Wednesday, January 5, 2011

তিব্বত

0 comments
বহির্বিশ্বের কাছে বছরের পর বছর ধরে এক নিষিদ্ধ" বিস্ময়ের নাম তিব্বত। হাজার হাজার কিলোমিটার চলে যাওয়া ঊষর, রুক্ষ, পাথুরে ভূমি আর পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোকে বুকে ধরা বরফগলা রুপালি নদীর সমন্বয়ে গঠিত এ বিস্ময়ভূমির এই তিব্বত। সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে নিষিদ্ধ দেশ তিব্বত আর নিষিদ্ধ নগরী তিব্বতের রাজধানী লাসার কথা পড়েনি এমন কেউ নেই। কেন তিব্বতকে নিষিদ্ধ দেশ বলা হয়? কী এমন গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা তিব্বতের অবয়ব? অবাক করা, জাদুময় রহস্যমন্ডিত ভূখণ্ড তিব্বতের নানা দিক নিয়েই এ প্রতিবেদন।

হিমালয়ের উত্তরে ছোট একটি দেশ হলো তিব্বত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ দালাইলামা কর্তৃক প্রবর্তিত গণচীনের একটি স্বশাসিত অঞ্চল এটি। মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত এ অঞ্চলটি তিব্বতীয় জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। তিব্বত তার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো মালভূমিগুলোর জন্য জগদ্বিখ্যাত। এখানকার মালভূমির গড় উচ্চতা ১৬,০০০ ফুট; যার কারণে এই অঞ্চলকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়।

তবে এখানকার অনেক তিব্বতীয় এই অঞ্চলকে গণচীনের অংশ মানতে রাজি নয়। ১৯৫৯ সালে গণচীনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যর্থ হয়। তখন দালাইলামার নেতৃত্বে অসংখ্য তিব্বতি ভারত সরকারের আশ্রয় গ্রহণপূর্বক হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে স্বাধীন তিব্বতের নির্বাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিব্বতের রাজধানীর নাম লাসা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই বৌদ্ধ"ধর্মাবলম্বী।

চিরতুষারে ঢাকা তিব্বত পৃথিবীর উচ্চতম স্থানও বটে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অনেক রহস্য। তিব্বতের রাজধানী লাসা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে বহির্বিশ্বের লোকের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। দেশটি পৃথিবীর অন্যান্য সব অঞ্চল থেকে একেবারেই বিচ্ছন্ন ছিল। লাসা নগরীর বিখ্যাত পোতালা প্রাসাদের ছবি প্রথমবারের মতো নজরে আসে ১৯০৪ সালে। আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় এই ছবি ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সভ্য মানুষ এই বিশাল প্রাসাদের ছবি দেখেনি। তিব্বতের চতুর্দিকে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাহাড়ি গুম্ফা। সেই পাহাড়ি গুম্ফাগুলোতে বাস করে বৌদ্ধ পুরোহিত লামারা। গুম্ফাগুলো নিয়েও রহস্য আর জল্পনা-কল্পনার কোনো শেষ নেই। বাইরের পৃথিবীতে তিব্বত যেন চেনা পৃথিবীর এক অচেনা অধ্যায়। এই জায়গাটা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিচিত্র সব ধারণা। রহস্যঘেরা তিব্বত নিয়ে পৃথিবীর মানুষের তাই কৌতূহলের শেষ নেই। সত্যিই কী আছে এই নিষিদ্ধ দেশটায়?

