Saturday, November 13, 2010

যৌনকর্মী

0 comments
যৌনকর্মীদের নিয়ে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত ধারাবাহিক আর্টিক্যালটি একত্রে এখানে সংগ্রহে রাখলাম। লিখেছেন জিন্নাতুন নূর।
১. নারী যৌনকর্মী
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার 'বারাঙ্গনা' কবিতায় নারী যৌনকর্মীদের 'মানুষ' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কবিতার প্রতিটি লাইনে ছিল পতিতালয় সম্পর্কে সমাজের মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ ও বিদ্রোহের স্পষ্ট প্রতিফলন। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে নারী যৌনকর্মীদের গণ্য করা হয় সামাজিকভাবে 'সুবিধাবঞ্চিত নারী' হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনেই পতিতাবৃত্তি বা কাজ হিসেবে যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তারপরও যৌনকর্মীরা এখনো তাদের পেশার স্বীকৃতি পাননি। এ পেশায় জড়িয়ে যৌনকর্মীদের সহ্য করতে হচ্ছে অসহনীয় কষ্ট। পেশাগত স্বীকৃতি ও সনদ ছাড়া তাদের এসব সমস্যা কখনো শেষ হওয়ার নয়।

ন্যাশনাল এইডস কমিটির ২০০৬-এর জরিপে জানা যায়, দেশে নারী যৌনকর্মীর সংখ্যা নব্বই হাজারেও বেশি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন এনজিওর তথ্যমতে, দেশে যৌনকর্মী রয়েছেন প্রায় দেড় লাখ। সেভ দ্য চিলড্রেন ইউএসএ ও আইসিডিডিআরবির তথ্যমতে, দেশের ১৪টি পতিতালয়ে রয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি যৌনকর্মী।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সচরাচর যৌনকর্মীরা গনোরিয়া, সিফিলিস, ক্ল্যামাইডা এবং ছত্রাক জাতীয় ইনফেকশনজনিত যৌনরোগে ভোগেন। অল্প বয়স্ক মেয়েদের মোটা করার জন্য নির্বিচারে ওরাডেকশন জাতীয় স্টেরয়েড-হরমোন জাতীয় ওষুধ বা ইনজেকশন দেওয়া হয়। এগুলো দীর্ঘদিন সেবনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়।

বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি, যেখানে যৌন পেশাকে অবৈধ বলা হয় না। বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনেই পতিতাবৃত্তি বা কাজ হিসেবে যৌনপেশাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাইতে প্রথম পেশাগত নারী যৌনকর্মীদের পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসনের নামে দেশের বৃহত্তম পতিতালয় টানবাজার ও নিমতলী থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০০-এর মার্চে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. ফজলুল করিম ও বিচারপতি এমএ ওয়াহাব মিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চের ঐতিহাসিক রায়ে জীবিকা বা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে যৌনকর্ম বেআইনি নয় বলে জানানো হয়।

যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন 'লাইট হাউস কনসোর্টিয়ামে'র ট্রেনিং বিশেষজ্ঞ সৈয়দ তাপস বলেন, বর্তমানে দেশে নারী যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয় হচ্ছে দৌলতদিয়ায়। সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে যৌনকর্মীরা এখনো পেশার স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মধ্যে এইডস সংক্রমণ কমেছে। যৌনকর্মীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই নাজেহাল হচ্ছেন। কয়েকবছর আগেও যৌনকর্মীদের মৃতদেহ দাফন করা যেত না। নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। রাজধানীর এক যৌনকর্মী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমার এ অবস্থার জন্য আমি সমাজ, সরকার, দেশ ও জাতিকে দোষারোপ করি। আমার মতো অভিভাবকহীন অসহায় মেয়েকে এ পেশায় আসতে বাধ্য করা হয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদফতর ভাসমান যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে। অধিদফতর এসব নারীকে 'সামাজিক প্রতিবন্ধী নারী' হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। দেশের ৬টি বিভাগে ১টি করে পুনর্বাসন কেন্দ্রে ১২০০ জন মেয়েকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন 'পায়েট বাংলাদেশ'। সংগঠনের উপপরিচালক জয়িতা সাহা বলেন, ২০০০ সালের দিকে যৌনকর্মীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বর্তমানে নারী যৌনকর্মীরা তাদের অধিকার রক্ষায় সচেতন। গত নির্বাচনে দেশের নারী যৌনকর্মীরা প্রথমবারের মতো ভোটার আইডি কার্ড পেয়েছেন, যা একজন নাগরিক হিসেবে যৌনকর্মীদের অস্তিত্ব নিশ্চিত করবে।

'মানুষের জন্য' ফাউন্ডেশনের সেক্স ওয়ার্কার ইনটারভেশন প্রোগ্রামের ম্যানেজার মহুয়া ফানিয়া বলেন, মাস্তান ও পুলিশ কর্তৃক যৌনকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হন। রাজনৈতিকভাবেও তারা হুমকির সম্মুখীন। তাদের রোজগারের বড় একটি অংশই পুলিশ বা মাস্তানদের পকেটে যায়। সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হলেও যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে এ কথার বাস্তব প্রতিফলন নেই।

