Sunday, October 21, 2012

পাণ্ডু রাজার ঢিবি

0 comments
খুব কমসংখ্যক বাঙালি পাণ্ডু রাজার ঢিবি সম্পর্কে জানেন। তবে অনেক বাঙালিই জানেন সিন্ধু সভ্যতার কথা। প্রাচীন হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর পরিকল্পিত নগরী তাদের অবাক করে। নীলনদকেন্দ্রিক মিসরীয় সভ্যতাও অনেকের অজানা নয়। ব্যবিলনীয়, মেসোপটেমীয়, এসেরীয় সভ্যতা কিংবা প্রাচীন গ্রিক অথবা পারসিক সভ্যতা সম্পর্কেও তারা অনেকে খবর রাখেন। বিশেষ করে শিক্ষিত বাঙালি। সভ্যতা সম্পর্কে এ জ্ঞান তাদের পুলকিত করে। তারা বিস্মিত হন, মানব জাতির অংশ হিসেবে গৌরব বোধ করেন। এরূপ গৌরব করার মতো উপাদানই পাণ্ডু রাজার ঢিবি। যাকে বাংলা ও বাঙালি সভ্যতার স্মারক হিসেবে অভিহিত করা যায়।
নদীকেন্দ্রিক বাংলার বিস্তীর্ণ সমতল ভূ-ভাগ অপেক্ষাকৃত নবীন বলে এসব অঞ্চলে মানব বসতি গড়ে উঠেছে অনেক পরে। তাই সভ্যতার বয়সও এসব অঞ্চলে বেশি নয়। তবে বাংলার উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের পার্বত্যভূমি এবং নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের ভূ-ভাগ অনেক প্রাচীন বলে এসব স্থানে মানব বসতি গড়ে ওঠে হাজার হাজার বছর আগে। অন্তত নব্য প্রস্তর যুগে স্থায়ী মানব বসতি গড়ে তুলে এসব অঞ্চলে আদি বাঙালিরা যে কৃষি সমাজের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। বিকাশের এ ধারা অব্যাহত ছিল এবং কালক্রমে উন্নতি ঘটেছিল। ক্রমোন্নতির ধারায় তাম্রপ্রস্তর যুগে বাংলার পুরনো ভূমি অঞ্চলের বিভিন্ন নদী উপত্যকায় গড়ে ওঠে সুসভ্য মানব বসতি। বিকাশ ঘটে উন্নত সংস্কৃতির। গড়ে ওঠে বাণিজ্যিক শহর। ধারণা করা হয় আলোচিত পাণ্ডুু রাজার ঢিবি এবং সংলগ্ন অঞ্চল ঘিরে এমনই এক বাণিজ্যিক শহরের পত্তন ঘটেছিল। বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার অজয় নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে এ শহর গড়ে ওঠে।
প্রতœতত্ত্ববিদদের নিরলস খনন-প্রয়াসে ১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত হয় পাণ্ডু রাজার ঢিবি। ঢিবি ও সংলগ্ন অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় অসংখ্য তাম্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন। এসব নিদর্শন থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার সুসভ্য বাঙালি সংস্কৃতি বা সভ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময়কাল জগদ্বিখ্যাত সিন্ধু সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক। তাই বলা যায়, যে সময়ে ভারতের পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে উন্নত ধরনের সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল সে সময়ে বাংলাও পিছিয়ে ছিল না। পাণ্ডু রাজার ঢিবি ও সংলগ্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রতœনিদর্শনসমূহ সাক্ষ্য দেয় চাষাবাদ, পশুপালন, ইট ও পাথরের ভিত্তির ওপর আরামদায়ক গৃহনির্মাণে বাঙালির পারঙ্গমতা ছিল ঈর্ষণীয়। তারা গোলাকার, বর্গাকার এবং আয়তাকার ঘর তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। পোড়া মাটির টুকরা এবং চুনের আস্তরণে ঘরগুলোর মেঝে পাকা করার কৌশল তারা আবিষ্কার করেছিলেন। নলখাগড়ার সঙ্গে মাটি মিশিয়ে তারা তৈরি করতেন ঘরের পোক্ত বেড়া বা দেয়াল। এরূপ দেয়াল আর খুঁটির ওপর নির্মিত হতো ঘরের ছাদ। শুধু গৃহনির্মাণ নয়, শিল্প ও শিল্পকলার নানা শাখায়ও তাদের উন্নতি ঘটেছিল ব্যাপক। ঢিবিতে প্রাপ্ত নিদর্শন এসব ক্ষেত্রে তাদের পারদর্শিতার প্রমাণ দেয়। একটি নিদর্শন ছিল মাটির পিণ্ডে রেশমি বস্ত্রের ছাপ। একে বস্ত্রশিল্প বিকাশের নিদর্শন হিসেবে পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন। ঢিবিতে প্রাপ্ত পোড়া মাটির নিদর্শন বিশেষ করে চিত্রশোভিত মাটির পাত্র এবং মাতৃদেবীর প্রতিকৃতি সমসাময়িক বাংলার বিকশিত শিল্পকলার পরিচয়কেই তুলে ধরে।
