Saturday, December 18, 2010

জিঞ্জিরা প্রাসাদ

0 comments
নবাব সিরাজদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে মীরজাফরের নির্দেশে নবাব আলীবর্দী খাঁর বিধবা স্ত্রী শরীফুন্নেসা, তাঁর দুই মেয়ে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগম এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে এ প্রাসাদে বন্দি করা হয়। বস্তুত ঘসেটি বেগমকে এখানে বন্দি করার কারণেই প্রাসাদটি নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
বড় একটি জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক প্রাচীন প্রসাদের ধ্বংসাবশেষ। এখন আর বোঝার উপায় নেই একসময় এখানে একটি সুরম্য প্রাসাদ ছিল। অথচ এ প্রাসাদেরই ইতিহাসখ্যাত ঘসেটি বেগমকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। তাঁর জীবনের শেষদিনগুলো কেটেছে এখানেই।
মোগল শাসনামলে সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ বুড়িগঙ্গার ওপারে ১৬২০ সালে রঙমহল আদলে এ সুরক্ষিত প্রাসাদ নির্মাণ করেন। নিরিবিলি পরিবেশে নির্মিত চারদিকে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত এ প্রাসাদে ছিল নাচঘর, গুপ্ত কক্ষ, বিশ্রাম কক্ষ, হাম্মামখানা, প্রহরী কক্ষ এবং বেশ উঁচু একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। ইব্রাহিম খাঁর মৃত্যুর পর ঢাকার সুবেদার ও ফৌজদাররা এ প্রাসাদটি অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহার করতেন। পরে এটি অভিজাতদের কয়েদখানা হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। সিংহাসন বা ক্ষমতার জন্য হুমকি হতে পারে_এমন কাউকে অথবা অভিজাত পরিবারের বখে যাওয়া তরুণদের এখানে বন্দি করা হতো। লোকজন দেখত প্রায়ই কোনো ব্যক্তিকে জিঞ্জির (লোহার শিকল) দিয়ে বেঁধে রাজকীয় নৌকা থেকে নামিয়ে এ প্রাসাদে বন্দি করা হচ্ছে। এ জিঞ্জির থেকেই এলাকাটি পরবর্তীকালে জিঞ্জিরা নামে পরিচিত হয়।
নবাব সিরাজদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে মীরজাফরের নির্দেশে নবাব আলীবর্দী খাঁর বিধবা স্ত্রী শরীফুন্নেসা, তাঁদের দুই মেয়ে ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগম (সিরাজের মা) এবং সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে এ প্রাসাদে বন্দি করা হয়। বস্তুত ঘসেটি বেগমকে এখানে বন্দি করার কারণেই প্রাসাদটি নিয়ে সর্বমহলে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।
সিরাজের ফুপু ঘসেটি বেগম ছিলেন দুর্বিনীত, কুটিল, অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু এক চরিত্র। দেশ ও পরিবারের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজ স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি যে ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছিলেন, শেষমেশ বুমেরাং হয়ে তা তাঁকেই ঘায়েল করেছিল।
নবাব আলীবর্দী খাঁর কোনো ছেলেসন্তান ছিল না। তিনি তাঁর তিন কন্যাকে অগ্রজ হাজি আহমদের তিন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ঘসেটি বেগমের (মেহেরুন্নেসা) সঙ্গে বিয়ে হয় নওয়াজিশ মুহম্মদ শাহমত জংয়ের। নবাব আলীবর্দী এ আদরের মেয়ের ইচ্ছায় জামাতা শাহমত জংকে ঢাকার নায়েব নাজির নিযুক্ত করেন। ঢাকায় আসার পর ঘসেটি বেগম ব্যক্তিগত প্রভাববলয় তৈরি করেন। মূলত তিনিই পেছন থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন। নিঃসন্তান ঘসেটি বেগম এ সময় সিরাজের অনুজ একরামদ্দৌলাকে পালক ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন। একরাম ঢাকায় এসে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর কিছুদিন পর শাহমত জংও মারা যান। ফলে ঘসেটি বেগম তাঁর স্বামী ও সন্তানের রেখে যাওয়া বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী হন।
এদিকে মৃত্যুর আগে নবাব আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। নবাব পদে সিরাজকে মনোনীত করায় ঘসেটি বেগম, মীরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখ সহজভাবে নিতে পারেননি। তাই তিনি সিরাজকে ঠেকাতে মীরজাফর, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ প্রমুখের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তোলেন।
এবার নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরোধের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এদিকে মীরজাফর সিরাজের পারিবারিক কলহকে কাজে লাগিয়ে অগ্রসর হন এবং ইংরেজদের সঙ্গে চক্রান্ত করে পলাশীর যুদ্ধে নবাব বাহিনীকে পরাজিত করেন। সিরাজ আত্দরক্ষার্থে পাটনায় যাওয়ার পথে ঘাতকের হাতে নিহত হন। বাংলার সিংহাসনে বসেন মীরজাফর।
কিন্তু মীরজাফর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করার জন্য ঘসেটি বেগম এবং সিরাজের মা আমেনা বেগমকে বন্দি করেন রাজমহলে। কিন্তু সেখানেও তাঁকে নিরাপদ মনে না করে কিছুদিন পর তাদের জিঞ্জিরার নিভৃত ওই প্রাসাদের গুপ্ত কক্ষে বন্দি করা হয়। দীর্ঘদিন ঘসেটি বেগম এ প্রাসাদে অন্তরীণ থাকেন।
তারপর একদিন মীরন ঘসেটি বেগমসহ সব বন্দিকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের কথা বলে এক বিশ্বস্ত অনুচরকে ঢাকা পাঠায়। মীরনের পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন ঘসেটি বেগম, আমেনা বেগম, শরীফুন্নেসা ও লুৎফুন্নেসাকে বন্দি অবস্থায় একটি রাজকীয় নৌকায় তোলা হয়। ওই নৌকাটি বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যার ত্রিমোহনায় এলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আর এভাবেই সলিলসমাধি ঘটে নবাব পরিবারের সব সম্ভ্রান্ত মহিলার। রচিত হয় ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়।
ঘসেটি বেগমের করুণ মৃত্যুর পর প্রাসাদটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। দিনের বেলাও ভয়ে সেখানে যেত না কেউ। জনশ্রুতি আছে, এখানে নাকি ঘসেটি বেগমের চাপা কান্না শোনা যেত। এভাবে শতাধিক বছর অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থেকে একসময় পুরো প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে। এখন এর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গড়ে উঠেছে দালানকোঠা। তার পরও দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ ঘসেটি বেগমের স্মৃতিবিজড়িত প্রাসাদটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে আসেন।

সূত্রঃ কালের কন্ঠ


0 comments:

Post a Comment