Friday, July 16, 2010

বিষবৃক্ষের মালিনী হীরা দাসী

1 comments
বিষবৃক্ষের বীজ মূলত বপিত হয়েছিল হীরা দাসীর মানসে। বিষবৃক্ষ (১৮৭৩) উপন্যাসের হীরা দাসী পুরো বঙ্কিম (১৮৩৮-৯৪) সাহিত্যের এক উজ্জ্বল খল চরিত্র। তাঁর কপটতা, প্রতিশোধস্পৃহা, হিংসাত্দক জীবনাচরণ পুরো উপন্যাসের কাহিনীকে ঘনীভূত ও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। একটি খল চরিত্রে এত ডাইমেনশনের সার্থক সমন্বয় পুরো বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিরল। বিষবৃক্ষের আরেকটি খল চরিত্র হরি দাসী। হীরা দাসী চরিত্রটিকে পরিপূর্ণ ও সজীব করে তোলার পেছনে এ চরিত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। যদিও বঙ্কিম এ উপন্যাসে পুরনো রীতি, রেওয়াজ ও আচারে নিষ্ঠ থাকার পক্ষে হিতবাণী প্রচার করেছেন; কিন্তু হীরা দাসী ও হরি দাসী চরিত্র দুটি নিপীড়নে অভ্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু সমাজব্যবস্থাকে পাঠক-সম্মুখে উন্মোচিত করেছে। তাঁর খল চরিত্রগুলো সার্থক হয়ে ওঠার পেছনে এটিও একটি বড় অনুষঙ্গ।
হীরা দাসী চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য হরি দাসী সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। দেবেন্দ্র নারীমহলে প্রবেশাধিকার হেতু হরি দাসী বৈষ্ণবীর ছদ্মবেশ ধারণ করে। বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে নারীর মন হরণের ক্ষমতা তার আছে। তা ছাড়া তার নারী ছদ্মবেশের রূপ দেখে নারীকুলও মুগ্ধ হয়। 'সকলেই বিস্মিত হইয়া দেখিল যে, বৈষ্ণবী যুবতী, তাহার শরীরে আর রূপ ধরে না। ...ফুল্লেন্দীবরতুল্য চক্ষু চিত্ররেখাবৎ ভ্রূ যুগল, নিটোল ললাট, বাহুযুগলের মৃণালবৎ গঠন এবং চম্পকদানবৎ বর্ণ, রমণীকুল দুর্ল্লভ।'
উপন্যাসের নায়ক নগেন্দ্র ও খলনায়ক দেবেন্দ্র একই বংশের। তবে পুরুষানুক্রমে উভয় পরিবারের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। মোকদ্দমায় নগেন্দ্রর পিতামহের কাছে দেবেন্দ্রর পিতামহ পরাজিত হলে দুর্বল হয়ে পড়ে তাদের পরিবার। দেবেন্দ্রর পিতা তাঁর সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত হন। তিনি গণেশ বাবু নামে এক জমিদারের একমাত্র কন্যা হৈমবতীর সঙ্গে দেবেন্দ্রর বিবাহ দেন। হৈমবতী কুরূপা, মুখরা এক রমণী। দেবেন্দ্র সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু পরিবারে তার সুখের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা না মেটায় সে রূপতৃষ্ণা মেটাতে গৃহত্যাগী হয়। অ্যান্টি হিরো চরিত্র নির্মাণে এখানেই বঙ্কিমের বিশেষত্ব। তাঁর খলনায়ক-নায়িকারা কোনো না কোনো বঞ্চনার শিকার হয়ে বিপথগামী হয়। তারা এ বঞ্চনার কারণে সমাজের প্রতি, ব্যক্তির প্রতি প্রতিশোধমূলক আচরণ করে। ফলে এসব খল চরিত্রের ওপরও পাঠকের মনে এক ধরনের সমবেদনা সঞ্চারিত হয়। এভাবে বহু ডাইমেনশনের কারণে চরিত্রগুলো আরো মানবীয় ও সজীব হয়ে ওঠে। কী ছিল না দেবেন্দ্রর_সৌন্দর্য, বংশ পরিচয়, শিক্ষা? তবে কেন সে পরম আকাঙ্ক্ষার নারীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হবে?
