Saturday, March 19, 2011

প্রেম প্রতারণা ও ধর্ষণের শিকার অতঃপর আত্মহত্যা

0 comments
রাজশাহী পুঠিয়ার কিশোরী মহিমা, দুর্গাপুরের রোজিনা, মোহনপুরের শেফালী থেকে গোদাগাড়ির আদিবাসী তরুণী সিরাফিনার মতো ধর্ষণ আর প্রেমে প্রতারণার শিকার হয়ে গত ৯ বছরে রাজশাহীতে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ২৬ জন। এদের মধ্যে শুধু ধর্ষণের শিকার হয়ে লজ্জা ও অপমান সহ্য করতে না পেরে এবং বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন এবং প্রেমের নামে প্রতারণার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। বয়সের দিক থেকে এদের অধিকাংশই কিশোরী। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ৫ জন এবং প্রেমের নামে প্রতারণার শিকার হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ৭ জন।
৯ বছর আগে ২০০২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন পুঠিয়ার কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের কিশোরী মহিমা। ধর্ষকরা তাকে ধর্ষণের দৃশ্যও ক্যামেরাবন্দি করেছিল। ছবিগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল বাজারে। এরপর অপমান আর লজ্জা সইতে না পেরে ক্ষোভে ১৯ ফেব্রুয়ারি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল মহিমা। ঘটনাটি নাড়া দিয়েছিল মানুষের বিবেককে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল মানুষ। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল ক্ষোভ। ঘটনার বিচার আর নারী ও কিশোরীর প্রতি যৌন নির্যাতন বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নেমেছিল সচেতন মানুষ আর মানবাধিকার সংস্থাগুলো। কিন্ত এরপরেও বন্ধ হয়নি নারী আর কিশোরীদের প্রতি যৌন নির্যাতন। একের পর এক ঘটে চলেছে ঘটনা। আত্মহননের ঘটনাও ঘটেছে একের পর এক। মহিমার পর ২০০৩ সালের ২৬ এপ্রিল দুর্গাপুরে উত্ত্যক্তর শিকার হয়ে রোজিনা (২২) নামে এক তরুণী বেছে নেয় আত্মহননের পথ। একই বছর ৯ মে নগরীর একটি ক্লিনিকে একজন নার্সের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর স্বামীর বিকৃত যৌনাচার ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ২০০৩ সালের ৯ জুন বাগমারার পালোপাড়া গ্রামে মঞ্জুয়ারা (২০) নামে এক গৃহবধূর আত্মহত্যার ঘটনা। ওই বছরেরই ২ অক্টোবর মোহনপুরের মাটিকাটা গ্রামে ধর্ষণের বিচার না পেয়ে শেফালী (৩৬) নামে এক গৃহ পরিচারিকা আত্মহত্যা করে। এভাবে ২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর বাগমারার নিমপাড়ায় ধর্ষণের শিকার হয়ে লজ্জায় রাবেয়া (৩৫) নামে একজনের আত্মহননের ঘটনা ঘটায়। ২০০৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর চারঘাটে বিয়ের প্রলোভনে ফুপাতো ভাই দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে এক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায়। ২০০৫ সালের ১৯ এপ্রিল দুর্গাপুরের চুনিপাড়া গ্রমে ধর্ষণের শিকার হয়ে জলি (১১) নামে এক শিশু আত্মহত্যা করে। মোহনপুরে চাচাতো ভাই কর্তৃক উত্ত্যক্তর শিকার হয়ে উল্টো বাবার বকুনি খেয়ে ২০০৫ সালের ২৫ আগস্ট আত্মহত্যা করে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া ১২ বছর বয়সী এক শিশু। তানোরের ভালুককান্দি গ্রামে একটি বাড়িতে কাজ করতো সেলিনা (৩০)। সেখানে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে কোন উপায় না দেখে ২০০৭ সালের ৬ জুলাই আত্মহননের পথ বেছে নেয় সেলিনা (৩০)। দুর্গাপুরের পারচৌপুকুরিয়া গ্রামে ২০০৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের শিকার হয় কিশোরী চায়না খাতুন। লজ্জা আর অপমানে ওইদিনই সে বিষপানে আত্মহত্যা করে। এছাড়াও এক যুবক কর্তৃক অশ্লীল ভাষায় অপমানের শিকার হয়ে ২০০৫ সালের ২২ জুন আত্মহত্যা করে দুর্গাপুরের ময়না (১৭)। সর্বশেষ চাঞ্চল্যকর আত্মহননের ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে। গত ২০১০ সালের ৪ এপ্রিল স্টার সানডের অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার সময় বখাটে যুবকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় গোদাগাড়ীর রিশিকুল ইউনিয়নের আমতলি গ্রামের আদিবাসী কিশোরী সিরাফিনা। এ ব্যাপারে মামলা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হয় আদালতে। বিচারও শুরু হয়। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালীদের চাপে সিরাফিনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটনার মীমাংসা করে নেন তার বাবা। এরপর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে সিরাফিনা। জীবনের প্রতি প্রচ- অনীহা আর ক্ষোভ নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি নিজেই নিজের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সিরাফিনা। দগ্ধ শরীর নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়ে সে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক কল্পনা রায় বলেছেন, দারিদ্র্যতার কারণে এবং প্রভাবশালীদের চাপেরমুখে মীমাংসাযোগ্য নয়। এমন ঘটনাগুলো মীমাংসা হচ্ছে। মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছে বাদী। এতে ভিকটিম নানান সমস্যায় পড়ছে। মূলত সামাজিক অবস্থা এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনার পেছনে দায়ী। ভিকটিমকে ভর্ৎসনা করা হয় সমাজে। ধর্ষিতা হবার পরও ধর্ষণের শিকার নারীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অপবাদ দেয়া হয়। ভিকটিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। পরিবার এবং সমাজে মানসিক চাপেরমুখে পড়ে যায় ভিকটিম। চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় ভিকটিম।


-সুব্রত দাস, রাজশাহী

0 comments:

Post a Comment