Thursday, May 6, 2010

নাটোরের ঐতিহ্যবাহী মুখানাচ

0 comments
অর্ধবঙ্গের মহারানী ভবানীর নাটোর জেলা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বর্ণিল ধারায় সমৃদ্ধ। এ অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে মূলত শিব ও কালির পূজাকে কেন্দ্র করে মুখা নাচ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকের তালে তালে নির্দিষ্ট পোশাক ও চরিত্রানুযায়ী মুখোশ পরিধান করে শারীরিক কসরতের প্রয়োগে পরিবেশিত এই নাচ স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। নাটোর জেলার সিংড়া থানাধীন শেরকুল ইউনিয়নের অন্ত্যজ শ্রেণীর অধিবাসীরা লোকিক দেবতা শিব ও কালীর পূজাকে কেন্দ্র করে মুখানাচের আয়োজন করে থাকে। বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ উৎসবের সূচনা হয়। এদিন দিবাগত সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর বানপাট ও আসন জাগানো হয়। একদল লোক শিবের আসন ও মা কালীর দুটো মুখোশ নিয়ে স্থানীয় শ্রীরামপুর শিব কালীমাতা মন্দিরে আসে। প্রথমে কালিমন্দিরে পূজা দেয়া হয়। বট ও পাকুড় গাছতলায় বেদির উপর মা কালীর মুখোশ দুটো রাখা হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি রয়েছে বেদিটি তৈরির সময় ১০৮টি মাথার খুলি পুঁতে রাখা হয়েছিল। অতঃপর মা কালীর এক ভক্ত পবিত্র হয়ে মন্ত্রপাঠ করে পূজা সম্পন্ন করেন। পূজা শেষে লোকজন মিস্ত্রিপাড়ার বাড়ির আঙিনায় এসে জমায়েত হয়। চারদিক দর্শক পরিবেষ্টিত স্থানে শুরু হয় মুখা নাচ।
মুখা নাচ বিভিন্ন চরিত্রের ছোট ছোট পর্বের ধারাবাহিক পরিবেশনা। বাদ্যযন্ত্র কেবল ঢাক। নাম মুখা নাচ হলেও এর পরিবেশনায় নাট্যিক উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে উপস্থিত। চরিত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট পোশাক ও মুখোশ লাগিয়ে হনুমান নৃত্য, বাঘ ও শিকারি নৃত্য, লাস্যনৃত্য, রাক্ষস নৃত্য, কৌতুক নৃত্য, লব-কুশ নৃত্য, রাম-লক্ষণ-সীতা রাবণ নৃত্য প্রভৃতি পর্ব একাধিক কুশীলব কর্তৃক পরিবেশিত হয়। সাধারণত মধ্যরাত পর্যন্ত নাচ চলতে থাকে। ১৩ বৈশাখ বেলা দশটার দিকে পরবর্তী দিনের কৃত্য শুরু হয়। বিভিন্ন পাড়ার ভক্তরা একযোগে আমের ডাল নিয়ে হাজরা নাচ নাচতে নাচতে মন্দির প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়। এ সময় একজন সন্যাসী ভক্তদের কানে মানসা অর্থাৎ তন্ত্রমূলক কথা বলে। এ সময় ঢাকের শব্দ বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ভক্তদের উদ্দাম নৃত্য শুরু হয়। ঢাক বাজনার তালে তালে তাণ্ডব নৃত্যের এক পর্যায়ে ভক্তদের মধ্যে কেউ কেউ উন্মাদের মতো হয়ে যায়। নির্দিষ্ট সময় পর সব হাজরা ও ঢাকি মিলে শিব ও কালী মন্দিরকে ঘিরে সাত পাক দেন। অতঃপর তারা নৃত্য সহযোগে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করতে বের হন। এক একটি পাড়ায় আসার পর নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রাবিরতি হয় এবং উৎসবমুখর পরিবেশে আগের রাতের ন্যায় মুখা নাচ পরিবেশিত হয়। বিকেল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্থানে এরূপ নাচ চলতে থাকে। পুরো এলাকা প্রদক্ষিণ শেষ হলে সব ভক্ত হরিবাড়ি নামক মন্দিরে মিলিত হয়।
এখানে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের সহস মানুষের সামনে মুখা নাচ প্রদর্শিত হয়। মূলত এ স্থানে নাচের মাধ্যমেই মুখানাচ পর্বের সমাপ্তি হয়। পরদিন গ্রামের মানুষ ভোগ নিয়ে শিব কালী মন্দিরে আসেন। একই সঙ্গে শিব ও কালী মন্দিরে দুইজন ব্রাহ্মণ পৃথকভাবেপূজা করেন। সবশেষে পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। নাটোর জেলার সিংড়া থানার শেরকুল ইউনিয়নের মুখা নাচ ও উৎসব উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন স্থান ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও লোকজন এসে থাকেন। এটি এ অঞ্চলের একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

0 comments:

Post a Comment