২.পুরুষ যৌনকর্মী

জীবিকা অর্জন ও জৈবিক চাহিদা পূরণে নারীর পাশাপাশি পুরুষরাও এখন যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। জাতীয় এইডস কমিটির তথ্যে দেশে পুরুষ যৌনকর্মীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। পুরুষ যৌনকর্মীদের বলা হয় এমএসএম (মেইল টু মেইল সেক্স)। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত এ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব জানা যায়নি। পেনাল কোড ৩৭৭ ধারায় স্বীকার করা হয়েছে, অল্পসংখ্যক মানুষ মেইল টু মেইল সেক্সে জড়িত। মোট পরিসংখ্যানের ২ থেকে ৩ শতাংশ যদি এমএসএম হয় তাহলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার। পুরুষ যৌনকর্মীরা আত্মগোপনে থাকায় আড়ালেই থাকছে তাদের পেশার স্বীকৃতি, অধিকার ও স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য বিষয়।

এমএসএমদের মধ্যে যে পুরুষ মেয়ের ভূমিকা পালন করেন তাকে বলা হয় 'কথি'। যে পুরুষ ছেলের ভূমিকা পালন করেন তাকে বলা হয় 'পান্থি' এবং কথি'র ভালোবাসার লোক হচ্ছেন 'পারিক'। এদের মধ্যে একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকেই যৌনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। এদের এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকির হার অন্য যৌনকর্মীদের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যসেবায় প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে 'ড্রপ ইন' এদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। জাতীয় এইডস প্রোগ্রামের ডেপুটি ম্যানেজার ডা. হাসান মাহমুদ বলেন, এ জনগোষ্ঠীর এইচআইভি সংক্রমণের হার ১ শতাংশের নিচে। মহাখালী মেরী স্টোপস ক্লিনিকের প্রোগ্রাম অফিসার ডা. হাফিজুর রহমান জানান, তারা পুরুষ যৌনকর্মীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। লাইট হাউসের এইচআইভি প্রোগ্রামের প্রকল্প কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, অন্যান্য দেশে এমএসএমদের স্বীকৃতি ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করা হলেও সামাজিক প্রতিকূলতায় তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। তবে তারা হিজড়াসহ পুরুষ খদ্দেরদের সঙ্গে যৌনকর্মে অংশ নিচ্ছেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের সহকারী ম্যানেজার এএসএম রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, দেশের HATI(HIV/AIDS Target Intervention) প্রোগ্রামে তাদের কথা সর্বপ্রথম গুরুত্ব পায়।

৩. শিশু-কিশোরী
বাংলাদেশে শিশু-কিশোরীদের যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অল্পবয়সীদের চাহিদা থাকায় শিশু-কিশোরীদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করা হয়। জরিপে দেখা যায়, যৌনকর্মীদের বয়স ১৬ বছর বা তার কম। এর অন্যতম কারণ খদ্দেররা মনে করেন শিশু-কিশোরীদের থেকে যৌন রোগে সংক্রমণের আশঙ্কা প্রাপ্ত বয়সীদের তুলনায় কম। এ পেশায় তাদের সহজে ও ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যায়। এর প্রেক্ষিতে অল্প বয়সী মেয়েদের যোগান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে দেশি-বিদেশি পতিতালয়ে মেয়ে শিশু পাচার। এছাড়া যৌনকর্মীরাও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে গর্ভজাত বা পালক মেয়েদের পতিতাবৃত্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দারিদ্র্যের শিকার শিশু-কিশোররা অন্ন-বস্ত্র ,যত্ন ও নিরাপত্তার অভাবে অল্পবয়সেই পতিতালয়ে পেঁৗছায়। পায়েট বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর জয়িতা সাহা জানান, দেশের সর্ববৃহৎ দৌলতদিয়া পতিতালয়ের বড় একটি অংশই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। এনজিও লাইট হাউস কনসোর্টিয়াম-এর বিশেষজ্ঞ সৈয়দ তাপস বলেন, পূর্বের তুলনায় অল্পবয়সী মেয়েদের এ পেশায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে বেশি। তিনি বলেন, আইনে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পতিতাবৃত্তি করা নিষিদ্ধ হলেও আইনের রক্ষকরাই এর অপব্যবহার করছেন। দেখা যায়, অপ্রাপ্ত বয়সী যৌনকর্মীদের ধরা পড়ার পর সর্দারনিরা মার দাবিতে কোর্টে গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনে।

এনজিও কর্মীরা জানান, কিশোরীদের শরীর বড় করার জন্য ট্যাবলেট খাওয়ানোয় তারা ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। শহরের রাস্তায় যারা ফুল, পানি, বাদাম বিক্রি করে তাদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা না থাকায় পার্কের দারোয়ান কর্মচারীদের নির্যাতনের শিকার হয়ে এই পেশায় জড়িয়ে যায়। ঢাকার কাওরান বাজারের এক ফুল বিক্রেতা কিশোরী শিলা জানায়, ঢাকায় আইস্যা ফুল বিক্রি কইরা খাই। একদিন এক ব্যাডা আমারে টাকা দেওয়ার লোভ দেখাইয়া খারাপ কাম করে। এরপর থেইক্যা প্রায়ই আমারে ডাক দেয়। পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীর প্রায় ১৫ হাজার পতিতার রয়েছে ৫ হাজার সন্তান। মোহাম্মদপুরের দুর্জয় শিশু যত্ন কেন্দ্রে তাদের যত্ন দেওয়া হয়। এই শিশুরা চরম অবহেলিত ও নির্যাতনের শিকার । জন্ম নিবন্ধনে মা-বাবার নাম না থাকায় এই শিশুরা রাষ্ট্রে অদৃশ্য। অনেক শিশুদের মা তাদের সামনেই যৌনকাজ করে যা এই বাচ্চাদের মানসিক উন্নয়নে বাধা দেয়।

0 comments:

Post a Comment