Sunday, February 13, 2011

জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, নেপাল

0 comments
নেপাল সীমান্তবর্তী মিরিকের পাহাড়ি লেকে ঘুরে প্রায় মধ্যবেলায় শিলিগুড়িতে পেঁৗছাই। ব্রিজের পাশে হোটেল 'স্নোভিউ'তে ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ি। বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি ভোজনশালায় গরম গরম আলু পরাটা, সয়াবিন আর গরম চা খেয়ে তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হই। মাঝবয়সী রিকশাচালকের কাছে জানতে পারি নকশালবাড়ির কিংবদন্তি সিপিএম নেতা চারু মজুমদারের বাড়ি আশপাশেই। বাসস্ট্যান্ড থেকে জয়গাঁর বাসে মাদারীহাটের জলদাপাড়ায় যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা। অরণ্যের সামনে বাস যখন থামল তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। দীর্ঘ পথ কুচবিহার, জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের চা বাগান পেরিয়ে এসেছি। বিশাল আয়তনের বিখ্যাত ডুয়ার্স বাগান- পশ্চিম বাংলার অনেক কথাসাহিত্যিকের লেখার পটভূমি নকশালবাড়ী, আঙরাভাসা নদী, ডুয়ার্সের চা বাগানে জীবনচিত্র। জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে প্রবেশপথে চোখে পড়ল 'দ্য রাইনোল্যান্ড' খ্যাত পাথরের সাইনবোর্ড খোদাই করা ফটক। পূর্ব হিমালয়ের ভুটান পাহাড়ের গা-ঘেঁষে ২১৬ বর্গ কি.মি. বিস্তৃত জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের খ্যাতি লুপ্তপ্রায় এক শৃঙ্গী গণ্ডারের জন্য। মালঙ্গী, হলং, বুড়িবসরা, কালিঝোড়াসহ পূর্ণেন্দ্র পত্রী কবিতার যুবতী তোর্সা নদী এ অরণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। নদীর নামে নাম বনবাংলো হলং অতিথিশালায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। বাংলাদেশের বন বিভাগের সুন্দরবনে কাজ করেছি, তাই কিছুটা বাড়তি আপ্যায়ন। চারপাশে জঙ্গলের মাঝখানে অনেকটা জায়গাজুড়ে ছোট ছোট কয়েকটি কটেজ। হলং বাংলো কাঠের মাচার উপর। ১০/১২টা সিঁড়ি ভেঙে কটেজে উঠতে হয়। প্রথম কয়েকটি ছোট বারান্দা। পরিপাটি বাথরুম, সুন্দর পরিচ্ছন্ন বিছানা, অরণ্যের ভেতরেও নাগরিক সুবিধা। রাতের আলো-আঁধারে মনে মনে সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিন-রাত্রিতে যেন বসবাস। তবে খেয়েদেয়ে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ বাস জার্নির ক্লান্তি বুঝতে না বুঝতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল খুব সকালে চেনা-অচেনা নানা পাখির ডাকে। যেন পাখির স্বর্গরাজ্য। টিয়া, ময়ূর, চিল, বাজ, বক, ধনেশসহ আরও কত নাম না জানা পাখি। আজ থেকে ৫৬ বছর আগে ১৯৫৪ সালে জলদাপাড়া বনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়। আর এখনো বিভিন্ন জীবজন্তু আর পশুপাখির অভয়ারণ্য। একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে অফিসের পাশেই। এখানে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির পরিসংখ্যান আর পরিবারসহ জীবন্ত চিতাবাঘ। জঙ্গলে সাফারি হয় দুটো ট্রিপে। সকালে আর বিকালে। প্রতি হাতিতে চারজন পর্যটক বক্সারে সাফারি করতে পারে। যেন ধীরগতির গজগামিনীতে ভিন্ন আমেজে অরণ্য দর্শন। একটু আতঙ্ক কাজ করে চিতাবাঘের কথা মনে হলেই। কাজীরাঙা বন থেকে কেবল ভ্রমণ শেষ করে আসা এক বৃদ্ধ অরণ্যচারী দম্পতির সঙ্গে দেখা হয়। আমাদের ট্যুরগাইড বীনা। সবকিছুই যেন তার চোখে আগে ধরা পড়ে। এ বনে হরিণ, হাতির দেখা মেলে সহজেই। পরিদর্শন টাওয়ারে উঠে দূরের দৃষ্টিতে আবছাভাবে নজরে এলো বিখ্যাত একশিঙা ভয়ঙ্কর রাইনো। পাহাড়ি নদীর স্বচ্ছ কাচের মতো টলটলে পানি। নিচে পাথরের নুড়ি, ছোট রং-বেরংয়ের মাছের মেলা। রোদ পড়তেই এ অভয়ারণ্যের পোষা হাতিরা সারাদিন মুক্ত জঙ্গলে ঘাস-পাতা খেয়ে ফিরে আসছে। পাশের নদীতে কয়েকটি হাতি গোসল করছে আমাদের উপেক্ষা করেই। সাফারি শেষে এবার কটেজে। শুধু খাবারের জন্য নিচে নামতে হয়, চাইলে উপরেও খাবার মেলে। নীরব, নিস্তব্ধ, রহস্যঘেরা অরণ্যে এক রাত দুইদিন পাড় করে এবার জয়গাঁ যাওয়ার পালা। বনের মায়ায় মনে হলো, ট্যুরের পরিকল্পনাটি বুঝি ভুলই ছিল। অন্য কোথাও না গিয়ে শুধু পশুপাখির কাকলিতে নিঃসর্গে কয়েকদিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবুজে হারিয়ে গেলে মন্দ হতো না। তবে মনে মনে ভাবি, আবারও ফিরব অরণ্যে, অরণ্যের দিনরাতে। শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে জয়গাঁর বাসে মাদারিহাট। মাদারিহাট বাসস্টপের সামনেই জলদাপাড়া অরণ্যের প্রবেশদ্বার। জলদাপাড়া অরণ্যের মধ্যে বিলাসবহুল হলং বাংলো অথবা ভুটানের প্রবেশদ্বার জয়গাঁয় রয়েছে নানা মানের হোটেল।

-মার্জিয়া লিপি

0 comments:

Post a Comment