Monday, August 16, 2010

ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই

0 comments
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা নগরের আয়তন অনুসারে জনসংখ্যা ৫০ লাখ হওয়া উচিত। অথচ বর্তমানে প্রায় ২ কোটি লোক বসবাস করছে। এই বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানীয় জলের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা অধিককাল যাবৎ প্রদান করা মোটেই সম্ভবপর নয়। স্বাভাবিক নিয়মেই যেকোনো সময় মানববিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ৭ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হলে লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটবে। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু যেন সেই মহাবিপর্যয়েরই আগাম সতর্কবার্তা। সেজন্য সরকারসহ সবাই ঢাকা নগরের জনসংখ্যা কমানোর পক্ষে। কিন্তু সবাই একমত হবেন যে, রাজউক প্রণীত ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধি সম্বলিত ড্যাপ মানে ঢাকা নগরে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অবস্থানকারী লোকদের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেয়া এবং আরো মানুষ ঢাকা নগরে আসুক, সেটিকেও উৎসাহ দেয়া। যদি আমরা ঢাকা নগরের জনসংখ্যা ক্রমবৃদ্ধির স্থলে ক্রমহ্রাস দেখতে চাই এবং সমগ্র দেশে কৃষি জমিকে রক্ষা করে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণ করতে চাই, তাহলে দেশের ৩১৫টি নগরে একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ৩১৫টি 'নগর সরকার' গঠনের প্রস্তাবটি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

অভিযোগ উঠেছে, মানুষ খালবিল, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠসহ সব খালি জায়গা দখল করে বহুতল ভবন তৈরি করছে। প্রশ্ন হলো, এমনটি হচ্ছে কেন! উত্তর একটাই, ঢাকা নগরমুখী সব ব্যবস্থার কারণেই সব মানুষ ঢাকা নগরকেন্দ্রিক হতে চায়। ঢাকা নগরে সব আছে। ঢাকা নগরে গেলে যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকা সম্ভব। ঢাকা নগরের প্রতি ইঞ্চি জায়গায় মূল্যবান ভবন বানালেই টাকা আর টাকা। সে কারণে বাড়ির আঙিনা, খেলার মাঠ, খালবিল, ফুটপাত বেদখল ও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য বলা যায়, কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে কোনো পরিকল্পনাই ঢাকা নগরকে বাঁচাতে সক্ষম হবে না। অথচ রাজউক ঢাকা নগরকেন্দ্রিকতা অক্ষুণ্ন্ন রাখতেই ড্যাপ-এর মাধ্যমে ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধির কৌশল গ্রহণ করেছে। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংক্রান্ত এক সাধারণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা নগর ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের আওতায় ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) এবং আরবান এরিয়া প্ল্যান (১৯৯৫-২০০৯) প্রণয়নের কাজ ১৯৯২-১৯৯৫ সালে সম্পন্ন করা হয় যা ১৯৯৭ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত পরিকল্পনার আওতায় তৃতীয় ধাপ হিসেবে ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধি করে ৫৯০ বর্গমাইল (১৫২৮ বর্গ কি. মি.) এলাকাব্যাপী ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। ড্যাপের আওতাভুক্ত সীমানা উত্তরে গাজীপুর পৌরসভার উত্তরপ্রান্ত; দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী; পশ্চিমে বংশী নদী ও ধলেশ্বরী নদী এবং পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী, মেঘনা নদী ও সোনারগাঁও থানার অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা নগর করপোরেশন এলাকাসহ নারায়ণগঞ্জ ও কদমরসুল, সিদ্ধিরগঞ্জ, তারাবো, সাভার, টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা, সাভার ইপিজেড, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা এবং রূপগঞ্জ ও কালীগঞ্জ থানার অংশবিশেষ রাজউকের অন্তর্ভুক্ত। সরকার গত ২২ জুন '১০ তারিখে উপরোক্ত 'ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ' গেজেট প্রকাশ করেছে। গেজেট প্রকাশের পর থেকেই ড্যাপ বাস্তবায়নের পক্ষে-বিপক্ষে কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে। পক্ষে অবস্থানকারীদের বক্তব্য হলো- ঢাকা নগরকে বাঁচাতে হলে ড্যাপ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বিপক্ষে অবস্থানকারীদের বক্তব্য হলো- ড্যাপ প্রণয়নকালে আবাসন ব্যবসায়ী, স্থানীয় প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়নি। মজার বিষয় হলো কোন পক্ষই বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থার বিপক্ষে কিছু বলছেন না। অনেকে মনে করেন, ড্যাপ অনুযায়ী ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধি করা হলে প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। ফলে ঢাকা নগরের জনসংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটিতে উন্নীত হতে বেশি সময় লাগবে না।

