Sunday, August 15, 2010

রূপলাল হাউজ

0 comments

টাকা যখন মানুষকে পেয়ে বসে ভাগ্য তখন ফুলে ফেঁপে উঠে। টাকার নেশায় মত্ত মানুষ এক সময় বিলাসিতায় গা ভাষায় রূপলাল দাস নিজের জন্ম, প্রতিপত্তি আর আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশের প্রতীক হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন রূপলাল হাউজ। রূপলালের আদি নিবাস বুড়িগঙ্গার অপর পারে শোভড্যা গ্রামে। তার দাদা মথুরানাথ পোদ্দার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে শুরু করেন পোদ্দারি ব্যবসা। তিনি তখন বাট্টা দিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙ্গিয়ে দিতেন। মথুরানাথ তখনকার দিনে প্রতিদিন বাংলা বাজারে রাস্তার উপর চট পেতে টাকা ভাঙানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। তৎকালিন পূর্ববঙ্গে বাংলাবাজার ছিল পয়সা লগ্নি ও টাকা বিনিময়ের কেন্দ্র। মেধা ও শ্রমের কারুকার্য্যে মথুরানাথ খুব অল্প সময়ে অসম্ভব সফলতা অর্জন করেন। তখন তিনি পথের ধারের দোকান উঠিয়ে বাংলা বাজারে জমি কিনে নিজস্ব দোকান দিয়ে বসেন (বর্তমানে দোকানটি নওরোজ কিতাবিস্থান বইয়ের দোকান)। পরে তিনি মুদ্রা ভাঙানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে লগ্নী ও হুণ্ডীর কারবারে নামেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মথুরানাথ তৎকালিন এক টাকায় বছরে ৫৭০ টাকা শোধ নিতেন। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতির ফলে ক্রমেই মথুরানাথ ঢাকার শ্রেষ্ঠতম ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হন। ১৮৬০ এর দশকে সামাজিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে মথুরানাথের পুত্ররা জমিদারিও কিনতে শুরু করেন। মথুরানাথের ছিল দুই পুত্র। স্বরূপ চন্দ্র দাস এবং মধুসূদন দাস। স্বরূপচন্দ্রের পুত্র (মথুরানাথের পৌত্র) রূপলাল দাস ফরাসগঞ্জে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে একটা বিশাল জমকালো বাড়ি নির্মাণ করেন। তিনি নিজের নামে এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। অধিকাংশ ইতিহাস বেত্তাদের মতে, ঊনিশশতকের ষাটের দশকে রূপলাল আরাতুন নামের এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি পুরনো ভবন ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ ববনটি মার্টিন এন্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতিকে দিয়ে পুনঃনির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন রূপলাল হাউজ। রূপলাল হাউজ সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান ব্লকে বিভক্ত একটি দ্বি-তল প্রাসাদ। এটি প্রায় ৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ। বাড়িটির পেছনে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত। রূপলাল হাউজ ঔপনিবেশীক আমলে প্রবর্তিত পরবর্তী রেঁনেসা যোগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের এক চমৎকার উদাহরণ। এর গঠন কাঠামো আলফাবেট E’ আকৃতির। যার তিন বাহু নগরের দিকে প্রসারিত। মাঝের বাহুটি সবচেয়ে বড়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮.৩৩ মিটার। এ ভবনটির ছাদ নির্মিত হয়েছিল কোরিনথীয় স্টাইলে। এর উপরে রয়েছে পেডিমেন্ট। যা রেঁনেসাযোগীয় পেডিমেন্টের অনুকরণে নির্মিত, দ্বিতীয় তলায় দুটি ব্লকে বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। তর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পশ্চিম ব্লকের উপর তলায় অবস্থিত নাচ ঘরটি। এ ঘরের মেঝে ছিল কাঠের। পুরো বাড়ি জুড়ে উত্তর দক্ষিণপাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি সেমি-কোরিনথীয় স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের থামের উপর স্থাপিত। এ স্তম্ভ বা থামসমূহের উপর বিভাজিত, ত্রিপদ খিলান ছিল। তৎকালীন ঢাকার নবাব বাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের সাথে তুলনা করার মতো একমাত্র বাড়ি ছিল রূপলাল হাউজ। গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে এসেছিল এক অমর নতুনত্ব।
তত্কালীন ঢাকার কোনো বাড়িতে ছিল না। রূপলাল হাউজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাড়ির উপরে মাঝখানে স্থাপিত একটা প্রকান্ড ঘটি, যা ঢাকা শহরের সম্মুখভাগের সমস্ত নদী বা খাল থেকে দেখা যেত। নৌ-পথে চলাচলকারী মাঝি বা নৌকারোহীগণ এ ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করতেন। ১৮৯৭ সালের দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পে ঘড়িটির চূড়া ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তা আর মেরামত করা হয়নি। ১৮৮৮ সালে ভারতের ডাইসরয় লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরকালে রূপলাল হাউজে আসেন। তার সম্মানে রূপলাল বল নাচের (Bandance) আয়োজন করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষীদের গর্বের ধন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রূপলাল হাউজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। বাউন্ডেলে যাযাবর দুখু নজরুল, নিজ অসম প্রতিভার পরিবেশনায় রূপলাল হাউজ মাতিয়েছিলেন। এক সময় রূপলাল হাউজ থেকে শান্তি নামে একটি পত্রিকা বের হতো। পরবর্তী সময়ে তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই রূপলাল হাউজের জৌলুস কমতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় রূপলালের উত্তরাধিকারীরা কলকাতায় চলে যান। বাড়ির ফটকে এখন জামাল হাউস লেখা। তবে কথিত মালিক জামাল উদ্দীনের কোনো উত্তরাধিকারীও বর্তমান বাংলাদেশে নেই। এ সুযোগে অনেক অসাধু চাটুকারই রূপলাল হাউজের দখল সত্ত্ব নেওয়ার নেশায় মত্ত। রূপলাল হাউজ দেখতে আসা কোনো ভ্রমণ পিপাসু বা গণমাধ্যমকর্মীর আগমণে তাদের গায়ে আগুন ধরে যায় যে যতটুকু জায়গা ভোগ দখল করছেন তারা সবাই জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন নিজস্ব ব্যক্তি মালিকানা হাসিলের।

