চাতাল। চাতাল ও পাশের মাঠে ইতস্তত ছড়ানো অনেক লোক। আর সেই দাওয়ার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে এক যুবতী, পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ী এলোমেলো, চোখ দুটি বোজা, নাকের পাটা ফোলা, মুখের দুপাশে ক্ষীণ রক্তের দাগ। মহিলাটির ভর হয়েছে। কালী পুজা করতে করতে অচেতন হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন। মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে থাক। হঠাৎ মহিলা বলে উঠেন: স্বামীর লগে এয়েছিস কে?

শাখা-সিদুর মাঝবয়সী এক আধা-শহুরে মহিলা ঠেলাঠেলি করে সামনে এলেন। মন্দিরে ছোট দরজার সামনে হাটু মুড়ে বসে 'মা' বলে হাতজোর করে ডাকতে লাগলেন।

'মা' বললেন- "সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না আমার জল পড়া খাইয়েছিস?"
মহিলা- খাইয়েছি মা। সারছে না মা।
মা বললেন- "ওতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।"

এরপর মা বললেন ব্যবসার জন্য কে এসেছিস? বোস। আমার কাছে আয়।" শাট প্যান্ট পড়া মাঝবয়সী ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। একইভাবে-হাতজোড়। হটু মুড়ে বসা। মায়ের কাছে সমস্যার কথা জানালেন। মা অভয় দিলেন। ভদ্রলোক চলে গেলেন।
এরপর মা বললেন সন্তানের লগে এয়েছিস কে? শিশুকোলে এক রমনী এগিয়ে এলেন। মা শিশুটাকে তার হুকের উপর শুইয়ে দুই হাতে সজোরে শিশুটির পিঠের ওপর চড় মারতে লাগলেন। তারপর শিশুটিকে দু'হাত দিয়ে উচু করে তুলে ধরলেন এবং আবার চড় মারতে লাগলেন, এরপর "মা" শিশুটিকে তার মা-য়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেন।
মায়ের ভরমুক্তির সময় হয়ে এল। মহিলা। পুরুষ ঠেলাঠেলি করে এগোতে লাগলেন। নিজের নিজের সমস্যার কথা বলবেন এরা। মায়ের ভরমুক্তি হলো। চিৎ হওয়ার অহস্থা থেকে উপুড় হয়ে শুলেন 'মা'। কিছুক্ষন পরে উঠে হসলেন তিনি। পূজো করতে লাগলেন। মন্ত্র পড়ে, হাততালি দিয়ে দেবীর আরাধনা চলল।


এছাড়াও আছে শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগঃ

আমরা অনেকেই জানি না বা বিশ্বাস করতে চাই না যে, শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগ হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক সত্য এই যে, শিশু জন্মের তিন বছর পর থেকে তারা মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছে বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ, স্কুল পালানো, খাদ্যগত সমস্যা, ওটিসম (এটি ৩ বছরের পূর্বে দেখা দেয়) আচরণগত সমস্যা, চঞ্চলতা রোগ। অন্যান্য মানসিক রোগের মধ্যে আছে মাদকাশক্তি, মৃগীরোগ জনিত মানসিক রোগ, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রভৃতি। মানসিক রোগ এক নীরব ঘাতক ব্যাধি তাই এই রোগ সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত এবং সচেতন হওয়া উচিত।

সাইফিহমু

Saturday, December 25, 2010

মানুষ গন্ধ টের পায় কেমন করে

0 comments
মানুষ নাকের সাহায্যে গন্ধ অনুভব করে। গন্ধ গ্রহণ করার জন্য নাকের মধ্যে ঘ্রাণ আবরণী কলা থাকে। এর মধ্যে থাকে অসংখ্য ঘ্রাণ ও স্তম্ভাকার কোষ। এর মধ্যে আছে হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ। ঘ্রাণ কোষের সঙ্গে ঘ্রাণ স্নায়ু যুক্ত থাকে। এর সাহায্যে আমরা গন্ধ টের পাই।

দাগেস্তান

0 comments
দাগেস্তান হচ্ছে উত্তর ককেশাস অঞ্চলের অন্তর্গত রাশিয়ার একটি প্রদেশ। এটি চেচনিয়ার পাশর্্ববর্তী একটি মুসলমান অধু্যষিত অঞ্চল। রাশিয়ার সম্রাট জার পিটার দ্য গ্রেট ১৭২২ সালে দাগেস্তানকে রাশিয়ার অন্তভর্ুক্ত করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ককেশাস অঞ্চলের প্রদেশ চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দেখা দিলে তার অনুসরণে দাগেস্তানও স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু রাশিয়া সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দাগেস্তানের বিছিন্নবাদী আন্দোলন দমন করে।

ওডারল্যান্ড

0 comments
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে যারা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসকে করেছেন গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা ও সুমহান অবদান এ দেশের মানুষ চিরকাল মনে রাখবে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একজন বিদেশি নাগরিক বীরপ্রতীক উপাধি পেয়েছেন। অনেকেই হয়তো তার নাম জানি না। তিনি হলেন ওডারল্যান্ড। তিনি ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। কাজ করতেন বাটা সু কোম্পানিতে। সেইসূত্রে ১৯৭০ সালে ঢাকায় পোস্টিং পেলেন। নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ওডারল্যান্ড ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন বীর সেনানী। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কখনো গোয়েন্দাগিরি, কখনো আলোকচিত্রী আর কখনো বাঙালিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন ওডারল্যান্ড খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকার আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ করেন। পঁচিশে মার্চের কালো রাত্রে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর যে বর্বর হামলা চালায়, তা দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে।

জীবদ্দশায় ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধের উপর কোনো স্মৃতিচারণ লিখে যাননি। তবে, ক্ষুদ্রাকারের কিছু চিঠিপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক কিছু অবতারণা করেছিলেন। তিনি এক চিরকুটে লিখেছেন, 'আমার জন্ম ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে, আমস্টারডামে। ইউরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৃতীয় বছর। ১৯৩৬ সালে আমি ন্যাশনাল সার্ভিসে যেতে বাধ্য হই। এর কিছুদিন পর বাটা সু কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ডাচ বাহিনীর পক্ষে লড়াই করে নাভেসি বাহিনীর বর্বতার সম্মুখীন হই। তিনি আরো লেখেন, 'নাৎসি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাবার পর আমি আন্ডারগ্রাউন্ড তৎপরতায় যুক্ত হই। জার্মান এবং বিভিন্ন ডাচ উপভাষায় আমি অনর্গল কথা বলতে পারতাম। এই সময় জার্মান হাই কমান্ডের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ফলে, ডাচ আন্ডার গ্রাউন্ড তৎপরতাকে যেমন আমি সাহায্য করতে পেরেছিলাম, তেমনি মিত্রবাহিনীকে জরুরি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালে মার্চ মাসে ঢাকায় ট্যাংক নামার পরও একই ব্যাপার হয়েছিল।' ওডারল্যান্ডের চোখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেদনা, রক্তাক্ত স্মৃতি আর বাংলার মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে পড়েছিল। আর তাই তিনি বাংলার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা দেখে আমার ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে কারো না কারো জানানো উচিত। আমি অবাধেই চলাফেরা করতে পারছিলাম। নিরীহ মানুষজনের উপর পাকিস্তানিরা যেসব ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল, সেসবের ছবিও তুলতে পেরেছিলাম। এরপর সেই ছবিগুলো বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়াতে পাঠিয়ে দিতাম।' তিনি আরো লেখেন, 'হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পরিধি বাড়িয়ে নানা তথ্য গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে লাগাতে থাকলাম। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধের আরো গভীরে। বাটার শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করে টংগীসহ সেক্টর ১ এবং ২ নম্বরে গড়ে তুলি গেরিলা বাহিনী। আর নিজেই দায়িত্ব নিলাম প্রশিক্ষকের।' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এ অকুতোভয় বীর আরো লিখেছেন, 'সেসময় বাঙালিদের জন্য যে ভালোবাসা আর টান আমি অনুভব করেছি, এ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ।' যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। চাকরি শেষে ১৯৭৮ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান। এরপর ২০০১ সালের ১৮ মে বাংলাদেশের এই বন্ধু বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড পরলোকগমন করেন।

নাইজেরিয়া

0 comments
নাইজেরিয়া পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর রাজধানীর নাম আবুজা। তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এর পশ্চিমে বেনিন, পূর্বে শাদ ও ক্যামেরুন, উত্তরে নাইজার এবং দক্ষিণে গিনি উপসাগর অবস্থিত। নাইজেরিয়া ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে দেশটি ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় রাজধানী এলাকা নিয়ে গঠিত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত দেশটি সামরিক শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের দিকে নাইজেরিয়ায় গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। নাইজেরিয়া সম্পর্কে মজার তথ্য হলো, দেশটির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নাইজার নদীর নামানুসারে। বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়ার অবস্থান অষ্টম। মজার ব্যাপার হলো, অধিবাসীদের অধিকাংশেরই গায়ের রঙ কালো। আড়াইশ নৃতাত্তি্বক গোষ্ঠীর মধ্যে মোটামুটি চার হাজার রকম ভাষা প্রচলিত আছে। তবে গোষ্ঠী সংখ্যা আড়াইশ' হলেও প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠী তিনটি। দেশটির সরকারি ভাষা ইংরেজি হলেও নাইজেরিয়ানরা প্রধানত আড়াইশ' ভাষায় কথা বলে থাকে। দেশটির উত্তরাঞ্চল আধা মরুভূমি। দেশটি আফ্রিকার অন্যতম অপরিশোধিত তেল উৎপাদক। প্রায় ২৫০-এর অধিক উপজাতি গোষ্ঠী অধু্যষিত এই দেশটির অধিকাংশ লোকই কৃষ্ণাঙ্গ।

ঐতিহাসিক পটভূমি

৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলে নক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। ১৫ শতকে নাইজেরিয়ায় ইউরোপীয়রা প্রবেশ করে। তারা এখানে দাস ব্যবসা শুরু করে। ১৯৬১ সালে অঞ্চলটি ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। ১৯৬০ সালে নাইজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে রিপাবলিক। ১৬ বছর সামরিক শাসনের পর ১৯৯৯ সালে এক নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। পেট্রোলিয়াম নির্ভর অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে প্রেসিডেন্ট কিছুটা ঝুঁকির মুখে পড়েন। কারণ, রাজস্ব ক্ষেত্রে তখন চলছিল দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। গণতন্ত্র পুনর্গঠনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিও ছিল কষ্টকর। পরবর্তীকালে বাসনেজো প্রশাসন দীর্ঘকালের জাতিগত এবং ধর্মীয় চাপা উত্তেজনাকে প্রশমনে সক্ষম হয়। কারণ, এটিই ছিল অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসের নির্বাচনের মাধ্যমে নাইজেরিয়ার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

অবস্থান ও আয়তন :এটি ১০০০র্০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮০০র্০ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। দেশটির উত্তরে নাইজার, পূর্বে চাদ ও ক্যামেরুন, দক্ষিণে গিনি উপসাগর এবং পশ্চিমে বেনিন।

দেশটির আয়তন প্রায় ৯,২৩,৭৬৮ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের ৩২তম বৃহত্তম দেশ।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা :দেশটিতে ৩৬টি স্টেট ও ১টি ফেডারেল ক্যাপিটাল টেরিটরি আছে।

উচ্চতম স্থান :দেশটির উচ্চতম স্থান হচ্ছে_চাপ্পাল ওয়াদি, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৯৩৬ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।

জলবায়ু :দেশটির আবহাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান। তাই সর্বত্র তাপমাত্রা প্রখর থাকে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাধারণত বর্ষাকালে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় এবং উপকূল থেকে দূরবর্তী এলাকাগুলোতে বৃষ্টিপাত কম হয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৫৪-৯৮ ইঞ্চি।

প্রধান নদী :নাইজার, বেনিউ।

প্রাকৃতিক সম্পদ :প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম, টিন, আকরিক লৌহ, কয়লা, চুনাপাথর, সীসা ও দস্তা।



এ ক ন জ রে

রাষ্ট্রীয় নাম : ফেডারেল রিপাবলিক অব নাইজেরিয়া।

রাজধানী : আবুজা

জাতীয়তা : নাইজেরিয়ান

আয়তন : ৯,২৩,৭৬৮ বর্গ কিমি

আন্তর্জাতিক সীমান্ত : স্থল সীমান্ত ৪,০৪৭ কিমি এবং সমূদ্র উপকূলবর্তী ভূমি ৮৩৫ কিমি।

জনসংখ্যা : ১৫,৪৭,২৯,০০০

ধর্ম : মুসলমান ৫০%, খ্রিস্টান ৪০%, আদি ধর্মে বিশ্বাসী ১০%।

মুদ্রা : নাইরা (ঘঘে)

স্বাধীনতা লাভ : ১ অক্টোবর ১৯৬০

জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ : ৭ অক্টোবর ১৯৬০

জাতীয় দিবস : ১ অক্টোবর

ভাষা : ইংরেজি, হাউনো, ইবো

সরকার পদ্ধতি : রাষ্ট্রপতি শাসিত

সরকার প্রধান : রাষ্ট্রপতি।

সোমালিয় জলদস্যু

0 comments
মাঝ সমুদ্র থেকে একের পর এক জাহাজ ছিনতাই ও নাবিকদের জিম্মি করে কোটি কোটি ডলার আদায় করলেও নিজেদের জলদসু্য বলে না তারা। নিজেদের কোস্টগার্ডস দাবি করে সোমালি জলদসু্যরা। বিদেশিরা তাদের সমুদ্র উপকূলে এসে অবৈধভাবে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। বাণিজ্য জাহাজগুলো রাসায়নিক বজর্্য ফেলে পানি দূষণ করছে। এখন আর সোমালিয়ার জেলেদের জালে মাছ ওঠে না। এগুলো ঠেকাতেই তারা সাগর পাহারা দেয়। সোমালি জলদসু্যরা নিজেদের কর্মকান্ডের এমন সরল ব্যাখ্যা দিলেও এর সবটাই সত্য নয়। বেশিরভাগ সোমালি তাদের এ কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না।

