Thursday, October 21, 2010

রানী ভবানীর স্মৃতিচিহ্ন

0 comments
এককালের অর্ধে বঙ্গেশ্বরী নামে পরিচিত 'রানী ভবানীর' স্মৃতিবিজড়িত ছাতিয়ান গ্রামে তার স্মৃতিটুকু আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে মহীয়সী এই নারীর জন্মস্থান হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। ভেঙে ফেলা হয়েছে তার পিতৃগৃহ, যেখানে তিনি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। এখন তার পিতৃগৃহের ধ্বংসাবশেষ আছে মাত্র। ভেঙে ফেলা হয়েছে মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত জয় দুর্গা মন্দির এবং শিব মন্দির। এগুলো রক্ষার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কখনো। অথচ এলাকাবাসী এটি সংরক্ষণের দাবি করে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে। আদমদীঘি উপজেলা সদর থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে পাকা রাস্তার পাশে ছাতিয়ান গ্রাম। আজও তার সময় তৈরি করা ৩৬৫টি পুকুরে মাছ চাষ অব্যাহত রেখেছে এলাকার মানুষ। কেউ দখল কেউ বা লিজ নিয়ে আছে এসব সম্পদ। সপ্তদশ শতাব্দীর কথা; ছাতিয়ান গ্রামে ছিলেন ছোটখাটো জমিদার আত্মারাম চৌধুরী ও শ্রী জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানী। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। সন্তান লাভের আশায় জমিদার তার বাড়ির অদূরে নির্জন এক পুকুর পাড়ে ঈশ্বরের সাধনা শুরু করেন। শ্রী জয়দুর্গার গর্ভে জন্মেছিলেন এক কন্যাসন্তান। তার নাম রাখা হয় ভবানী। আত্মারাম চৌধুরী যে স্থানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন সে স্থানটি আজও সিদ্ধেশ্বরী নামে স্মৃতি বহন করে আছে। ভবানীর বয়স যখন ৯/১০ বছর; একদিন নাটোর রাজবাড়ির দেয়াল (মগনেহর) দয়ারাম নবাব আলীবর্দী খানের দরবার থেকে ফেরার পথে ছাতিয়ান গ্রামে এসে রাত হয়ে যায়। সেখানে তাঁবু ফেলা হয় রাত যাপনের জন্য। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস ছিল দয়ারামের। ভোরে তিনি শয্যা ত্যাগ করে বের হন তাঁবু থেকে। দেখেন ফুটফুটে একটি মেয়ে লালশাড়ি পরে পূজার জন্য ফুল তুলছে। দেওয়ান দয়ারামের পছন্দ হলো ওই মেয়েটিকে। তিনি পিছু নিলেন মেয়েটির। পৌঁছলেন তিনি আত্মারাম চৌধুরীর বাড়িতে। জানলেন মেয়েটি আত্মারাম চৌধুরীর। নাম তার ভবানী। দেওয়ান নাটোরের রাজকুমার রামকান্তের সঙ্গে ভবানীর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন আত্মারামের কাছে। তিনি ভবানীর মতামত জানতে গেলে ৩টি শর্তে বিয়েতে রাজি হন। প্রথম শর্ত ছিল বিয়ের পর তিনি এক বছর পিতার বাড়িতে থাকবেন। এক বছরে প্রতিদিন একটি করে পুকুর স্থাপনের জন্য ছাতিয়ান গ্রামে ৩৬৫টি পুকুর খনন করে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত ছিল ছাতিয়ান গ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত নতুন রাস্তা নির্মাণ করে পুরো রাস্তায় লাল সালুর কাপড় দিয়ে ছাউনি তৈরি করতে হবে। যার ভিতর দিয়ে স্বামীর বাড়ি যাবেন। তৃতীয় শর্ত ছিল এলাকার প্রজাদের ভূমি দান করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ছাতিয়ান গ্রামে ৩৬৫টি পুকুরের স্মৃতিচিহ্ন আজও বিদ্যমান। ছাতিয়ান গ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বদিকে যে রাস্তাটির স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে সে রাস্তাটির নাম ছিল ভবানীর জঙ্গল। ওই সড়কটি ছাতিয়ান গ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ থেকে প্রমাণিত হয় রাজকুমার রামকান্তের সব শর্ত পূরণ করে রানী বানিয়েছিলেন। ভবানীর বিয়ের পর মা জয়দুর্গা দেবী দেহ ত্যাগ করেন। রানী ভবানী তার মায়ের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য যে স্থানে তিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন যেখানে মন্দির তৈরি করেন। যার নাম ছিল জয়দুর্গা মন্দির। এই মন্দিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অষ্টধাতু নির্মিত এক দুর্গা প্রতিমা। রানী ভবানীর জন্ম হয়েছিল কৃষ্টামী তিথিতে। নিয়মিত পূজা ছাড়াও তিথিতে বিশেষ পূজা অর্চনা হতো। রানী ভবানী শিশুকাল থেকেই ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও মানবকল্যাণে নিয়োজিত। তার বিয়ের শর্তানুযায়ী ৩৬৫টি পুকুর এবং রাস্তাটি তার নিজের জন্য করেননি, করেছিলেন জনসাধারণের উপকারের জন্য। ১৭৪৮ সালে রাজ রামকান্তের মৃত্যুর পর রানী ভবানী নবাব আলীবর্দী খানের কাছ থেকে নাটোরের জমিদারির ভার গ্রহণ করেছিলেন। ১৮০২ সালে পর্যন্ত তিনি জমিদারি পরিচালনা করেন। প্রবাদ আছে, নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে কাশিমবাজার কুঠিতে যে ষড়যন্ত্র সভা হয়েছিল সেখানে রানী ভবানী আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি ইংরেজদের বিরোধিতা করেছিলেন এবং জমিদারদের খাল কেটে কুমির না আনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। নাটোরের বাজার কাচারি ছিল ছাতিয়ান গ্রাম। ১৯৫০ সালে সান্তাহারে সংঘটিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। জয়দুর্গা মন্দিরে অষ্টধাতুর দুর্গা নিরাপত্তার অভাবে তিনি নাটোরে নিয়ে যান। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সময় রানী ভবানীর জন্মস্থান ছাতিয়ান গ্রামের জয়দুর্গা মন্দির নাটোরসহ তার সময় নির্মিত সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পদ চয়েজ অব ল্যান্ড হিসেবে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও ছাতিয়ান গ্রামের জয়দুর্গা মন্দিরের বিশাল এলাকা রানী ভবানীর চয়েজ অব ল্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হত।



-নাজমুল হক ইমন

0 comments:

Post a Comment