দেবেন্দ্র ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী ছিল। সে বিধবা বিবাহেও বেশ উৎসাহী ছিল। তাই মেয়েদের গ্রাম্য আড্ডায় রূপবতী, কুন্দনন্দিনীকে বৈধব্যের বেশে দেখেও খুব সহজে তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে এবং একান্তে তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। হরি দাসী মতৃষ্ণ বিলোলনেত্রে কুন্দনন্দিনীর মুখপানে চাহিয়া পুনশ্চ কীর্তন আরম্ভ করিল,
'শ্রীমুখপঙ্কজ_দেখবো বলে হে,
তাই এসেছিলাম এ গোকুলে।
আমায় স্থান দিও বাই চরণ তলে।
মানের দায়ে তুই মানিনী,
তাই সেজেছি বিদেশিনী,
এখন বাঁচাও রাধে কথা কোয়ে,
ঘরে যাই হে চরণ ছুঁয়ে।...'
হরি দাসীরূপী দেবেন্দ্র কুন্দকে হরণ করার জন্য প্রথমে এক বাহানা করে। সে কুন্দকে তার কুলভ্রষ্টা দেশত্যাগী শাশুড়ির সঙ্গে তার সঙ্গে গিয়ে সাক্ষাৎ করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু কুন্দ নগেন্দ্রর স্ত্রী সূর্যমুখীর অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। কুন্দর সঙ্গে সূর্যমুখীর সম্পর্কটা ছিল ঝরনার পানির মতো স্বচ্ছ ও মানবীয়। কিন্তু সম্পর্কে ফাটল ধরায় দাসী হীরা। হীরা দেবেন্দ্রর পৌরুষের অনুরক্ত হয়ে কাজটি করে। সূর্যমুখী অনেক আগেই অনুমান করেছিল নগেন্দ্র কুন্দকে ভালোবাসে। কিন্তু নিরাশ্রয় বিধবা মেয়েটিকে সে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেনি। হীরা যখন সূর্যমুখীকে জানায়, দেবেন্দ্র হরি দাসীর ছদ্মবেশে কুন্দর সঙ্গে অভিসারে মিলিত হয়_সূর্যমুখী কুন্দর বিষয়ে আর ধৈর্য ধরতে পারে না। সে কুন্দকে ভর্ৎসনা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। হীরা সচেতনভাবেই কুন্দ ও সূর্যমুখীর পাশে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ সৃষ্টি করেছিল। মূলত হীরা দাসীর সক্রিয় প্রচেষ্টায় কুন্দ, নগেন্দ্র ও সূর্যমুখীর সম্পর্কের জটিলতা অনিবার্য সংঘাতের দিকে এগিয়ে যায়।
হীরা নগেন্দ্রর পরিবারের গৃহপরিচারিকা হিসেবে সুখে ও সম্মানের সঙ্গে থাকত। হীরা কায়স্থ কন্যা। হীরার বয়স বিশ বছর। নিজ জ্ঞান, বুদ্ধি ও চরিত্রের গুণে দাসীদের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সে বাল্য বিধবা। কিন্তু তার স্বামী প্রসঙ্গে কেউ কিছু শোনেনি। হীরা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চোখ দুটো পদ্ম পলাশ ফুলের মতো সুন্দর। সুন্দরী হীরা গান গাইতে, শুনতে ভালোবাসে। তাই সে খুব সহজেই সুরেলা কণ্ঠের দেবেন্দ্রর অনুরক্ত হয়ে পড়ে। হীরার মনে অনেক ক্ষোভ। রূপ, গুণ কী নেই তার? সূর্যমুখীর জায়গায় সেও তো থাকতে পারত। বিধাতার এ কেমন বঞ্চনা। আর কুন্দর মধ্যে দেবেন্দ্র এমন কী দেখেছে? 