আবদুল কাদিল মোহাম্মদ নামের এক সোমালিয় জানান, বেশিরভাগ জলদসু্যর বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। শুধু অর্থের লোভে জাহাজ ছিনতাই করে তারা। মুক্তিপণের টাকায় বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, সুন্দরী বউ, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই পায় তারা।

সোমালিয়া এখন জলদসু্যর দেশ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ১৯৬০ সালে দেশটি স্বাধীন হবার পর গ্রামীণ গণতন্ত্রের জন্য আফ্রিকার 'ওয়েস্ট' হিসেবে চিহ্নিত হয়। সে সময় প্রায়ই দেখা যেত গোত্র সংঘর্ষ। ১৯৬৯ সালে সিয়াদ বারের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণ করে। উন্নয়নের জন্য দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র গ্রহণ করেন তিনি। মডেল হিসেবে নেয়া হয় চীনকে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তখন শস্য উৎপাদন, হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মাণ শুরু হয়। জাতীয়করণ করা হয় প্রায় সব ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সমবায়ের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে থাকে শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেমে আসে শূন্যে। গোত্র প্রধানরা মেনে নেন সিয়াদ বারের শাসন। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যায় সোমালিয়া। তবে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যায় ১৯৯১ সালে সিয়াদ বারে ক্ষমতা হারানোর পর। আবারও শুরু হয় গোত্র সংঘর্ষ, রক্তারক্তি আর হাঙ্গামা। সোমালিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

মৎস্য শিল্পের উন্নয়নের জন্য ডেনমার্ক, ব্রিটেন, ইরাক, জাপান, সুইডেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং পশ্চিম জামর্ানির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেত সিয়াদ বারে সরকার। নিজেদের দেশে সামুদ্রিক খাবারের চাহিদা না থাকায় বিপুল মাছ রপ্তানি হতো ঐ সব দেশে। সিয়াদ বারের পতনের পর মাছ রপ্তানিতে নেমে আসে ধস। সোমালিয়ার উপকূলে এসে অবৈধভাবে মাছ ধরতে থাকে বিভিন্ন দেশের ট্রলার। কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় কিছু কিছু গোত্র প্রধান অর্থের বিনিময়ে তাদের এ সুযোগ করে দিতেন। চলতো বাণিজ্য জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্রসীমায়। ঐ সব জাহাজ থেকে ব্যাপক হারে রাসায়নিক বর্জ্য পড়ায় সমুদ্রে দূষণ বাড়তে থাকে। ফলে সোমালিয় জেলেরা আগের মতো আর সাগরে মাছ পেত না। তাছাড়া মাছ ধরার উন্নত প্রযুক্তি না থাকায় তারা আধুনিক বিদেশি মাছ ধরার ট্রলারের সঙ্গে পেরেও উঠছিল না। কার্যকর নৌ-বাহিনী এবং জাহাজ না থাকায় বিশাল সমুদ্র উপকূলও থাকতো অরক্ষিত।

বিরতিহীন গোত্র সংঘর্ষের কারণে দেশটিতে গড়ে ওঠে নি কোন কেন্দ্রীয় সরকার। দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষেরই বিদেশি খাদ্য সহায়তার উপর বেঁেচ থাকতে হয়। নেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান। হর্ন অব আফ্রিকা (মানচিত্রে দেশটির অবস্থান অনেকটা শিং এর মতো) নামে পরিচিত দেশটির অনেক মানুষই এ কারণে দসু্যবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে।

ভৌগোলিকভাবে সোমালিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। লোহিত সাগর, এডেন উপসাগরের প্রবেশমুখে দেশটির অবস্থান। আর একটু দূরেই আরব সাগর। লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযোগ করেছে সুয়েজ খাল। ১৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খাল পেরুলেই ইউরোপ, আমেরিকা মহাদেশের সঙ্গে এশিয়ার সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরত্ব কমে যায়। আর তাই এটিই বিশ্বের সবয়েয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট।

এমন আকর্ষণীয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সোমালীয়রা জাহাজ ছিনতাইয়ে নেমে পড়ে। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জাহাজ ছিনতাই ব্যবসা। ছিনতাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও অস্ত্র কেনার জন্য আছে অর্থলগি্নকারী। ছিনতাই অভিযান সফল হলে নাবিকদের মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর হয় ভাগ-বাটোয়ারা। জলদসু্যদের কাছে জিম্মি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই জিম্মিদের দেখাশুনায় কোন ক্রটি করে না তারা। ছিনতাই বাণিজ্যে অনেক টাকা বিনিয়োগ করা হয় বলে জলদসু্য সদস্য বাছাই করা হয় বেছে বেছে।

জলদসু্যদের যে কোন অভিযানে তিনটি গ্রুপ থাকে। একটি গ্রুপে থাকে সাবেক জেলেরা। তাদের বলা হয় অভিযানের মাথা। আরেক গ্রুপে থাকে মিলিশিয়া বাহিনীর সাবেক সদস্য। তাদের রয়েছে গোত্র লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ও আধুনিক অস্ত্র চালনায় পারদর্শিতা। এদের বলা হয় অভিযানের শক্তি। অপর গ্রুপে থাকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। তারা অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন স্যাটেলাইট ফোন, জিপিএস এবং সামরিক সরঞ্জাম সম্পর্কে অভিজ্ঞ। এদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে সম্মানিত যিনি সবার আগে টার্গেট জাহাজে চড়েন। তিনি নেন সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক। কারণ ঐ জাহাজ থেকে প্রতিরোধ আসলে তিনিই শিকার হবেন সবার আগে। আর যে যত বার এ কাজটি করতে পারেন তার প্রোফাইল হয় তত ভারি। তার কদরও বহুগুণ বেড়ে যায়। এমন একজন জলদসু্য প্রতি অভিযানে পেয়ে থাকেন পাঁচ হাজার ডলার করে।

সোমালিয়া ও ইয়েমেনের মাঝে এডেন উপসাগর। অভিযোগ রয়েছে, ইয়েমেন থেকে জলদসু্যরা বেশিরভাগ অস্ত্র পেয়ে থাকে। ১৯৯২ সাল থেকে সোমালিয়ায় অস্ত্র বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিপুল অস্ত্র সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকেও সংগ্রহ করে ছিনতাইকারীরা। 'হাওয়ালা' কোম্পানির (হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠিকভাবে মূল্য স্থানান্তর ব্যবস্থা) মাধ্যমে জলদসু্যরা মোগাদিসুর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে থাকে। অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই সোমালিয়ার অন্যতম প্রধান শহর পুন্টল্যান্ডে অস্ত্র দিয়ে যায়। অতীতে শোনা যেত, দুবাইয়ের বড় বড় ব্যবসায়ীরা জাহাজ ছিনতাইয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা দিত।

অভিযানে এ কে-৪৭ রাইফেল, রকেট লঞ্চার ও ভারি গ্রেনেড সঙ্গে নেয় জলদসু্যরা। জলদসু্যদের অভিযান পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ হয় এক অভিনব পদ্ধতিতে। অভিযানের আগেই প্র্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, অস্ত্র ও ট্রলারের ভাড়া একেকজন দিয়ে থাকে। মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর সে অনুপাতে হয় ভাগাভগি।

মুক্তিপণের অর্থ আদায়েও জলদসু্যরা ব্যবহার করে অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। মুক্তিপণের অর্থ তারা নিয়ে থাকে ডলারে। মুক্তিপণের অর্থ আদায়ে জলদসু্যরা ঐ জাহাজের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাযোগের জন্য তাদের সঙ্গে থাকেন ইংরেজিতে দক্ষ একজন দোভাষী। তিনিই বলে থাকেন মুক্তিপণের অর্থের পরিমাণের কথা বা কোথায় তা ডেলিভারি দিতে হবে তাও। ডলার গণনার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক মেশিন, যা আনর্্তজাতিক মুদ্রা গণনায় ব্যবহার করা হয়। ওয়াটারপ্রুফ সুটকেস কিংবা কাপড়ের থলে ভর্তি করে পাঠাতে হয় ডলার। ২০০৯ সালে ছিনতাইকৃত সৌদি জাহাজ এম ভি সাইরাসের নাবিকদের মুক্তিপণ নেয়া হয় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে প্যারাসুটে ফেলা ওয়াটারপ্রুফ সুটকেসে করে।

এমন নগদ অর্থের লোভ ও ভগ্ন অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে দেশটির তরুণরাই মূলত এই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। আবদি ফারাহ নামে এক সোমালিয় বিবিসিকে জানান, 'সোমালিয়ার জলদসু্যদের সবই আছে- অর্থ, প্রতিপত্তি। দিনে দিনে তারা আরো শক্তিশালি হয়ে উঠছে। তারা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে করে, অভিজাত এলাকায় সবচেয়ে বড় বাড়িতে তারা থাকে, সবচেয়ে দামি গাড়িতে তারা চড়ে। তারা হয়ে উঠছে সমাজের এলিট। দসু্যবৃত্তি অনেক ক্ষেত্রে এখানে সামাজিকভাবে স্বীকৃত। কারণ এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি এনে দেয়।

বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এই রুটে জাহাজ ছিনতাই ঠেকাতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, বিশ্ব সমুদ্র সংস্থা (আইএমও), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ (ডবি্লউএফও) বিভিন্ন দেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ঐ রুট ব্যবহারকারী দেশগুলোকে জলদসু্যদের প্রতিরোধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার জন্য আহবান জানায়।

আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থার (আইএমও) ১০১ তম অধিবেশনে ভারত সোমালিয়ার জলদসু্যদের দমনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের দাবি করে। কারণ জলদসু্যরা লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের পাশাপাশি ইদানীং আরব সাগর থেকেও জাহাজ ছিনতাই করা শুরু করেছে। সমপ্রতি বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এম ভি জাহানমনিকে ছিনতাই করা হয় আরব সাগর থেকে। জাহাজে ২৫ জন নাবিকসহ ২৬ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। জলদসু্যরা দেড় কোটি ডলার মুক্তিপণ চেয়েছে।

জলদসু্যদের টার্গেটে পরিণত হয় ছোটখাটো জাহাজ থেকে মালবাহী জাহাজ, তেল ও রাসায়নিক ট্যাংকার। ২০০৮ সালের নভেম্বরে ভারতীয় নৌবাহিনী সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের অনুমতি লাভ করে। জলদসু্যরা ২০০৮ সালে সর্বমোট ১১১টি আক্রমণ চালায়। এর মধ্যে ৪২টিতে তারা সফল হয়। ২০০৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের একই সময়ে ১০ গুণ বেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ বছর ঘটে ৩২টি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনা। সোমালিয়ার পুন্টল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসিত সরকার জলদসু্যদের প্রতিরোধে আইন পাস করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা মিলে শুরু করে জলদসু্যদের গ্রেফতার ও বিচার কার্যক্রম।

জলদুস্যদের আস্তানায় চালানো হয় অভিযান। ইসলামি মনীষী, বিভিন্ন সংস্থা দসু্যবৃত্তির নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে প্রচার প্রচারণা চালাতে থাকেন। এ ছাড়া সোমালিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল প্রধান ও গোত্র প্রধানরাও দসু্যবৃত্তি ইসলামি শরিয়াহ বিরোধী বলে প্রচারণা চালচ্ছেন। ন্যাটো এবং বিভিন্ন দেশের নৌ টহল থাকা সত্ত্বেও জাহাজ ছিনতাই বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূল এত বড় যে তারা পুরো এলাকা টহল দিতে পারছে না।

জলদসু্যরা অভিযান পরিচালনায় নেয় নানা কৌশল। একটি বড় জাহাজের (মাদার শিপ) সঙ্গে থাকে অনেকগুলো ছোট ট্রলার। বড় জাহাজটি ট্রলারগুলো বেঁধে নিয়ে যায় মাঝ সাগরে। কোন টহল জাহাজ আসতে দেখলেই জলদসু্যরা অস্ত্রসহ অন্য সরঞ্জাম পানিতে ফেলে দেয়। ট্রলারে থাকে শুধু জাল আর মাছ ধরার সরঞ্জাম। টহল বাহিনী নিশ্চিত হলেও এ কারণে কিছু করার থাকে না। আর সন্দেহভাজন জলদসু্য গ্রেফতার হলেও উপযুক্ত সাক্ষ্যের অভাবে তারা রেহাই পেয়ে যায়। তারপর জলদসু্যরা আবারো সজ্জিত হয়ে ফিরে যায় সাগরে।

অভিযানে বিভিন্ন সময় অনেক জলদসু্য গ্রেফতার হলেও কোন দেশই বিচারের বিষয়টি তাদের কাঁধে নিতে চায় না। সাক্ষ্যের অভাবেও অনেক জলদসু্য রেহাই পেয়ে যায়। ২০০৮ সালে ব্রিটেন সরকার নৌ বাহিনীকে আদেশ দেয়, তাদের গ্রেফতার না করার জন্য। কারণ এটি তাদের আইনে মানবাধিকার বিরোধী। চলতি বছর ডেনমার্কের একটি জাহাজ ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে পাঁচ জলদসু্যকে গ্রেফতার করা হয়। নেদারল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের পাঁচ বছরের সাজা হয়। অনেক বিশেস্নষকই বলছেন, আন্তর্জাতিক আদালত যা সাজা দেয় তাতে জলদসু্যরা সাজা ভোগের পর আবারও দসু্যতার পেশায় ফিরে যাবে। এদিকে সোমালিয়াও বিদেশে তার দেশের নাগরিকদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। দেশটি চাইছে তার দেশের নাগরিকের বিচার নিজেদের দেশেই হোক।