তিব্বতের মতো অজ্ঞাত দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ দেশটি সম্পর্কে কিছুই যেন জানা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্গমতার জন্যই তিব্বত অপরিচিত থেকে গেছে। রাজধানী লাসা থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের মাঝেই আছে বিরাট গোবি মরুভূমি। সেদেশের বেশিরভাগ স্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০০ ফুটেরও ওপরে। বছরের প্রায় ৮ মাস জায়গাটি তুষারে ঢেকে থাকে। ধর্ম তিব্বতীদের সামাজিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাদের প্রধান ধর্মগুরুর নাম দালাইলামা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সেখানে লামা বলে পরিচিত। এর অর্থ হচ্ছে সর্বপ্রধান। দালাই শব্দের অর্থ হলো জ্ঞানসমুদ্র। দালাইলামার মানে হচ্ছে জ্ঞানসমুদ্রের সর্বপ্রধান। তিনি বাস করবেন সোনার চূড়া দেওয়া রহস্যময় পোতালা প্রাসাদে। ১৩৯১ সালে প্রথম দালাইলামার আবির্ভাব ঘটে। দালাইলামাকে তিব্বতীরা বুদ্ধের অবতার মনে করেন। তিব্বতীদের বিশ্বাস, যখনই কেউ দালাইলামার পদে অভিষিক্ত হন তখনই ভগবান বুদ্ধের আত্মা তার মধ্যে আবির্ভূত হয়। এক দালাইলামার মৃত্যুর পর নতুন দালাইলামার নির্বাচন হয়। এটি একটি রহস্যময় এবং রোমাঞ্চকর পদ্ধতি। বর্তমান দালাইলামা রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরী। তিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন। বিশ্ব শান্তির জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

তিব্বতীদের দালাইলামা বা নেতা নির্বাচনের পদ্ধতিটি খুবই বিচিত্র। তিব্বতি প্রথা মতে কারো মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তার মরদেহের সৎকার হয় না। তাদের দৃড় বিশ্বাস, মৃত্যুর পরও আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডলে বিচরণ করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা জাগতিক পরিমণ্ডল ত্যাগ না করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মরদেহটি তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। কোনো লামার মৃত্যু হলে লাসার পূর্বে লহামপূর্ণ সরোবরের তীরে লামারা ধ্যান করতে বসে। তারা এক রহস্যময় কারণে কিছু অদ্ভুত বিশ্বাসকে লালন করে। ধ্যানযোগে লামারা দেখতে পায় সেই সরোবরে স্বচ্ছ পানির ওপর ভেসে উঠছে একটি গুম্ফার প্রতিবিম্ব। যে গুম্ফার পাশে আছে একটি ছোট্ট বাড়ি। প্রধান লামা তার সেই অলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা দৃশ্যের মাধ্যমে এঁকে দিবেন। বড় বড় লামারা সেই দৃশ্যের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। তারপর কয়েকজন লামা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন স্থানে যায় শিশু অবতারের খোঁজে। বর্তমান দালাইলামাকে পাওয়া গিয়েছিল এমনি এক পদ্ধতির মাধ্যমে। খোঁজ চলাকালীন একটি দল উত্তর-পূর্বে আম দো প্রদেশের অন্তর্গত দো খাম জেলার তাকসের গ্রামে পেঁৗছে দূর থেকে একটি গুম্ফা দেখতে পেলেন। সেখানেই ছোট্ট একটা কুটির। অবিকল যেন সেই প্রধান লামার এঁকে দেওয়া ছবিটির মতো। দলনেতা এবার একজন সঙ্গী লামাকে গুম্ফার অদূরে ওই বাড়িটিতে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য পাঠালেন। লামাটি ফিরে এসে জানালেন, ওই কুঠিরে একজন কৃষক সপরিবারে বাস করেন এবং তার ছোট ছেলেটির বয়স দু'বছর। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল লামাদের মুখ। তারা তাহলে সঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আশ্চর্যের কথা, সেখানে যাওয়ামাত্র সেই দু'বছরের শিশুটি এসে দলনেতা লামাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন তিনি তার কতকালের চেনা। এবার শুরু হলো আসল পরীক্ষা। লামারা শিশুটির শরীরের বিভিন্ন লক্ষণ দেখে বুঝলেন। শিশুটি অত্যন্ত সুলক্ষণযুক্ত। ত্রয়োদশ দালাইলামার ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র তারা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। জপের মালা, ধর্মচক্র, টুপি, পোশাক, লাঠি ইত্যাদি। ওই জিনিসগুলোর সঙ্গে একই রকম মালা, লাঠি ইত্যাদি মিলিয়ে শিশুটির সামনে রাখা হলো। দু'বছরের ছোট শিশুটি কিন্তু সঠিকভাবে ত্রয়োদশ দালাইলামার জিনিসগুলোই বেছে নিলেন। এভাবে পরীক্ষা ও প্রমাণ শেষ হলে সন্তুষ্ট লামারা ত্রিরত্নের শরণ নিলেন এবং তাদের অভিপ্রায় শিশুটির পিতার কাছে জানালেন। তিব্বতি পিতা-মাতার কাছে এ যেন মহাপুণ্যের ফল। সামান্য কৃষক তারা, তাদের ঘরে কিনা জন্ম নিয়েছেন স্বয়ং দালাইলামা। এরপর সেই অবতার শিশু ও তার পরিবারের লোকজন সবাইকে নিয়ে লামারা রাজধানী লাসার উদ্দেশে রওনা হলেন। লাসায় পৌঁছানোর পর জনসাধারণ বিপুল উল্লাসে অভ্যর্থনা জানালেন শিশু অবতারকে। কিন্তু সেখানেও আরও অনেক পরীক্ষা দিতে হলো শিশুটিকে। অবশেষে লামারা নিশ্চিন্ত হলেন যে, এই শিশুই দালাইলামা। অন্যদিকে শুরু হলো শিশু অবতারের বিভিন্ন শিক্ষা।

