Tuesday, October 19, 2010

দার্জিলিং

4 comments
পর্যটন শিল্পসমৃদ্ধ দেশ ভারত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পুরাকীর্তি, আধুনিক ও প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প, সর্বোপরি বিশ্বের অন্যতম সপ্তাশ্চর্য আগ্রার তাজমহল ভারতকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে স্বমহিমায়। ভারতজুড়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলো এরই মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দার্জিলিং তারই একটি। এটির অবস্থান ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের হিমালয়ের পাদদেশে । প্রকৃতির নৈসর্গিক ছোঁয়া পেতে লাখ লাখ পর্যটক প্রতিবছর দার্জিলিংয়ে ছুটে আসেন। ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে এ শহরের আবহাওয়া একটু ব্যতিক্রম। শহরটি হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময়ই বিরাজ করে শীত ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া। দার্জিলিং শহরটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ফুট উপরে। বছরের ৯ মাসই থাকে ঠাণ্ডা। মনে হবে মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশে নিজ হাতে ছোঁয়া যাবে মেঘমালাকে। বাকি ৩ মাস পুরোপুরি নিজেকে মেলে ধরতে পারে সূর্য। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে উঠতে হয় মূল দার্জিলিং শহরে।

বস্তুত দার্জিলিং শহরটি ব্রিটিশ আমলেই বিশ্ব পর্যটকদের নজরে আসে। শহরে উঠেই দেখতে পাবেন সব জায়গায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চিহ্ন। রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি চিড়িয়াখানা পর্যন্ত সব স্থানেই ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ছোঁয়া। মূলত ব্রিটিশরা এ শহরকে তাদের নিজের মতো করে সাজিয়েছিল। কারণ ছিল একটাই_ এর নির্মল আবহাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে নিয়মিতভাবে জিপ ও ছোট ছোট গাড়ি যায় দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। এ পথে সচরাচর কোনো বড় বাস বা গাড়ি দেখা যায় না। কারণ পাহাড়ি পথগুলো সরু আর দুর্গম। বর্তমানে এসব পথে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পাশাপাশি শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি টয় ট্রেনে করে ওঠা যায় দার্জিলিং শহরে। তবে এতে লেগে যায় প্রায় ৭-৮ঘণ্টা। গাড়িতে উঠতেও লাগে প্রায় ৩ ঘণ্টা। অথচ শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং শহরের দূরত্ব মাত্র ৯৫ কিলোমিটার। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে গাড়ি চলার বিরতিতে বিভিন্ন ছোট ছোট টি-স্টলে খেয়ে নিতে পারেন দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী চা-এর পাশাপাশি বিখ্যাত খাবার 'ম ম'। দার্জিলিং ঘুরতে গেছেন অথচ ম ম খাননি এমন লোক খুব কমই আছেন।

মূল শহরকে স্থানীয় অধিবাসীরা ম্যালে নামে ডেকে থাকে। এই ম্যালেকে ঘিরেই তাদের সব ব্যবসা-বাণিজ্য, হাটবাজার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সন্ধ্যার আগ থেকেই রাস্তাঘাট, মার্কেট-বাজার ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই আরামপ্রিয়। সন্ধ্যার পরপর ঘরে বসেই কাটাতে চায়। তাছাড়া ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করাতে সন্ধ্যার পরে তেমন একটা লোকজন থাকে না। থাকেন শুধু পর্যটকরা। ইচ্ছামতো হাঁটাহাটি করেন। ক্রয় করেন তাদের পছন্দমতো জিনিসপত্র। দার্জিলিং শহরে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হিমালয়ান মাউন্টেরিয়ান ভিলেজ, চিড়িয়াখানা, স্টেডিয়াম, রক গার্ডেন, গঙ্গামাইয়া ইত্যাদি। তাছাড়া ব্রিটিশ আমলের কিছু স্কুল-কলেজ, যা আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি এলাকায়। এ শহরের বাড়ি-ঘরগুলো গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ঢালের ভাঁজে ভাঁজে। এখানকার বেশির ভাগ ঘরবাড়ি কাঠের তৈরি।

