Saturday, January 22, 2011

ইস্টার আইল্যান্ড

0 comments
১৯২২ সালের ইস্টারসানডের দিন, এক ওলন্দাজ অভিযাত্রী দল প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে এসে উপস্থিত হলেন। যে দ্বীপের চারদিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দানব আকৃতির মূর্তি। অকল্পনীয় বিশাল দানব আকৃতির মূর্তিরা যেনো তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দ্বীপের এই সব মূর্তিগুলো দেখে ওলন্দাজ অভিযাত্রী দলের সবাইতো অবাক! সবার কৌতুহলে সেই ওলন্দাজ অভিযাত্রী দলের ক্যাপ্টেন অ্যাডমিরান জ্যাকব রগেভিন সিদ্ধান্ত নিলেন এই দ্বীপেই জাহাজের নোঙর ফেলবেন। তাঁর যেই কথা সেই কাজ। তৎক্ষনাৎ সবাই জাহাজেই অবস্থান করলেন। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায়। দ্বীপের চারদিক জুড়ে নেমেছে অন্ধকার। ফলে সবাই সারারাত ভয়ে কাঠ হয়ে দ্বীপের দিকে তাকিয়ে রইলেন-কখন ভোর হবে, চারদিক আলো করে সূর্য উঠবে পুরো দ্বপি জুড়ে।

সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভয় অবশ্য ভেদে গেলো সবার। যখন দেখলো তারা, নিশ্চল মূর্তিগুলো সত্যিই মূর্তি। অভিযাত্রী দল লক্ষ্য করলেন, বিশাল বিশাল পাথরের মূর্তিগুলো সারা দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে উৎসাহের সন্দে সবাই জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন। দ্বীপের মান। মানুষ জনের সঙ্গেও দেখা হল সবার। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়-অভিযাত্রী দল তথ্য নিয়ে জানতে পারলেন-দ্বীপের মানুষেরা এই মূর্তিগুলো গড়েনি। তারা জানেও না, কেবা কারা এই মূর্তিগুলো গড়েছিলো। তবে এই মূর্তিগুলোকে দেবতা মনে করে দ্বীপবাসীরা নিয়মিত পুজো দেয়। ফরে দ্বীপে ছুড়িয়ে থাকা এই মূর্তিগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে পুরো ওলন্দাজ অভিযাত্রী দলের আরো কৌতুহল বেড়ে গেলো। সেই দিনটি ছিল ইস্টারসানডে। তাই কৌতুহল বশেই ক্যাপ্টেন রগেভিন এই দ্বীপের নামকরণ করলেন ইস্টার আইল্যান্ড নিজের জার্নালে তিনি ইস্টার আইল্যান্ডের এক অদ্ভুত দৃশ্যের কথা লেখেন। তা হল-বিস্ময়কর রকমের বড় পাথরগুলো উপকূল বরাবর দাঁড় করানো ছিল। পরবতর্ী বছরগুলোতে অনেকে ওই অদ্ভুত মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অনেক মজার মজার মন্তব্য করেছেন। উলেস্নখ্য, ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তিগুলো সবই তৈরি হয়েছে বিশাল পাথর কুঁদে বা কেটে। কিন্তু গবেষকদের প্রশ্ন হল এই দ্বীপ বাসীরা সেই কৌশল শিখলো কি করে? আর পাথরগুলোই তারা বয়ে আনলো কিভাবে এবং কোথা থেকে?

এব্যাপারে দ্বীপবাসীদের কেউ কিছু জানেনা। অথচ যুগ যুগ ধরে এই মূর্তিগুলো ইস্টারদ্বীপেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে অভিযাত্রী দলের সকলেই অবাক হলেন। এরপর ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে এই রহস্যের কথা ছড়িয়ে পড়লো। ইস্টার আইল্যান্ড নিয়ে শুরু হল গবেষণা। বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব থর হেয়ারডাল প্রচুর গবেষণা ও খনন কার্যের পর তথ্য দিলেন ৩৮০ খৃষ্টাব্দে পেরু থেকে কিছু মানুষ এসে এই দ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তারা তৈরী করেছিলো রাস্তা, মন্দির, মানমন্দির ও সুরঙ্গ পথ। ১২৮০ খৃষ্টাব্দে পেরু থেকেই অন্য লোকজন এসে দ্বীপটি দখল করে নেন। ধারণা করা হয়, তারাই এই মূর্তিগুলো গড়েন। মূর্তিগুলোর কান লম্বা। কারণ পেরুবাসীদের মধ্যে কানে ভারি দুল পরে কান লম্বা করার রেওয়াজ ছিল। এর প্রায় চারশত বছর পর ১৬৮০ সালে পলি নেশীয়রা এশিয়ার দিক থেকে এসে দ্বীপটি অধিকার করে, এবং সে সময় মূর্তি তৈরি প্রচলন লোপ পায়। রেডিও কার্বন পরীক্ষার সাহায্যে থর হেয়ারডাল এসব তথ্য পেঁৗছালেও বহু গবেষক এর বিরোধিতা করেন। তাদের মতে, দ্বীপ সংলগ্ন আগ্নেয়গিরি থেকে বিরাট গাছের গুঁড়ির সাহায্যে পাথর গড়িয়ে এনে এই মূর্তিগুলো গড়া হয়েছে।