শোনা যায় এখনো তিব্বতে প্রেতাত্মার সন্ধানে বহু লামা ঘুরে বেড়ায়। প্রেতাত্মা নিয়ে লামাদের চিন্তার শেষ নেই। প্রেতাত্মাদের লামারা ভীষণ ভয়ও পায়। সেজন্য প্রেতাত্মা থেকে রক্ষা পেতে তারা নানা ক্রিয়াকলাপ করে। প্রেতাত্মাদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। অধিকাংশ তিব্বতীর ধারণা_ মানুষের মৃত্যুর পর দেহের ভেতর থেকে প্রেতাত্মারা মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওই প্রেতাত্মার সদ্গতি হওয়ার আগ পর্যন্ত সে মানুষের ক্ষতি করার জন্য ঘুরে বেড়ায়। কখনো মানুষের ওপর ভর করে, কখনো পশু-পাখি কিংবা কোনো গাছ অথবা পাথরের ওপরও ভর করতে পারে। আর সে জন্য প্রেতাত্মাদের খুশি রাখতে তিব্বতীরা পূজা করে। এ পূজারও রয়েছে বিশেষ লগ্ন। ওই লগ্নে বিশেষ মুখোশ পরে ভূত-পিশাচ সেজে পূজা করে তারা।

এসব অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের বাইরেও তিব্বতের সামাজিক একটা অবস্থা রয়েছে। আর তিব্বতের সামাজিক অবস্থার কথা বলতে গেলে বলতে হবে এমন এক সমাজের কথা, যা কিনা গড়ে উঠেছিল আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগে। তখন পীত নদীর উপত্যকায় চীনারা জোয়ার ফলাতে শুরু করে। অন্যদিকে আরেকটি দল রয়ে যায় যাযাবর। তাদের মধ্য থেকেই তিব্বতী ও বর্মী সমাজের সূচনা হয়। চীনের হান ও অন্যান্য প্রদেশের সমাজ থেকে এদের সমাজ বিকাশের ধারা ছিল আলাদা। ইয়ারলুং নদী উপত্যকায় প্রথমবারের মতো এ সভ্যতার গোড়াপত্তন শুরু হয়। এখানকার শাসক সোং সান গাম্পো যখন সাম্রাজ্য গড়তে শুরু করলেন, তার সৈন্যরা কালিম্পং, লে, উলান বাটোর, সিয়ান, কুমবুম এবং তাশখন্দ পর্যন্ত ক্ষমতাকে বিস্তৃত করল। আজ সেই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সামাজিক তিব্বতের অস্তিত্ব সেসব জায়গায় আজো টিকে রয়েছে।

