Sunday, December 12, 2010

মাহিসন্তোষ, নওগাঁ

0 comments
মাহিসন্তোষ নওগাঁ জেলায় অবস্থিত পুরাকীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলায় এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিটির অবস্থান। ঐতিহাসিক প্রত্নস্থল মাহিসন্তোষ ধামইরহাট উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তঘেঁষা চৌঘাট মৌজায় অবস্থিত। ধামইরহাট সদরের ফারসিপাড়া নামক স্থান থেকে পশ্চিমমুখী একটি কাঁচা সড়ক ধরে ৬ কিলোমিটার চলার পর প্রত্নস্থলটিতে পৌঁছানো যায়। প্রত্নস্থলটিতে বর্তমানে একটি মাঝারি আকারের পাঁচিল ঘেরা চতুষ্কোনাকার দুর্গ রয়েছে। কয়েকটি দিঘি, পুকুর, রাজবাড়ি ও বারোদুয়ারী নামের একটি ঢিবি এবং একটি মাজার রয়েছে। দুর্গের উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তঘেঁষা একটি প্রশস্ত খাল রয়েছে।

প্রত্নস্থলটির উত্তর প্রান্তে চারটি অসম বাহুর সমন্বয়ে এ দুর্গটি গঠিত। চতুষ্কোণ দুর্গটির পূর্ব বাহু ২৩২ মিটার, দক্ষিণ বাহু ১৯২ মিটার লম্বা। মাটির পাঁচিলগুলো আজও ৩.৫ মিটার উঁচু এবং ১৬.৭৬ মিটার চওড়া। দুর্গের বাইরে পূর্ব দিকে পুরোপুরি এবং উত্তর দিকে কয়েক মিটার ঘিরে যে সংলগ্ন খাল রয়েছে সেটি গড়ে ২৫ মিটার চওড়া এবং ২.৭৫ মিটার গভীর। দুর্গের ভেতরের অংশের জমিপিঠ এবড়ো-থেবড়ো। বিভিন্ন স্থানে পাটকেল ও খোলামকুচির ঘন সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়।

দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষে বাইরের দিকে মাজার নামে একটি স্থান রয়েছে। এর ভেতরে পাশাপাশি দুটি কবর রয়েছে। লোকে বলে এ দুটি কবর মাহিসন্তোষ ও তার কন্যার কবর। এছাড়া মাজারের বাইরে আরও একটি কবর রয়েছে। কবরটি হলো এক উজিরের। কবরটি ১৪ হাত লম্বা। যা কোথাও কোনোদিন দেখা যায়নি। এ মাজারের সামান্য পশ্চিমে আরও কয়েকটি পুরনো কবরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। লোকে বলে এগুলোও উজিরের কবর। উজিরের কবরের দক্ষিণ-পূর্বে রাজবাড়ি। সম্প্রতি এগুলোকে ঘিরে নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তবে এ মাহিসন্তোষের ইতিহাস জানার মতো কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। অতীতে এ স্থান থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৫ শতকের চারটি আরবি লিপি পাথরে উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এ স্থানে সম্প্রতি কাঁচা মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। তবে পশ্চিম দিকে একটি অবতল মেহরাবসহ উত্তর-দক্ষিণে লম্বা একটি ভাঙা ইটের দেয়ালের চিহ্ন দেখা যায়। দেয়ালটির কয়েকটি স্থানে পাথরের বহিরাবণের চিহ্নও রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালের সমান্তরালে কিছুদূর পূর্বে এক সারি (বর্তমানে দুইটি) পাথরের থামও দাঁড়ানো রয়েছে। এ প্রত্নস্থলে ১৯১৮ সালে তদানীন্তন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি সীমিত আকারের একটি খননও পরিচালনা করেছিল। ওই সময় এ ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি পাথরের উৎকীর্ণ অবতল মেহরাব সংগ্রহ করে ওই সমিতির রাজশাহীস্থ সংগ্রহশালায় (বর্তমানে বরেন্দ্র জাদুঘর) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই সময় প্রথম ধ্বংসস্তূপটি থেকে ১৫০৬-১৫০৭ সালের জনৈক সুহাইলের পুত্রের নিমির্ত একটি মসজিদ সম্পর্কিত আরবি ভাষ্য উৎকীর্ণ একটি পাথরের ফলক আবিষ্কৃত হয়েছিল। সেটি বর্তমানে রাজশাহী শহরের বরেন্দ্র জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

বারোদুয়ারী রাজবাড়ি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উত্তর-পূর্বে মিঠাপুকুর এবং দক্ষিণ-পূর্বে সরকপুকুর নামে দুটি পুকুর রয়েছে। এছাড়া গোটা এলাকায় আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ইট-পাটকেলসহ অজস্র খোলামকুচি ও পাথর খণ্ড।

মাহিসন্তোষের সঠিক ইতিহাস জানার মতো কোনো কিছুই বর্তমানে সেখানে নেই। তবে চৌঘাট বা এর আশপাশে প্রাক-ইসলামী আমল থেকেই কোনো না কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল। সেই কেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষের উপরই খ্রিস্টাব্দ ১৩ শতকের মুসলিম বিজেতারা কোনো একটি সেনাশিবির গড়ে তুলেছিলেন। সেই সেনাশিবির অন্তত খ্রিস্টাব্দ ১৬ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত এটি প্রশাসনিক কেন্দ্রের পাশাপাশি একটি ধর্মীয় কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছিল। আবার অনেকের বিশ্বাস, বখতিয়ার খিলজি আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত ইজউদ্দীন মোহাম্মদ শিরান খিলজি (খ্রিস্টাব্দ ১২০৭ থেকে ১২০৮ সাল) এখানেই একইভাবে নিহত ও কবরস্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া এটি ছিল সুলতানী আমলের বারবকাবাদ প্রশাসনিক এলাকার টাকশাল। এ ঐতিহাসিক প্রত্নস্থলটি জেলার মধ্যে অন্যতম।

-বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

0 comments:

Post a Comment