বেশ কিছু কোম্পানি জাহাজ ছিনতাই ঠেকাতে বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানির শরণাপন্ন হচ্ছে। এমনই একটি বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি হল টেক্সাসের এসপাডা লজিকটিকস গ্রুপ। ঐ কোম্পানির সদস্যরা বাণিজ্য রুটে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এমইউএসসি হল এমন আরেকটা লন্ডনভিত্তিক নিরাপত্তা সংস্থা। তাদের গ্রিস, আরব আমিরাত, আমেরিকা, এস্তোনিয়া ও মাল্টায় অফিস আছে।

ট্যাঙ্কার মালিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ট্যাঙ্কার অ্যাসোসিয়েশন ২০০৮ সালে জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানায় তাদের সহায়তার জন্য।

০০মো. পলাশ সরকার

Friday, December 24, 2010

কুমিল্লা টাউন হল

0 comments
বিকাল না হতেই পাঠকের ঢল নামে কুমিল্লা টাউন হলে। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির ওপর নিজ অর্থায়নে এ ভবন নির্মাণ করেন। এটিই কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের শিক্ষা ও সাংস্কৃতি বিকাশে টাউন হলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানটির পঞ্চম রজতজয়ন্তী উপলক্ষে গত মঙ্গলবার বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

টাউন হলের মাঠ থেকেই কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হতো। এক সময় এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। যিনি পাকিস্তান গণ-পরিষদে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মহান ভাষা আন্দোলনে তার অবদান জাতি বিশেষ শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধেও তার ব্যাপক অবদান ছিল। এ পর্যন্ত টাউন হলের দুইবার ১৯৩৩ ও ২০০২ সালে সংস্কার করা হয়েছে। তারপরও বৃষ্টি হলেই এর ভেতরে অনায়াসে পানি প্রবেশ করে।

জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি পরিচালনা পরিষদ টাউন হল পরিচালনা করে। বর্তমানে এর সাধারণ সদস্য সংখ্যা এক হাজার। টাউন হলে দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি গণপাঠাগার, অন্যটি নগর মিলনায়তন। এর মধ্যে পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য সংখ্যা ৬০০। আজীবন সদস্য ১৪ জন। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকাসহ বিভিন্ন ভাষায় রচিত প্রায় ২৪ হাজার বই রয়েছে। ৬৩টি আলমিরায় বইগুলো সজ্জিত। সমৃদ্ধ এই পাঠাগারে উৎসাহী পাঠক যে কোনো সময় এখানে পড়ার সুযোগ পান। হলের নিচ তলায় রয়েছে দৈনিক পত্রিকা পড়ার জন্য একটি রিডিং রুম। যেখানে প্রতিদিন ৪৪টি জাতীয়, আঞ্চলিক দৈনিক ও সাময়িকী রাখা হয়। এ টাউন হলটি কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে মহারাজ বীরন্দ্রচন্দ্রের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে।

মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা

জাতীয় স্মৃতিসৌধ

0 comments
সাভারের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে। আর এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালের জুনে। তিন পর্যায়ে সম্পন্ন হওয়া এই নির্মাণ কাজে ব্যয় হয় মোট ১৩ কোটি টাকা।
ত্রিশ লাখ প্রাণের দামে এসেছে বাংলাদেশ। পতপত করে উড়তে শুরু হয়েছিল একটা নতুন পতাকা। লাল আর সবুজে ভরা সেই পতাকার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে শহীদদের স্মরণে দেশজুড়ে নির্মিত অসংখ্য ভাস্কর্য আর স্মৃতিসৌধের মধ্যে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রধান।

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ বরাবরই সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে সবাই এসে দেশপ্রেম আর জাতিসত্তার অস্তিত্ব অনুভবের সুযোগ পায়। স্মরণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভারের নবীনগরে অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধ। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লাল ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা চারদিক। মাঝখানে প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই সরাসরি চোখ চলে যায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের উঁচু মিনারের দিকে আর মনে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। এরপরই চোখে পড়ে শ্বেতপাথরে উৎকীর্ণ একটি লেখা। 'বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলোয় হবে হারা'। এর একটু সামনেই শ্বেতপাথরের ভিত্তিপ্রস্তর। ডানদিকে রয়েছে নজরকাড়া উন্মুক্ত মঞ্চ। সোজা হেঁটে গেলে মূল স্মৃতিসৌধ। ১৫০ ফুট বা ৪৫ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট স্মৃতিসৌধটিতে রয়েছে ৭টি ফলক। প্রতিটি ফলকের রয়েছে পৃথক অর্থ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রমের ৭টি পর্যায়কে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি জাতির অভ্যুদয়ের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোকে। এই সাতটি পর্যায়ের প্রথমটি সূচিত হয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য যে সংগ্রামের সূচনা হয়, সেটিই পরবর্তীকালে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। আর এর মাঝখানের সময়টুকু অর্থাৎ চুয়ান্ন, আটান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তর পর্যন্ত ৭টি অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে স্মৃতিসৌধের ৭টি ফলক।

সাভারের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে। আর এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালের জুনে। তিন পর্যায়ে সম্পন্ন হওয়া এই নির্মাণ কাজে ব্যয় হয় মোট ১৩ কোটি টাকা। প্রতি বছর এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোনো প্রবেশ মূল্য লাগে না। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থী ও ভ্রমণপিপাসুদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও অরূপ সুন্দর এই স্থাপত্যের সৌন্দর্যদর্শনে ছুটে আসেন। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই বীর শহীদদের স্মরণে এখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান কিংবা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা জাতীয় বীরদের শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে আসেন এবং সফরের স্মৃতিস্বরূপ স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে রোপণ করেন বিভিন্ন গাছের চারা। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মঈনুল হোসেন। এছাড়া আশপাশের অন্য সব নির্মাণ কাজের স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদফতর। মূল স্মৃতিসৌধের বাম দিকে রয়েছে সৌধ চত্বর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের নাম না জানা দশজন শহীদের সমাধিসৌধ রয়েছে। অন্যদিকে ডান পাশে রয়েছে একটি পুষ্পবেদী। যেখানে এক সময় শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হতো। এর তিন দিক ঘিরে আছে একটি নয়নাভিরাম কৃত্রিম লেক। স্মৃতিসৌধের চারদিকের পুরো জায়গাটি সবুজ গাছপালায় পরিপূর্ণ । চারদিককার সবুজের সমারোহ একে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। উল্লেখ্য, শুধু স্মৃতিসৌধ এবং এর প্রাঙ্গণের আয়তন ৮৪ একর এবং সৌধ ঘিরে আছে আরও ২৪ একর জায়গা। এসব ছাড়াও স্মৃতিসৌধে রয়েছে হেলিপ্যাড, মসজিদ, অভ্যর্থনা কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া। সবমিলিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সব সময়ই সঙ্গ দেয় দর্শকদের। আর জাতির কাছে বীর শহীদদের যে ঋণ, তাও জানান দেয় মাথা উঁচু করে।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

ত্বকের সৌন্দর্য বর্ধনে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি

0 comments
শারীরিক সৌন্দর্যের বিচারে সুস্থ, আকর্ষণীয় ও যৌবনদীপ্ত ত্বক একটি অন্যতম প্রধান মাপকাঠি। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ত্বকেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয় এবং চলি্লশোধর্ে্বাদের মধ্যে তরুণ্যদীপ্ত ত্বক ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা বা প্রবণতা দেখা যায়। এ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতবিশ্বে বহু আগেই এ ধরনের সেবা প্রদানের ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব বিশেষায়িত সেবা প্রদানের জন্য চিকিৎসক/বিশেষজ্ঞদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে 'মেডিক্যাল স্পা' একটি সফল শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আমাদের দেশেও ইদানীং ত্বকের সৌন্দর্য বর্ধন (কসমেটিক) সেবা প্রদানের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

ত্বকের সৌন্দর্য বর্ধনের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ডার্মাব্রেশন/ মাইক্রোডার্মাব্রেশন, কেমিক্যাল পিলিং, ইনজেকশন/ফিলার পদ্ধতি, লাইট থেরাপি, সেলুলাইট পদ্ধতি এবং লেজার প্রয়োগ। এছাড়াও কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে নাক, মুখ, বক্ষদেশ, নিতম্ব, উরু ইত্যাদির গঠন পরিবর্তন করে সৌন্দর্যবর্ধন করা যায়।

এসব পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণত বয়স বৃদ্ধিজনিত বলিরেখা, গর্ভ-পরবর্তী দাগ, রোদে গোড়াজনিত দাগ, ব্রণ ও ত্বকের রোগজনিত ক্ষত, জন্মগত দাগ, মেছতাসহ বিভিন্ন বর্ণ পরিবর্তনজনিত রোগের দাগ ইত্যাদি সমস্যার দূর করা সম্ভব।

ডার্মাব্রেশন/ মাইক্রোডার্মাব্রেশন : এ পদ্ধতিতে যন্ত্রের মাধ্যমে ঘষে ত্বকের অনাকাক্সিক্ষত অংশ তুলে ফেলা হয়। পরবর্তীতে নতুন কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাভাবিক আকার ধারণ করে। বলিরেখা, ব্রণজনিত ক্ষত, রোদে পোড়া ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।

কেমিক্যাল পিলিং : চিকিৎসকরা এ পদ্ধতিতে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে ত্বকের অনাকাক্সিক্ষত অংশ তুলে ফেলেন অনেকটা ঝলসে ফেলার মতো। পরবর্তীতে নতুনভাবে সৃষ্ট কোষের মাধ্যমে স্থানটি স্বাভাবিক রূপ ফিরে পায়। বলিরেখা, মেছতা, ব্রণজনিত ক্ষত ইত্যাদিতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।

ইনজেকশন/ফিলার পদ্ধতি : বয়সজনিত বা অন্য কোনো কারণে বলিরেখা (ডৎরহশষব) দূর করতে বিশেষ ধরনের পদার্থ যেমন বটোক্স, কোলাজেন কিংবা চর্বিজাতীয় পদার্থ ইনজেক্শনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। এমনকি সেবা গ্রহণকারীর শরীরের অন্যকোনো স্থান থেকে বিশেষ ধরনের চর্বি আহরণ করে তা আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করা হয়।

লাইট থেরাপি : এই পদ্ধতিতে যন্ত্রনিঃসরিত আলোকের (খঊউ) মাধ্যমে ত্বকের কোলাজেনকে উজ্জ্বীবিত করা হয়, নতুন কোষ তৈরি করার জন্য। বলিরেখা দূর করার জন্য পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়।

সেলুলাইট চিকিৎসা : শরীরের চর্বি থেকে সেলুলাইট নামে এক ধরনের পদার্থ তৈরি হয়, যা ত্বকে জমে বিভিন্ন স্থানে ভাঁজ তৈরি করে। এ পদ্ধতিতে অনাকাক্সিক্ষত এসব সেলুলাইট দ্রবীভূত করার মাধ্যমে ত্বকের গাঁথুনি ও বিন্যাস ফিরিয়ে আনা হয়।

লেজার চিকিৎসা : চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো ত্বকের চিকিৎসায়ও লেজার ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রয়োজন মাফিক বিভিন্ন ধরনের লেজার ত্বকের টিউমার অপসারণ, জন্মগত দাগ দূর করা, ব্রণজনিত ক্ষত, রোদে পোড়া দাগ দূর করা, অনাকাক্সিক্ষত রোম তুলে ফেলা, বলিরেখা দূর করা ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। তবে সৌন্দর্যবর্ধক সেবা প্রদানেই ত্বকের চিকিৎসায় এ পদ্ধতি সর্বাধিক ব্যবহৃত হচ্ছে।

লাইপোসাকশন ও কসমেটিক সার্জারি : লাইপোসাকশনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা অতিরিক্ত অনাকাক্সিক্ষত চর্বি বের করে আনা হয়। তাছাড়া কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে নাক, মুখ, বক্ষদেশ, উরু, নিতম্ব ইত্যাদির গঠন পরিবর্তন করে কাক্সিক্ষত আকার/আকৃতি প্রদান করা যায়।

এসব পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ত্বকের বিন্যাস, গাঁথুনি, উজ্জ্বলতা ও মসৃণতা ধরে রাখা যায়। ত্বকের ভাঁজ ও দাগ দূর করে, এমনকি রং পরিবর্তনের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সৌন্দর্যবর্ধনে সাহায্য করে। এসব চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের আগে অবশ্যই কার্যকারিতা, চিকিৎসাকালীন সময়, চিকিৎসা-পরবর্তী স্থায়িত্ব, ব্যয় এবং সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে জানা জরুরি। চিকিৎসক ব্যতীত অন্য কারও কাছ থেকে এসব সেবা গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে সৌন্দর্যবর্ধনের চেয়ে সৌন্দর্যহানির সম্ভাবনাই থাকে বেশি।

লেখক : ডা. এমআর করিম রেজা, কনসালটেন্ট

চর্ম, এলার্জি ও কসমেটিক বিভাগ, এশিয়ান জেনারেল হাসপাতাল লি. ঢাকা। ফোন : ০১৮১৯-২৩৭৩৫০

রহস্যময়ী রানী হাটসেপসুট

0 comments
প্রায় ৪ হাজার বছর আগেকার মিসরের সম্রাজ্ঞী তিনি। ইতিহাসে এক অমর চরিত্র। খুবই সুন্দরী ছিলেন। ছিলেন রহস্যময়তার অদ্ভুত আবর্তে বন্দী। নিজেকে সুন্দরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো চেষ্টা ছিল না তার। বরং বেছে নিয়েছেন ছেলেদের পোশাক। নকল দাড়িতে তাকে দেখে সবাই মনে করত চেনা-পরিচিত ঢংয়ে কোনো পুরুষই বুঝি শাসন করছে মিসর।