সরকারি ভাষা হিসেবে চীনা ভাষার প্রচলন থাকলেও তিব্বতীদের ভাষার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। তাই চীনের বেশ কিছু প্রদেশ এবং ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে তিব্বতী ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভাষার আলাদা আলাদা ধরন রয়েছে। জনজাতি হিসেবে জোংখা (ভুটানি), সিকিমি, শেরপা এবং লাদাখিরা যে ভাষায় কথা বলে, তার সঙ্গে তিব্বতী ভাষার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তিব্বতী ভাষার নিজস্ব লিপি এবং লিখন পদ্ধতি রয়েছে। সর্বত্র হয়তো সে লিপির ব্যবহার নেই; তবে মূল ভিত্তি কিন্তু এ ভাষাই। এখানকার প্রাচীন ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম এখানে এসে আরও প্রাচীন প্রকৃতি-পূজা (যা 'বন' ধর্মের মধ্যে রয়েছে) ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লেষের ফলে অদ্ভুত এক ভিন্ন তিব্বতী চরিত্র ধারণ করেছে। আজকের তিব্বত আন্দোলনের সমাবেশে সর্বত্রই হয়তো এই তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের কিছু আচরণ যেমন- মশাল বা প্রদীপ জ্বালানো, প্রার্থনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেবল ধর্মের বন্ধন দিয়ে এই সমাজ বা তার রাজনীতিকে বোঝা মুশকিল হয়।

ঠিক তেমনি বোঝা মুশকিল তিব্বতীদের অদ্ভুত রীতি। তিব্বতীরা দেবতার চেয়ে অপদেবতার ভয়েই তটস্থ থাকে বেশি। অপদেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য বিচিত্র সব কাণ্ড-কীর্তি করে এরা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কোনো কোনো তিব্বতীর বাড়িতে বিপুলাকার কুকুরের চামড়ায় ভুসি ভরে দেয়ালে টাঙানো। কোথাও এ রকম ভালুক কিংবা ইয়াকের চামড়া লাগানো থাকে। তিব্বতীদের বিশ্বাস_ এসবের প্রভাবে বাড়িতে অপদেবতাদের উপদ্রব বন্ধ থাকবে।

মজার ব্যাপার হলো, তিব্বতীরা নাকি উকুন খায়। একাধিক পর্যটকের বিবরণ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বছর পঞ্চাশেক আগে এক পর্যটক সেই নিষিদ্ধ দেশে গিয়ে এ দৃশ্য দেখে লিখেছিলেন, "তিব্বতীরা সহজে গোসল করতে চায় না। শুকনো থাকার মধ্যে তাদের একরকম স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। তবে সেজন্য তাদের ভোগান্তিরও শেষ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেকের দেহেই উকুন বাসা বাঁধে। মেয়েদের পরনে থাকে গরম কাপড়ের ছুপা, উপরে চাপানো থাকে রেশম, এন্ডি অথবা মুগার রঙিন জ্যাকেট। সেই সঙ্গে থাকে সুতির ঘাঘরা। পোশাকের যে অংশ গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকে, উকুন সেখানেই বাসা বাঁধে। সেদিন এক যুবতী আমাদের সামনে তার জ্যাকেট খুলে কালো কালো মুসুরি দানার মতো উকুনগুলো ধরে খেতে লাগল।" পরে আরও একজনকে উকুন খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে, সেও স্বীকার করেছিল। বলেছিল, 'এদেশের সর্বত্রই উকুন খাওয়ার রেওয়াজ আছে। আর উকুন খেতে একটু টক লাগে'।

