Tuesday, June 22, 2010

নওগাঁ

0 comments
                                                     ০০ আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন ০০
নানা ঐতিহাসিক স্থানসমৃদ্ধ রাজশাহী বিভাগের জেলা নওগাঁ। এর উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে নাটোর ও রাজশাহী জেলা, পূর্বে জয়পুরহাট ও বগুড়া জেলা এবং পশ্চিমে নবাবগঞ্জ জেলা। আত্রাই, ছোট যমুনা, নাগর, চিরি, তুলসীগঙ্গা, পুনর্ভবা এ জেলার প্রধান নদী। কড়চার এবারের বেড়ানো নওগাঁ জেলায়।
দুবলহাটি জমিদারবাড়িঃ নওগাঁ সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জমিদার জগৎরাম রাজ পরিবারের আবাসস্থল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত এ জমিদার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন বেহাল দশা। ইট-সুরকিতে নির্মিত এ বাড়িতে আছে সুরম্য প্রাসাদ, দুর্গা মন্দির, রঙ্গমঞ্চ। বাড়ির মূল ভবনটিতে কমপক্ষে একশটি কক্ষ আছে। এছাড়া কারুকাজময় বারান্দা, রঙিন কাচের অলংকরণ, নানা ধরনের ভাস্কর্য এ জমিদার বাড়ির প্রধান আকর্ষণ।
বলিহার রাজবাড়িঃ জেলা সদর থেকে প্রায় সতেরো কিলোমিটার দূরে বলিহার গ্রামে অবস্থিত। জানা যায় সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক জায়গির লাভ করে বলিহারের জমিদারগণ এ এলাকায় নানা স্থাপনা গড়ে তোলেন। বলিহার রাজবাড়ি এর মধ্যে অন্যতম।
কুসুম্বা মসজিদঃ নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মান্দা জেলার কুসুম্বা গ্রামে অবস্থিত দেশের উল্লেখযোগ্য প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন কুসুম্বা মসজিদ। এর আরেক নাম কালা পাহাড়। মসজিদের প্রধান প্রবেশ পথের উপরে স্থাপিত আরবি শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি তথা ১৫৫৮-৫৯ সালে নির্মিত। শেরশাহ শুরির শাসনামলের শেষ দিকে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে জনৈক সুলাইমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইটের তৈরি এ মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়াল পাথরের আস্তরণ দিয়ে আবৃত। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি ও উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে প্রবেশপথ আছে। পশ্চিম দেয়ালে আছে দুটি মিহরাব। উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে একটি উঁচু প্লাটফর্ম। ধারণা করা হয় সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা এখানে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদের মিহরাবগুলো খোদাই করা পাথরের নকশায় পরিপূর্ণ। নওগাঁ থেকে বাসে আসা যায় কুসুম্বা মসজিদে।
পাহাড়পুরঃ নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার। এ বিহারের আরেক নাম সোমপুর বিহার। নওগাঁ শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার। বহুকাল ধরে মাটি চাপা পড়ে থাকা এই বৌদ্ধ বিহারটি বেশ কয়েকবার প্রতœতাত্ত্বিক খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল আনুমানিক ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮২১ খ্রিস্টাব্দে এই বিহার ও মন্দির নির্মাণ করেন। যুগ যুগ ধরে এর ধ্বংসাবশেষের উপরে মাটি চাপা পড়ে বিশাল আকৃতির পাহাড়ে রূপ নেয়। আর এ কারণেই এর নাম হয় পাহাড়পুর। হিমালয়ের দক্ষিণের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। উত্তর ও দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ৯১৯ ফুট বিস্তৃত এই বিহারের চার পাশে ১৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৩ ফুট প্রস্থের ১৭৭টি কক্ষ আছে। ধারণা করা হয়, এসব কক্ষে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। বিহারের উত্তর দিকে এক সারিতে ৪৫ টি এবং অপর তিন সারিতে ৪৪টি করে কক্ষ ছিল।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের ভেতরের উন্মুক্ত স্থানের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দির। প্রায় ২৭ বর্গ মিটার জায়গার ওপরে এ মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষের উচ্চতা প্রায় ২১ মিটার। মন্দিরটি ক্রসাকৃতির এবং তিন ধাপে ক্রমহ্রাসমান ঊর্ধ্বগামী। মন্দিরের দেয়ালে রয়েছে নানা রকম পোড়ামাটির ফলকচিত্র। পাহাড়পুর খননের সময় প্রাপ্ত নানা নিদর্শন নিয়ে একটি জাদুঘর আছে পাহাড়পুর কমপ্লেক্সে ঢুকতেই। এর শীতকালীন সময়সূচি হলো সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। রবিবার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং অন্যান্য ছুটির দিনে এটি বন্ধ থাকে। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ইউনেস্কো ঘোষিত ৩২২ তম বিশ্ব ঐতিহ্য। ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব ঐতিহ্য’র অন্তর্ভুক্ত হয়। নওগাঁ থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার প্রায়। শহরের বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাস যায় পাহাড়পুর। ভাড়া ৩০-৪০ টাকা।