তিনি নিজেকে ফারাও বলেই পরিচয় দিতেন। সময়টা ১৪৭৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ১৪৫৮ পর্যন্ত। অপরিসীম দক্ষতায় মিসর শাসন করেছেন রানী হাটসেপসুট। তিনি ছিলেন অন্য আট/দশজন রাজা-রানীর তুলনায় একেবারেই অন্যরকম। তিনি পরম সুন্দরী ছিলেন, ছিলেন শান্তশিষ্ট। অথচ রাজনৈতিক প্রজ্ঞারও কোনো কমতি ছিল না তার। আর এ কারণেই দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর মিসরের রাজসিংহাসন ছিল তার দখলে।

মিসরের রাজা প্রথম থুতমোস এবং রানী আহমোসের কন্যা ছিলেন হাটসেপসুট। ছোটবেলা থেকেই ভাইদের তুলনায় বাবা-মায়ের কাছে একটু বেশি প্রিয় ছিলেন তিনি। সবার প্রত্যাশা ছিল রাজার মৃত্যুর পর হাটসেপসুটের ভাই অ্যানিনেমিস সিংহাসনে বসবেন। কিন্তু অ্যানিনেমিসের সেই দক্ষতা কখনোই ছিল না। সে সময় সিংহাসনে বসার যোগ্যতা ছিল আরেকজনের। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় থুতমোস, হাটসেপসুটের সৎ ভাই। সে সময় মিসরের রাজ রক্তের বিশুদ্ধতা ঠিক রাখার জন্য ভাই ও বোনের বিয়ের প্রথা ছিল। সেই প্রথা মেনেই হাটসেপসুট হয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় থুতমোসের রানী।

এভাবেই প্রায় ১৪ বছর থুতমোস আর হাটসেপসুট মিসর শাসন করেন। কিন্তু এর পরপরই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন দ্বিতীয় থুতমোস। ক'দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। এবার কে হবে রাজা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়ল মিসরের রাজপ্রশাসন। কারণ একটাই। হাটসেপসুট আর থুতমোস দম্পতির উত্তরাধিকারী বলতে কেবল একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে একটা মেয়ের কথা শুরুতেই ভেবে ফেলার মতো সাহস তখনকার প্রশাসনের ছিল না। অন্যদিকে দ্বিতীয় থুতমোস রানী হাটসেপসুটকে ছাড়াও তখনকার রীতি অনুযায়ী আরও ক'জনকে বিয়ে করেছিলেন। তবে হাটসেপসুট ছিলেন আসল রানী বা রয়েল কুইন। নিয়মানুসারে তার সন্তানরাই সিংহাসনে বসার কথা। কিন্তু সন্তান তো মেয়ে! তাও আবার অপরিপক্ব।

তাহলে? থুতমোসের অন্য এক রানীর ছেলে ছিল। হাটসেপসুটের সেই সৎ ছেলে তৃতীয় থুতমোসও এক অর্থে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। কিন্তু তারও বয়স কম। অভিজ্ঞতার অভাবে রাজ্য শাসন যে কোনো মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে হাটসেপসুটও নিজেকে রানীর আসন থেকে সরাতে চাইছিলেন না। অবশেষে ঠিক হয় তৃতীয় থুতমোস এবং হাটসেপসুট দু'জনেই সিংহাসনে বসবেন। শুধু পরিস্থিতির কারণে সেই সময়কার মিসরীয় প্রশাসন রানীকে সিংহাসনে বসাতে রাজি হয়েছিল, বিষয়টা এমন নয়। রানী হাটসেপসুটের অসীম দক্ষতা, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা আর যোগ্যতা সম্পর্কে মিসরীয়দের আগে থেকেই ধারণা ছিল। তাছাড়া ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে প্রাচীন মিসর, গ্রিসের মতো অনেক দেশের চেয়ে একটা বিষয়ে মিসরীয়রা বেশ উদার ছিল। আর সেটি হচ্ছে মেয়েদের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা। মেয়েদের ঘরের ভেতর বন্দী করে রাখার নীতিতে মোটেও বিশ্বাসী ছিল না মিসরীয়রা। সম্পত্তির মালিকানা থেকে শুরু করে, কোর্টে সওয়াল জবাব কিংবা রাজ সিংহাসন পর্যন্ত সর্বত্র নারীদের পূর্ণ অধিকার ছিল। হাটসেপসুটের আগেও মিসরে ফারাও হিসেবে অনেক রানী ছিলেন। যদিও তাদের অনেকেই খুব বেশিদিন রাজ্য শাসন করতে পারেননি। এরপরও ইতিহাস থেকে তাদের মুছে ফেলার কোনো উপায় নেই। তবে এবার হাটসেপসুট একা ছিলেন না। সঙ্গে ছিলেন রাজা তৃতীয় থুতমোস। সৎ পুত্রের সঙ্গে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে রানী হাটসেপসুটকে সহজেই স্বীকার করে নিয়েছিল মিসরের জনগণ।

তবে হাটসেপসুট রাজসিংহাসনে বসার প্রথম দিন থেকেই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। এটা তাকে আস্তে আস্তে অর্জন করে নিতে হয়েছে। আর রাজ্য শাসনের প্রথম দিন থেকেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দেশ শাসনের সবরকম প্রস্তুতি আর প্রজ্ঞা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। প্রথম দু'বছর সৎ ছেলের সঙ্গে রাজ্য ভাগ করে নিলেও তৃতীয় বছরে এসে নিজের সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন হাটসেপসুট। তিনি নিজেকেই ফারাও বা রাজা বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণায় খুব যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল, এমন নয়। কিন্তু কিভাবে প্রজাদের সম্মতি নিয়ে নিতে হয় আর মন জয় করে নিতে হয়, সেটা বেশ ভালো করেই জানতেন রানী হাটসেপসুট।
প্রথম থুতমোসের অনেক প্রিয়, একমাত্র কন্যা ছিলেন রানী হাটসেপসুট। বাবার সঙ্গেও তিনি সিংহাসন ভাগ করে নিয়েছিলেন, তার দাবি এমনটাই। লিখিতভাবেও সে কথার উল্লেখ পাওয়া গেছে। সাড়ে তিন হাজার বছরের বেশি সময় পরেও দায়ের এল-বাহারিতে তার সমাধিমন্দিরে বিভিন্ন খোদাইয়ে এসব স্পষ্ট লেখা আছে।

সেকালের সাধারণ মানুষ ফারাওকে দেবতাদের প্রতিভু মনে করত। আর ফারাওরাও নিজেদের কোনো না কোনো দেবতার পুত্র বা কন্যা হিসেবে প্রচার করত। অথবা দাবি করত কোনো দেবতার মানব সংস্করণ তারা। সবাই সেটা বিশ্বাসও করত। হাটসেপসুটও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। এক্ষেত্রে তার অভিধা ছিল 'গডস ওয়াইফ অব আমুন'। অর্থাৎ আমুনের স্ত্রী। আর আমুন মিসরের সূর্যদেবের একটি রূপ। সিংহাসনের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠার পরও রানী হাটসেপসুটকে প্রতিনয়ত নানারকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কখনো ভাগ্য তার সহায়ক হয়েছে। অবশ্য সেজন্য প্রতিদিনই রাজ্যে যুদ্ধ বেধে ওঠেনি। কিন্তু রানীর আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হতেই পারে যুদ্ধ হলেও তিনিই হয়তো জয়ী হতেন। তার রাজত্বকালে অনেক সময়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করে গণতন্ত্র। কিন্তু নিজস্ব কৌশলে সবাইকে শান্ত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন রানী। রানীর হাবভাব, চালচলন আর রাজ্য পরিচালনার রূপ দেখে মনে হচ্ছিল রানী বুঝি এই সিংহাসনের জন্য অপরিহার্য।

মজার ব্যাপার হলো অন্য সব মিসরীয় রানী থেকে হাটসেপসুট একটি জায়গায় একেবারেই আলাদা। আর সেটি হলো যথেষ্ট সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে সত্যিকারের সুন্দরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোনো চেষ্টা ছিল না তার মধ্যে। বরং তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছেলে মানুষের ছদ্মবেশ। ছেলেদের পোশাক, নকল দাড়ি আর গেটআপ দেখে সবাই মনে করেছে চেনাপরিচিত ঢংয়ে কোনো পুরুষই হয়তো সিংহাসনে রয়েছেন। ঠিক কি কারণে রানী পুরুষের ছদ্মবেশে সিংহাসন সামলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। নিজের কন্যাকেও তিনি পুরুষের পোশাক, নকল দাড়িতে সাজিয়ে রাখতেন। রানীর এমন পদক্ষেপের দিকে তাকালে তার প্রজ্ঞা, অন্যরকম চিন্তাভাবনা এবং সাহস সম্পর্কে অনুমান করা যায়। মিসরে ফারাওদের যে সব মূর্তির দেখা মেলে তাতে হাটসেপসুটের পুরুষালি রূপটাই চোখে পড়বে। রানীর বেশে তিনি যদি সে সময় রাজ্য শাসন করতেন তাহলে সত্যিই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে অসফল হতেন কিনা সে কথা কারও জানা নেই। কিন্তু ক্ষমতাশালী পুরোহিতমহলে শক্ত-সামর্থ্য পুরুষ হিসেবে নিজের বাহ্যিক রূপটাকে প্রতিষ্ঠা করা নিশ্চয়ই অনেক সহজ হয়েছিল রানীর জন্য। রাজার বেশে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত রানী পুরোহিতমহলের কাছেও হয়ে ওঠেন একজন যোগ্য ফারাও।

এ সময় পুন্টে (বর্তমান সোমালিয়া) এক যুদ্ধ অভিযানও হয়েছিল রানীর নির্দেশে। রাজসিংহাসন কোনো বীর পরাক্রমশালী রাজার দখলে থাকলে যেমন যুদ্ধ হতো, তার সঙ্গে এ অভিযানের কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই পার্থক্য না রাখার জন্যই হয়তো রানী হাটসেপসুট অভিযানের জন্য এত বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক দৃশ্যে রানীকে ঠিক একজন সৈনিকের মতো ভঙ্গিতে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কেবল সৈন্য হিসেবেই নয়, রানী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরিরও চেষ্টা চালান। তিনি মিসরে আনিয়েছিলেন অনেক নতুন গাছের চারা, যেগুলো এখানে পরিচর্যা করা হতো। তখন রাজারাই নিজেদের সমাধিমন্দির তৈরি করত। বিখ্যাত দায়ের এল-বাহারি জুড়েও ছড়িয়ে রয়েছে হাটসেপসুটের মরচুয়ারি টেম্পল বা সমাধিমন্দির। এমনকি রানীর মন্দির থাকার কারণে জায়গাটিকে বলা হয় 'ভ্যালি অর দ্য কুইন'। বিখ্যাত কারনাক মন্দিরে একটি পাথরের ওবেলিস্ক [অর্থাৎ লম্বাটে স্তম্ভ যার চূড়াটা অনেকটা পিরামিডের মতো। আর এর সারা গায়ে প্রাচীন মিসরীয় ভাষায় লেখা] তৈরি করিয়েছিলেন রানী হাটসেপসুট। যেটি এখনো দেখতে পাওয়া যায় কারনাকের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে।

রানী হাটসেপসুটের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কোনো কমতি ছিল না। আর সে কারণে তিনি দীর্ঘদিন রাজসিংহাসন আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছিলেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে তার রণকৌশল যেন দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চাইলেন তৃতীয় থুতমোস। দীর্ঘদিন আড়ালে থেকে দৃশ্যপটে আবারও চলে এলেন তিনি। হাটসেপসুটের বিরুদ্ধে সব সময়ই সরব ছিলেন তৃতীয় থুতমোস। কারণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েও সৎ মায়ের কৌশলের কাছে দীর্ঘদিন তাকে পরাস্ত হয়ে থাকতে হয়েছে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে তিনি কি রানী হাটসেপসুটের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? আর এতেই কি মৃত্যু হয়েছিল প্রবল পরাক্রমশালী রানী হাটসেপসুটের? এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের পাতায় নেই।

তবে তৃতীয় থুতমোস মনেপ্রাণে রানী হাটসেপসুটের পতন চেয়েছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রানীর বিরুদ্ধাচারের পরিপূর্ণ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে তৃতীয় থুতমোসের সব কাজে। হাটসেপসুটের মৃত্যুর পর সব মূর্তি, কোনো আঁকা বা লেখা, সব জায়গা থেকে রানীর নাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন তিনি। রানীর সব ছবিই ছিল পুরুষের বেশে। সে জন্য সব ছবির নিচে নাম পাল্টে থুতমোস করে দেওয়া হয়েছিল বলেও মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। তবে তৃতীয় থুতমোসের চেয়ে রানী হাটসেপসুট অনেক জনপ্রিয় ছিলেন মিসরীয় জনগণের কাছে। আর তাই তৃতীয় থুতমোস অনেক চেষ্টা করে রানীর চিহ্ন মুছে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন কিন্তু মিসরের জনগণের মন থেকে রানীকে মুছে ফেলতে পারেননি মোটেই।