'আমরা গতর খাটিয়ে খাই, আমরা যদি ভালো খাই, ভালো পরি, পটের বিবির মতো ঘরে তোলা থাকি, তাহলে আমরাও অমন হতে পারি। আর এটা (কুন্দ) মিনমিনে ঘ্যানঘেনে, প্যানপেনে, সে দেবেন্দ্র বাবুর মর্ম বুঝিবে কি?' সূর্যমুখীর প্রতি হীরার এক ধরনের হিংসাত্দক বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছিল; যদিও সে জানত এটা অযৌক্তিক, একপেশে। কারণ সূর্যমুখী তার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী_সে কখনো হীরার ক্ষতি করেনি বরং উপকারই করেছে। "তবে সেইখানে (নগেন্দ্রর বাড়িতে) কুন্দকে ফিরিয়া রাখিয়া আসাই মত। কিন্তু কুন্দ যাইবে না_আর সে বাড়িমুখো হইবার মত নাই। কিন্তু যদি সবাই মিলে 'বাপু, বাছা' বলে লইয়া যায়, তবে যাইতেও পারে। আর একটা আমার মনের কথা আছে, ঈশ্বর তাহা কি করবেন? সূর্যমুখীর থোঁতা মুখ ভোঁতা হবে? দেবতা করিলে হতেও পারে। আচ্ছা সূর্যমুখীর উপর আমার এত রাগই বা কেন? সে তো কখন আমার কিছু মন্দ করে নাই; বরং ভালই বাসে, ভালই করে। তবে রাগ কেন? তা কি হীরা জানে না?... সূর্যমুখী সুখী, আমি দুঃখী, এই জন্য আমার রাগ। সে বড়, আমি ছোট_সে মুনিব, আমি বাদী। ...আমি তার হিংসা করি কেন? তাতে আমি বলি, ঈশ্বর আমাকে হিংসুটে করেছেন, আমারই বা দোষ কি?" হীরার অর্থলোভও ছিল। সে কুন্দকে পুঁজি করে দত্তবাড়ি থেকে কিছু অর্থ আদায়ের অভিসন্ধি করেছিল। হীরা জানত কুন্দনন্দিনীর বিরহ বিচ্ছেদে নগেন্দ্রর প্রেম আরো অদম্য হয়ে পড়বে। আর কুন্দকে সে তার আজ্ঞাকারী করে তুলবে, যাতে কুন্দর উপাসক নগেন্দ্রর কাছ থেকে পুজোর ছোলাটা কলাটার ভোগ সে নিজেও পায়।
হীরার প্রথম কাজ নগেন্দ্রর সঙ্গে তার স্ত্রী সূর্যমুখীর সম্পর্কের ফাটল ধরানো। অতি কৌশলে সে এ কার্য সাধন করল। নগেন্দ্রকে সে জানাল, সূর্যমুখী অতি কটু কথা বলে কুন্দকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এভাবে সে নগেন্দ্রর বিরহ যন্ত্রণাকে আরো গাঢ় করে তোলে। কুন্দ একদিন নির্জন রাতে হীরার গোপন আশ্রয় থেকে বেরিয়ে দত্তবাড়িতে যায়। সূর্যমুখী তাকে পেয়ে সাদরে গ্রহণ করে। সে তার স্বামী নগেন্দ্রর মনের অবস্থা জানত, তাই সে নিজ উদ্যোগে কুন্দর সঙ্গে তার স্বামীর বিয়ে দেয় এবং নিজে গৃহত্যাগী হয়।
এর পরও হীরার ধ্বংসাত্দক প্রবৃত্তি প্রশমিত হলো না। কুন্দর সুখও তার চোখের কাঁকর হয়ে উঠল। দেবেন্দ্র ভেবেছিল, হীরা তাকে কুন্দর বিষয়ে সহায়তা করবে। কিন্তু হলো উল্টো। হীরা কুন্দ-দেবেন্দ্রর মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াল। কারণ স্বয়ং হীরা দেবেন্দ্রর প্রণয়প্রার্থী। দেবেন্দ্র প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে হীরার প্রণয় স্বীকার করে নেয় এবং তাকে ব্যবহার করে শরীরে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে পদাঘাত দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। হীরা তার এ দুর্ভাগ্যের জন্য কুন্দনন্দিনীকে দোষী সাব্যস্ত করে। আর প্রতিশোধস্পৃহা এতটাই বেড়ে যায় যে সে কুন্দকে বিষ খাইয়ে মারার পরিকল্পনা আঁটে। 