আমরা ভুলে যাই যে, দেশের প্রতিটি মানুষই নগরীয় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশী। সেজন্য নগরীয় জীবনের প্রতি মানুষের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় সব জনগোষ্ঠী নগরীয় এলাকায় বসবাস করবে (যেমন জাপান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি প্রভৃতি দেশের জনগণ নগরীয় সুবিধা নিয়ে বসবাস করছে)। তাই এখন থেকে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণের বিষয়টি সুনিশ্চিত না করলে সমগ্র দেশ ঢাকা নগরের মতো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কেন্দ ীয় সরকারের দায়িত্ব হলো গোটা দেশকে অর্থাৎ নগর ও ইউনিয়নকে বাঁচানোর স্বার্থে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নকশা প্রনয়ন করা। নগরীয় ও গ্রামীণ স্থানীয় সরকারগুলোর কাজ হবে সেই নকশা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু রাজউক স্থানীয় সরকারকে তোয়াক্কা না করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘকাল যাবৎ স্থানীয় সরকারগুলোকে এজেন্ট হিসেবে রেখে দিয়েছে। ফলে স্থানীয় সরকারগুলো স্বশাসিত না হয়ে ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ- বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সরকার বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশের স্তূপীকৃত পলিথিন ও বর্জ্য অপসারণের জন্য ৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার এক পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু একদিকে বর্জ্য উত্তোলন ও অন্যদিকে নতুন করে বর্জ্য ফেলার কারণে পুরো টাকাই জলে গেছে বলে জানা গেছে। পত্রিকা সূত্রে আরো জানা গেছে, প্রতিদিন ৫০০ লিটার করে বর্জ্য উত্তোলন করা হলেও বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নদীর উভয় পাড়ের লোকজন ১০ টন করে গৃহস্থালী বর্জ্য নতুনভাবে ফেলছে (সূত্র : দৈনিক আমাদের সময়, ১ জুন '১০)। সেজন্য নদীটি দূষণমুক্ত রাখার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের না স্থানীয় সরকারের সেটা নির্ধারণ করতে হবে আগে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার এটা দূষণমুক্ত রাখতে অক্ষম তা প্রমাণীত হয়েছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার নামক একটিমাত্র সরকার যে খাল-বিল, নদী-নালাসহ সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করতে সক্ষম নয়, সেটিও ইতোমধ্যে শত-সহস বার প্রমাণিত হয়েছে। সেজন্য দুই ধরনের সরকার ব্যবস্থা_ কেন্দ্রীয় সরকার ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। সেরকম ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে বুড়িগঙ্গা নদীটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়বে নদীর উভয়পাশের স্বশাসিত স্থানীয় সরকারগুলো এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। ধরা যাক, সে ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের পার্লামেন্টে আইন পাস হলো যে, স্ব স্ব স্থানীয় ইউনিটের স্থল ও জল অংশটি দূষণমুক্ত রাখতে ব্যর্থ হলে স্থানীয় ইউনিট ও তার প্রতিনিধিদের এর দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। তখন বুড়িগঙ্গা পাড়ের স্থানীয় জনগণ ও তাদের সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার বাধ্য হবে স্থলভাগের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা নদীকেও দূষণমুক্ত রাখতে। এই পদ্ধতিতে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কেন্দ্রীয় সরকার মূলত স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই তাদের নগর ও নদীগুলো দূষণমুক্ত রাখছে। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সব পর্যায়ের স্থানীয় সরকারকেই প্রাথমিকভাবে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণের কাজ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।

আবার তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ন ছাড়া পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব হতে পারে না। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব প্রণীত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থটি মূল্যায়নের দাবি রাখে। তিনি ২০৫০ সাল নাগাদ নগরায়ণসহ বর্তমান বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দেশের ৩১৫টি নগরে (৬টি নগর করপোরেশন ও ৩০৯টি পৌরসভা) ৩১৫টি 'নগর সরকার' স্থাপন করে তাদের নেতৃত্বে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ণ সুনিশ্চিত করার কথা বলেছেন। প্রতিটি 'নগর সরকার' নগর নির্বাহিক বিভাগ, নগর বিধানিক বিভাগ ও নগর বিচারিক বিভাগ মিলে গঠিত হবে। নগর নির্বাহিক বিভাগে রাজউক ও এলজিইডির মতো প্রকৌশল বিভাগ থাকবে। উক্ত প্রকৌশল বিভাগের কাজ হবে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমতে নগরের নিজস্ব বিধিবিধানের আলোকে ইউনিটটির ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণের ডিজাইন দেয়া। নগর সংসদের কাজ হবে ডিজাইনটি উপযোগী কিনা সে বিষয়ে মতামত দেওয়া এবং প্রয়োজনে নগরবাসীর বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে পরামর্শ করে বিকল্প ডিজাইন দেয়া। অনুরূপ নিয়মে অন্যান্য ইউনিট (ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার ও বিভাগীয় সরকার) পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত উন্নয়নে স্থানীয়তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।

কাজেই আমরা মনে করি, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান রাজউক প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের মাধ্যমে ঢাকা নগরের আয়তন আর বৃদ্ধি না করে দেশের সব নগরীয় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণের কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করাই হবে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন দেশের ৩১৫টি নগরে ৩১৫টি 'নগর সরকার' গঠন করা, এবং তাদের মাধ্যমে প্রায় এক ধরনের সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর গঠন ও রক্ষণ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার কাজ এখনই শুরু করা। আশা করি সরকার মেয়াদ উত্তীর্ণ পৌরসভাগুলোর নির্বাচনের আগেই তা খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেবে।

লেখকবৃন্দ : প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ডিরেক্টর ইন-চার্জ, জাপান স্টাডি সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; কলামটির সহলেখক হিসেবে রয়েছেন_ ড. একেএম রিয়াজুল হাসান, সহযোগী অধ্যাপক, বিসিএস (শিক্ষা) এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
ই-মেইল-janipop1995@gmail.com

0 comments:

Post a Comment