রানী হাটসেপসুট নিজেই তার জন্য একটি সমাধিমন্দির নির্মাণ করে রেখেছিলেন। তার সেই সমাধিমন্দিরটি এখনও অটুট রয়েছে। কিন্তু এটি মোটামুটি অক্ষত থাকলেও রানীর মমি সেখানে পাওয়া যায়নি। ভ্যালি অব দ্য কিংসের কোনো সমাধি গুহাতেও মিলেনি রানীর মমি। তবে একটি গুহা থেকে পাওয়া গিয়েছিল হাটসেপসুটের নাম লেখা একটি বৈয়াম বা ক্যাপোনিক জার। আর সেটাতে মমি তৈরির সময় বের করে নেওয়া রানীর লিভার আর অন্যান্য প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়। সঙ্গে ছিল একটি দাঁত। অন্যদিকে আরেকটি সমাধি গুহায় বেশ কয়েকটি নাম না জানা মমি খুঁজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি মমি ছিল মহিলার।

পরীক্ষা করে জানা যায়, ৪৫ থেকে ৬০ বছর হবে মহিলার বয়স। একটু মোটা কোনো মহিলার মমি এটা। মমির চোয়াল থেকে একটি দাঁত নিখোঁজ ছিল। পরে হাটসেপসুটের নাম লেখা বাক্সেও দাঁতের সঙ্গে মমির দাঁত মিলিয়ে জানা যায় এটাই রানী হাটসেপসুটের মমি। মমিটি বর্তমানে মিসরের কায়রো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সাড়ে তিন হাজার বছর পরও রানীর দেহ সাজানো আছে কাচের বাক্সে। শত চেষ্টা করেও তৃতীয় থুতমোস রানীকে একেবারে গায়েব করে দিতে পারেননি।

-.::রণক ইকরাম::.-

Monday, December 20, 2010

মাদারীপুরের গণকবর

0 comments
স্বাধীনতার ৪ দশকেও ১৯৭১ সালের গণহত্যার তীর্থক্ষেত্র মাদারীপুরের ৫টি বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিসৌধ। মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুটমিল, পাখুল্যা, মিঠাপুর, সেনদিয়া, কলাগাছিয়া বধ্যভূমি শুধু কালের সাক্ষী হিসেবে স্মৃতি বহন করছে। ১৯৭১ সালে যখন সারা বাংলার মানুষ স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল তখন এদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারা দেশে ব্যাপক নারকীয় গণহত্যা চালায়। তাদের অত্যাচারের দুঃসহ স্মৃতি মনে হলে আজো শিউরে উঠে হাজার হাজার বাঙালি। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিমান থেকে প্রথম গোলাবর্ষণ ও ২৪ এপ্রিল স্থলপথে মাদারীপুরে প্রবেশ করে। তারপর মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘটাতে থাকে একে একে ধ্বংসযজ্ঞ। হত্যা করে শত শত নিরীহ বাঙালিকে। শরীয়তপুর ছিল তখন তৎকালীন মাদারীপুর মহাকুমার একটি অংশ। বর্তমান শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত নিরীহ বাঙালিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলের অভ্যন্তরে ডি-টাইপ বিল্ডিংয়ে স্থাপিত হানাদার বাহিনীর টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। তাদের পাশবিকতার শিকার হয়ে অগণিত কিশোরী-যুবতী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এছাড়াও ৫ শতাধিক নিরীহ বাঙালিকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এই টর্চার সেলে। আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরসংলগ্ন এআর হাওলাদার জুট মিলের জেটির ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বাঙালি নর-নারীদের। তারপর কখনোবা লাশ ফেলে দেওয়া হয় প্রমত্তা আড়িয়াল খাঁ নদীতে, কখনোবা বীর শহীদদের এআর হাওলাদার জুট মিলের ডি-টাইপ বিল্ডিংয়ের পশ্চিম দিকের খোলা জায়গায় দেওয়া হয় গণকবর বা মাটিচাপা। এআর হাওলাদার জুট মিল এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিকামী অগণিত বাঙালি নারী-পুরুষের লাশ। স্বাধীনতার ৪ দশকেও সেসব স্থান চিহ্নিত করে শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত এসব এলাকায় নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ এই গণকবরগুলো কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের অভাবে। এছাড়াও মাদারীপুর শহর থেকে ৭/৮ কি.মি দূরে মাদারীপুর-শ্রনদী সড়কের পাশে মিঠাপুরের শিকদারবাড়ির বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয় শত শত মুক্তিপাগল বাঙালিকে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন এ অঞ্চলের অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যক্তি। সে সময়ের প্রতক্ষদর্শী নিত্যগোপাল ঠাকুর (৭০) বলেন, প্রতিদিন শিকদারবাড়ি ও তার আশপাশের হাজার হাজার মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি জানান, সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গুলি খেয়ে বেঁচে থাকা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান তিনি। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তার পিঠে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ফেলে যায় কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। সেদিন নিহত সবাইকে বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালিরবাজার শাখার ভবনের পাশে মাটিচাপা দেওয়া হয়। বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালিরবাজার শাখা নির্মাণকালে এখানে অনেক মানুষের খুলি ও হাড় পাওয়া যায়। বর্তমান কৃষি ব্যাংক কালিরবাজার শাখার পাশে যে বধ্যভূমি রয়েছে তা চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দীর্ঘদিনের দাবি। দ্রুত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত না হলে হয়তো একদিন এ স্থানটি বেহাত হয়ে যাবে। এছাড়াও পাখুল্লা সেনদিয়া, কলাগাছিয়ার বধ্যভূমিতে এখনো নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ।



