Friday, September 21, 2012

সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভিন্ন যৌক্তিকতাবোধ

0 comments
ক্ষমতায়ন শব্দটি ১৯৯০ থেকে উন্নয়নের মাঠে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যেখানে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় নারীর ক্ষমতায়ন মানে কী, তাহলে উত্তরটি নানারকম হতে পারে, বিশেষত যেখানে নারীরা কোনো সমশ্রেণীভুক্ত গোষ্ঠী নয় এবং দেশ, শ্রেণী, জাতি অনুযায়ী তাদের পরিস্থিতি ও অবস্থান ভিন্ন। তারপরও বিশেষজ্ঞরা ক্ষমতায়নের কিছু কাঠামো তৈরি করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নকে নারীবাদী, সমাজকর্মী, উন্নয়ন কর্মীরা নানা দিক থেকেই ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে, তৃতীয় বিশ্বের নারী আন্দোলনের মূল দিক হলো নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। নারীর ক্ষমতায়নের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে অন্যতম হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ নারী তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে কিনা এবং তার ক্ষমতা দিয়ে সম্পদে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে কিনা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারীর ক্ষমতায়নকে বুঝতে হলে এখানকার সমাজ কাঠামোকে বুঝতে হবে। সাধারণত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নারীরা পুরুষের তুলনায় অধস্তন অবস্থানে থাকে। এখানকার বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামোর কারণে একটি মেয়েশিশুর জন্মকে বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীকালে খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা, শিক্ষা, আয়, সম্পদে বৈষম্যের শিকার হয়ে পরিবারে, সমাজে একজন নারীর অবস্থান দাঁড়ায় পুরুষের অধস্তন। এই পরিপ্রেক্ষিতে একজন নারীর এই সুবিধাগুলো অর্জনের সংগ্রামকেই ক্ষমতায়ন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সেক্ষেত্রে ধারণা করা যেতে পারে এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে একজন নারী পরিবারে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাটি চর্চা করতে পারবে।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী কতখানি তার সিদ্ধান্তকে পরিবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে? এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সাথে আরও একটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। বহুকাল ধরেই অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকে ক্ষমতায়নের প্রধান মানদ- হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে। যেহেতু অর্থ উপার্জনের সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি যোগসূত্র রয়েছে, তাই শিক্ষিত চাকরিজীবী নারীর মতামতকে পরিবারে যথেষ্টই মূল্য দেয়া হয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বহু গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে উপলব্ধি করেছেনÑ নারীর ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করে অর্থ উপার্জনের সক্ষমতা তাকে এক ধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়, যার ফলে সে তার পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করে থাকে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, অর্থ উপার্জন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে। কিন্তু যেসব নারী বাইরে কাজ করছেন না, তাদের মতামতটি কি তবে মূল্যহীন হবে? তারা কি যৌক্তিক সিদ্ধান্তনিতে পারে না? 
ধরা যাক, একটি পরিবারে মাকে দূরে কোথাও যেতে হবে জরুরী প্রয়োজনে এবং সেই মুহূর্তে পরিবারের শিশু সন্তানটিও ভীষণ অসুস্থ। কিন্তু সেই জায়গায় যাওয়াটাও অত্যন্ত জরুরী। এই পরিস্থিতিতে একজন মা কী করেন? তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা চালান যাতে না যেতে হয়, তিনি বাচ্চাটার কাছে থাকতে পারেন। এই সিদ্ধান্তটি তিনি কিসের ওপর ভিত্তি করে নেন?
কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী ও পুরুষের সিদ্ধান্তের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কেননা নারীরা ভিন্ন অনুভূতি বা নৈতিক যৌক্তিকতাবোধ ধারণ করে। ঐতিহাসিকভাবে নারীর জীবন গড়ে ওঠে পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে, যার ফলশ্রুতিতে একজন নারী ও একজন পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। আর নারীর এই ভিন্ন অভিজ্ঞতা তার মধ্যে একটি স্বতন্ত্র যৌক্তিকতাবোধ তৈরি করে, যেটা গড়ে ওঠে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে, পরিবারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। নারীরা পরিবারে তাদের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের সাথে এক ধরনের আবেগীয় বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, যার ফলস্বরূপ সে যখন পরিবারের কোন সিদ্ধান্ত নিতে যায় তখন সবার কথা, ভালোমন্দ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। নারীবাদী সাইকোলজিস্ট ক্যারল গিলিগান তার ‘ইন ও ডিফারেন্ট ভয়েস’ বইয়ে নারীর এই ভিন্নধর্মী গুণাবলীর বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে একজন পুরুষ শুধু নিয়মনীতি, ন্যায়-অন্যায়, অধিকার, নিরপেক্ষতা ইত্যাদির মানদ-ে সিদ্ধান্ত নেয়, সেখানে একজন নারী সবসময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের চাহিদার বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যা কিনা অনেক বেশি যৌক্তিক এবং একই সাথে সংবেদনশীল।
পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থা তৈরি হয় নারীর ওপর অর্পিত কাজগুলোর কোনো আর্থিক মূল্যমান না থাকার কারণে। গিলিগান নারীর এই প্রথাগত কাজগুলোকেই নারীর ক্ষমতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখান থেকে নারী সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিতে শিখে। সেক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীবাদীদের সংজ্ঞার সাথে গিলিগানের এই তত্ত্বের সংঘর্ষ হয়। যেমন, শ্রীলতা বাটলিওয়ালা (১৯৯৪), নায়লা কবির (১৯৯৪, ২০০১), জো রওল্যান্ডস (১৯৯৭, ১৯৯৮) প্রমুখ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার কথা বলেছেন, যেখানে তার জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন। অর্থাৎ পরিবারে নারীর প্রথাগত দায়িত্ব এবং কাজের পরিবর্তন জরুরি। 
কেননা এগুলোর কোনো আর্থিক স্বীকৃতি নেই এবং এর ফলে পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্ব খাটায়। কিন্তু গিলিগান মনে করেন, নারীর এই ভিন্নধর্মী পরিবারকেন্দ্রিক গুণাবলি তার নিজ মহিমায় প্রশংসার দাবিদার। সেক্ষেত্রে নারীর এই আলাদা সংবেদনশীল যৌক্তিকতাবোধটাকে উপলব্ধি করে যদি পরিবারের যে কোনো সিদ্ধান্তে নারীর মতামত নেয়া হয় সেক্ষেত্রে সেটি হবে অনেক বেশি ফলপ্রসূ এবং সুদূরপ্রসারী। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন নারীর ঘরের কাজকে মূল্যায়নে করতে শেখা, তার এই স্বতন্ত্র যৌক্তিকতাবোধটাকে উপলব্ধি করে সেটাকে সম্মান করতে জানা।

রওশন আক্তার ঊর্মি

0 comments:

Post a Comment