Sunday, September 5, 2010

রিকশা

0 comments
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিচয় মসজিদের শহর নামে। কিন্তু আধুনিক ঢাকার বড় পরিচয় 'রিকশার শহর' হিসেবে। ঢাকায় রিকশা কবে এলো? এই প্রশ্নের জবাবে বলা যায় হয়তো খুব বেশি যুগ আগে নয়। সুবা ঢাকায় অর্থাৎ সুবাদারি আমল, কি তার পনের নবাবী আমলে, ঢাকা শহরে প্রিয় বাহন ছিল টমটম। এই টমটমে চড়ে নবাব থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যাতায়াত করত। সে আমলের যে যানবাহনের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আজকের এই রিকশার কথা শোনা যায়নি। অবশ্য রিকশা কোথায় আগে এসেছে, ঢাকায় না কলকাতায়, এর উত্তরে কলকাতার কথাই আগে আসে। কারণ সেই পুরনো আমলের আঁকা ছবিতেও কলকাতায় রিকশা দেখা গেছে। তবে কলকাতার সেই রিকশা আর ঢাকার রিকশার মধ্যে বিস্তর তফাৎ।

কলকাতার রিকশার দুটো চাকা। ওগুলো আবার আয়তনে গরুর গাড়ির চাকার সমান। আর রিকশার আকারও অনেক বড়। পুরো একটা পরিবার, এমনকি মালসামানা পর্যন্ত সেই রিকশায় দিব্যি উঠিয়ে বয়ে নেওয়া যেত। সেই রিকশার কোনো প্যাডেল ছিল না। মানুষ টেনে নিয়ে যেত। পরাধীন ভারতবর্ষে শাসক ইংরেজদের প্রিয় বাহন ছিল এই টানা রিকশা। পুরনো স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যই হয়তো হাতেগোনা কিছু টানা আছে ওখানে। তবে মানুষ নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মালপত্র টেনে নিয়ে যায় ওগুলো।

আর এই ঢাকার রিকশা এসেছে বোধ হয় ১৯৪৭ সালের পর। দেশভাগের পর ঢাকা হয়ে ওঠে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও প্রধান শহর। নতুন করে যেমন ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট গড়ে ওঠে, তেমনি আরো বেশকিছু যানবাহনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে ঠিক কোন সালের কোন মাসের কত তারিখে ঢাকার রাস্তায় এই তিন চাকার পরিবেশ দূণমুক্ত রিকশা চলতে শুরু করে, তা আমাদের অজানা। আজ রিকশা সাধারণ মানুষের একমাত্র সুবিধাজনক বাহন হয়ে উঠেছে। অন্যান্য যানবাহন সব জায়গায় চলে না। কিংবা যাত্রীর প্রয়োজনীয় দূরত্বে যেতে চায় না সব সময়। ফলে রিকশাই তখন শেষ ভরসা।

মুক্তিযুদ্ধের পরও ঢাকা শহরে এত রিকশা ছিল না। ভাড়াও ছিল অনেক কম। এখনকার রিকশাচালকরা ইচ্ছামতো ভাড়া হাঁকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রিকশার সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেছে। আগে পৌরসভা রিকশা ভাড়ার চার্ট করে দিত। ভাড়ার দর কষাকষি করতে হত না। যাত্রী নেমে চার্ট অনুযায়ী ভাড়া দিতেন। তবে রাজধানী ঢাকায় এই চার্ট অনুযায়ী রিকশা চলেনি। এবং এখনো ভাড়ার সুনির্দিষ্ট চার্ট নেই। ঢাকা পৌরসভা এখন সিটি করপোরেশনে রূপ নিয়েছে। এই সিটি করপোরেশনই লাইসেন্স দেয় রিকশার। বৈধ লাইসেন্স আশি হাজার থেকে এক লাখের বেশিও হবে না। অথচ ঢাকায় রিকশার সংখ্যা তিন লাখের বেশি। মাঝে-মধ্যে হঠাৎ বিশেষ অভিযান চালিয়ে শত শত অবৈধ রিকশা ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরও অবৈধ রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছেই।

রিকশার জন্যই মহানগরীর পথে পথে দুর্বিষহ যানজট সৃষ্টি হয়। বেয়াড়া বাস ট্রাকের চাকা উঠে যায় রিকশার ওপর। এভাবে আহত নিহতের সংখ্যাও কম নয়। তারপরও রিকশাই যেন ঢাকার সৌন্দর্য, সাধারণ মানুষের প্রিয় বাহন।

যাত্রীকে আকর্ষণ করতে রিকশাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা হয় রঙে রঙে, মনোলোভা রঙিন চিত্রকর্মে। বেশ মজার মজার কথাও লেখা থাকে রিকশার পেছন দিকে। ঢাকাই ছায়াছবির দৃশ্য আঁকা হয় রিকশার পেছনের গায়ে। আঁকা হয় প্রাকৃতিক দৃশ্যও। 'ক্ষণিকের সাথী', 'ভুলো না আমায়', 'আবার দেখা হবে', 'ও বন্ধু আমার', 'দিন যায় কথা থাকে', তুমি কত সুন্দর, বন্ধু তুমি শত্রু তুমি আরো কত রকম লেখা শোভা পায় রিকশার পেছনে। রিকশাচালকের জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে, গান রচিত হয়েছে, কবিতা গল্প উপন্যাসও রচিত হয়েছে অনেক।

বিদেশি মেহমানদেরও মুগ্ধ করেছে আমাদের রিকশা। অতীতে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাফসান। জানি ঢাকা সফরে এসে রিকশার রংয়ে রূপে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। পরে তাকে দুটো রিকশা উপহার দেওয়া হয়। শোন যায় সুদূর ইরানের রাজপথে সেই রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে রাফসানজানি পরিবার। কিছু বেকার বাঙালির বদৌলতে সুদূর ব্রিটেনেও চলছে বাংলাদেশের রিকশা। নির্দিষ্ট এলাকায় এই রিকশায় বিনোদন বিহার করে সাদা চামড়ার ইংরেজরা ভীষণ খুশি। রিকশা এখনো ঢাকার স্পন্দন, সৌন্দর্য এবং সাধারণের চলার পথে সঙ্গী। তিলোত্তমা ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে মাঝে মাঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রিকশা তুলে দেওয়ার। রাজধানীর অনেক পথও রিকশামুক্ত করা হয়েছে। তারপরও রিকশা আছে। তবে কলকাতার টানা রিকশার মতো আমাদের রিকশাও ভবিষ্যতে শুধু স্মৃতির স্মারক হয়ে এখানে ওখানে কালেভদ্র দেখা যাবে কি না_সময়ই বলে দেবে।

0 comments:

Post a Comment