Sunday, February 13, 2011

ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম

0 comments
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। এটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেক তরুণ শহীদ হয়। ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম নিয়ে এবারের জানার দুনিয়া সাজানো হয়েছে_
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস :তমদ্দুন মজলিশ একটি বই প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল_'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? বাংলা নাকি উর্দু?' এই বইয়ে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাস :পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত 'পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্স-এ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবি জানান ।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাস :শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগের বিপক্ষে ঢাকায় তমদ্দুন মজলিশের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ এবং মিছিল হয়। এবং ৮ ডিসেম্বর একটি সমাবেশ হতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নুরুল হক ভুইয়া এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন ।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাস :পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগের জন্ম। এর প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগে ডান ও বামধারার ছাত্রনেতাদের একটি সম্মিলন হয়। উলেস্নখ্য, প্রতিষ্ঠাতাদের প্রায় সবাই ছিলেন মুসলিম ছাত্রনেতা। এটি গঠনের মুল লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগ সরকারের এন্টি বেঙ্গলি পলিসির বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

১৯৪৮ সালের ৪-৭ মার্চ :বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠাকে সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করে। স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ১১ মার্চ ১৯৪৮ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ :এইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি বড় সমাবেশ আয়োজন করা হয়। সমাবেশ শেষে বের হওয়া মিছিলে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায় এবং মিছিল থেকে কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ আরো বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ :রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত একটি বিশাল সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন যে, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।' সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও জনতার একাংশ সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করে ওঠে। জিন্নাহ সেই প্রতিবাদকে আমলে না নিয়ে তার বক্তব্য অব্যাহত রাখেন।

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং' শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি ক্যাটাগরিক্যালি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে।'

জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির সদস্যরা দাঁড়িয়ে নো নো বলে প্রতিবাদ করেন। জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল :জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। উপায়ান্তর না দেখে খাজা নাজিমুদ্দিন ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি'তে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা এবং ডাক টিকেট, ট্রেন টিকেট, স্কুলসহ সর্বত্র উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের কথা উলেস্নখ করে একটি প্রস্তাব আনেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবে কিছু সংশোধন প্রস্তাব করে বাংলাকে 'ওয়ান অফ দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাকিস্তান' করার জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব করেন। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী বাতিল করে খাজা নাজিমুদ্দিনের মূল প্রস্তাবটি 'ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি'তে গৃহীত হয়।'

১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ :পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে সরকারি কর্মকাণ্ড ও শিক্ষার একমাত্র ভাষা এবং সেই সাথে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার অব্যাহত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে আরবি হরফে প্রচলন করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দেয়।

১৯৫০ সালের এপ্রিল মাস :পার্লামেন্টে আরবি হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে।

১৯৫০ সালের নভেম্বর মাস :পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত 'কমিটি অফ অ্যাকশন ফর ডেমোক্র্যাটিক ফেডারেশন' ১৯৫০ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় 'গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন' আয়োজন করে। এখান থেকে বাঙালিদের মূল দাবিগুলোর পাশাপাশি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গৃহীত হয় ।

১৯৫১ সালের ১১ মার্চ :'দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টেট স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট কমিটি' পূর্ব বাংলার সকল পত্র-পত্রিকায় এবং গণপরিষদের সদস্যদের মাঝে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে একটি মেমোরেন্ডাম পাঠায়।

১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ :পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পুনরায় অ্যাসেম্বলিতে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবটি পেশ করে। এখানে উলেস্নখ্য যে, মৌলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যবিশিষ্ট 'ইস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি' আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবকে বাস্তবতা বিবর্জিত এবং উদ্ভট হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করলেও সেই রিপোর্টকে সাধারণ জনগণের সামনে প্রকাশ করেনি পাকিস্তান সরকার। ততদিনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের এদেশীয় সদস্যদের মধ্যেও অনেকে বাংলার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এ রকমই একজন হাবিবুলস্নাহ বাহার অ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। পূর্ব বাংলার এমপি'দের একাংশের তীব্র বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার ।