ঘুরেফিরে দেখার জন্য যে কেউ ভাড়া করতে পারেন ছোট ছোট জিপ। এতে চড়ে শহরের আনাচে-কানাচে থাকা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ঘুরে দেখতে পারেন চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানাটিকে ইউনেস্কোর ওয়াইল্ড এনিমেল হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চিড়িয়াখানা যাওয়ার পথে চোখে পড়বে দার্জিলিং ফুটবল স্টেডিয়াম। একে তো পাহাড়ের উপর শহর তার ওপর স্টেডিয়ামের মতো স্থাপনা। ভাবতেই অবাক লাগে। এখান থেকে চলে যেতে পারেন হিমালয়ান মাউন্টেরিয়ান ইনস্টিটিউটে। এখানে পাহাড়ে ওঠার যাবতীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক পাহাড়ের পাশাপাশি আছে তৈরি করা কৃত্রিম কিছু পাহাড় বা পাহাড়সদৃশ স্থাপনা। দার্জিলিং থেকে ৩ হাজার ফুট অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উপরে টাইগার হিলের অবস্থান। এখান থেকে সরাসরি হিমালয় পর্বত দেখা যায়। সারাদিন দূর থেকে হিমালয়কে সাদা হিমবাহ রংয়ে দেখা গেলেও ভোরে এ চিত্র থাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। সূর্য ওঠার সময় হিমালয়কে মনে হয় সম্পূর্ণ সোনার তৈরি। সূর্যের সোনালি কিরণ ছড়িয়ে থাকে হিমালয়ের গায়ে। এ দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ভোর রাতেই রওনা দিতে হয় টাইগার হিলের উদ্দেশে। অন্যথায় এ দৃশ্য ধরা দেবে না আপনার চোখে। শহর থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট নিচে রক গার্ডেন অবস্থিত।

মূল শহরের বাইরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে যে কেউ ঘাবড়ে যেতে পারেন। রাস্তা-ঘাটগুলো খুবই ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর শব্দটা এই অর্থে, কারণ সরু পথ বেয়ে রক গার্ডেনে নামতে গেলে যে কারো মনে মৃত্যুভয় জাগতে পারে। রাস্তার মোড়গুলো এতটাই ভয়ানক ২টি গাড়ি পাশাপাশি চলার সময় পাহাড়ের ঢালের দিকে গাড়িটির চাকা থাকে রাস্তায় এবং চাকার বাইরের অংশটি থাকে শূন্যে। যাই হোক, এরকম রাস্তা পাড়ি দিয়ে রক গার্ডেনে পেঁৗছামাত্র যে কারো মন ভালো হয়ে যেতে পারে। ভুলে যেতে পারেন সরু রাস্তার ভয় জাগানিয়া প্রতিচ্ছবি। পুরো গার্ডেনকে সাজানো হয়েছে মনের মতো করে। পাহাড়ের নিচ থেকে উপর অবধি আছে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে যে কেউ পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পারেন। সেখান থেকে উপভোগ করতে পারেন প্রকৃতির অপরূপ রূপ। রক গার্ডেন থেকে আরো এক হাজার ফুট নিচে নামলে চোখে পড়বে গঙ্গামাইয়া পার্ক। পার্কজুড়ে রয়েছে বড় বড় পাথর খণ্ড। সত্যি কথা বলতে পাথরগুলোকে মনে হবে এক একটা আস্ত পাহাড়। এসব পাহাড়ের আনাচে-কানাচে বয়ে চলছে ঝরনার নির্মল বারিধারা। গড়িয়ে পড়ছে পানি পাহাড়ের ছোট ছোট ফাটল বেয়ে ঝরনায়। এরকম আরো অনেক কিছু রয়েছে, যা আপনার মনকে নাড়া দিতে পারে। ভুলে যেতে পারেন যান্ত্রিক জীবনের দৌড়ঝাঁপ। সত্যি তখন মনে হবে প্রকৃতিই পারে মানুষকে পূর্ণাঙ্গ নির্মল আনন্দের ছোঁয়া দিতে।

-শামছুল হক রাসেল

4 comments:

Post a Comment