Thursday, January 27, 2011

পূর্ণিমায় রাস নৃত্য

0 comments
মধ্যরাত। পূর্ণিমার পরিষ্কার আলো। হালকা শীতের আমেজ। বৃদ্ধ নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এবং শিশু, সবাই বসে আছে মণ্ডপের চারপাশে। আর তাদের সবার দৃষ্টি মণ্ডপে নৃত্যরত শিল্পীদের প্রতি। নৃত্য চলছে। নৃত্য চলে এক জাতীয় বিশেষ গান ও বাজনার তালে। মণ্ডপের এক পাশে বসে গান-বাজনা বাজায় ৫/৬ জন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। আর যারা নৃত্য করছে, তারা বেশির ভাগ বয়সে শিশু ও কিশোরী। ১৫ থেকে ২০ জন দলবেঁধে এক ধরনের বিশেষ ঝলমলে পোশাক পরে এই নৃত্য করছে। যারা নৃত্য দেখছে তারা মাঝেমধ্যে নৃত্যশিল্পীদের টাকা পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে আসে।

প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমা রাতে মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে এবং আদমপুর বাজারে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরীদের হলেও এ উৎসবে যোগ দেয় এ অঞ্চলের মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই। উৎসবে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকে সংস্কৃতিপ্রেমীরাও ছুটে আসেন।

বেলা ১১টায় রাখাল নৃত্য দিয়ে রাস পূর্ণিমা উৎসব শুরু হয়। রাখাল নৃত্যের আগে যারা নৃত্য করে, তারা প্রথমে মণ্ডপে গোল হয়ে গোপী ভোজন করেন। গোপী ভোজন হলো বিভিন্ন সবজি দিয়ে রান্না করা তরকারি ও ভাত। এটা খেয়েই রাখাল নৃত্য শুরু করে শিল্পীরা। রাখাল নৃত্য চলে একটানা বিকেল পর্যন্ত। পাশাপাশি দিনভর চলতে থাকে মণিপুরীদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। রাখাল নৃত্য পরিবেশন করে মণিপুরী শিশু-কিশোর ও ছেলেমেয়েরা। এ নৃত্যের সময় ছেলেরা এক ধরনের এবং মেয়েরা বিশেষ পোশাক পরে। ঝলমলে এ বিশেষ পোশাকের নাম 'পলয়'। এ পোশাকের পরিকল্পনা করেছিলেন রাজা ভাগ্যচন্দ্র। রাখাল নৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো কৃষ্ণ ও তার সখাদের নিয়ে। মণ্ডপে কখনো একক, কখনো দ্বৈত এবং কখনো দলবেঁেধ এ নৃত্য পরিবেশিত হয়।

অনুষ্ঠান শেষে এখানে রাসের বিশেষ খাবার খাওয়া হয়। রাস উৎসবে মণিপুরীরা বিভিন্ন সবজি, ডাল, গাছের লতা-পাতা দিয়ে উতি, পাকাউরা, সৈবুম, ইরোলবা নামের বিশেষ খাবার তৈরি করে। মণ্ডপে সবাই বসে কলা পাতায় এ খাবার খায়। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় রাস নৃত্য। চলে ভোর পর্যন্ত। রাস নৃত্য পরিবেশন করে মণিপুরী শিশু ও কিশোরী মেয়েরা। রাস নৃত্যের সময়ও পলয় পরা হয়। পলয় পোশাকের মাথার উপরি ভাগের নাম 'কোকুতম্বি'। এ পোশাকের মুখের উপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণ থাকে। তার নাম 'মাইমুখ'। গায়ে থাকে সোনালি-রুপালি চুমকির কারুকাজের ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ। পরনে থাকে ঘন সবুজ রংয়ের পেটিকোট, যা শক্ত বক্রমের দ্বারা গোলাকৃতি ও ভাঁজমুক্ত করা হয় এবং অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা কারুকাজ করা থাকে, যা সামান্য আলোতে ঝলমল করে ওঠে। পলয়ের এ অংশের নাম 'কুমিন'। এছাড়া জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান খাওন, খবাংনপ পলয়ের অংশ। এছাড়া পলয়ের সঙ্গে কলথা, খবাংচিক, খুঁজিসহ স্বর্ণালঙ্কারও নৃত্য শিল্পীরা পরেন। রাস নৃত্যও গোলাকার মণ্ডপে কখনো একক, কখনো দ্বৈত এবং কখনো দল বেঁধে পরিবেশিত হয়। রাস নৃত্যের সঙ্গেও মণিপুরী সংস্কৃতির গান এবং বাজনা বাজে। রাস নৃত্যের মূল বিষয়বস্তু হলো রাধা ও তার সখাদের নিয়ে। এই নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের শুরু, মান-অভিমান এবং শেষে মিলন দেখানো হয়।

রাস পূর্ণিমা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক এইচ ফাল্গুনী বলেন, ১৭৮৯ সালে রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র ভারতের মণিপুরে রাস পূর্ণিমা উৎসবের প্রবর্তন করেন। তার তিরোধানের পর মহারাজ চন্দ্রকীর্তি এ উৎসবকে আরও বেশি জনপ্রিয় করার জন্য কাজ করেন এবং উৎসবকে মণিপুরীদের কাছে ছড়িয়ে দেন।

১৯১৯ সালের নভেম্বরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণে এলে তার সম্মানে মণিপুরী রাস নৃত্যের আয়োজন করা হয়। কবিগুরু এ নৃত্যের ভাবরস দেখে অভিভূত হন। পরে তিনি ত্রিপুরার রাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুদ্ধিমন্ত্র সিংহকে মণিপুরী নৃত্যের শিক্ষক হিসাবে শান্তিনিকেতনে নিয়োগ করে মণিপুরী রাস নৃত্যকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তোলেন। বাংলাদেশে মণিপুরী সমপ্রদায়ের বসবাস প্রায় ২০০ বছর ধরে। এদেশে তাদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। মণিপুরীদের তিনটি সমপ্রদায় রয়েছে। এগুলো হলো_ মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া এবং মৈতেই পাঙ্গাল। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতেই সমপ্রদায় হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। এরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমপ্রদায়ভুক্ত। এছাড়া মৈতেই পাঙ্গালরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তিন সমপ্রদায়ের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিতে কিছু ভিন্নতা থাকলেও তাদের প্রধান বার্ষিক উৎসব 'রাস পূর্ণিমা'।

গাজী মুনছুর আজিজ

0 comments:

Post a Comment