Wednesday, April 18, 2012

সিরাজগঞ্জ

0 comments
দেশের ঐতিহাসিক প্রাচীন নির্দশন দেখার ইচ্ছা আমার প্রবল। তাই একটু ফুরসত্ পেলেই দেশের কোনো একটি ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে আসি। অবশ্য ওইসব এলাকায় পরিচিত কোনো বন্ধু-স্বজন থাকলে তো আর কথাই নেই, ঘুরতে যাবই। বেশ কিছু দিন যাবত কোথাও বের হওয়ার সুযোগ পাইনি। প্রতিবন্ধকতা ছিল এমএ পরীক্ষা, ক্ষুদ্র ব্যবসা কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, শখের নেশা সাংবাদিকতা। গত বছর ৬ জুলাই কারমাইকেল কলেজে ইতিহাস (এমএ) শেষ বর্ষের মৌখিক পরীক্ষা শেষ করেই ঢাকা হয়ে সিরাজগঞ্জ ঘোরার মনস্থির করি। মাঝে বিরোধী দলগুলোর হরতাল, পবিত্র শবেবরাতের কারণে কয়েকদিন দেরি হলো।
২৭ জুলাই তেঁতুলিয়া থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। ঢাকায় পৌঁছে সেখান থেকে সিএনজিযোগে মহাখালী বাস টার্মিনালে যাই। ‘অভি এন্টারপ্রাইজ’ বাসযোগে সাড়ে ১১টায় সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হলাম। ডাক্তার বন্ধু জানাল, ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছতে ঘণ্টা চারেক সময় লাগে। কিন্তু রাস্তার জ্যাম এবং টাঙ্গাইল বাইপাস সড়কে ফুকে গাড়ির সামনের চাকা পাংচার হওয়ায় এক ঘণ্টা দেরিতে সিরাজগঞ্জে পৌঁছলাম।
হার্ডপয়েন্ট থেকে ফেরার পথে আমাকে সাংবাদিক হেলাল ভাই নিয়ে গেল উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণিত সম্রাট জাদব চক্রবর্তীর ঐতিহাসিক বাড়িতে। প্রায় সাড়ে তিন একর জমির ওপর অবস্থিত প্রাচীন নিদর্শন কারুকাজের নকশাকৃত পুরনো বিল্ডিংটি দেখে মন জুড়িয়ে গেল। সেখানে প্রবেশ করে মনে হচ্ছিল আমি এক রাজবাড়িতে ঢুকেছি। শুনেছি স্বাধীনতার পর বাড়িটি ‘এতিম শিশু সদন’ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। প্রফেসর ডা. এমএ মতিন প্রাচীন বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে একশ’ বছরের জন্য লিজ নিয়ে মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছেন। প্রতি সেশনে ৩৭ জন দেশের এবং ১৩ জন বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী মেডিকেল বিষয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন। সেখানে ফটোসেশন করার পর আমাকে নিয়ে গেল ঐতিহাসিক ইলিয়াট ব্রিজ দেখার জন্য, যা ‘বড় পুল’ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। লোহার নকশাকৃত ব্রিজটি সিরাজগঞ্জের দু’শহরকে একত্রিত করেছে। ব্রিজের পাশে রয়েছে ছোট একটি শিশুপার্ক। নকশাকৃত লোহা দিয়ে তৈরি ব্রিজটি দেখার মতোই। সেখানেও ফটোসেশন করলাম।
ইলিয়াট ব্রিজ থেকে আবারও সাংবাদিক হেলাল ভাইয়ের অফিসে গেলাম। হেলাল ভাই আগের মতো গরম কলজি সিংড়া ও চমচম মিষ্টি এনে আপ্যায়ন করাল। তখন সময় দুপুর ২টা। আমি নাস্তা সেরে সাংবাদিক হেলাল ভাইকে প্রস্তাব দিলাম, চলুন রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি ঘুরে আসি। কিন্তু তার জরুরি কাজ থাকায় তিনি অব্যাহতি চেয়ে আমাকে কাচারি বাড়ি যাওয়ার দিকনির্দেশনা দিলেন। একই সঙ্গে শাহজাদপুরের সাংবাদিক বন্ধু ‘দৈনিক করতোয়া’র সাগর বশাককে ফোনে জানিয়ে দিলেন আমার যাওয়ার কথা। তখন সিরাজগঞ্জ শহর থেকে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি যেতে লোকাল বাসে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে। কিন্তু আমাকে রাতে বাড়ি ফিরতে হবে। ঐতিহাসিক কাচারি বাড়ি দেখার প্রবল ইচ্ছা পূরণের জন্য বাস টার্মিনাল সংলগ্ন মোড় থেকে চারশ’ পঞ্চাশ টাকায় সিএনজি ভাড়া করে বিকাল পৌনে ৩টায় শাহজাদপুর রবীন্দ্র কাচারি বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। যাওয়ার প্রাক্কালে রাস্তার দু’পাশে অবলোকন করলাম তাঁতিদের তাঁত বোনার দৃশ্য। সিএনজি চালককে বললাম, ভাই দেখেশুনে জোরে চালিয়ে যাবেন। আমি এক ঘণ্টা দশ মিনিটে শাহজাদপুর পৌঁছলাম। বাসস্ট্যান্ড মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি ফোন দিলাম সাংবাদিক বন্ধু সাগর বশাককে। তিনি আমার ফোন পেয়ে বাজারের ভেতরে গৌড়ি সিনেমা হলের সামনে আমাকে যেতে বললেন। আমি সিএনজি চালককে নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি অপেক্ষমাণ সাংবাদিক বশাক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তার বাজারে বড় কাপড়ের দোকানও রয়েছে। তাই তিনি খুব ব্যস্ত। তবু আমার সঙ্গে সিএনজিতে উঠে কয়েক মিনিটে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি পৌঁছালাম। বর্তমানে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি জাদুঘর হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত। সেখানে প্রবেশকালে ২০ টাকার টিকিট নিতে হয়। স্থানীয় সাংবাদিক সাগর বশাকের অতিথি হওয়ায় আমাকে সে টাকা দিতে হয়নি। সাংবাদিক বন্ধু আমাকে প্রথমে জাদুঘরে নিয়ে গেল। জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশদ্বারে দু’পাশে বড় হার্ডবোর্ডে লিখা ‘ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে একটি দ্বিতল ভবন যার দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার ও উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির প্রতি তলায় সিঁড়িঘর ছাড়া বিভিন্ন আকারের মোট সাতটি কক্ষ এবং উত্তর-দক্ষিণ পাশে প্রশস্ত বারান্দা।
শাহজাদপুরের জমিদারি একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারির অংশ ছিল। ১৮০৪ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তেরশ’ টাকা দশ আনায় কিনে নেন। জমিদারির সঙ্গে শাহজাদপুরের কাচারি বাড়িটি হস্তগত হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ পর্যন্ত মাত্র আট বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য এ বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন। তিনি থাকতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৯৬৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর জরাজীর্ণ অবস্থায় পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। রবীন্দ্র আলোকচিত্র ও বাড়িতে প্রাপ্ত আসবাবপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি জাদুঘর করার চেষ্টা চলছে।
সেখানে ঢুকে নিচতলায় দেখলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শৈশবের ছবি, বয়সের ভারে পৌঢ় ছবি ও তার হাতের লেখা পাণ্ডুলিপি দেয়ালিকা। জাদুঘরের উপরতলায় আছে কবির ব্যবহৃত চেয়ার, শোফা সেট, খাট সেট, পালকি, হারমোনিয়াম, চিনামাটির প্লেট, নানা ধরনের চেরাগ বাতি ইত্যাদি। যেগুলো সংরক্ষণের জন্য সাদা চকচকে প্লাস্টিক কাগজ দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু জিনিস স্বচ্ছ আলমিরার মধ্যে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরের ভেতরে স্বল্প সময়ে অবস্থান করে বিশ্বকবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখে মন জুড়িয়ে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম রবীন্দ্র চর্চার জন্য নবনির্মিত অডিটোরিয়াম ভবনে। সেখানে জাদুঘরের দায়িত্বরত কাস্টডিয়ান জহরুল হকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি আমাকে এক কাপ চা খেতে বললেন। প্রচণ্ড গরমে আমি ঠাণ্ডা পানি খেয়ে বিদায় নিলাম। এবার সাংবাদিক বন্ধু সাগর বশাক বাজারে তার এলাকার চমচম মিষ্টি ও দই খাওয়ালেন। বিকাল পৌনে ৫টায় সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে ফিরলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সিরাজগঞ্জ বাজারে পৌঁছলাম। সুযোগ পেলে আপনিও ঘুরে আসুন উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণিত সম্রাট জাদব চক্রবর্তীর বাড়ি, শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি, ইলিয়াট ব্রিজ ও সিরাজগঞ্জ শহররক্ষা বাঁধ।

আমার দেশ
এম. এ. বাসেত

0 comments:

Post a Comment