Sunday, September 5, 2010

হোসনী দালান

0 comments

হোসনী দালান শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব মহররম পালনের প্রধান কেন্দ্রভূমি। এটি মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আরবি ৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম (৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর) বর্তমান ইরাকের কারবালার ময়দানে শাহাদাৎবরণ করেছিলেন রাসুল (সা.)-এর পৌত্র ইমাম হুসাইন (রা.)। তার শহীদত্বকে স্মরণ করার জন্য ইমারত বা প্রতীকী ইমাম বাড়ি নির্মাণ করা শিয়া সম্প্রদায়ের একটা প্রচলিত সাধারণ রীতি। মুঘল সম্রাট শাহ সুজার শাসনামলে সৈয়দ মুরাদ নামে কোনো এক ব্যক্তি প্রথম এ ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। শাহ সুজা নিজে সুন্নি মুসলমান হলেও শিয়াদের এমন ধর্মীয় রীতিনীতি তিনি বেশ পছন্দ করতেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বাস করতেন। যা এখন আর নেই। সে সময় হোসনী দালান (ইমাম বাড়ি) নির্মাণে শাহ সুজার পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালন ছিলো উল্লেখ করার মতো। জনশ্রুতি আছে, সৈয়দ মুরাদ (বর্তমান হোসনী দালানের নির্মাতা) কোনো এক রাতে স্বপ্নে হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) কে তাজিয়াখানা নির্মাণ করতে দেখেন। এতে তিনি উৎসাহী হয়ে একটি ইমারত নির্মাণ করে তার নাম দেন হোসনী দালান। নির্মাণকালীন ইমারতটি একটি ছোট্ট স্থাপনা ছিল বলে মনে করা হয়। পরবর্তী সময়ে ব্যাপক সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে তা বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। তবে তার নির্মাণকাল বা প্রাচীনত্ব নিয়ে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে। আরেকটি সূত্র মতে, সৈয়দ মুরাদ ব্যক্তিগত উপাসনার জন্য যে ছোট্ট ইমারতটি নির্মাণ করেছিলেন তা হয়তো এক সময় ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক সে জায়গাতেই ঢাকার নায়েবে নাজিম জেসারত খাঁ বর্তমান দালানটি নির্মাণ করেন। এ মতটি অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা সমর্থন না করলেও হোসনী দালানের সাথে ঢাকার নায়েবে নাজিমদের অতিসখ্যতা এবং সেখানে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তৎকালীন ঢাকার নায়েবে নাজিম মহররম মাসে হোসনী দালানে উৎসব পালনের জন্য প্রতি বছর আড়াই হাজার টাকা করে দিতেন। ঢাকার নায়েবে নাজিমদের সুনজরের ফলে ঊনিশ শতকে হোসনী দালান শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে একটি মর্যাদার স্থান হয়ে ওঠে। ১৮০৭ ও ১৮১০ সালে ঔপনিবেশিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক হোসনী দালান সংস্কার করা হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে দালানটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঢাকার নবাব আহসানুল্লাহ তা আবার পুনঃনির্মাণ করে দিয়েছিলেন। হোসনী দালান একটি উঁচু মঞ্চের উপর স্থাপিত। দালানে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে পূর্বদিকের সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে হয়। মূল ইমারতটির দু’পাশে দুটি হল ঘর নিয়ে স্থাপিত। দক্ষিণমুখী শিরনি হলটি হুসাইনের মৃত্যুকে স্মরণ করে দুঃখ ও শোক প্রকাশার্থে নির্মিত। তাই এটিকে কালো রঙে আবৃত করা হয়েছে। উত্তরমুখী খুৎবা হলটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ হলের মাঝখানে রয়েছে সাত ধাপ বিশিষ্ট একটি কাঠের তৈরি মিম্বর। শিরনি ও খুৎবা হলের ডান ও বামে সম্ভবত মহিলাদের জন্য নির্মিত সম্পূরক হল রয়েছে। ভবনটির দক্ষিণ দিকে দু’প্রান্তে দু’টি তিন তলা বহুভূজ ফাঁপা বুরুজ রয়েছে। বুরুজগুলোর শীর্ষে রয়েছে গম্বুজ। হোসনী দালানের প্যারাপেট রঙিন পদ্ম পাঁপড়ির নকশা দ্বারা অলংকৃত। প্যারাপেটের চারকোণে রয়েছে চারটি ছত্রী। সর্বোতভাবে হোসনী দালানকে একটি আধুনিক ভবন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে এর নির্মাণশৈলীর কোথাও কোথাও পুরোনো স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর ভাষ্যে, বর্তমান হোসনী দালান ছাড়া ঢাকায় আরও বেশ কিছু হোসনী দালান তথা ইমামবাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। তার মতে, ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো হোসনী দালান ছিলো ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা মহল্লায়। যার নির্মাতা ছিলেন আমির খা নামের এক ব্যক্তি। বিবিকা রওজা মহল্লায় এ হোসনী দালানটি ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তখনও ইসলাম খা’র ঢাকায় আগমন ঘটেনি। ১৮৬১ সালে আরএম দাস কিষাণজি এ দালানটির সংস্কার করেছিলেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছেও একটি হোসনী দালান ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া ফুলবাড়িয়ার কাছে ছিল মীর ইয়াকুবের হোসনী দালান। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকাই মুসলমানদের উৎসবের প্রধান দুটি স্থান হিসেবে ঈদগাহ (তৎকালীন ধানমন্ডি ঈদগাহ) এবং হোসনী দালানকে বুঝানো হতো। এখনো মহরমের শুরুতে হোসনী দালানকে ঘিরে মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে পুরো ঢাকা শহর। শিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সুন্নি মুসরমানদের একটা বিশাল অংশও এসব উৎসবে যোগ দেন। এ সময় হায় হোসেন হায় হোসেন বলে ধর্মপ্রাণ শিয়া সম্প্রদায় মাতম করতে থাকেন। আশুরার দিনে (১০ মহররম) হোসনী দালান থেকে একটি বিশাল তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করার পর এ মিছিল প্রতিকীভাবে ‘কারবালা নাম’ দেয়া একটি স্থানে শেষ হয়।
**আল মেহেদী**

0 comments:

Post a Comment