Thursday, August 5, 2010

আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, বগুড়া

1 comments
বগুড়ার একমাত্র শতবর্ষী আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল। শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের সদর থানা ঘেঁষা এই হোটেলে ভাসমান-ছিন্নমুল-অভাবী মানুষ সারাদিনে একমুঠো ভাত যারা জোগাতে পারেনি তাদের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়। প্রতিদিন রাত ১২টায় শহরে অবস্থানরত নাম পরিচয়হীন এই মানুষদের একবেলা ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এ জন্য কোনো শ্রম বা দাম নেওয়া হয় না। হোটেলে সারাদিনের কোনো বাসি-পচা বা উচ্ছিষ্ট খাবার নয় একেবারে আলাদা খাবার। প্রতিদিন আলাদা করে রান্না করা হয় বিতরণকৃত খাবার। এই খাবারের জন্য প্রতিদিন শহরে অভাবী মানুষ ভিড় করে। অভাবী মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করে মরহুম আকবর আলী মিঞা এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। যা শত বছর ধরে অভাবী মানুষের মাঝে বিতরণ করে চলেছে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ আকবর আলী মিঞা তৎকালীন ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে সপরিবারে বাংলাদেশের পাকশী, সান্তাহার এবং পরে বগুড়ায় আসেন। স্বাধীনচেতা মানবদরদি আকবর আলী মিঞা ভাইয়ের সঙ্গে মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। স্বাধীনচেতা এই মানুষটার মধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন খেলে যায়। কিছু একটা করার স্পৃহা তার মধ্যে কাজ করতে থাকে। সে সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের কোনো খাবার হোটেল ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের হোটেলে আবার মুসলমানরা যেত না। আবার হিন্দুরা তাদের হোটেলের আসবাবপত্র মুসলমানদের ছুঁতেও দিত না।

এখান থেকেই তিনি হোটেল করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। অভাবী এই মানুষটার মাঝে স্বপ্ন দেখা দিলেও স্বপ্ন পূরণের প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। যা দিয়ে তিনি একটি হোটেল দিতে পারেন। হোটেলের পুঁজির জন্য তিনি নিজে মিষ্টি তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। কিছুদিন এভাবে মিষ্টি বিক্রি করে মোটামুটি কিছু পুঁজি নিয়ে শহরের চকযাদু রোডের (বর্তমান নাম) মুখে মাসিক ৮ টাকা ভাড়ায় একটি হোটেল করেন। এখান থেকেই শুরু। বগুড়া শহরে তৎকালীন সময়ে স্বাধীনচেতা আকবর আলীর এই ছোট্ট হোটেলই ছিল মুসলমানদের একমাত্র খাবার হোটেল। খুব দ্রুত হোটেলের নাম ডাক ছড়িয়ে যায়। বগুড়ায় সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে খদ্দেরদের স্থান সংকুলান হতো না। খদ্দেরদের কথা ভেবে তিনি শহরের (বর্তমান) থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন। যা বর্তমানে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল হিসেবে পরিচিতি পায়। মানবদরদি আকবর আলী মিঞা খদ্দেরদের কথা মাথায় রেখে খাবারের মান সবসময় অক্ষুণ্ন রাখতেন। চলি্লশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি তার হোটেলে মাসিক ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। সে সময় ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল ১ টাকা প্লেট। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্বভাবে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব নানা কারণে হোটেলটির নাম-ডাক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ার সাদা সেমাইয়ের দেশব্যপী যে কদর তার মূলেও ছিলেন আকবর আলী। সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসত বাংলাদেশে। সেমাই তৈরির গল্প কারো জানা ছিল না। এই অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষকে অল্পদামে সেমাই খাওয়ানোর তাগিদ থেকে তিনি সেমাই তৈরি করেন এবং সফল হন। হোটেল ব্যবসায় দিন দিন ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি এবং প্রসারে সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতি রাতে ফকির-মিসকিনদের খাওয়াতেন। তাদের খাওয়াতে গিয়ে তৎকালীন আয়কর বিভাগ তাকে আয়কর দিতে চাপ দিতে থাকে। এক সময় নিজের একটা পুকুর ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করে আয়কর পরিশোধ করেন। তারপরও তিনি ফকির-মিসকিনক খাওয়াতেন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়াতেন। দিন যত গড়িয়েছে তত হোটেলের রোজগার বেড়েছে। নাম ছড়িয়েছে। ১৯৭৫ সালে তিনি মৃত্যুর আগে তার পুত্রদের হোটেলের আয় থেকে ফকির, মিসকিন, গরিবদের খাওয়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়ে যান। সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি আজো। পিতার শুরু করা নিয়ম মেনে তার পুত্ররা আজো তা পালন করে যাচ্ছেন। আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলের এখন শহরেই চারটি শাখা। কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া গ্রান্ড হোটেল, ইয়াকুবিয়ার মোড়স্থ মিষ্টি মেলা, কোর্ট চত্বরে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ও শজিমেক হাসপাতালে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। সংযোজন করা হয়েছে, আবাসিক, বেকারি, চাইনিজ, থাই ও ফাস্ট ফুড, লাচ্ছা সেমাই ও দই। কর্মচারী রয়েছে সহস্রাধিক। আকবর আলীর সেই লাচ্ছা সেমাই এখন বিদেশের বাজারেও বিক্রি হয়ে থাকে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার বৃদ্ধ আবদুল বাতেন জানান, একাত্তরের যুদ্ধ এবং যমুনা নদীর ভাঙনে সংসার চালানোর মতো তার কিছুই ছিল না। যুবক বয়সে শহরের বিভিন্ন স্থানে দিন মজুরির কাজ করে সংসার চালাতেন। বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র ছেলে তার কোনো খবর নেয় না। তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আরো অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। একটা সময় দিনমজুরির কাজ করতে পারেন না। তারপর ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। গত প্রায় ১৩/১৪ বছর ধরে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে যাচ্ছেন। বগুড়া শহরের দিন মজুরির সময় যে দিন কাজ পেতেন না সেদিনও তিনি রাতের খাবারটা এখান থেকে খেতেন।

মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট পুত্র ও আকবরিয়া গ্রুপের পরিচালক মো. হাসান আলী আলাল জানান, ১৯১৮ সালের আগে তার বাবা প্রথম দীনহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার সেই নিয়ম পালন করে যাওয়া হচ্ছে। এ খাবার বিতরণের জন্য প্রতিদিন এক মনেরও বেশি চাল রান্না করা হয়। এই খাবার উন্নতমানসম্পন্ন আলাদাভাবে রান্না করে শহরের ভাসমান, ছিন্নমূল, অভাবী মানুষদের খাওয়ানো হয়। মূল হোটেলের খাবার বাঁচে না। বাঁচলেও সে খাবার কখনই বিতরণ করা হয় না। তিনি জানান, প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে তিনশ' অভাবী মানুষ একবেলা পেটপুরে খাবার খান।

1 comments:

Post a Comment