Monday, May 24, 2010

ফ্রিক ওয়েভ

0 comments
সর্বোচ্চ কত উঁচু হতে পারে সমুদ্রের ঢেউ? লিনিয়ার মডেল অনুযায়ী সমুদ্রের ঢেউ সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত ফুলে উঠতে পারে। এর বেশি কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রাচীনকাল থেকেই সমুদ্রের নাবিকদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে_ দানবীয় বিশাল ঢেউয়ের আঘাতে সপ্তাহে অন্তত একটি জাহাজ গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায়। বর্তমান কালের নাবিকদের মুখেও অতর্কিত ২৫-৩০ মিটার উঁচু ঢেউ মোকাবিলা করার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়। কিন্তু অনেকেরই দাবি, বিষয়টি কেবলই জেলে আর মাঝিদের গালগপ্প। বিজ্ঞানীরা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে_ একটি ক্লাসের শিশুদের একটি গড় উচ্চতা আছে। কোনো কোনো শিশু এই গড় উচ্চতার কম হবে আবার কেউ কেউ এই উচ্চতার বেশি হবে। কিন্তু এরকম কখনো হবে না যে, কোনো একটি শিশু গড় উচ্চতার ৩-৪ গুণ বেশি লম্বা হবে। বৈজ্ঞানিকদের তত্ত্ব অনুসারে এরকম অস্বাভাবিক উঁচু ঢেউ বড়জোড় প্রতি দশ হাজার বছরে একবার হতে পারে। তবে এই তত্ত্ব এখন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। লিনিয়ার মডেলের পাশাপাশি সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্চতা বিষয়ক নন-লিনিয়ার মডেল অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।বিশ্বজুড়ে লিনিয়ার মডেল এতটাই গ্রহণযোগ্য যে, বিশ্বে বিখ্যাত শিপিং ইন্ডাস্ট্রিগুলো এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে। অর্থাৎ, ১০-১৫ মিটার উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে টিকে থাকবে এমন করেই সমুদ্রগামী জাহাজগুলোকে তৈরি করা হয়। ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজ ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়, মরচে ধরা জাহাজ আর নাবিকদের অদক্ষতা।এর ব্যতিক্রমও কিন্তু বিরল নয়। ১৯৯৫ সালে নর্থ সির একটি অয়েল প্লাটফর্মের ঘটনায় সচকিত হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। ওইদিন নর্থ সিতে ফেনিয়ে উঠছিল সামুদ্রিক ঝড়। অয়েল প্লাটফর্মটি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটারের মতো উঁচুতে অবস্থিত। ঝড়ের সময় হঠাৎ দেখা গেল একটি বিশাল ঢেউ উঠে আসছে সমুদ্র থেকে। অয়েল প্লাটফর্মটিকে বিশাল ঢেউটি স্পর্শ করে গেল। বিজ্ঞানীরা এই ঝড়কেই প্রতি দশ হাজার বছরে একবার আসা ঝড় হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু এরকম ঝড় হরহামেশাই দেখা যেতে লাগল। ফলে বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলল।হেরিওট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জুলিয়ান উলফ্রাম চার বছর ধরে গবেষণা করে দেখান প্রচলিত লিনিয়ার মডেলের তত্ত্বের বাইরে গিয়ে বেশ কয়েকটি বিশাল আকারের ঢেউ ওই অঞ্চল দিয়ে বয়ে গেছে। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ান রিমোট সেনসিং স্যাটেলাইটে মাত্র এক সপ্তাহে ১০টি ২৬ থেকে ৩০ মিটার উচ্চতার ঢেউ ধরা পড়ে।আগের ধারণা অনুযায়ী এ ধরনের ঢেউ হওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটছে। এরপর পর্যটকবাহী দুটি জাহাজ দক্ষিণ মেরু থেকে ফেরার পথে এই অস্বাভাবিক ঢেউ বা ফ্রিক ওয়েভের মুখে পতিত হয়। জাহাজ দুটি কোনোমতে রক্ষা পেলেও বিশ্বের বড় বড় শিপিং ইন্ডাস্ট্রি আর চুপচাপ বসে থাকতে রাজি হলো না। তারা এ রহস্যের সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। অবশেষে ইউনিভার্সিটি অব টুরিনের প্রফেসর অল অসবোর্ন আবিষ্কার করেন, কোন কারণে সমুদ্রের ঢেউয়ের স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন দেখা যায়, দুই পাশের দুটি ঢেউয়ের উচ্চতা হঠাৎ কমে গিয়ে তৃতীয় একটি ঢেউয়ে সেই শক্তি সঞ্চারিত হয়। ফলে ওই ঢেউটির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে তৈরি হয় ফ্রিক ওয়েভ। তবে মজার বিষয় হলো, জাহাজগুলোর দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার মূল কারণ কিন্তু এই ঢেউয়ের অস্বাভাবিক উচ্চতা নয়। আসল কারণ হলো, ফ্রিক ওয়েভের ভেঙে যাওয়া। অর্থাৎ, সমুদ্র তীরে যেমন ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে, ফ্রিক ওয়েভ মাঝ সমুদ্রে ঠিক ওইভাবে আছড়ে পড়ে। এরকম বিশাল উচ্চতার বিপুল জলরাশি যখন কোনো কিছুর ওপর আছড়ে পড়ে, তখন তার পক্ষে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। জাহাজগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠা ঢেউয়ের সঙ্গে লড়তে পারে কিন্তু তিন-চার গুণ ফুলে ওঠা ঢেউ যখন আছড়ে পড়ে তাকে সামাল দেওয়া এই সময়ের তৈরি জাহাজগুলোর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। অসবোর্ন তার তত্ত্বের নাম দেন নন-লিনিয়ার মডেল। এখন সামুদ্রিক ঢেউয়ের দুটি প্যাটার্ন তৈরি হলো_ লিনিয়ার ও নন-লিনিয়ার মডেল। দেখা গেল, সমুদ্রের নাবিকরা যুগ যুগ ধরে সঠিক কথাই বলে এসেছেন। এগুলো কোনো রূপকথা নয়। বরং বিশ্ব শিপিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি রূঢ় সত্য। রূপকথার মতো সব গল্পই রূপ কথা নয়, অসবোর্নের গবেষণা সেটাই প্রমাণ করল। ফলে এখন নন-লিনিয়ার মডেল অনুসরণ করে জাহাজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো ফ্রিক ওয়েভ মোকাবেলা করার পথ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

0 comments:

Post a Comment