বেলাল রিজভী, মাদারীপুর

Sunday, December 19, 2010

সম্রাট আকবর ও দিন-ই-ইলাহি

0 comments

লিখেছেনঃ মো: আটিকুর রহমান

সম্রাট আকবর ও তার দিন-ই-ইলাহির পতন কাহিনি -

ইমামে রাব্বানী হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুক সেরহিন্দ (রাঃ) ছিলেন দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মোজাদ্দেদ বা সংস্কারক।তিনি
১৪ই শাওয়াল ৯৭১ হিজরিতে ভারতের সেরহিন্দ শহরে জন্ম গ্রহন করেন।তিনি আকবর ও জাহাঙ্গীর দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী সম্রাটের মধ্যবর্তী সময়ে মোজাদ্দেদ হিসাবে আত্নপ্রকাশ করেন।সম্রাট আকবর ছিলেন ইসলাম ধর্মের ঘোড় বিরোধী।তার শাসনামলে মোসলমানদের দুরবস্হার কোন সীমা ছিল না। সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন।ইহা ছিল স্পষ্টতই এক কুফরী ধর্ম অথচ এই নতুন ধর্মের নাম দেওয়া হলো ”দ্বীন-ই-ইলাহী”।
এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা।বাদশাহ প্রভাতে,দ্বিপ্রহরে,সন্ধায় ও অর্ধরাত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করিতেন।তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন।সূর্যদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো।এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারনকালে ‘জাল্লাত কুদরাতুহু’ বলা হতো।বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে ,সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী।তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন।মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন।শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ,ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়।
‘ব্রাক্ষ্মদান’ নামক জনৈক ব্রাক্ষ্মনকে বাদশাহ রাজকবি নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে তিনিই ”বিরবল” নামে পরিচিত ।তারই পরামর্শে ‘দেবী’ নামক জনৈক হিন্দু দর্শনিক বাদশাহর সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়।রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই দার্শনিকের
অবাধ যাতায়াত ছিল।বাদশাহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন।এই দেবী ও গৌতম নামের জনৈক ব্রাক্ষ্মনের কাছ থেকে বাদশাহ মূর্তি,সূর্য,আগুন,ব্রক্ষ্মা,মহামায়া,বিষ্ঞু, কৃষ্ঞ ও মহাদেব পূজার কায়দা কানন শুনে বড়ই উৎফুল্ল হতেন এবং এইসব গ্রহনও করতেন।ইহা ছারা এই ধর্মে আগুন,পানি,গাছ,গাভী পূজা করা হত।নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতেন।
হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য।
হির বিজয় সূরী নামক জনৈক সাধুকে বাদশাহ ‘জগৎগুরু’ উপাধি দেন।
সম্রাট আকবর হিন্দুদের পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করতেন। মৃত্যুর পর তিনিও পুনরায় অন্য কোন সিংহাসনে আরোহন করবেন বলে বাদশাহ বিশ্বাস করতেন।ব্রাক্ষ্মনগন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে ,শক্তিশালী বাদশাহর শরীরে আত্নার জন্ম হয় এবং কামেল মণীষীগনের আত্না মৃত্যুর সময় মস্তকের তালু দিয়া বাহির হয়ে যায়।এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি মাথার তালুর চুল কামাইয়া ফেলিতেন এবং মস্তকের চারিদিকে চুল রেখে দিতেন।বাদশাহ জৈন সাধুদের যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তাহার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমনের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত।”হির বিজয়সুরী” নামক এক সাধুকে তিনি ‘জগৎগুরু’ উপাধী দিয়েসিলেন।নন্দা বিজয়সূরী নামক এক সাধুকে তিনি ‘খশফহম’ উপাধী দিয়েছিলেন। হির বিজয় সূরীকে খুশী করবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব ‘পর্যুষনে’ বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করবার ফরমান জারী করেছিলেন।জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও মাংশ ভক্ষন ত্যাগ করেছিলেন।এ বিষয়ে বাদশাহ স্বয়ং সূরীজিকে এক পত্র প্রেরন করেন।উহাতে তিনি সূরীজি কতৃক কিরূপ প্রভাবিত হন তাহার পরিচয় পাওয়া যায়।পত্রটি নিম্নরূপঃ
”আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ী সম্পূর্নরূপে জীবহিংসা পরিত্যাগ করতে পারি নি।তবে আমি আগের চেয়ে এখন অনেক কম মাংশ আহার করি।আপনি হয়ত জানেন যে , আমি ফতেহপুর হতে আজমীর পর্যন্ত রাজপথের পার্শ্বে প্রতি একশ ক্রোশ পর পর একশত চৌদ্দটি স্তম্ভ নির্মান করেছি।ঐগুলি প্রায় ছত্রিশ হাজার হরিনের শিং দিয়ে সজ্জিত করেছি।ঐগুলি আমি নিজ হাতে শিকার করেছিলাম।আমি এত জীবের প্রান সংহার করেছি। আমার মতো পাপী কেহ নেই।ইহা ছাড়া আমি প্রতিদিন নানা প্রকার জীবের মাংশ সহ পাচশত চড়াই পাখীর জিহ্বা দ্বারা উদর পূর্তি করতাম। ঐ কথা ভাবিতে গেলেও এখন আমি আতংকিত হয়ে উঠি।আপনার শ্রীমুখের অমিয়বানী আমাকে মাংসাহারে অরুচি এনে দিয়েছে।এখন বৎসরে ছয়মাস বা ততোধিক সময় আমি মাংস আহার করি না।-”
অগ্নিপূজকদের দারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।তাহার আদেশে দরবারের সন্মুখে সর্বক্ষন অগ্নি প্রজ্জলন করবার ব্যাবস্হা করা হয়।ঘন্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহন করা হয় খৃষ্টানদের নিকট থেকে।মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত।তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম।তাই তার নতুন ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহির’ বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে।তাই সঙ্গত কারনেই
হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশী।সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই।
দীন-ই-ইলাহির মূলমন্ত্র ছিল ”লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবারু খলিলুল্লাহì”যাহারা নুতন ধর্মে দাখিল হত তাদেরকে এরূপ শপথ বাক্য উচ্চারন করতে হতো- ”আমি অমুকের পুত্র অমুক এতদিন বাপ দাদাদের
অনুকরনে ইসলাম ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠত ছিলাম, এখন স্বেছ্ছায় ও সগ্গানে
পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করে ‘দীন-ই-ইলাহি’ গ্রহন করিতেছি এবং এই ধর্মের জন্য জীবন,সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি।”
দীন-ই-ইলাহির লোকেরা চিঠিপত্রের শিরোনামে ‘আল্লাহ আকবর’
লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলত
‘আল্লাহ আকবর” এবং অপরজন এর জবাবে বলত ‘জাল্লাজালালুহু’।
বাদশাহ তাহাদিগকে শিজরা স্বরূপ তাহার একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করতেন।তারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ
পাগড়ীতে বসিয়ে রাখত।
বাদশাহ যে সব পুজাপাবন করতেন অনুসারীগনকেও সেই সব করতে হত।উপরন্তু তাদেরকে বাদশাহকেও সেজদা করতে হত।ভন্ড সূফীদের সর্দার ‘তাজুল আরেফিন’ বাদশাহকে সেজদা করা ওয়াজেব বলে ফতোয়া দান করেন।এই সেজদার নাম করন করা হয় ‘জমিন বোছ’।তিনি বলেন বাদশাহর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ।হিন্দুস্হানের ভ্রষ্ট সূফীদের কার্যপ্রনালী দলীলরূপে খাড়া করে তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন।সাধারন ব্যক্তিছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগনও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্হ ছিলেন।
এই নুতন ধর্মে সূদ ও জুয়া ছিল হালাল।খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি ঘর নির্মান করা হয় এবং জুয়াড়ীদেরকে রাজকোষ থেকে সুদি কর্জ দেয়া হত।মদ্যপান করাও হালাল সাব্যস্হ করা হয়। বাদশাহ স্বয়ং দরবারের নিকট একটি শরাবখানা খুলে দেন।নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম,কাজী ও মুফতিগনকে শরাব পান করতে বাধ্য করা হত।এই সব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লোকের নামে পেয়ালা নির্বাচিত হত। ফৈজি বলতেন , ”আমি এই পেয়ালাটি পান করছি ফকিহদএর অন্ধ বিশ্বাসের নামে।-”
এই ধর্মে দাড়ি মুন্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হত। বাদশাহ এই ব্যাপারে রাজপুত পত্নীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।
নাপাকির জন্য গোসল করা ইসলামে ফরজ।কিন্তু বাদশাহ আকবরের ধর্মে এর বিপরিত মত প্রকাশ করা হয়।বলা হয় যে ‘মনী’ উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ। তাই গোসল করিয়া সহবাস করাই উত্তম।তাহা
ছারা বিবাহ সম্পর্কে আইন করা হয় কেহ তাহার চাচাত,মামাত,ফুফাত ইত্যাদি সম্পর্কের বোনকে বিবাহ করতে পারবে না। ষোল বৎসর পুর্বে বালক এবং চৌদ্দ বৎসরের পুর্বে বালিকাদের বিবাহ দেওয়া চলিবে না এবং কেহ একাধিক বিবাহ করিতে পারিবে না।
যুবতী নারীদের বাধ্যতামুলকভাবে চেহারা খুলিয়া পথ চলা ছিল এই ধর্মের আইন। শহরের বাহিরে বিভিন্ন যায়গায়
পতিতাদের বসতি স্হাপন করিয়া ব্যাভিচারকে আইন সঙ্গত করা হয়।পতিতালয় গুলির নাম দেয়া হয় ‘শয়তানপুর’।এই সব স্হানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্হা করা হয়।
খৎনারূপ সুন্নতকে মিটাইয়া দেবার জন্য বার বৎসরের পূর্বে বালকদের খৎনা করা নিষিদ্ধ করা হয়।
মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই বিধান জারি করা হয় যে -এই ধর্মাবলম্বী কোন লোকের মৃত্যু হলে তাহার গলায় কাচা গম ও পাকা ইট বাধিয়া তাহাকে পানিতে নিক্ষেপ করতে হবে এবং
যেখানে পানি পাওয়া যাইবে না সেখানে মৃতদেহ জ্বালাইয়া দিতে হবে অথবা পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করিয়া দাফন করতে হবে।
একদিন আবুল ফজল বাদশাহকে একখানি কেতাব দেখাইয়া বলিলেন,”আপনার জন্য ফেরেশতা ইহা আসমান হতে এনেছেন।সেই কেতাবের একস্হানে একটি আরবি বাক্য লিখিত ছিল,যাহার অর্থ এইরূপঃ
”হে মানুষ তুমি গাভী হত্যা করিও না ।যদি কর তবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”নিরক্ষর বাদশাহ ইহা বিশ্বাস করিলেন এবং গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন।কানুন জারী করলেন,কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে।এই নুতন ধর্মে গরু,উট,ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলিয়া ঘোষিত হল।পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে।মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দিন-ই-ইলাহির মূল উদ্দেশ্য।
একদিন সভাসদগনকে বাদশাহ ডাকিয়া বলিলেন ,”হিন্দুস্হানের জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান যোগী ৃষীদের লিখিত হিন্দি ভাষার পুস্তক গুলি নির্ভুল জ্ঞানের উৎস।আমরা জদি এইগুলি ফার্সী ভাসায় অনুবাদ করে নেই তা হলে আমাদের ইহকাল ও পরকালে শান্তি লাভ হবে।
তৎক্ষনাৎ বাদশাহর বাসনা পুরন করবার ব্যবস্হা করা হল।অনুবাদ করার জন্য অনেক আলেম নিয়োগ করা হল এবং এর জন্য পৃথক দফতর কায়েম করা হলো।সঙ্গে সঙ্গে আরবী ভাষা পড়া ও জানা অপরাধ বলে সাব্যস্হ হলো।ইহার বদলে জ্যোতিষ শাস্ত্র,অংক,চিকিৎসা,ইতিহাস,ও কথা কাহিনী প্রভৃতি পুস্তকের প্রচলন করা হল।
ইহার পর বাদশাহ আকবর হিন্দুদের উপর হতে কয়েক কোটি টাকার জিজিয়া কর উঠিয়ে নিলেন।পূর্বে যারা ‘এলমে ফেকাহ ‘ শিক্ষা দান করতেন তাদেরকে একশত বিঘা জমি জায়গীরসরূপ দেয়া হত। বাদশাহ আকবর এই জায়গীর ছিনিয়ে লইলেন।ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার করার জন্য নিযুক্ত করা হত।জায়গীর প্রথা বন্দ্ধ করার ফলে ইসলামী বিচার ব্যবস্হার মূলে কুঠারাঘাত করা হল।এমনি করে ইসলামী হুকুমতের শেষ চিহ্ন টুকুও বিলুপ্ত করার জন্য বাদশাহ আকবর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন।ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে হুকুমতের কোন ক্ষেত্রেই আর ইসলামের চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।মসজিদ বিরান হল।মাদ্রাসা ধ্বংস হল।অধিকাংশ আলেম দেশ ত্যাগে বাধ্য হল।
শেষ পর্যন্ত বাদশাহ আকবরের রাজত্বে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হল যাতে সুন্নি মুসলমানগন অতিষ্ট হয়ে উঠলেন।কারন একমাত্র সুন্নী মুসলমানগন ব্যতিত অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল বাদশাহর প্রিয়।কাফেররা সন্মানিত হল,মোসলমানগন হলেন অপদস্হ।ইসলামী আহকাম পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাফেরদের বিদ্রুপবানে জর্জরিত হতে লাগলেন।
হিন্দুরা একাদশীর দিন উপবাস থাকেন।তাই সেই দিন মোসলমানদেরকেও উপবাস করতে বাধ্য করা হত।অথচ রমজান মাসে কাফেররা অবাধে খদ্যদ্রব্য বেচাকেনা করত ও প্রকাশ্যে আহার করত।স্বয়ং বাদশাহ যাদের শায় তাদের বিরুদ্ধে শাহী অনুকম্পা পৃষ্ঠপোষকতা হতে সম্পুর্নরুপে বন্চিত মুসলমান কি-ইবা করতে পারবেন।তাহারা অন্তরে অন্তরে দগ্ধীভুত হতে লাগলেন।আল্লাহপাকের তরফ থেকে সাহায্য আসবার প্রতীক্ষায় থাকা ছারা তারা আর করনীয় কিছুই খুজে পেলেন না।একজন মোজাদ্দেদের প্রতীক্ষা করতে করতে তাহারা ধৈর্যের শেষ সীমানায় এসে পৌছলেন।
”কতদিন পর আসিবে সেই সত্য নূর-
ইয়া এলাহী রহমত তোমার আর কতদুর ?”
হযরত সেলিম চিশতি(রঃ) এর পুত্র মাওলানা বদরুদ্দীন ছিলেন উচ্চপদস্হ রাজকর্মচারী।বিশিষ্ট দরবারীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বাদশাহর এইসব কুফরি আকিদার বিরোধিতা করলেন।প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি সরকারী চাকুরী হতে ইস্তফা দিলেন।বাদশাহ তাহাকে দেওয়ানে খাছে ডেকে নিয়ে অনেক বুঝালেন।কিন্তু তিনি নিজ সিদ্ধান্তে রইলেন।হুকুমতের তরফ থেকে তার প্রটি কঠোরতা আরোপিত হল।কঠোরতা চরমে উঠলে তিনি নীরবে হজ্ব করতে চলে গেলেন।
বঙ্গদেশ ও বিহারের মুসলমাননের নিকট যখন বাদশাহ আকবরের এই পথভ্রষ্টতার সংবাদ পৌছল তখন তারা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরলেন।তারা এই বিরাট ফেতনায় শংকিত হয়ে হক্কানী আলেমগনের স্বরনাপন্ন হলেন।কাজী মোহাম্মদ ইয়াজদি ছিলেন জৌনপুরের অধিবাসী।তিনি ফতোয়া জারী করলেন, ”বাদশাহ আকবরের কার্যকলাপ হিন্দুস্হানে ইসলাম বিপন্ন করতেছে।সুতরাং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত।”
কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিতমোঘল সাম্রাজ্যে এইসব কর্মসূচী কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারল না।শতকরা পচানব্বই ভাগ দেশবাসী হিন্দু।তারা সবাই বাদশাহর পক্ষে।তাছারা দুনিয়াদার আলেম ভন্ড সূফীকূল,শিয়া প্রভৃতি গোষ্টিও বাদশাহর হস্তকে শক্তিশালী করেছে।জৈন,পারসী ও অন্নান্য সম্প্রদায়ের লোকদেরও রয়েছে বাদশাহর প্রতি অকুন্ঠ সরর্থন।সুতরাং বাদশাহ নির্বিঘ্নে ইসলাম বিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করে যেতে লাগলেন।
সমগ্র হিন্দুস্হানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি(রঃ) তাহার মোজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কর্যে ঝাপিয়ে পড়লেন।বেদাত ও কুফরীর যাতাকলে পিষ্ঠ ইসলামের ভয়াবহ দূরবস্হা দেখে তাহার ফারুকী রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গভীরভাবে পরিস্হতি বিশ্লেষন করে মোজাদ্দেদে আলফেছানি (রঃ) সিদ্ধান্তে আসলেন যে,সর্বপ্রথম বাদশাহর এছলাহ হওয়া প্রয়োজন।কারন বাদশাহ রূহ এবং জনগন শরীর তুল্য। রূহের ব্যাধী দুরিভূত হলে শরীরও ব্যাধিমুক্ত হবে।কিন্তু বাদশাহর এছলাহ হওয়ার পুর্বে আমিরওমরাহ গনের এছলাহ হওয়া প্রয়োজন।হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) সেই দিকেই মনোনিবেশ করলেন।
খান খানান, খানে আজম,সৈয়দ ছদরে জাহান,মোর্তজা খান,মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ গন পুর্ব হতেই মোজাদ্দেদ(রঃ) এর মুরিদ ছিলেন।তিনি তাহাদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরি কর্যকলাপ হতে তওবা করার জন্য আহ্বান জানালেন।তিনি ওমরাহগনকে নির্দেশ দিলেন -”তোমরা বাদশাহকে আমার পক্ষ থেকে বলে দাও যে,বাদশাহী ক্ষনস্হায়ী।এইসব আড়ম্বর চিরদিন থাকবে না।দুই দিনের চাকচিক্যের মোহে সত্যকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।সুতরাং অবিলম্বে এইসব কুফরী কাজ হতে তওবা করে চিরনিরাপত্তার ধর্ম ইসলামের সুশীতল পুষ্পশোভিত বাগিচায় আগমন করা উচিৎ।নতুবা গজব আসবে।আল্লাহ পাকের গজব হতে বাচবার সাধ্য কেউর নেই।আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান।বাদশাহীর পরোয়া তিনি করেন না।ফেরাউন,নমরুদ প্রমুখ প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহগনও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।সেই গজব থেকে কেউই তাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।”
মোর্শেদের কথামত ওমরাহগনও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।শেরেক,কুফরীর প্রভাবে তাহার মন পাষান হয়ে গিয়েছে।হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন।স্বপ্ন তাকে অস্হির করে তুললো।রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষগনকে তিনি স্বপ্নের বিষয়বস্তু জানালেন এবং উহার অর্থ জানতে চাইলেন।তারা বাদশাহকে জানালেন,”এই স্বপ্নের অর্থ হছ্ছে এই যে বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে।” বাদশাহ তা শুনে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলেন।তিনি অনেকটা দমে গেলেন।নতুন করে ফরমান জারী করা হলো যে- পুর্বে দীন-ই-ইলাহী পালনের ব্যাপারে যে সব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হত,এখন হতে তা থাকবে না।যারা সেজদা করতে ইছ্ছুক না -তাদেরকে আর সেজদা করতে বাধ্য করা হবে না।
এদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেছানি (রঃ) এর সারগর্ভ বাণী ও তার উজ্জল ব্যাক্তিত্যের আলোকে আলোকিত হয়ে লোকজন দীন-ই-ইলাহীর অসত্যতা ও অসারতা বোঝতে পেরে দলেদলে তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল।বিষয়টা বাদশাহ আকবরের আর অজানা রইল না।
বাদশাহ তাই জনসমক্ষে দীন-ই-ইলাহীর শান-শওকত ও জাকজমকতা প্রদর্শন করার জন্য কিছুদিন পর এক উৎসবের আয়োজন করলেন।উৎসবে দুটি পৃথক দরবার নির্মান করা হল।একটির নাম করা হল ‘আকবরী দরবার’ যা নির্মান করা হল বহু অর্থ ব্যয় করে।চোখ ঝলসানো আলোক সজ্জার ব্যবস্হা করা হল।ব্যবস্হা করা হল মনোরম মন্চ্ ও বিছান হল জৌলুসপূর্ন গালিচা।পুষ্পের সৌরভ,আতরের সুঘ্রানে আকবরী দরবার পরিনত হল ছোটছোট শাদ্দাদের বেহেশতে।ব্যবস্হা করা হল শাহী খাবারের ও সুমিষ্ট ফল-মুল ইত্যাদির।
অপর দিকে মুহাম্মদী দরবারের অবস্হা ছিল খুবই করুন। ছিন্নভিন্ন
ও জরাজীর্ন কাপড় দ্বারা তৈরী করা হলো মুহাম্মদী দরবার।খাবারের ব্যবস্হা করা হলো নিম্নমানের।আলোক সজ্জার কোনো ব্যবস্হা নেই।নিতান্ত সাধারনভাবে তৈরী এই দরবারটিকে আকবরী দরবারের তুলনায় জীর্নশীর্ন কুড়েঘর মনে হতে লাগল।
ইসলাম জড়াজীর্ন ও বর্তমানযুগের অনুপযযোগী বা অচল
এবং দীন-ই-ইলাহী জাকজমকপূর্ন ও আধুনিক এটা জনসাধারনকে বুঝানোর জন্যই এ দুটি দরবার করা হল।
কিন্তু সম্রাট এটা বোঝলেন না যে ,সত্য চিরদিনই সত্য।সত্য কোনদিনই সময়ের অধীন নয়।
অবশেষে সেই উৎসবের দিন আসল।সম্রাট আকবর তাহার সভাসদ ,আমির-ওমরাহ ও বিশিষ্ট অতিথিগনকে সঙ্গে নিয়ে মহাসমারোহে আকবরী দরবারে প্রবেশ করলেন।লোভী দুনিয়াদার লোকরাও তার অনুসরন করল।আনন্দ উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো ‘আকবরী দরবার’।
এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ আলফেসানী শয়েখ আহমদ ফারুকি
সেরহিন্দ(রঃ) তার কিছু মুরিদান সহ আগমন করিলেন।তাহার বুঝিতে বাকি রইল না কোন উদ্দেশ্যে এই উৎসবের আয়োজন এবং কেনই বা দুই
দরবারের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান।মোসলমানদের হেয় ও অপদস্ত করাই যে বাদশাহর উদ্দেশ্য এটা বুঝতে আর বাকি রইল না।কিন্তু মান,সম্মান, ইজ্জত কাউর নিজের অর্জিত সম্পদ নয়।ইহা আল্লাহ প্রদত্ত
এক নেয়ামত।তিনি যাকে ইছ্ছা ইহা দান করেন।
হজরত মোজাজ্জেদ(রঃ) তার মুরিদান সহ মোহাম্মদী দরবারে প্রবেশ
করলেন।আহারের সময় হল।এমন সময় হজরত মোজাজ্জেদ(রঃ) এক মুরিদকে বলিলেন,”যাও মোহাম্মদী দরবারের চতুর্দিকে লাঠি দ্বারা দাগ দিয়ে আস এবং এক মুষ্ঠি ধুলি তার হাতে দিয়ে বলিলেন সম্রাটের দরবারের দিকে তা নিক্ষেপ কর।”উক্ত মুরিদ তাই করল।
মূহুর্তের মধ্যে একটি ঘুর্নিঝর উঠিয়া আকবরী দরবারকে ঘিরে
ফেলল।দরবারে মহা ধুমধাম চলছিল।হটাৎ তুফান দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল।কি করিবে বুঝিয়া উঠার আগেই তাবু উড়ে গেল।আসবাবপত্র , সাজসজ্জা, খদ্যসাগ্রী সমস্তই তছনছ হয়ে গেল।নিমন্ত্রিত অতিথিগন একে অন্যের উপর পরে ধস্তাধস্তি করতে লাগল।তাবুর খুটি গুলো উপড়ে উঠে
তাহাদের মস্তকে আঘাত করতে শুরু করল।একটি খুটি গিয়ে সম্রাটের মস্তকে পর পর সাতটি আঘাত করল।আঘাত পেয়ে সম্রাট মারাত্নক আহত
হয়ে শয্যাশায়ী হলেন এবং কিছুদিন পরেই মৃত্যুবরন করলেন।
সুদীর্ঘ পণ্চাশ বৎসরের কালিমা যুক্ত শাসনের অবসান হল।ক্ষমতায় আসলেন তার পূত্র জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের যৌবনকাল এই বাতিল ধর্মের উপরেই অতিবাহিত হয়েছিল।হিন্দু ব্রাম্মন ও যোগীদের সাহচর্য পিতার ধর্মমতের প্রভাব তাকেও ইসলাম ধর্ম হতে উদাসীন করে রেখেছিল।ফলে আকবরের মৃত্যু হল ঠিকই কিন্তু রয়ে গেল তার দীন-ই-ইলাহীর সমস্ত বাতিল মতবাদ ও হুকুমত।

সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন পিতা আকবরের প্রতিষ্ঠিত দীন-ই-ইলাহীর একনিষ্ঠ মুরিদ।পিতার নাম উচ্চারনের পুর্বে তিনি ”আমার মোর্শেদ”
শব্দ উচ্চারন করতেন।তিনি বলতেন,”আমার মোর্শেদ বুজর্গ ছিলেন বগুবিধ প্রশংসনীয় গুনের অধিকারী।তাহার গুনাবলীর সামান্যতম অংশও
যদি কোনবিরাটকায় পুস্তক রচনা করা যায় তবুও তাহার গুনাবলীর সামান্যতম অংশও বর্ননা করা সম্ভব হবে না।অজস্র ধন সম্পদ,হস্তী-অশ্ব,সৈন্যসামন্ত ও বিশাল পরাক্রমের অধিকারী হওয়া সত্তেও তিনি আল্লাহর দরবারে বড়ই দীনতা ও হীনতা প্রকাশ কর‌তেন।
আমার ওয়ালেদ ধর্মে জ্ঞানী ও পন্ডিতগনের সাহচর্য বড়ই পছন্দ করতেন।বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের পন্ডিতগনের সাহচর্য ছিল তাহার অত্যধিক পছ্ন্দনীয়।তিনি সূর্য ও বিভিন্ন দেবতার পূজা করতেন।এইসব করায় কি দীনে মোহাম্মদীর সহিত সত্রুতা ছিল বলে প্রমানিত হয় ?”
জাহাঙ্গীরের আকিদা বিশ্বাস ছিল এইরূপ।তিনিও তাহার পিতা আকবরের মত মনে করতেন যে, বিবেক যাহা ভাল বলে গ্রহন করবে সেই অনুযায়ী আল্লাহপাকের ইবাদত বন্দেগী করলেই চলবে।তাই ইসলামী শরীয়ত পালনের ব্যাপারে কোন গুরুত্বই তিনি দিলেন না।কবির ভাষায়
”যে পথিক চলে না পথ নবীদের পথে,
পড়ে রয় সে বহুদুর মনজিল হতে।”

মানুষ বদল হল কিন্তু আদর্শ বদল হলনা। জাহাঙ্গীর তাহার পিতার মত মুরিদ করতে লাগলেন।তিনি সূর্যকে বড়ই সম্মান করতেন এবং পরম শ্রদ্ধাভরে সশব্দে সুর্যের নাম উচ্চারন করতেন।সমস্ত কার্যের উপর নক্ষত্রের প্রভাব আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন নক্ষত্রসমুহ নুরে এলাহীর বিকাশস্হল।জ্যোতিস শাস্ত্রে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল।তার সভার প্রধান জ্যোতিষ ছিল কৃষ্ঞদৈবজ্ঞ । বিশেষ বিশেষ কাজ করবার পুর্বে তিনি জ্যোতিষদের পরামর্শ অনুযায়ী শুভক্ষন ও শুভলক্ষন এর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন।
তিনি তাহার মুরিদগনকে উপদেশ দিতেন , ”কোন ধর্মের প্রতি
শত্রুতা করিয়া নিজের মুল্যবান সময় নষ্ট করিও না ।যুদ্ধের সময় এবং
শিকারের সময় ব্যতীত কোন জীবকে হত্যা করিও না।নক্ষত্রসমুহকে সম্মান করিও।কেননা ঐসব আল্লাহর নূরের বিকাশস্হল এবং ঘটনা ও অবস্হার উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভাব আছে বলিয়া মনে করিও।”
বাদশাহ মনে করতেন, যেহেতু তিনি হিন্দু মোসলমান সকল জাতির বাদশাহ সুতরাং সব ধর্মের প্রতিই তার সমান পৃষ্টপোষকতা থাকা
উচিৎ।এই ধারনার বশবর্তী হয়ে তিনি যেরূপ হিন্দু সাধুদের সম্মান করতেন তেমনি মোসলমান পীর ফকিরদের প্রতিও ভক্তি রাকতেন।
তার এই আপোষমূলক নীতির ফলে কাফেরদের প্রভাবতো বিন্দুমাত্র কমলো না বরং আরও বেড়ে গেল।
সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে উপবেশন করে পিতার আমলের আমির ওমরাহগনকে তাদের স্ব স্ব পদে বহাল রাখলেন।ফলে শাহী দরবারে হিন্দুদের প্রভাব বিন্দুমাত্রও কমলনা।কারন দরবারের বড় বড় পদগুলো
সব হিন্দুদের দখলেই ছিল।ফলে জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তিত হলো না,গরু জবেহ বন্ধের হুকুম রহিত হল না ।বাদশাহ দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড
সুফীদের কার্যকলাপের প্রতি উদাসীন রইলেন।ফলে পরিস্হিতি এমন
আকার ধারন করল যে ,প্রকৃত ইসলামের নিশানা সমগ্র দেশ থেকে মুছে যাবার উপক্রম হল।
ইহার উপর যোগ হল নুতন আর এক ফেতনা।এই ফেতনার মুল নায়িকা হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম নুরজাহান।নুরজাহান ছিলেন শিয়া।শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র হল ইরান।বাদশাহ হুমায়ুন ইরানের সুলতানের সহায়তায় শের শাহের হাত থেকে দিল্লীর মসনদ পুনরুদ্ধার
করেছিলেন।তখন থেকে শিয়াদের এক বিড়াট দল হিন্দুস্হান এসে বসবাস করতে থাকে এবং শাহী অনুকম্পায় রাষ্ট্রের বহু বিশিষ্ট পদ দখল
করতে থাকে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন আশেক মেজাজের মানুষ।তিনি নুরজাহানকে অত্যধিক ভালবাসতেন।নুরজাহান ছিলেন অত্যধিক
বুদ্ধিমতি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ক্রমে ক্রমে বাদশাহ
ও বাদশাহীর উপর একছ্ছত্র প্রভাব করে ফেললেন।পরিস্হিতি এমন
পর্যায়ে পৌছল যে ,সম্রাট জাহাঙ্গীর কেবল নামমাত্র বাদশাহ রইলেন।
প্রকৃত ক্ষমতা চলে গেল নুরজাহানের হাতে।বাদশাহ স্বয়ং বলতেন ,”আমার
বাদশাহী এখন নুরজাহানের ও তার দলের হাতে।আর আমি এক সের শরাব আর আধাসের গোশ্‌ত পাইলেই খুশী।”
নুরজাহানের নানা ছিলেন ইরানের উজির।নুরজাহানের এইরুপ
প্রভাব প্রতিপত্তির কথা তার নিকট পৌছল।উজির সাব ছিলেন বিখ্যাত
শিয়া নেতা।শিয়াগন সুন্নি মোসলমানদের প্রতি চরম শত্রুতা ভাব পোষন করত।নুরজাহানের সাহায্যে তারা সুন্নি মোসলমানদের কোনঠাসা করবার পরিকল্পনা করলো এবং সফলও হল।নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খান হলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের উজির।শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত নুরুল্লা শুছতরীকে
প্রধান কাজী নিযুক্ত করা হল।এই কাজী সাহেব সুন্নি মোসলমানদের প্রতি অত্যধিক বিদ্বেষভাব পোষন করতেন।
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) পরিবর্তিত পরিস্হিতি বিশ্লেষন
করে সংস্কারের নুতন পরিকল্পনা প্রনয়ন করবার বিষয়ে চিন্তা শুরু করলেন।পরিস্হিতি ভয়াবহ।আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি কাহারও লক্ষ্য নেই।
রসুল পাক (সাঃ) এর প্রদর্শিত ছিরাতাল মুস্তাকিমের উপর চলবার কাহারো আগ্রহ নেই।গতানুগতিক নফসপরস্হ আর শয়তানী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সবাই অমুল্য সময় বৃথা অতিবাহিত করতেছে।মোঘল হুকুমত এই শয়তানী ধ্যান ধারনার পৃষ্ঠপোষক।
মোজাদ্দেদ আলফেছানি(রঃ) হুকুমত হতে এই শয়তানী শক্তি নির্মুল করার
জন্য দন্ডায়মান হলেন।বাদশাহ বদল করলে কাজ হবে না ।বাদশাহর এছলাহ(সংশোধন) করতে হবে। তার জন্য সর্বপ্রথমে এছলাহ করতে হবে হুকুমতের আমিরওমরাহগনের।কারন তাদের এছলাহ ব্যতিরেকে বাদশাহর এছলাহ স্হায়ী হবে না।হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) তাই ইসলামী
আইন-কানুন আকিদা-বিশ্বাসের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য খানে আজম,
লালাবেগ,খান জাহান,কলীজ খান, শায়েখ ফরিদ প্রমুখ দরবারীদের সঙ্গে
যোগাযোগ করলেন।
তিনি শায়েখ ফরিদের নিকট লিখলেন,”দেহের মধ্যে আত্না যেরূপ,
বাদশাহ জনসাধারনের মধ্যে সেইরূপ।অন্তর পবিত্র থাকলে দেহও যেমন পবিত্র থাকে।তদ্রুপ বাদশাহ আদর্শবান হলে দেশবাশীও আদর্শবান হয়।
আপনি জানেন,পুর্ববর্তী জামানার মুসলমানরা কতই না দুরবস্হার মধ্যে
দিনাতিপাত করেছে।ইসলামের প্রথমাবস্হায় মোসলমানগন নগন্য
সংখ্যক থাকা সত্বেও এইরূপ দুরবস্হার সম্মুখীন হননি।মুসলমান নিজ
ধর্ম পালন করত।আল্লাহ পাক ফরমাইয়াছেন, ”লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন”।অর্থাৎ ” তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।”কিন্তু কিছুকাল পুর্বে বেদীংন প্রকাশ্যে দৃঢ়তার সাথে
তাদের ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের ধর্মের প্রচারনা চালাত,কিন্তু মোসলমান গন
তদের ধর্ম প্রচার করার ক্ষমতা রাখতেন না।এমাকি এরকম করলে তাদের
হত্যা করা হত।আহা কি আফছোস! কি সর্বনাশ! কি বিপদ! কি কষ্ট!”
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) আমির লালাবেগের নিকট
লিখলেন,”প্রায় এক শতাব্দী অতীত হল,ইসলাম পথিকের ন্যায় দিন গুজরান করতেছে।কাফেরগন দারূল ইসলামে প্রকাশ্যভাবে কুফরী আহকাম জারী করেও তৃপ্ত হছ্ছে না ।তাদের বাসনা ইসলামী আহকাম
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।মোসলমান ও মোসলমানীর নাম নিশানা যেন বাকী না থাকে।তারা এত বেড়ে গিয়েছে যে ,মোসলমান গন ইসলামের কোন শেয়ার প্রচার করতে গেলে তাদেরকে হত্যা করা হয়।গরু কোরবানী করা ইসলামের একটি বিশেষ কাজ।কাফেররা জিজিয়া কর দিতে রাজী হলেও
গো হত্যা করতে দিতে রাজী হবেনা বলে মনে হয়।বর্তমানে বাদশাহর
রাজত্বের শুরুতেই যদি ইসলামী হুকুমগুলি জারী করা হয় এবং মোসলমাংনকে সম্মানিত করা হয় তবেই কার্য সিদ্ধি হবে,নতুবা মোসলমানগন সংকটজনক অবস্হায় পতিত হবে।ইয়া আল্লাহ রক্ষা কর! রক্ষা কর ! আল্লাহপাকই জানেন কোন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এই সৌভাগ্যের আকাংখা করে এবং কোন বীরপুরুষ উক্ত দৌলত হাসিল করতে সক্ষম হয়।”
কলিজ খানের নিকট লিখিলেন,”আপনার মাধ্যমে এই দুঃসময়েও
শ্রেষ্টনগরী লাহোরে যে শরীয়তের অনেক হুকুম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ,তাহার জন্য আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছ.—-হজরত রসুলে পাক (সঃ)বলেছেন,’আমার উম্মতগনের মধ্যে সর্বদাই সত্য পথে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকে জয়ী হবে।বিপক্ষ দল তদের ক্ষতির চেষ্টা করেও সফলকাম হবে না।এইভাবে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে।’ ”
এইভাবে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) হুকুমতের বিভিন্ন
গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিবর্গের সহিত যোগাযোগ করে তাদেরকে ইসলাম প্রচারে উদ্বুদ্ধ করেন।সুন্নত ওয়ালজামাতই একমাত্র উদ্ধারপ্রাপ্ত দল এবং তাদের অনুসরনের জন্য দেশের বাদশাহ ও জনসাধারনকে উৎসাহিত করা এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে এই আকিদা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমেই যে প্রকৃত
ইসলামের খেদমত করা হয়, বিভিন্ন মকতুবের মাধ্যমে তিনি সবাইকে উত্তম রূপে বিশ্লেষন করে দেখালেন।
ক্রমে ক্রমে আব্দুর রহিম খানখান জাহান,ছদরে জাহান,খান জাহান, মীর্জা দারাব,কলিজ খান,নবাব শায়েখফরিদ,হাকিম ফাতহুল্লাহ ,শায়েখ আব্দুল ওয়াহাব,সেকান্দার খান লোদী,খেজের খান লোদী,জব্বারী খান,মীর্জা বদিউজ্জামান,সৈয়দ মাহমুদ,সৈয়দ আহমদ প্রভৃতি ব্যক্তি গন
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর দলভুক্ত হলেন।তিনি তাদেরকে
নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষঠত্ব,বেলায়েত,নবুয়ত,সুন্নতের অনুসরন,ক্বলবের সুস্হতা,নফসে আম্বারার স্বভাব ও তার অনিষ্ট থেকে মুক্ত
হবার উপায় ইত্যকার বিভিন্ন বিষয়ে অবগত করিয়ে তাহাদিগকে এছলাহ
করলেন।ফলে হুকুমতের এক বিড়াট অংশ হতে বেদাত ও বেদাত সুলভ
মনোভাব দুরীভুত হল।মনে প্রানে এই দল হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর নির্দেশে বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে ইসলামের প্রতি উৎসাহিত করতে লাগলেন।বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমির ওমরাহগনের মুখে সত্য পথের সন্ধান
পেয়ে শরীয়ত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠলেন।
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) সেনাবাহিনির মধ্যেও ইসলাম
প্রচারের ব্যবস্হা করলেন।সেনাবাহানী হুকুমতের আর একটি গুরুত্বপুর্ন
অংশ।এই অংশের এছলাহ হওয়াও জরুরী।হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) শায়েখ বদিউদ্দীন (রঃ) কে সেনাবাহিনীর মধ্যে সুন্নত ওয়াল জামাতের
আকিদা বিশ্বাস,ক্বলব পরিশুদ্ধ করা ও ক্বলবি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে নকশবন্দিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব , প্রভৃতি বিষয় প্রচার করার জন্য নিযুক্ত করলেন।আস্তে আস্তে সেনাবাহিনির এক বিড়াট অংশ হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এর ভক্ত হয়ে উঠল এবং অনেকেই তার মুরিদ হলেন।
মোজাদ্দেদিয়া কাফেলা দিন দিন বেড়ে চলল।হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) বিভিন্ন শহর ও গুরুত্বপুর্ন পল্লীঅন্চলে খলিফা নিযুক্ত
করলেন।তিনি তাহাদের প্রতি নিয়মিত সারগর্ভ নসিহত ও জেহাদের কর্মসুচী পেশ কর‌্তে লাগলেন।তার মকতুবাদের অনুলিপি প্রায় একই সঙ্গে
বিভিন্ন খলিফার নিকটে প্রেরিত হতে থাকল।এইসব মকতুব ছিল এক একটি সংগ্রামেী ইশতেহার।
জেহাদ দ্বিমুখী। প্রথমত নিজের নফসের ও মনের এছলাহ ও অপরটি হছ্ছে হুকুমতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে,সমাজের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ্যকাল
ধরে পুন্জিভুত বেদাত ও কুসংস্কারের বিলুপ্তিসাধন।সমাজ জীবনে এই ফেতনার মুল উৎস হছ্ছে দুনিয়াদার আলেম ও ভন্ড সূফিগনের মংড়া বাক্যসমুহ।
হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) দুনিয়াদার আলেমদের স্বরূপ
উন্মোচন করে দিলেন এবং তাদের ফেতনা থেকে মোসলমানদের মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে যেতে লাগলেন।তিনি লিখলেনঃ ”হাদিস শরীফে
উল্লেখ আছে,নিশ্চয় ঐ ব্যক্তিই কিয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা কঠিন শাস্তি ভোগ করবে,যে আলেম নিজের এলেম দ্বারা উপকৃত হয়নি।”
ভন্ড সূফীকুলও দীনের মধ্যে ফেতনা সৃষ্টির এক অন্যতম হাতিয়ার।
তাদের বাতিল চিন্তাধারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে মোসলমানদের আকিদা বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।তাদের অসৎ কার্যকলাপের প্রাবল্য শরীয়তের সৌন্দর্যকে বিকৃত ও বিবর্ন করে দিয়ে
মোসলমানদের পদস্খলন ঘকাইতেছিল।হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি (রঃ) এই বিভ্রান্ত দলের ভিতেও আঘাত হানলেন।তাদের বদ আকিদা খন্ডন ও নির্মুল করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন।
”যে ব্যক্ত জাহেরী জ্ঞান কে ছেড়ে শুধু বাতেনকে

