Friday, January 28, 2011

উপমহাদেশের প্রথম গৌরবময় বিদ্রোহ

0 comments
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজ বেনিয়ারা ভারতে আসেন সামান্য ব্যবসার অজুহাত নিয়ে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে নানা চক্রান্ত ও কূটকৌশলের মাধ্যমে তারা ভারতের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে সক্ষম হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ্দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে তারা এদেশে তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্যের জানান দিয়েছিল আর ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমকে পরাজিত করে সমগ্র ভারত তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পায় তা কাজে লাগিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষে শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। বাংলার স্বাধীনচেতা জনগণ কখনও পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই দীর্ঘ একশ বছরের অসন্তোষ অবসানের জন্য ১৮৫৭ সালে রাস্তায় নেমে আসে। ফলে সংঘটিত হয় ইতিহাসের অন্যতম কাহিনী মহাবিদ্রোহ, যাকে সিপাহি বিদ্রোহ বা ভারতীয় বিদ্রোহও বলা হয়ে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল ভারতীয় শাসকবর্গের তীব্র ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব। লর্ড ডালহৌসি তার স্বত্ব বিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ডালহৌসি অযোধ্যা দখল করে নবাবকে কলকাতায় নির্বাসন দেন। ফলে নবাবের অধীনে অনেক পরিবার সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের এসব কর্মকাণ্ড ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে চরমভাবে অসন্তুষ্ট করেছিল। ব্রিটিশ শাসনের আগে এদেশ ছিল কৃষি ও শিল্পসমৃদ্ধ। কিন্তু কোম্পানি শাসনে এদেশে শুরু হয় লাগামহীন শোষণের পালা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতীয় দরিদ্র কৃষককুলের ওপর জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারী শক্তির শোষণ বৃদ্ধি পায়। কৃষক ও জনসাধারণের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপানো হয়। এসব কর্মকাণ্ড ভারতীয়দের বিদ্রোহে বাধ্য করেছিল। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের জন্য ধর্মীয় অসন্তোষ দায়ী ছিল। ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের তৎপরতায় ভারতীয়দের মনে এ আশঙ্কা জন্মায় যে, ইংরেজ শাসনে তারা ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হবে। খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রকাশ্য ধর্মপ্রচার, হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা, মন্দির ও মসজিদের জমির ওপর করারোপ জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ১৯৫৭ সালে জ.উ. গধহমধষবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক ভাষণে বলেন, 'খ্রিস্টধর্মের বিজয় পতাকা ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সগৌরবে উড্ডীন রাখার জন্য ভাগ্যবিধাতা হিন্দুস্থানের বিস্তৃত সাম্রাজ্য ইংল্যান্ডের হাতে তুলে দিয়েছে'। তার এ ধরনের বক্তব্য ভারতীয়দের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছিল।

মহাবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সামরিক বৈষম্য এবং এনফিল্ড রাইফেলের ব্যবহার। ব্রিটিশ সরকার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ ভারতীয় সৈন্যের জন্য বার্ষিক ব্যয় করত ৯৮ লাখ পাউন্ড এবং ৫১ হাজার ৩১৬ জন ইউরোপীয় সৈনিকের জন্য ব্যয় করত ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড। যা ছিল ভারতীয় সৈনিকদের জন্য চরম বৈষম্য। ব্রিটিশ সরকারের কয়েকটি সংস্কার যেমন তিলককাটা নিষিদ্ধ, দাড়ি কামানো এবং পুরনো পাগড়ি ব্যবহারে চাপ গ্রয়োগ ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিম সৈনিকদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানে। মহাবিদ্রোহে সিপাহিদের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলের ব্যবহার। তখন ব্রিটিশ সরকার এনফিল্ড নামক এক ধরনের রাইফেলের ব্যবহার শুরু করে। এই রাইফেলের কার্তুজ পশুর চর্বি দ্বারা আবৃত থাকত। এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, এনফিল্ড রাইফেলের গুলির কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি মাখানো আছে। এ চর্বি দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হতো। মুসলমান সৈনিকরা শূকরের চর্বি এবং হিন্দু সৈনিকরা গরুর চর্বি মুখে নেওয়ার গুজবে চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই সিপাহিদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহ। সিপাহি বিদ্রোহের ফলাফল ছিল ভারতীয় ইতিহাসের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিদ্রোহের মাধ্যমে ১৮৫৮ সালে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন হয় এবং ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে। এ বিদ্রোহের ফলে ইংল্যান্ডের মহারানী এলিজাবেথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার মাধ্যমে স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করা হয়, দেশীয় রাজন্যবর্গের দত্তকপুত্র গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়, ভারতীয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং যোগ্যতানুযায়ী ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। মূলত সিপাহি বিদ্রোহ ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। এই বিদ্রোহ ভারতীয় ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ এই বিদ্রোহ ছিল উপমহাদেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গৌরবময় প্রথম বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের সাহসে বলীয়ান হয়ে পরবর্তী সময়ে?ভারতীয়রা অন্যান্য বিদ্রোহ ও সংগ্রাম করতে সক্ষম হয়েছিল এবং সর্বোপরি পেরেছিল ব্রিটিশদের ভারত থেকে পরিপূর্ণভাবে বিতাড়িত করতে।

-আল মুতাসিম বিল্লাহ

0 comments:

Post a Comment