Sunday, March 6, 2011

প্রিয়া বিহার

0 comments
শান্তি আর সম্প্রীতির জন্য হিন্দু দেবতা শিবকে উৎসর্গ করে নির্মিত মন্দির 'প্রিয়া বিহার' এখন হয়ে উঠেছে মৃত্যুর মন্দির! দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র কম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ডের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাতের মূলে আছে 'প্রিয়া বিহার'। এমনকি দেশ দু'টির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ভোটের লড়াই ও স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে এই শিব মন্দিরটি।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ড এই দুই দেশের কোনোটিই হিন্দু অধু্যষিত রাষ্ট্র নয়। দু'টি দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। অথচ উভয় দেশের বিরোধের মূলে আছে হিন্দু দেবতা শিবকে নিয়ে নির্মিত এই মন্দিরটি। কম্বোডিয়ার সীমান্তবতর্ী উপত্যকা এলাকায় মন্দিরটির অবস্থান। যা কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সীমান্তের খুব কাছাকাশি নিভৃত এক এলাকা। এগার শতকের প্রথমভাগে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। কম্বোডিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকার বাইরে মন্দিরটির অবস্থান হওয়ায় এখনো এটি অনেকটাই সুরক্ষিত অবস্থায় আছে। এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী একেবারেই ব্যতিক্রম। গঠন প্রক্রিয়ার কারণে মন্দিরটি স্থায়িত্বের দিক থেকেও শক্তিশালী। খোদাইকৃত পাথরের কারুকাজের সমন্বয়ে প্রায় ৮০০ মিটার এলাকা জুড়ে মন্দিরটি বিস্তৃত। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো কম্বোডিয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রিয়া বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর ফলে থাইল্যান্ডের সঙ্গে কম্বোডিয়ার বিরোধ নতুন মাত্রা নেয়া। শুরু হয় হানাহানি, রক্তক্ষয়ী সংঘাতের। অবশ্য মন্দিরকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ অনেক দিনের। থাইল্যান্ড প্রিয়া বিহারকে সবসময়ই তার ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে আসছে। প্রিয়া বিহারকে দুই দেশই তাদের সম্পদ বলে দাবি করায় এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ও সালিশী কার্যক্রম কম হয়নি। ১৯৬২ সালে বিবদমান এই দুই দেশের মধ্য মীমাংসার উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক আদালত। প্রিয়া বিহার কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে অবস্থিত এবং এই মন্দিরটি কম্বোডিয়ায় অধিকারে ও তত্ত্বাবধানে থাকবে- ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের এই রায়কে আজ পর্যন্ত মেনে নেয়নি থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডের যুক্তি প্রিয়া বিহারে প্রবেশের মূল পথ তাদের ভূখণ্ডে অবস্থিত। এর পাশাপাশি প্রিয়া বিহার সীমান্তের যে অংশে অবস্থিত তা থাইল্যান্ড তাদের সীমানা বলে দাবি করছে। যদিও সীমান্তের এই অংশটি দীর্ঘদিন ধরে কম্বোডিয়ার নিয়ন্ত্রণে আছে। '৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের দেয়া রায়ের পর থেকে দুই দেশের সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে একাধিকবার গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ইউনেস্কো ২০০৮ সালে প্রিয়া বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ায় পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই দুই দেশের সীমান্তবতর্ী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি ও সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে থাই বাহিনীর বোমা বর্ষণে প্রিয়া বিহারের কিছু অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কম্বোডিয়ান সরকার এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য থাইল্যান্ডকে দায়ী করেছেন। ইউনেস্কোর ডাইরেক্টর জেনারেল ইরিনা বুকোভা এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ প্রিয়া বিহার পৃথিবীর সব মানুষের সব সভ্যতার জন্য নিদর্শন স্বরূপ। ঐতিহ্য মানুষকে একীভূত করে সংঘাত থেকে দূরে রাখে। কিন্তু এখানে তার ব্যত্যয় ঘটছে। প্রিয়া বিহারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন তিনি। তবে প্রিয়া বিহারকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার মূলে আছে রাজনীতি। গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে কম্বোডিয়ান আদালত সে দেশে ধরা পড়া দু'জন থাইল্যান্ডের নাগরিককে ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ বছরের সাজা দিয়েছে। আর এতে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য থাইল্যান্ডের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এরপরই সীমান্তে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে রেখেছে প্রিয়া বিহার ইসু্য। ২০০৮ সালের পর থেকেই থাইল্যান্ডের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রিয়া বিহার ইসু্যকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে। ইউনেস্কো কম্বোডিয়ার আবেদনে সাড়া দেয়ায় একে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে প্রচারণা চালায় থাইল্যান্ডের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। যার নেতৃত্বে ছিল সরকারের কট্টর সমালোচক ইয়েলো শার্ট গোষ্ঠী। তাদেরকে সমর্থন যুগিয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা। অন্যদিকে কম্বোডিয়ান রাজনৈতিক নেতারা ইউনেস্কোর ঘোষণাকে ভোটে জেতার কৌশল হিসাবে কাজে লাগিয়েছে। যার ফলে দুই দেশেই প্রিয়া বিহারকে কেন্দ্র করে বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক অসন্তোষ আর সংঘাত। যার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শ্রদ্ধা, সংযম, সহানুভূতি আর ভালোবাসার মন্দির হয়ে উঠেছে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জাতিগত আভিজাত্যের লড়াই। রাজনৈতিক নেতারা মন্দির ইসু্যকে ব্যবহার করছেন ভোটের লড়াই এবং ক্ষমতায় যাবার হাতিয়ার হিসাবে। ব্যক্তিস্বার্থও রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হচ্ছে প্রিয়া বিহার। মন্দির রক্ষার নামে দুই দেশে যে আন্দোলন উস্কে দিচ্ছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাতে মন্দিরের অস্তিত্বই এখন ধ্বংস হতে চলেছে। দিন দিন দুই দেশের সীমান্ত পরিস্তিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পাল্টাপাল্টি গুলি, কামান ও বোমা বর্ষণে হয়তো কারো জয় হবে একদিন কিন্তু মন্দিরটি ততোদিন অক্ষত থাকবে কিনা এখন সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মন্দির রক্ষায় এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে আর কতো মানুষকে প্রাণ দিতে হবে তা একমাত্র শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই বলতে পারবেন।

-ইমাম হোসেন সাঈদ

0 comments:

Post a Comment