Monday, May 3, 2010

শতরঞ্জি

0 comments
রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপের বাজারে স্থান করে নিয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্প সামগ্রী রপ্তানি করা হয় তার ৫০ ভাগই রপ্তানি হয়ে থাকে শতরঞ্জি। আর এই শতরঞ্জি কেবল রংপুর থেকেই সরবরাহ করা হয়। সম্পূর্ণ দেশী প্রযুক্তিতে স্থানীয় শ্রমিকদের নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ খচিত হাজার হাজার পিস শতরঞ্জি রপ্তানি করে প্রতি বছর আয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তুলনামূলক স্বল্পমূল্য, টেকসই, উজ্জ্বল রং ও নানা শৈল্পিক দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ করা শতরঞ্জির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব শতরঞ্জি সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে কার্পেট, ওয়ালমেট ও পাপোশ। দেশে বিদেশে শতরঞ্জি সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২০ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক যেমন জীবিকা নির্বাহ করছে, তেমনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
শতরঞ্জির অগ্রযাত্রা শুরু হয় রংপুর শহরের উপকণ্ঠে নিসবেতগঞ্জ গ্রাম থেকে। প্রায় ২শ বছর আগে এই গ্রামের মানুষ নিজ উদ্যোগে সম্পূর্ণ দেশি প্রযুক্তিতে বাঁশের তৈরি একপ্রকার তাঁত জাতীয় যন্ত্রের মাধ্যমে মোটা সুতি কাপড় ও উলেন সুতা ব্যবহার করে স্থানীয় ভাষায় 'মালুদা' নামের একপ্রকার পাটি জাতীয় সামগ্রী তৈরি শুরু করে। মালুদা তৈরিতে শ্রমিকদের মননশীল কারুকাজে ফুটে উঠে গ্রামবাংলার দৃষ্টিনন্দন এক শৈল্পিক আবহ। যা উপমহাদেশের সে সময়কার রাজা-বাদশাহদের নজর কাড়ে। ধীরে ধীরে এই দৃষ্টিনন্দন সামগ্রী ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিস্তৃতি লাভ করে। সম্রাট আকবরের দরবারেও দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ডিজাইনের এই মালুদা ব্যবহারের কথা শোনা যায়। পরবর্তীতে জনৈক ব্রিটিশ কর্মকর্তা এই শিল্পকে বেগবান করার জন্য গ্রামটির নামকরণ করেন নিসবেতগঞ্জ। কালের বিবর্তনে মালুদা শতরঞ্জি নাম ধারণ করে। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রংপুরের কৃতী সন্তান আবু সা'দত মোহাম্মদ সায়েমের নির্দেশে সর্বপ্রথম সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় বিসিক ওই এলাকায় ৩৩ শতক জমির উপর ৫০/২৮ ফুটের একটি আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে শতরঞ্জি তৈরি শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারিভাবে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলার জন্য ৬ মাসের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শতরঞ্জি শিল্পে কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়নি। এরপরও থেমে থাকেনি এই শিল্পের অগ্রযাত্রা। আর্থিক সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে এই পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। একই বছর বিসিকের তত্ত্বাবধানে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় শতরঞ্জি উৎপাদন কেন্দে গড়ে তুলে সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকদের কাজ দেওয়া হয়। বিসিকের উদ্যোগে এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিসিকের এই কেন্দ্রটি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। তার আকস্মিক মৃত্যুতে থমকে পড়ে ওই কেন্দ্রের উৎপাদন। পরে রংপুর শহরের কারুপণ্যের মালিক শফিকুল আলম সেলিমকে লিজ দেওয়া হয় প্রকল্পটি। প্রথমদিকে এই শিল্পটিকে ব্যবসাসফল করে তুলতে কাঁচামাল, নকশা, যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। শফিকুল আলম সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরো বহুমুখী হয় এবং এই শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালেরও নতুন উপকরণ চিহ্নিত করেন তিনি। শুরু হয় শতরঞ্জির বিভিন্ন রকম সামগ্রী তৈরি। তার প্রচেষ্টায় দিন দিন এই শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে।
কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মধ্যদিয়ে ইউনিসেফের বিশেষ দূত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার রংপুরের সন্তান বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপীয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির পরিচয় ঘটে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'আইকা' বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী আমদানি করে তা ইউরোপের ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করেছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় 'আইকা' ছাড়াও বিবি রাসেল ও কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই শতরঞ্জিকে ঘিরে শহরের উপকণ্ঠে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি পল্লী। সেখানে কারুপণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন ছোট ছোট মহাজনের নিজস্ব অর্থায়নে পল্লীর প্রায় ২শ পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত হয়ে তৈরি করছে শতরঞ্জি। এখানে উৎপাদিত শতরঞ্জি সামগ্রী ঢাকার বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারকের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কারুপণ্যের উদ্যোগে শহরের রবার্টসনগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলা সদর, কুড়িগ্রাম এবং উলিপুর পৌর এলাকায়ও গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি তৈরি কেন্দ্র । এসব কেন্দ্রে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শত শত পিস শতরঞ্জি উৎপাদন করা হচ্ছে। কেন্দ্রগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতি বর্গফুট শতরঞ্জি তৈরিতে ১০ থেকে ১২ টাকা মজুরিতে কাজ করছে। দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করে ৫ বর্গফুটের বেশি শতরঞ্জি বুনতে পারেন না। দিন শেষে একেক জন মজুরি পায় মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মহিলা শ্রমিক জরিনা (৪০), দুর্গা (২৬), মাজেদা (২৮) বলেন, কর্মসংকটের কারণে তারা স্বল্প মজুরিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা সরকারি শ্রমনীতি অনুযায়ী নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম চালুর দাবি জানান।
নিসবেতগঞ্জ শতরঞ্জি পল্লীতে ক্ষুদ্র কারখানা মালিক আইনুল হক বলেন, তিনি ১৯৮৫ সালে বিসিকের আওতায় ৬ মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজ বাড়িতে শতরঞ্জি সামগ্রী তৈরি শুরু করেন। প্রথমদিকে স্ত্রী পারভীনকে নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন তার কারখানায় ৫০ জন মহিলা শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। একটি বড় আকারের শতরঞ্জি কার্পেট তৈরি করতে সুতা লাগে সাড়ে ৪ কেজি ও মাঝারি আকারের শতরঞ্জি কার্পেট তৈরিতে সুতা লাগে ৩ কেজি। প্রতি কেজি সুতা কিনতে হয় ১৫০ টাকা দরে। এছাড়াও গার্মেন্টসের বাতিল উলেন সামগ্রী কিছুটা কম দামে পাওয়া গেলেও তা সব সময় মেলে না। তার হিসেবে একটি মাঝারি ২৪ বর্গফুট আকারের শতরঞ্জি কার্পেট তৈরিতে উৎপাদন খরচ পড়ে ৮০০ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মহাজনদের কাছে তা বিক্রি হয় ১ হাজার টাকায়।
এ ব্যাপারে কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী শফিকুল আলম সেলিম বলেন, আগে বাজার না থাকায় উৎপাদিত শতরঞ্জি নিয়ে তারা বিপাকে পড়তেন। এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ জাপান ও ভারতে শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা এই শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। তিনি জানান, ইউরোপের দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী তারা শতরঞ্জি সরবরাহ করতে পারছেন না। কারিগরি জ্ঞানের অভাব, কারখানা গড়ে তুলতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা, শিল্প এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় তারা শতরঞ্জি কারখানা গড়ে তুলতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তার মতে এই শিল্পের ব্যবহৃত কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির জন্য বিদেশের উপর নির্ভর হতে হয় না। দেশেই প্রচুর কাঁচামাল রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এই শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব। মোতাহার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রংপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, রংপুরের শতরঞ্জি এখন ইউরোপের বাজারে যেভাবে সুনাম অর্জন করেছে তাতে এই শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই প্রয়োজন।

0 comments:

Post a Comment