Sunday, September 5, 2010

ডুবে যাচ্ছে মালদ্বীপ

0 comments
বিশ্ব উষ্ণায়নের চরম শিকার হতে যাচ্ছে মালদ্বীপ। প্রতিনিয়ত বরফ গলে যাওয়ায় বাড়ছে পানির উচ্চতা। ফলে আশংকা দেখা দিয়েছে দেশটির ডুবে যাওয়ার।
সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নাতিদীর্ঘ ও সবুজ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। ভারত মহাসাগরের মূল ভারতীয় উপদ্বীপের অন্তর্গত মালবার উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। প্রায় ছোটবড় ১২০০টি দ্বীপখণ্ড নিয়ে গড়ে ওঠা এই মালদ্বীপের অস্তিত্বই এখন সংকটের মুখে। এর মূল কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ক্রমশ বাড়তে থাকা মহাসাগরীয় ও উকূলীয় জলস্তর। ভবিষ্যতে মালদ্বীপের স্থান যে অর্থে জলের তলদেশে হতে পারে সেটা বিশ্বের পরিবেশবিজ্ঞানীদের বোঝানোর জন্য সমুদ্রের তলায় একটি অভিনব বৈঠকও সেরে ফেলেছেন মালদ্বীপের রাষ্টপ্রধান মোহাম্মদ নাশিদ ও তার অন্যান্য মন্ত্রীরা। ডুবুরির পোশাক পরে নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক পরিবেশ শীর্ষ বৈঠকেও রাষ্ট্রপতি নাশিদ, উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণগুলোকে বন্ধ করে তারা মালদ্বীপের মতো ক্ষুদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারে। বিশ্বের শক্তিধর ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর দেওয়া পরিবেশকে বাঁচানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মালদ্বীপের মতো বহু দেশকে আবার অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দেবে। ৭০ দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিতে পারেনি জলজ জীববৈচিত্র্য এবং ব্যতিক্রমী বাস্তুতন্ত্রের ধারক মালদ্বীপ। ষোড়শ শতকের পর্তুগিজ শাসন এবং ১৮৮৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার জোয়াল বইতে হয়েছে মালদ্বীপের রাজধানী শহর মালে, মুলাকু, মালিন্দে, কোখুমদুতু, হাদুধুনামাম্বি, আরি, গোইধু, রাসদু, ফাস্কিপোন্ত, খিলাদুনমাম্বি, আতোল, মাম্মাকুনুধু, নিলানঠু প্রভৃতি দ্বীপে বসবাসকারী পেশায় মূলত মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী অধিবাসীদের গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের আগে রাজনৈতিক সমস্যায়ও জর্জরিত ছিল দ্বীপরাষ্ট্রটি। পূর্বতন রাষ্ট্রপতি মামুন আবদুল গাইয়ুমকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন 'র‌্যাসট্যাক' নামক সেনা অভিযান চালিয়ে মালদ্বীপে সেই একনায়কীয় স্বৈরশাসনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়।

জলবায়ুর পরির্বতনের ওপর সমীক্ষা করার জন্য গঠিত আন্তঃরাষ্ট্র পর্ষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে উষ্ণায়নের দরুন মেরুপ্রদেশ দু'টির বরফের স্তর এবং হিমবাহ গলতে শুরু করলে একবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সমুদ্রতলের উচ্চতা আরো দুই মিটারের মতো বেড়ে যাবে। অন্যদিকে মালদ্বীপের অন্তর্গত অধিকাংশ দ্বীপেরই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা মাত্র দেড় মিটারের মতো। মালদ্বীপে এখন অনেক ছোটবড় কলকারখানা গজিয়ে উঠেছে। মোটর গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এর ফলে এই দ্বীপটির পরিবেশ উত্তপ্ত ও দূষিত হয়ে উঠছে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং সালফার-ডাই-অক্সাইয়ের মতো ক্ষতিকর, গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাধিক্যের জন্য। ভৌগোলিকভাবে মালদ্বীপের অবস্থান ভারতের লাক্ষ্যাদ্বীপের দক্ষিণাংশে, মিনিকর দ্বীপপুঞ্জ ও শ্যাপোস উপদ্বীপ বা আর্কিপে সাগরে মধ্যবর্তী অঞ্চল। শ্রীলঙ্কা থেকে ৭০০ কি.মি দূরে অবস্থিত মালদ্বীপ। মালদ্বীপের বেশিরভাগ ভূখণ্ডই নির্মিত হয়েছে সামুদ্রিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীব, পসিপদের দেহাবশেষ সদা প্রবাল (Coral) দিয়ে। এই প্রবাল প্রাচিরেই মালদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে। নিরক্ষরেখা, এই দ্বীপরাষ্ট্রের প্রায় মাঝামাঝি অংশ দিয়ে যাওয়ার জন্য মালদ্বীপের জলবায়ু অনেকটাই ক্রান্তীয়ধর্মী। জুন-জুলাই মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আসা বৃষ্টিপাতে ছাড়া মালদ্বীপে সারা বছর জলবায়ুর প্রকৃতির সে রকম কোনো পরিবর্তন হয় না।

মালদ্বীপের পরিবেশ দূষণের কেন্দ্রবিন্দু নিঃসন্দেহে প্রায় আড়াই বর্গ কি.মি এলাকাজুড়ে রাজধানী শহর মালে। দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাস করেন এই শহরটিতে। টোকিও, লন্ডন, কলকাতা, ওয়াশিংটনের মতো অভিজাত মহানগরীর মতোই মালেতেও জনবিস্ফোরণ আর মোটরযানের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য পরিবেশের ভারসাম্য প্রায় বিদায় নেওয়ার মুখে। মালেতে প্রতিটি পরিবারের কাছেই এখন একাধিক মোটরগাড়ি, ৮০ হাজার বিদেশি কর্মী এবং প্রায় ৩৫ হাজার বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর চাপে মালের জনবিস্ফোরণ আরো ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। মালদ্বীপের অন্তর্গত সবচেয়ে বড় দ্বীপটির আয়তন ৮ বর্গ কি.মির বেশি নয়। সুতরাং এ ধরনের দ্বীপে জনবসতির ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে মালদ্বীপের পর্দাবরণ ও বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়তে বাধ্য। মালদ্বীপের পরিবেশ দূষণের পিছনে আরো একটি কারণ ধনী বিদেশি পর্যটকদের বাড়াবাড়ি। সাধারণ পর্যটকের পক্ষে মালদ্বীপের যে কোনো দ্বীপে আধা ঘণ্টার জন্য ১৭৫ মার্কিন ডলার খরচ করে বিমান সফর করা সম্ভব নয়। বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে আসা প্লাস্টিক বর্জ্য, ট্যুরিস্ট প্লেনের গ্যাসোরিন জ্বালানির ধোঁয়া এবং তাদের ভ্রমণসুখের জন্য সবুজ অরণ্যছেদন করে বানানো অসংখ্য বিলাসবহুল পর্যটন আবাস, নিদারুণ ক্ষতি করছে মালদ্বীপের।
মেহেদী হাসান বাবু

0 comments:

Post a Comment