Monday, May 3, 2010

পাহাড়পুর

0 comments
বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত প্রত্নস্থলগুলোর মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারটি অন্যতম। এটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এর আদি নাম সোমপুর বিহার। ইতিহাসবিদদের মতে, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল অষ্টম শতকের শেষের দিকে এ বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন। এ বিহারটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পাহাড়পুর ইউনিয়নে অবস্থিত তদানীন্তন পাহাড় (গোপালের চিতা) নামে এটি পরিচিত ছিল। ১৯২৩-৩৪ সালে প্রত্ন-খননের ফলে এই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এরপর এ প্রত্নস্থলে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ (মাঝখানে ১৯৮৬-৮৭ বাদ দিয়ে) সাল পর্যন্ত একাধিকবার প্রত্ন-খনন পরিচালিত হয়। এর ফলে যে স্থাপত্যের ধংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় সেটিকে দুই পর্বে বিভক্ত করা হয়। প্রথম পর্বের স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষটি এমনই জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে যে সেটির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ তখন কয়েকটি বিক্ষিপ্ত স্থানে কেবল একটি চওড়া দেয়ালের চিহ্নের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে এ বিখ্যাত স্থাপনাটির সময় নির্ধারিত হয়েছে খ্রিস্টীয় পাঁচ-ছয় শতক। ওই সময় এ এলাকাটির পরিচয় ছিল বটগোহালী। সেকালে ধ্বংসাবশেষ টিকে 'মঠ' হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাহাড়পুর ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বে (বর্তমান দৃশ্যমান) পূর্ববর্তী জৈন বিহারটির ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি বৌদ্ধ মহাবিহার নির্মিত হয়েছিল। এ বৌদ্ধ মহাবিহারটির নির্মাণ কাজে পূর্ববর্তী ধ্বংসাবশেষটির বহু নির্মাণ উপকরণ পুনঃব্যবহার করা হয়েছিল। এসব উপকরণের মধ্যে কয়েকটি ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য। কারণ ওইসব ভাস্কর্যে খ্রিস্টাব্দ ছয়-সাত শতকের প্রচলিত শৈল্পিক ধারা বিদ্যমান ছিল। অথচ বৌদ্ধবিহারটি বরেন্দ্র ভূখণ্ডের পাল বংশীয় দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল বিক্রম শীলের (খ্রিস্টাব্দ ৭৭১-৮১০) আমলে নির্মত হয়ে কার্যত খ্রিস্টাব্দ ১২ শতক পর্যন্ত সচল ছিল। ওই সময় এটির পরিচিতি ছিল সোমপুর বা চাঁদের লোকালয় নামে। তবে স্মরণ রাখা দরকার যে, বর্তমানে যেটুকু অংশ টিকে আছে তা কেবল নিচের অংশের অংশবিশেষ মাত্র। এ অংশের উপরের দেওয়াল ও ছাদ বিহারটি আবিষ্কারের বহু আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। আবিষ্কারের পর অক্ষত অংশের দৈর্ঘ্য ২৮১ মিটার ও প্রস্থ ২৮০ মিটার পাওয়া গেছে। মূল পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মাঝখানে একটি ছাদবিহীন চত্বর ঘিরে চারবাহুতে একসারি করে ভিক্ষু কোঠার সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছিল এই ঐতিহ্যবাহী বিহার। এতে মোট ১১৭টি ঘর ছিল। এতে ভিক্ষুরা বসবাস করত। চত্বরের মাঝখানে একটি প্রধান মন্দির ছিল। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৩৫০ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট। কালের পরিক্রমায় মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধসে গেছে। বিহারের মূল বেষ্টনীর দেয়াল প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে আরেকটি মন্দির। এটি মূল মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ বলে ধারণা করা হয়। বিহারের উত্তর বাহুর মাঝমাঝি ছিল বাইরের দিকে রয়েছে বারান্দা আকারের সদর তোরণ। এ অংশে মূল প্রবেশ নির্গমন গলির দুপ্রান্তে থামযুক্ত দুটি হলঘর এবং দু'পাশে একাধিক প্রহরী কোঠা ছিল। এর পূর্বদিকে উত্তর কোণের কাছাকাছি একটি অপ্রশস্ত সাধারণ প্রবেশ নির্গমন গলি এবং পূর্ব বাহুর মাঝামাঝি আরো অপ্রশস্ত অপর একটি গোপন গলিপথের সংস্থান রাখা হয়েছিল। মাঝখানে চত্বরের সুউচ্চ ছাদবিহীন প্রধান মন্দিরটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর কার্নিশের উপরের অংশ একেবারেই পাওয়া যায়নি। শুধু তৃতীয় ধাপের দক্ষিণ কোণের যৎসামান্য অংশ টিকে আছে। এ থেকে অনুমান করা সম্ভব হয়েছে যে, একটি গ্রিকস ভিত পরিকল্পনা থেকে তিন ধাপে ঊর্ধ্বগামী পিরামিড আকৃতিতে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। মাঝখানে ছিল চতুষ্কোণাকার শূন্যগর্ভ মেরুদণ্ড। উপরের তৃতীয় ধাপে চতুষ্কোণ মেরুদণ্ডের প্রত্যেক বাহু ঠেস দিয়ে স্ব স্ব দিক থেকে যাতায়াতযোগ্য একটি করে পুজোঘর ছিল। প্রতিটি পুজোঘর দু'অংশে বিভক্ত। সামনে ছিল থামওয়ালা একটি মণ্ডপ এবং পেছনে ছিল একটি গর্ভগৃহ। এগুলোর চারপাশে রয়েছে প্রদক্ষিণ পথ। তবে নিচের দুটি ধাপে অনুরূপ প্রদক্ষিণ পথ ব্যতীত কিছু নেই। বিহারের প্রধান তোরণের দিকে মুখ করে উত্তরদিকে মন্দিরে উঠার সিঁড়িসমেত তোরণ ছিল যা বর্তমানে নিশ্চিহ্ন। ছাদবিহীন চত্বরের বাকি অংশে বিক্ষিপ্তভাবে বহু ধরনের বহু ছোট ছোট স্থাপনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে প্রশাসনিক ভবন, নিবেদন স্তূপ, ভোজনশালা, রন্ধনশালা, কূপ, প্রধান মন্দিরের প্রতিকৃতি প্রভৃতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিবেদন স্তূপগুলোর মধ্যে একটির নাম 'পঞ্চদেবী'। এটি বিহার চত্বরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে একটি নিরেট মঞ্চের উপর একত্রে ৫টি স্তূপ রয়েছে। এর পাশে একটি বাঁধানো কূপও রয়েছে। তবে নিবেদন স্তূপগুলোর কোনোটিরই উপরের অংশ পাওয়া যায়নি। বিহারের বিশেষ দিনগুলোতে তীর্থ পর্যটনে আসা বিভিন্ন ভক্তদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে পুণ্যকাজ হিসেবে এগুলো নির্মিত হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী এই বিহারের সব স্থাপনারই মূল নির্মাণ উপকরণ ছাঁচে তৈরি পোড়া ইট ও কাদামাটি। এ ছাড়াও পানি নিষ্কাশন নালী, থাম, সরদল, দরজার বাজুবন্ধ, পাদপট্ট প্রভৃতির ক্ষেত্রে বড় বড় সাইজ করা পাথরখণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে। দেয়ালের বাইরের অংশ পলেস্তারাবিহীন। কার্নিশ অংশ নানা ধরনের কারুকাজ করা ইটের অলংকরণে শোভিত। কারুকাজের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে পিরামিড, শিকল, দন্তপাটি, দাবার ছক, পাকানো দড়ি, বরফি, ফুলেল জ্যামিতিক রেখাচিত্র প্রভৃতি। এ ছাড়া নিচের ধাপের তলপত্তনে ৬৩টি পাথরের মূর্তি ছিল। এ ছাড়াও কার্নিশের নিচে ছিল সারিবদ্ধ পোড়ামাটির ফলক। এসব ফলকে বিবিধ দৃশ্য বিধৃত হয়েছে। দৃশ্যগুলোর মূল উপজীব্য বিহারের সমকালীন লোকায়ত জীবন, জীবজগৎ, ধর্ম, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ কাহিনীর খণ্ডচিত্র। নরওয়ে সরকারের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ সালে এখানে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়। এ জাদুঘরে খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলের রুপার মুদ্রাসহ বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা, কয়েক হাজর পোড়ামাটির ফলকচিত্র, পাথরের মূর্তি, তাম্রলিপি, শিলালিপি, বাটখাড়া, শিলনোড়া ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।

0 comments:

Post a Comment