ফেসবুক ফটো এ্যালবাম প্রাইভেট করার নিয়ম

0 comments
প্রথমে আপনার ফেসবুক একাউন্টে লগ ইন করুন। এরপর যে এ্যালবাম প্রাইভেট করতে চান তার উপর ক্লিক করুন। এবার ছবির এ্যালবামের নিচের দিকে বাম পাশে লেখা আছে দেখবেন_Edit Album Info। তাতে ক্লিক করুন।
Album Name:
Location:
Description:

এর নিচে Privacy → Custom → Only Me.
ব্যাস হয়ে গেলো।

সূত্রঃ প্রযুক্তি ব্লগ

Saturday, December 18, 2010

জিঞ্জিরা প্রাসাদ

0 comments
নবাব সিরাজদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে মীরজাফরের নির্দেশে নবাব আলীবর্দী খাঁর বিধবা স্ত্রী শরীফুন্নেসা, তাঁর দুই মেয়ে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগম এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে এ প্রাসাদে বন্দি করা হয়। বস্তুত ঘসেটি বেগমকে এখানে বন্দি করার কারণেই প্রাসাদটি নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
বড় একটি জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক প্রাচীন প্রসাদের ধ্বংসাবশেষ। এখন আর বোঝার উপায় নেই একসময় এখানে একটি সুরম্য প্রাসাদ ছিল। অথচ এ প্রাসাদেরই ইতিহাসখ্যাত ঘসেটি বেগমকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো কেটেছে এখানেই।
মোগল শাসনামলে সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ বুড়িগঙ্গার ওপারে ১৬২০ সালে রঙমহল আদলে এ সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করেন। নিরিবিলি পরিবেশে নির্মিত চারদিকে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত এ প্রাসাদে ছিল নাচঘর, গুপ্ত কক্ষ, বিশ্রাম কক্ষ, হাম্মামখানা, প্রহরী কক্ষ এবং বেশ উঁচু একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। ইব্রাহিম খাঁর মৃত্যুর পর ঢাকার সুবেদার ও ফৌজদাররা এ প্রাসাদটি অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহার করতেন। পরে এটি অভিজাতদের কয়েদখানা হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। সিংহাসন বা ক্ষমতার জন্য হুমকি হতে পারে_এমন কাউকে অথবা অভিজাত পরিবারের বখে যাওয়া তরুণদের এখানে বন্দি করা হতো। লোকজন দেখত প্রায়ই কোনো ব্যক্তিকে জিঞ্জির (লোহার শিকল) দিয়ে বেঁধে রাজকীয় নৌকা থেকে নামিয়ে এ প্রাসাদে বন্দি করা হচ্ছে। এ জিঞ্জির থেকেই এলাকাটি পরবর্তীকালে জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়।
নবাব সিরাজদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে মীরজাফরের নির্দেশে নবাব আলীবর্দী খাঁর বিধবা স্ত্রী শরীফুন্নেসা, তাঁদের দুই মেয়ে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগম (সিরাজের মা) এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে এ প্রাসাদে বন্দি করা হয়। বস্তুত ঘসেটি বেগমকে এখানে বন্দি করার কারণেই প্রাসাদটি নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
সিরাজের ফুপু ঘসেটি বেগম ছিলেন দুর্বিনীত, কুটিল, অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু এক চরিত্র। দেশ ও পরিবারের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজ স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি যে ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছিলেন, শেষমেশ বুমেরাং হয়ে তা তাঁকেই ঘায়েল করেছিল।
নবাব আলীবর্দী খাঁর কোনো ছেলেসন্তান ছিল না। তিনি তাঁর তিন কন্যাকে অগ্রজ হাজি আহমদের তিন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ঘসেটি বেগমের (মেহেরুন্নেসা) সঙ্গে বিয়ে হয় নওয়াজিশ মুহম্মদ শাহমত জংয়ের। নবাব আলীবর্দী এ আদরের মেয়ের ইচ্ছায় জামাতা শাহমত জংকে ঢাকার নায়েব নাজির নিযুক্ত করেন। ঢাকায় আসার পর ঘসেটি বেগম ব্যক্তিগত প্রভাববলয় তৈরি করেন। মূলত তিনিই পেছন থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম এ সময় সিরাজের অনুজ একরামদ্দৌলাকে পালক ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। একরাম ঢাকায় এসে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর কিছুদিন পর শাহমত জংও মারা যান। ফলে ঘসেটি বেগম তাঁর স্বামী ও সন্তানের রেখে যাওয়া বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হন।
এদিকে মৃত্যুর আগে নবাব আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। নবাব পদে সিরাজকে মনোনীত করায় ঘসেটি বেগম, মীরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখ সহজভাবে নিতে পারেননি। তাই তিনি সিরাজকে ঠেকাতে মীরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলেন।
এবার নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরোধের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদিকে মীরজাফর সিরাজের পারিবারিক কলহকে কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হন এবং ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করে পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনীকে পরাজিত করেন। সিরাজ আত্দরক্ষার্থে পাটনায় যাওয়ার পথে ঘাতকের হাতে নিহত হন। বাংলার সিংহাসনে বসেন মীরজাফর।
কিন্তু মীরজাফর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার জন্য ঘসেটি বেগম এবং সিরাজের মা আমেনা বেগমকে বন্দি করেন রাজমহলে। কিন্তু সেখানেও তাঁকে নিরাপদ মনে না করে কিছুদিন পর তাদের জিঞ্জিরার নিভৃত ওই প্রাসাদের গুপ্ত কক্ষে বন্দি করা হয়। দীর্ঘদিন ঘসেটি বেগম এ প্রাসাদে অন্তরীণ থাকেন।
তারপর একদিন মীরন ঘসেটি বেগমসহ সব বন্দিকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের কথা বলে এক বিশ্বস্ত অনুচরকে ঢাকা পাঠায়। মীরনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন ঘসেটি বেগম, আমেনা বেগম, শরীফুন্নেসা ও লুৎফুন্নেসাকে বন্দি অবস্থায় একটি রাজকীয় নৌকায় তোলা হয়। ওই নৌকাটি বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যার ত্রিমোহনায় এলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আর এভাবেই সলিলসমাধি ঘটে নবাব পরিবারের সব সম্ভ্রান্ত মহিলার। রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়।
ঘসেটি বেগমের করুণ মৃত্যুর পর প্রাসাদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। দিনের বেলাও ভয়ে সেখানে যেত না কেউ। জনশ্রুতি আছে, এখানে নাকি ঘসেটি বেগমের চাপা কান্না শোনা যেত। এভাবে শতাধিক বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে একসময় পুরো প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে। এখন এর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গড়ে উঠেছে দালানকোঠা। তার পরও দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ ঘসেটি বেগমের স্মৃতিবিজড়িত প্রাসাদটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসেন।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