Friday, August 6, 2010

স্পেতসেস

0 comments
পূর্ব থেকে আসত সেইসব দুর্লভ সুগন্ধী অপরূপ মশলা। দারুচিনি, জিরা, জাফরান বা হিং-এর সুগন্ধ বাতাসে ভেসে আসে আজও ক্ষণিকের জন্য। নানা জাতীয় মশলা সেদিন আসত ইটালিয় জাহাজে। দ্বীপটা কিন্তু গ্রিসের সমুদ্রসীমায়, নাম তার স্পেতসেস।


স্পেতসেস। ইটালিয় এই শাব্দের ইংরেজি অর্থ হলো স্পাইসেস অর্থাৎ নানা জাতীয় মশলা। সে অনেক আগের কথা। ভূমধ্যসাগরের নীল জলে চারদিক মোড়া একটা খাড়া পাহাড় ছোট্ট দ্বীপের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। তার বুকেই সেই ১৩০০ খৃস্টাব্দে গড়ে উঠেছিল বন্দর। পুব থেকে আসা নানা সুগন্ধী মশলা সেখানে নামত, তারপর আবার চলে যেত সমগ্র ইউরোপের পথে, জাহাজে ভেসে।


ইটালিয়রাই নাম দিল স্পেতসেস। দ্বীপটা কিন্তু গ্রিসের মানচিত্রে। রাজধানী এথেন্সের পেরিয়-স সমুদ্রবন্দর থেকে ফ্লাইং ডলফিনে সওয়ার হলে সে আপনাকে দুই ঘন্টা বিশ মিনিটে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে নীল জলের ওপর দিয়ে। উড়িয়ে নেবে বলার কারণ জলের ওপর এই জলযান দুশো যাত্রী নিয়ে যেভাবে জল ছুঁয়ে যায়, তাতে একে দূর থেকে দেখলে মনে হয় জাহাজটা বুঝি উডেই যাচ্ছে।


এই জাহাজ যেখানে গিয়ে থামবে, শ্বাস বন্ধ করেই তাকে দেখতে হবে দূর থেকে, এতটাই সুন্দরী দ্বীপ সে। দ্বীপে কোন গাড়ি চলার অনুমতি নেই, স্পেতসেসের পথে তাই ঘোড়ায় টানা রঙিন টাঙ্গার ছড়াছড়ি কচিৎ কদাচিৎ এক আধটা মোটরবাইকের ভোঁভোঁ, টাঙ্গার টুংটাং নূপুর, আর সমুদ্রের ছলাচ্ছল ঢেউ পথ উঠে গেছে পাহাড়ের ছোটখাটো ঢাল বেয়ে আঁকাবাঁকা সেই পথের ওপরে নিচে বাড়িঘরদোরের দাঁড়ানো যেন বিভঙ্গের মত। আর সব ছোটবড় বাড়িতেই রঙিন বাগানের বুকে প্রজাপতির খেলা বেলাভূমি অনুগত স্পেতসের বড় রাঁস্তাটি সমুদ্রের সঙ্গেই আধখানা চাঁদের মত বাক খেয়ে নতুন বন্দর থেকে নিয়ে চলে যায় পুরানো বন্দরে। সেখানে সেই সাতশো বছর আগে এসে থামত মশলার জাহাজ। পুরানো বন্দরের গা ঘেঁেয় দেশ-বিদেশের ইয়টের সারি। আর শ্যাওলাধরা বাতিঘরের মাথঅয় বসে থাকা সন্ধানী বাজপাখির চোখে ধূসর স্মৃতির ছায়া। স্মৃতির মতই অলিগলিময় স্পেতসেসের বিপণি সারণি। মাথার ওপর চাঁদোয়ার ছায়া, পাথের বাঁধানো প্রাচীন দিনের উঁচু-নিচু পথের দোকানপাটে ঝিনুক থেকে মুক্তো সবেতেই সুমদ্রের ভিজে গন্ধ। মাঝে মাঝে পানীয় চুমুকের ছোট ছোট দোকান, মাঝে মাঝে এতোলবেতোল হাওয়া, মাঝে মাঝে বাতাস টেনে আনে অতীত দিনের সুগন্ধী জাফরানের গন্ধ।


রাত করেই নামে সন্ধ্যা। ভূমধ্যসাগরের দ্বীপে সূর্য পাটে নামেন অনেক দেরিতে, ঘড়িতে যখন সাড়ে আটটা। তারপর উচ্ছ্বল অনাবিল রাত নেমে আসে চুপি চুপি। পাহাড়ের মাথা থেকে একটা পা সে রাখে দুর্গের চূড়ায়। তার পরের পাটা আরেকটু বেড়ে এগিয়ে যায় দূর সমুদ্রের দিকে। অস্তসূর্যের আবীর সেখানে এবার ধূসরে ঢাকা পড়তে থাকে। আর সেই ধূসর গভীর সমুদ্র থেকে বন্দরের দিকে মুখ ঘোরায় একটা সাদা জাহাজ। দ্বীপ থেকে তাকে তখনও ছোট্ট একটা ফুটকির মত দেখায়।


আলোগুলো জ্বলে উঠছে। টাঙ্গার গায়ে চৌখুপি আলো, ছোট্ট নৌকোর টেমি লণ্ঠনটি, জ্বলে উঠেছে পথবাতিরা, হাল্কা হলুদ হয়ে জ্বলে ওঠা আলোরা, রেস্তোঁরার আলোরমালারা এবার সমুদ্রের কালো জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। জ্বলে উঠেছে পশ্চিমের আকাশে আরেকটা গোল রূপালি বাতি। ও:! কাল পূর্ণিমা। চাঁদের ভরা যৌবন যে আজ! মায়াবী সেই আলো চারপাশকে ক্রমশ আরও অবিশ্বাস্য করে দিতে থাকে। স্পেতসেসের মশলাগন্ধী বাতাসে ততক্ষণে ধীর লয়ে এক পথশিল্পীর মনকেমন করানো ভায়োলিনের আওয়াজ মিশে যাচ্ছে। চেনা চেনা সুর। গ্রাম থেক আসা এক বোকা যুবক তার শহুরে প্রণয়িনীকে বলছে:‘ তোমার হাসির মধ্যে কি যে আছে, আমি চোখ ফেরাতে পারি না।’ ঃ সুরটা চেনা চেনা লাগে, কারণ, গ্রিক লোকগান আর আমাদের লোকগানে ভাষা ছাড়া আর কোন কিছুতেই তেমন পার্থক্য নেই। একই রকম প্রাণদোলানো সুর, একই রকম ভাবভঙ্গি। সেই সুর শুনতে শুনতেই রাত ক্রমশ ডানা মেলে নেমে আসে। কালো থেকে ঘনকালো হয়ে যায় ভূ-মধ্যসাগরের জল।


সাগরের বুকে ততক্ষণে ভেসে এসেছে আরেকজন। মাঝ সমুদ্রে মুখ ফেরানো সেই ঝকঝকে সাদা জাহাজ। অনেকদিন পর আবার প্রিয় মাটিতে পা। প্রিয় পৃথিবীর কাছে ফিরে আসা। ফিরে আসা উষ্ণতার কাছে। জীবনের ছন্দের কাছে। মশলার গ্রিক দ্বীপ স্পেতসেস সেই ঘরে ফেরা মানুষদের বুকে টেনে নেয়। তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তে থাকে সমুদ্রের অক্লান্ত ঢেউ।

0 comments:

Post a Comment