'আমি কি দোষে বিষ খাইয়া মরিব? যে আমাকে মারিল, আমি তাহাকে না মারিয়া আপনি মরিব কেন? এ বিষ আমি খাইব না। যে আমার এ দশা করিয়াছে, হয় সেই ইহা খাইবে, নাইলে তাহার প্রেয়সী কুন্দনন্দিনী ইহা ভক্ষণ করিবে। ইহাদের একজনকে মারিয়া, পরে মরিতে হয় মরিব।'
সূর্যমুখীর জীবনের এ পরিণতির জন্য কুন্দ নিজেকে অনেকটা দায়ী মনে করত। তাই সে আত্দ-অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছিল। আর এ অনুষঙ্গকে কাজে লাগিয়ে হীরা কুন্দকে আত্দহত্যার জন্য প্ররোচিত করে এবং সবশেষে সে এ কার্যে সফলকামও হয়।
বঙ্কিম উপন্যাসের খলনায়ক-নায়িকাদের শেষ পরিণতি অত্যন্ত মর্মপীড়াদায়ক হয়। সমাজের মানুষ যেন এ থেকে যথার্থ শিক্ষা নিতে পারে। এই অন্বিষ্ট অনুষঙ্গকে সামনে রেখে লেখক এমন পরিণতি রচনা করেন। কারণ বঙ্কিম সাহিত্যের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে হিতজ্ঞান প্রচার। শেক্সপিয়রিয়ান ট্র্যাজেডির সঙ্গে বঙ্কিম উপন্যাসের পরিণতিগত অনেক সাদৃশ্য থাকলেও এখানে একটি সূক্ষ্ম প্রাতিস্বিকতা স্পষ্ট। শেক্সপিয়রিয়ান ট্র্যাজেডিতে শুধু নায়ক-নায়িকাদের বিয়োগান্তক পরিণতি লক্ষ করা যায়। কিন্তু বঙ্কিম ট্র্যাজেডিতে নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে সঙ্গে খলনায়ক-নায়িকারাও করুণ পরিণতির শিকার হন।
পুরো উপন্যাসে খল চরিত্র হিসেবে হীরা চরিত্রটি প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছে। হরি দাসী এখানে হীরা দাসী চরিত্রটিকে স্পষ্ট করে তুলতে সাপোর্টিং চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। হীরা দাসী চরিত্রের কাছে বিষবৃক্ষের অন্য চরিত্রগুলো জলো, অনুজ্জ্বল, নিষ্প্রভ। হীরার মাঝে প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, কামনা আছে, লোভ আছে, হিংসা আছে, প্রতিশোধের আগুন আছে। একটি চরিত্রে এত ডাইমেনশন কথাসাহিত্যের এ সূচনা পর্বে সত্যিই বিরল। বিষবৃক্ষের উপন্যাস হিসেবে সার্থকতার পেছনে হীরা দাসী চরিত্রটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বিষবৃক্ষের বীজ বপন, চারাকে যত্নের মাধ্যমে লালন-পালন করে বৃক্ষে পরিণত করা, ফল পাকলে তা দত্ত পরিবারে পরিবেশন করার কাজটি তো করেছে হীরা দাসী। হীরা দাসী তাই তো বাংলা সাহিত্যের অমর, কালজয়ী খলনায়িকা চরিত্র।

1 comments:

Post a Comment