Friday, March 18, 2011

ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ

0 comments
সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলতে মূলত আঠারো শতকের শেষের দিকে(১৭৬০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতবর্ষের বাংলাতে সন্ন্যাসী ও ফকির বা মুসলিম ও হিন্দু তাপসদের তত্কালীন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলনকে বোঝানো হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক এ আন্দোলন ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামেও পরিচিত।. ইতিহাসবিদগণ বিদ্রোহটির পটভূমি নিয়েই শুধু দ্বিধা বিভক্তই নন, বরং ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা মতদ্বৈত্বতা লক্ষণীয়। কেউ কেউ একে বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকার বলে মনে করেন যেহেতু ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর খাজনা উত্তোলনের কতৃত্ব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়া হয়, আবার কারো কারো মতে এটি ১৭৭০ এর দুর্ভিক্ষোত্তর বাংলায় কিছু দস্যুর উন্মত্ততা ছাড়া কিছুই না।

পটভূমি
অন্তত তিনটি আলাদা ঘটনাকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে অভিহিত করা হয়। যার একটি মূলত সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলিম মাদারী এবং ধার্মিক ফকিরদের বৃহত্ গোষ্ঠী যারা পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্নস্থান ভ্রমন করতেন। যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসীগণ গোত্রপ্রধাণ,জমিদার অথবা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। সমৃদ্ধির সময়ে গোত্রপ্রধাণ, জমিদারগণও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদার ও অনুগত ছিলেন কিন্তু যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দেওয়ানী ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় ফলে স্থানীয় ভূস্বামী ও গোত্রপ্রধানগণ সন্ন্যাসী এবং ইংরেজ উভয়কেই কর প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়ে। উপরন্তু ফসলহানি,দুর্ভিক্ষ যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় যা তৎকালীন বাংলার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, সমস্যাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয় কারণ আবাদী জমির বেশীরভাগ থেকে যায় ফসলশূণ্য

১৭৭১ সালে, ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। এটি ছিল অনেকগুলো কারণের একটি যা ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীতে রূপ নেয় সংঘাতে বিশেষত নাটোরে,রংপুরে যা এখন আধুনিক বাংলাদেশের অন্তর্গত। যদিও কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদ মনে করেন আন্দোলনটি কখনোই জনপ্রিয় হয়নি।[২]

অন্য দুটি আন্দোলন ছিল হিন্দু সন্ন্যাসীদের একটি অংশ দসনমি নাগা সন্ন্যাসীদের, যারা একইভাবে তীর্থ ভ্রমনের পাশাপাশি অর্থ ধার দেয়ার সুযোগ কাজে লাগাত।[২] ব্রিটিশদের কাছে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সন্ন্যাসীরা ছিল লুটেরা । এদেরকে কোম্পানীর প্রাপ্য অর্থে ভাগ বসানো এবং এমনকি সম্ভব হলে বাংলায় প্রবেশ ঠেকাতে তারা ছিল সদা তত্পর। তাদের কাছে ভ্রাম্যমান মানুষের এই বিশাল স্রোত সম্ভাব্য হুমকি বলে মনে হত।

সন্ন্যাসী ও কোম্পানীর মধ্যে সংঘর্ষ
আঠারো শতকের শেষের তিন দশক জুড়ে যখনই কোম্পানীর সৈন্যরা সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রদেশে বাধা দেয়া হয়েছে তখনই ভয়ানক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষে সব সময় ই যে কোম্পানীর সৈন্যরা বিজয়ী ছিল তা নয়। বেশীর ভাগ সংঘর্ষের তথ্য নথিভুক্ত করা হয়েছে দুর্ভিক্ষের পরবর্তী বছরগুলোতে। কিন্তু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ১৮০২ সাল পর্যন্ত, যদিও তুলনামূলকভাবে কিছুটা অনিয়মিতভাবে। এমন কি উন্নততর প্রশিক্ষণ সুবিধা ও সৈন্য সম্ভার থাকা সত্ত্বেও কোম্পানী ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসীদের সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ ছিল না। এর কারণ মূলত পাহাড়ী এবং জঙ্গল আচ্ছাদিত জেলা যেমন মেদিনীপুর এবং বীরভূমে কোম্পানীর নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল।

ঐতিহাসিক তাৎপর্য
বাংলার পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহতে ধারাবাহিকভাবে যে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে তার মধ্যে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রথম। এছাড়া ১৭৯৯ সালের চর বিদ্রোহ ১৮৩১ ও ১৮৩২ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য।[৩] সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া কি তা বিতর্ক সাপেক্ষ। সম্ভবত এর সর্বোত্তম প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে সেই সময়কার সাহিত্যে বিশেষত ভারতের প্রথম আধুনিক সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বাংলা উপন্যাস আনন্দমঠে। উপন্যাসটি থেকে সংগ্রহীত বন্দে মাতরম গানটি তখন ভারতের জাতীয় গীত হিসেবে ঘোষিত হয়। (এটি ভারতের এখনকার জাতীয় সংগীত নয়।)

-সোহেল

0 comments:

Post a Comment