Wednesday, July 25, 2012

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

0 comments
ময়মনসিংহ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম প্রান্তে চিরসবুজে ঘেরা গ্রামীণ পরিম-লে ১ হাজার ২৩০ একর এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম বিদ্যাপীঠ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং গৌরবমতি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) কৃষি আধুনিকায়ন ও গবেষণায় উলেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চলছে। ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের প্রথম এ টেকনিক্যাল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বাকৃবি উন্নত মানসম্মত উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুদায়িত্ব বহনে সমর্থ তাত্তি্বক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসমপন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ তৈরি ও সরবরাহ করছে। এটি মূলত একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি ও সংশ্লিষ্ট সব বিজ্ঞানের শাখায় শিক্ষাদান, পরীক্ষা পরিচালনা ও অধিভুক্তি প্রদানের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি শিক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এছাড়া ৩৫টি বিভাগ থেকে ৪৪টি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটির ওপর স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের উন্নয়ন, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে জামালপুরের মেলান্দহে অবস্থিত বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ফিসারিজ কলেজে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২২ হাজার ৯৭৬ জন স্নাতক, ১২ হাজার ৬২৪ জন স্নাতকোত্তর এবং ৩৪১ জন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উওীর্ণ বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০১ জন। তাছাড়াও বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে নোবেল লরিয়েট কৃষি বিজ্ঞানী ড. নরম্যান ই বোরলগকে সন্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদে অধ্যয়নরত রয়েছেন স্নাতক পর্যায়ে ৩ হাজার ১৩৪ জন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ হাজার ৩৬৭ জন এবং পিএইচডি পর্যায়ে ২৬২ জন শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষকসংখ্যা ৫১৯। এছাড়া আছেন ৩৮৬ জন কর্মকর্তা, ৫২৯ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী এবং ১ হাজার ২৫৬ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে উত্তীর্ণ কৃষিবিদরা দেশে খাদ্য জোগানোর কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। আন্তর্জাতিকভাবেও কৃষি গবেষণায় তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক উপাচার্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট মাৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মুহাম্মদ আমিনুল হক বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গবেষণা করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শস্যের জাত, উৎপাদন কলাকৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন যা দেশের কৃষি প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এগুলোর মধ্যে বাউকুল, বাউ-৬৩ ও বাউধান-২ নামে দুটি উফশী ধানের জাত, 'সম্পদ' ও 'সম্বল' নামে দুটি উফশী সরিসা জাত, ডেভিস, ব্র্যাগ, সোহাগ ও জি-২ নামে চারটি সয়াবিন জাত, কমলা সুন্দরী ও তৃপ্তি নামে দুটি মিষ্টি আলুর জাত, লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী নামে তিনটি মুখীকচু জাত, রাইজোবিয়াল জৈব সার উৎপাদন প্রযুক্তি, সয়েল টেস্টিং কিট, পেয়ারার মড়ক দমনের কলাকৌশল, কলা ও আনারস উৎপাদনের প্রযুক্তি, শুষ্ক বা স্বল্প পানিতে ধান চাষ, হাঁস-মুরগির টিকা উৎপাদন, ধানক্ষেতে মাছ ও চিড়ি চাষ, পুকুরে মাছ চাষে সহজলভ্য মৎস্য খাদ্য তৈরি, মাগুর, শিং ও তারাবাইন মাছের কৃ্িত্রম প্রজননের কলাকৌশল, আফ্রিকান ধৈঞ্চার অঙ্গজ প্রজনন, বর্ষব্যাপী পাতাজাতীয় সবজি চাষ, সুষম পোলট্রি খাদ্য, কৃত্রিম পশুপ্রজনন, গোখাদ্য হিসেবে খড়ের সঙ্গে ইউরিয়া- মোলাসেস বকের ব্যবহার, উন্নত ধরনের লাঙ্গল, বাউ জিয়া সার ও বীজ ছিটানোর যন্ত্র, সৌর ড্রায়ার, বায়োগ্যাস প্লান্ট উদ্ভাবন, সবজি শোধন যন্ত্র, ভাইরাস শনাক্তকরণের যন্ত্র, পাতা দেখে রোগ নির্ণয়, পাতা দেখে উৎপাদনের পরিমাণ নির্ণায়নের যন্ত্র, খুঁটে খাওয়া হাঁস-মুরগির উন্নত জাত উৎপাদন, রোগ-প্রতিরোধী বেগুন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেম বা বাউরেসের তত্ত্বাবধানে ৮৬৬টি গবেষণা প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে এবং বর্তমানে এর চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ১৫২টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব গবেষণা তৎপরতার ফলে দেশের কৃষি প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে এমন উলেখযোগ্যসংখ্যক শস্যজাত, উৎপাদন কলাকৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গৌরব অর্জন করা সম্ভবপর হয়েছে।
জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণা সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমপ্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি মানসম্মত বিশেষায়িত ল্যাব গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিড প্যাথলজি সেন্টার, আইপিএম ল্যাব, বায়োটেকনোলজি ল্যাব, সয়াবিন ও অয়েল সিড ল্যাব, ফিল্ড ফার্টিলিটি ক্লিনিক ল্যাব এবং কেন্দ্রীয় গবেষণাগার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পশু-পাখিদের রোগ নির্ণয়ের জন্য ভেটেরিনারি ক্লিনিক, ফিল ফারটিলিটি ও উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়ের জন্য দেশের তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও প্রধান প্যান্ট ডিজিজ ক্লিনিক রয়েছে। বাউএক আয়োজিত ৩৬টি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৯ হাজার ৭৯৮ জন কৃষক-কৃষাণীকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তার কাজের উপর ভিত্তি করে 'সংযোগ' নামে একটি নিউজ লেটার প্রকাশিত হয়ে থাকে। তাছাড়াও শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে সমপ্রসারণের জন্য সমপ্রসারণ মাঠ সফরের আয়োজন করে থাকে।
দেশের কৃষি বিজ্ঞানী ও উন্নয়নকর্মীদের মাঝে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্য সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও বিভিন্ন বিজ্ঞান সমিতির উদ্যোগে ১৫টি উচ্চ মানসম্মত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জার্নাল প্রকাশিত হয়ে থাকে। দেশের একমাত্র সেশনজট মুক্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সময়ে জাতীয় কৃষি পুরস্কার হিসেবে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদকসহ অন্যান্য পদক লাভের গৌরব অর্জন করে সেগুলোর মাঝে রয়েছে, বৃক্ষরোপণ, গৃহাঙ্গন পর্যায়ে হাঁস-মুরগি পালন, কলা চাষের উন্নত প্রযুক্তি, গ্রামীণ সমবায় পদ্ধতি উদ্ভাবন, বায়োগ্যাস প্রযুক্তি উদ্ভাবন, সার বীজ ছিটানো যন্ত্র উদ্ভাবন, শস্য শুকানোর পদ্ধতি উন্নয়ন, বীজ শোধন ও সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা ও ফার্মিং সিস্টেম, জার্ম পাজম সেন্টারের পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার।
ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও কৃতিত্বকে উৎসাহদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তির উদ্যোগে বিশ্ববিদালয়ে বেশ কয়েকটি ট্রাস্ট তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। গবেষণা ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করা হয়। ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, বিজয়-'৭১ ও বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।

গুলশান আনোয়ার

0 comments:

Post a Comment