এক সময় বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য ছিল রূপলাল হাউজ। আজ পচন ধরা বিলুপ্ত প্রায় বুড়িগঙ্গার পাশে রূপলাল হাউজ দাঁড়িয়ে আছে নিতান্ত দায়সারাভাবে। নিচ তলায় পেঁয়াজ, রসুন, আলু মরিচ, বড়ই, হলুদের আড়ৎ ব্যবসা। আর উপর তলায় ইঞ্জিনিয়ারিং রিভার ব্যাটালিয়ান পরিবারগুলোর নোংরায় বসবাস। কাঁচা হলুদের ভ্যাপসা গন্ধ অসহনীয়। বাড়িটিকে দেখলে যেন মনে হয় বয়সের ভারে ন্যূজব শতবর্ষী কোনো বৃদ্ধ। সবাইকে হতচকিত করে যেকোনো সময় চিরতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তবে বাড়িটিকে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত ঘোষণা করলেও এর সংস্কারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। এ ব্যাপারে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট জাকিয়া সুলতানা বেদৌরা বলেন, আমাদের হাত পা বাঁধা, আমরা ইচ্ছা করলেও কিছু করতে পারি না। এসব ব্যাপারে একমাত্র সরকারই পারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। আপাতত সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ঐতিহ্যপ্রেমী সাধারণ জনগণের কোনো গত্যন্তর নেই। তাই আমরা নিরুপায় হয়ে সরকারের আশু পদক্ষেপের দিকেই তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে রইলাম।
০০ আল মেহেদী০০

0 comments:

Post a Comment