ঐতিহ্যগত তিব্বতী সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যাযাবর বা রাখাল জীবনযাপন। ভেড়া, ছাগল, ইয়াক ও ঘোড়া পালন তাদের প্রধান জীবিকা। শুধু চীনের তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার (২০০০ সালের হিসেবে) ২৪ শতাংশ এই যাযাবর রাখাল সম্প্রদায়। এরা কখনো চাষাবাদের কাজ করে না। মোট ভূমির ৬৯ শতাংশ এলাকা চারণ বা তৃণভূমি। কৃষিজমি আয়তনে বেশ কম, এখন তার ফলন বাড়লেও এলাকা বাড়ার সুযোগ নেই। প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারণে চারণভূমিকে চাষের উপযোগী করে তোলার কোনো চেষ্টা আজো তারা করেনি। জমিতে বার্লি, গম, রাই, আলু এবং কিছু বিশেষ ধরনের ফল ও সবজি ফলানো হয়। রোমশ চমরি গরু তিব্বতীদের কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জন্তু। এগুলো ছাড়া তিব্বতীদের জীবন যেন অচল। এদের সারা শরীর পশমে ঢাকা থাকে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এদের দিয়ে মাল বহন করা হয়। তিব্বতে বেশ বড় বড় কুকুর রয়েছে। শীতকালে সেখানকার কুকুরের গায়ে বড় বড় লোম জন্মায়, যার জন্য ওদের ঠাণ্ডা লাগে না। গ্রীষ্মে সেগুলো আবার ঝরে পড়ে। চীনা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখে তিব্বতীরাও ভীষণ চা-প্রিয়। তাদের বিশেষ চায়ে মেশানো হয় মাখন এবং লবণ। তবে তিব্বতীদের প্রধান খাবার হলো চমবা। গম এবং যবকে ভেজে পিষে নিয়ে চমবা তৈরি করে। আর চমবা তারা লবণ ও মাখন মিশিয়ে খায়। খাবারপাত্র হিসেবে ব্যবহার করে কাঠের পেয়ালা।

সম্রাট সগেন পো তিব্বতের রাজধানী লাসা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট একটি বিরাট জলাশয় ভরাট করে প্রাসাদ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতের বিভিন্ন মন্দিরের ভেতর সোনার তৈরি বড় বড় প্রদীপ মাখন দিয়ে জ্বালানো থাকে। ৪ হাজার ভরি ওজনের একটি প্রদীপও সেখানে রয়েছে। এই দুর্গম রহস্যময়ী দেশটির প্রতি অভিযাত্রীদের কৌতূহলও প্রচুর।

তিব্বতীদের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আচার হলো মৃতদেহের সৎকার। এদের মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি খুব অদ্ভুত। কোনো তিব্বতী যদি মারা যায়, তবে ওই মৃতদেহ কাউকে ছুঁতে দেওয়া হয় না। ঘরের এক কোণে মৃতদেহটি বসিয়ে চাদর অথবা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মৃতদেহের ঠিক পাশেই জ্বালিয়ে রাখা হয় পাঁচটি প্রদীপ। তারপর পুরোহিত পোবো লামাকে ডাকা হয়। পোবো লামা একাই ঘরে ঢোকে এবং ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর পোবো মন্ত্র পড়ে শরীর থেকে আত্মাকে বের করার চেষ্টা করে। প্রথমে মৃতদেহের মাথা থেকে তিন-চার গোছা চুল টেনে উপরে আনে। তারপর পাথরের ছুরি দিয়ে মৃতদেহের কপালের খানিকটা কেটে প্রেতাত্মা বের করার রাস্তা করে দেওয়া হয়। শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় লামা ডম্বুরু বাজাতে বাজাতে চলে। শবদেহকে নিয়ে রাখে একটা বড় পাথরের টুকরোর ওপর। ঘাতক একটি মন্ত্র পড়তে পড়তে মৃতদেহের শরীরে বেশ কয়েকটি দাগ কাটে।

দাগ কাটার পর একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে সেই দাগ ধরে ধরে মৃতদেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তারপর পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো হয়।

আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া এখনো লাগেনি তিব্বতে। গোটা বিশ্ব থেকে তিব্বতীরা যেন অনেকটা বিচ্ছিন্নই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে তিব্বতের বাতাস হালকা। ভয়ঙ্কর শীত ওখানে। কখনো কখনো শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যায় তাপমাত্রা। সাগরের মৌসুমী বায়ু হিমালয় পাহাড়ের বিশাল প্রাচীর ডিঙিয়ে সে দেশে যেতে পারে না বলে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়। তিব্বতীরা বেশিরভাগ পশুর চামড়ার পোশাক পরে। সাধারণ মানুষ পরে ভেড়ার চামড়া। ধনীরা পরে নেকড়ে, নেউল প্রভৃতির চামড়া। দুর্গম তিব্বত এখনো অনেক রহস্য ধারণ করে আছে।

-রণক ইকরাম

0 comments:

Post a Comment