হলুদ বিহারঃ জেলা সদর থেকে আঠারো কিলোমিটার উত্তরে বদলগাছি থানার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাচীন প্রতœস্থল হলুদ বিহার। স্থানীয়ভাবে দ্বীপগঞ্জ নামে পরিচিত এ গ্রামটিতে নানা প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। ১৯৭৬ সালে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণার পর প্রতœতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৪ ও ১৯৯৩ সালে এখানে খনন কাজ করে। ফলে প্রতি পাশে ৫.৮ মিটার দীর্ঘ বর্গাকার একটি ভিত্তি উন্মোচিত হয়। খননের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে হলুদ বিহারকে পাহাড়পুর ও সীতাকোট বিহারের সমসাময়িক কালের বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।
জগদ্দল মহবিহারঃ জেলার ধামুইরহাট উপজেলায় অবস্থিত প্রতœস্থল জগদ্দল মহাবিহার। পাল রাজাদের আমলে নির্মিত স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, রামপালের রাজত্বকালে (১০৭৭-১১২০) জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণ করা হয়। ১৯৯৬ সালে প্রতœতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে এই প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়। এছাড়াও খননের সময় এখান থেকে দেড়শটিরও বেশি প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। নওগার বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাসে ধামুইরহাট উপজেলা সদরে সেখান ধেকে আবার বাস কিংবা টেম্পুতে জগদ্দল মহাবিহার আসা যায়।
ভিমের পান্টিঃ জেলার ধামুইরহাট উপজেলায় আরেকটি প্রাচীন নিদর্শন গরুড়স্তম্ভ, স্থানীয়ভাবে যা ভিমের পান্টি নামে পরিচিত। পাল রাজা নারায়ণ পালের শাসনামলে খ্রিস্টীয় দশম শতকে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এ স্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। কালো পাথরে নির্মিত এ স্তম্ভটির উপরের অংশ ভাঙা, যেখানে আগে একটি গরুড় মূর্তি ছিল। জানা যায় বজ্রপাতের ফলে কোনো এক সময়ে মূর্তিটি ভেঙে যায় এবং স্তম্ভটি একদিকে কিছুটা হেলে পড়ে।
মাহিসন্তোষঃ জেলার পতœীতলা উপজেলায় অবস্থিত প্রতœস্থল। জনশ্রুতি আছে এক দরবেশ মাছের পিঠে চড়ে এ স্থানে এসেছিলেন। মানুষের কাছে তিনি মাহিসওয়ার নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার নামানুসারে এ জায়গার নাম মাহিসন্তোষ। আর অন্যমতে প্রথম মহীপালের নামানুসারে এ জায়গার নামকরণ হয়। এখানে একটি প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র ও একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে। এছাড়া দুটি প্রাচীন বড় পুকুর আছে এ এলাকায়।
ধীবর দিঘিঃ জেলার পতœীতলা উপজেলার আরেকটি দর্শনীয় জায়গা ধীবর দিঘি। এ দিঘির মাঝখানে আছে দিব্যক বিজয়স্তম্ভ। দ্বাদশ শতকে পাল শাসক দ্বিতীয় মহীপালকে যুদ্ধে পরাজিত করে কৈবত রাজা দিব্যক বিজয়ের নিদর্শন হিসেবে এ দিঘি খনন করে এর মাঝখনে বিজয়স্তম্ভটি স্থাপন করেন। পাথরের তৈরি স্তম্ভটির উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নিচের অংশ ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। নওগাঁ বালুডাঙ্গা বাস স্টেশন থেকে বাসে পতœীতলার নজিপুরের ধীবর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে রিকশায় ধীবর দিঘি যাওয়া যায়।
পতিসর কুঠিবাড়িঃ জেলা শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে আত্রাই উপজেলার পতিসরে নাগর নদীর তীরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগনার সদর কাচারি ছিল এখানে। রবীন্দ্র কাচারিবাড়িতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে কবির অনেক স্মৃতিময় নিদর্শন। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ কবির জন্মদিনে এখানে নানা অনুষ্ঠান এবং লোকজ মেলা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে।নওগাঁ সদর থেকে পতিসর আসা যায় বাসে। ভাড়া ৩০-৩৫ টাকা।
কীভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি নওগাঁ যাওয়া যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ঢাকার গাবতলী থেকে এ পথের বাসগুলো ছাড়ে এ পথের বাসগুলো। শ্যামলি পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এস আর পরিবহন, কেয়া পরবিহন, বাবলু পরিবহন, টি আর পরিবহন ইত্যাদি পরিবহন সংস্থার নন এসি বাস চলে এ পথে। ভাড়া ২২০-২৪০ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে নওগাঁ যায় শ্যামলি পরিবহন। ভাড়া ৪৫০ টাকা। রাজশাহী থেকেও বাসে নওগাঁ আসা যায়। ভাড়া ৭০ টাকা। এছাড়া ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন একতা এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস, নীল সাগর এক্সপ্রেস ও দ্রুতযান এক্সপ্রেস, রাজশাহী থেকে বরেন্দ্র ও তিতুমীর এক্সপ্রেস, খুলনা থেকে সীমান্ত এক্সপ্রেস ও রূপসা এক্সপ্রেসে সান্তাহার এসে সহজেই নওগাঁ আসা যায়।
কোথায় থাকবেনঃ নওগাঁ শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এরকম কয়েকটি হোটেল হলো- শহরের সান্তাহার রোডে হোটেল অবকাশ (০৭৪১-৬২৩৫৬), সান্তাহার রোডে হোটেল ফারিয়াল (০৭৪১-৬২৭৬৫), মুক্তির মোড়ে হোটেল আগমনী (০৭৪১-৬৩৩৫১), শহরের পাড়-নওগাঁ এলাকায় হোটেল যমুনা (০৭৪১-৬২৬৭৪), পুরনো বাস স্টেশনে হোটেল সরণী (০৭৪১-৬১৬৮৫)। এসব হোটেলে ৮০-৪০০ টাকায় থাকার ব্যবস্থা আছে।

0 comments:

Post a Comment