তাই থরের এই তত্ত্ব অনেকে মেনে নিলেন না। তাদের মতে, এক অতি প্রাচীন, অথচ উন্নত সভ্যতার চিহ্ন এগুলো। হয়তো সেই সভ্যতা প্রকৃতির খেয়ালে কোন কালে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে তলিয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু গবেষক এব্যাপারে তথ্য দিয়েছেন ভিন্ন ভাবে। তাদের মতে ১৭৭০ সালে স্পেনের একদল মানুষ ফিলিপ গঞ্জালেসের নেতৃত্বে এসে মূর্তিগুলোর টুকরো কুড়াল দিয়ে কেটে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু দ্বীপবাসী মানুষের মিলিত আক্রমণে তারা পিছিয়ে আসেন। এরই মধ্যেই আবার এই একই দ্বীপের আবিষ্কৃত হল কিছু কাঠের বোর্ড, যার ওপর লেখা আছে আশ্চর্য সব লিপি যার পাঠোদ্ধার করতে দ্বীপের মানুষেরাতো বটেই, বড়ো বড়ো পন্ডিতরা পড়তে ও অক্ষম হলেন। এগুলোর নাম দেয়া হল রং গোরগো। ১৮০০ শতাব্দীতে মূর্তিগুলো মাটিতে পড়ে যায়। এর কিছুকাল পরেই প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মূর্তিগুলো সমন্বন্ধে অনুসন্ধান শুরু করেন। অনুসন্ধানীদের মতে ইস্টার আইল্যান্ডের উপকূল বতর্ী অঞ্চলের সীমানায় এই প্রতিমূর্তিগুলো স্থাপিত। যার বৃহৎ মস্তকগুলো দ্বীপের অন্তর্ভাগের দিকে মুখ করে আছে। এদের উচ্চতা প্রায় তিনফুট থেকে ছত্রিশ ফুট পর্যন্ত। এদের ওজন প্রায় কুড়ি টন। এই রকম এক হাজারেরও বেশী মূর্তি এযাবৎ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মূর্তিগুলোর নাম (গঙও) মই। তাছাড়া আরো আছে, পাথুরে তৈরী আটশতটি মস্তুক। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মস্তকটির উচ্চতা বত্রিশ ফুট এবং ওজন নব্বইটন। তাছাড়া অধিকাংশ মূর্তিই তেরো থেকে ষোলো ফুট লম্বা ছিল। কোন কোনটির ওজন ছিল প্রায় পঁচাশিটন। ধারণা করা হয় মূর্তিগুলো খাঁড়া করতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে।

কিন্তু এও সত্য যে প্রাচীন দ্বীপবাসীদের কোন ক্রেন ছিল না। এমনকি তাদের কোন চাকাও ছিল না। তাহলে প্রশ্ন জাগে মনে, মূর্তিগুলো কিভাবে এলো উপকূলে। কোন কোন বিশেস্নষকের মতে মূর্তিগুলোকে আগ্নেয়গিরির ডাল থেকে নামানোর জন্য দ্বীপ বাসীরা আখের তৈরী মোটা দড়ি ব্যবহার করতো। পরে গাছের গুড়ির সাহায্যে তারা মূর্তিগুলোকে খাঁড়া করে উপকূলে নিয়ে যেতো। অথবা চ্যাপটা আকারে কর্বের উপর মূর্তিগুলো রেখে টেনে নিয়ে যেতো। পরে গাছে গুড়িকে লিভার হিসাবে ব্যবহার করে মূর্তিগুলো খাড়া করতো। উলেস্নখ্য, ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তিগুলো যে পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল, সেইসব পাথর বৃক্ষকান্ডের তৈরী এক ধরনের

সেস্নজগাড়ি দিয়ে বয়ে আনা হয়েছিল। অনুমান করা হয় যে, তখন সেই দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার। প্রত্নতত্ত্ব বিদ উইলয়াম মুলয় বলেন, এই দ্বীপের অধিবাসীরা একদিনের মধ্যে এক হাজার ফুটের বেশি দূর পর্যন্ত ওই ভারী পাথর বহন করে আনতে পারেনে। যদিও কাঠের ফ্রেম দিয়ে এই মূর্তিগুলো তৈরী করা হয়েছিলো বলে মনে করা হয়। লক্ষ্যনীয়, কতগুলি মূর্তির চোখ আবার সম্পূর্ণ তৈরী ছিলনা। এজন্য তাদে বলা হয় অন্ধমূর্তি।

ইস্টার আইল্যান্ডে এরকম মূর্তি রয়েছে প্রায় একশতটি। যদিও এগুলোর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল ছয়শতটির ও বেশি লম্বা কানওয়ালা মূর্তি। যার মধ্যে দ্বীপের ধারে অবস্থিত সবচেয়ে বড়োটির দৈর্ঘ্য ছিল তেত্রিশফুট এবং ওজন ছিল আশিটন। অবশেষে বলতেই হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার আইল্যান্ড সত্যিই রহস্যময়।

-মঈনুল হক চৌধুরী

0 comments:

Post a Comment