১৯৫১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর :এই সময়কালীন ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পৃথক পৃথক সমাবেশ করে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। এই সময়ের সমাবেশগুলোতে কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, গাজীউল হক প্রমুখ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন ।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি :ঢাকা সফররত পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানের সমাবেশে ঘোষণা করেন, কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাথে সাথে সমাবেশস্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেস্নাগান ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। এই বক্তব্য সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

১৯৫২ সালের ২৮ জানুয়ারি :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশ থেকে নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীপরিষদকে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতের পুতুল হিসেবে অভিহিত করা হয় ।

১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি :খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইদিন সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি :ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে ।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি :ছাত্রদের ডাকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় একটি মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।

১৯৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি :পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি :পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ-এর উদ্যোগে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে ব্যর্থ হন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি

সকাল ৯টা :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেশিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হয়।

সকাল ১১ টা :কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইনের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।

১২টা থেকে বিকেল ৩টা :উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান-এর মাস্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মৃতু্যবরণ করেন। পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম, যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন মৃতু্যবরণ করেন । অহিউলস্নাহ নামে ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে, কিন্তু পুলিশ গুলিবর্ষণ করেও ছাত্রদের স্থানচু্যত করতে ব্যর্থ হয়।

বেলা ৪টা : ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার সাধারণ জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকে। গুলিবর্ষণের সংবাদ আইন পরিষদে পেঁৗছালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ছয়জন আইন পরিষদ সদস্য আইন পরিষদ সভা মুলতবি করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে অনুরোধ করেন। সরকারি দলের সদস্য আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশও এই প্রস্তাবের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ হন, কিন্তু নুরুল আমিন সকল দাবি উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটি মসজিদে ও ক্লাবে পরদিন সকালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হবার আহ্বান সম্বলিত লিফলেট বিলি করা হয়।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি :হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়ো হতে থাকে। উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১শে ফেব্রুয়ারি নিহতদের স্মরণে কার্জন হল এলাকায় একটি জানাজা নামাজ আদায় করে এবং একটি শোকমিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ পুনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মৃতু্যবরণ করেন। উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকারপক্ষীয় পত্রিকা 'দি মর্নিং নিউজ'-এর অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। নুরুল আমিন পুলিশের পাশাপাশি আর্মি নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আর্মি ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক)-এ জমায়েত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব বক্তব্য রাখেন। উপায়ান্তর না দেখে নুরুল আমিন তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়।

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি :সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৫ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বরকত শহীদ হওয়ার স্থানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে ।

১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি :ভোর ৬টার সময় 'শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের' নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয় এবং সকাল ১০টার দিকে শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির ফলক উন্মোচন করা হয়।

১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি :ছাত্র বিক্ষোভকে দমাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি :পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখে স্থাপিত 'শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ' গুঁড়িয়ে দেয়। সরকারের দমন-পীড়ন নীতিতে ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে কিন্তু ঢাকার বাইরে আন্দোলন দানা বাঁধে।

১৯৫২ সালের ১৪ এপ্রিল :আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি গৃহীত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যাপারে দাবি উত্থাপন করলে আইন পরিষদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

১৯৫২ সালের ২৮ এপ্রিল :সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বার এসোসিয়েশন হলে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে বক্তারা মিছিল সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সকল বন্দির মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান।

১৯৫৪ সালের ৭ মে :যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি :পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে তা সংবিধানের অন্তর্গত করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।

১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি :পাকিস্তান জাতীয় অ্যাসেম্বলি বাংলা এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাশ করে।

১৯৫৬ সালের ৩ মার্চ :বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান এইদিন থেকে কার্যকর হয় এবং ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল, তার সাফল্য অর্জিত হয়।

সূত্র :ইত্তেফাক

0 comments:

Post a Comment