পাণ্ডু রাজার ঢিবি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক শহর থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এমনকি দূর দেশেও বাণিজ্য পরিচালনা করা হতো বলে পণ্ডিতরা ধারণা করেন। এ ধারণার ভিত্তি তৈরি হয় ঢিবিতে প্রাপ্ত স্টিটাইট পাথরে নির্মিত এক গোলাকৃতি সিল থেকে। সিলটিতে কিছু খোদিত চিহ্ন আছে। যে চিহ্নগুলোকে চিত্রাক্ষর বলে শনাক্ত করা হয়। আর এ চিত্রাক্ষর থেকে বোঝা যায় সিলটি ভূমধ্যসাগরীয় ক্রিট দ্বীপের এবং আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে তা নির্মিত হয়েছিল। এ সিল এবং অনুরূপ আরও কিছু নিদর্শন থেকে অনুমিত হয় মানব সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন ইজিয়ান সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ শহর ক্রিটের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পাণ্ডু রাজার ঢিবি এবং সংলগ্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক শহর থেকেই যে বাংলার প্রতিবেশী অঞ্চলে এবং দূর দেশে বাণিজ্য পরিচালনা করা হতো তা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমরা জানি, বাণিজ্যে মুদ্রা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, বিনিময়ের মাধ্যম। পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে একটি স্বর্ণমুদ্রার ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। এর এক পীঠে মাছের প্রতীক আঁকা। মুদ্রার এ উপস্থিতি বাংলা অঞ্চলে সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক অর্থনীতির পরিচয় তুলে ধরে। আর এরূপ পরিচয় সূত্রে বলা যায়, আলোচ্য পাণ্ডু রাজার ঢিবি স্পষ্টতই বাংলা ও বাঙালি সভ্যতার স্মারক। জীবনযাপনের ক্রমোন্নতির প্রশ্নে আদি বাঙালিরা সমসাময়িক অপরাপর মানবগোষ্ঠী থেকে কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিলেন না পাণ্ডু রাজার ঢিবি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
লেখক : প্রফেসর ড. এটিএম আতিকুর রহমান, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ সম্পর্কীয় আরেকটি রচনা_
পাণ্ডু রাজার ঢিবি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অজয় নদের তীরে বর্ধমান জেলার পাণ্ডুকে আবিষ্কৃত এ অঞ্চলের প্রথম তাম্র-প্রত্নযুগীয় প্রত্নস্থল। মধ্যপ্রস্তর যুগীয় প্রত্নস্থল বীরভনপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। ১৯৫৪-৫৭ সালের মধ্যে বিবি লাল কর্তৃক উৎখনন পরিচালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতাত্তি্বক অধিদফতরের উদ্যোগে ১৯৬২-৬৫ এবং ১৯৮৫ সালে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে কয়েক দফা প্রত্নতাত্তি্বক খনন চলে এবং বাংলার প্রাক-ইতিহাসের তাম্র-প্রত্ন যুগীয় সাংস্কৃতিক পর্যায়ে জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। পর্যায়ক্রমে এখানে ৭৬টি তাম্র-প্রস্তর যুগীয় প্রত্নস্থল পাওয়া গেছে, যা বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলায় এবং ময়ুরাক্ষী (উত্তর), কোপাই, অজয়, কুনুর, ব্রাহ্মণী, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শীলাবতী এবং রূপনারায়ণ (দক্ষিণ) নদীর আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তাম্র-প্রত্ন যুগীয় প্রত্নস্থল পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে এক বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদীতীরে কৃষি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। যদিও তাম্র-প্রত্ন যুগীয় মানুষ ছিল প্রধানত কৃষিজীবী, তথাপি তারা শিকার অথবা মাছ ধরার কাজ বাদ দেয়নি। তারা কাদার আবরণকৃত দেয়ালবিশিষ্ট গোলাকার ও বর্গাকার সাদামাটা কুঁড়েঘরে বাস করত। ঘরের কোণে উনোন ও জ্বালানি রাখার স্থান নির্ধারিত ছিল। তারা ভাত খেত। সিদ্ধ মাংস, মাছ এবং ফলমূলও তাদের খাদ্য তালিকায় ছিল। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত তাম্র-প্রস্তর যুগীয় প্রত্নস্থলের মধ্যে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হচ্ছে পাণ্ডু রাজার ঢিবি। ১৯৬২-৮৫ সালের মধ্যে ঢিবিটিতে (২০০ মি-১৭০ মি) পাঁচবার প্রত্নতাত্তি্বক খনন পরিচালিত হয়। ৪৪ মি থেকে ১০৫ মি পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের ৫৩টি ট্রেঞ্চে এ খনন কাজ চলে। ঢিবিটির প্রধান অংশ রাস্তা থেকে ৫ মিটার উঁচু। ১৯৮৫ সালের খননের মাধ্যমে প্রত্নস্থলে ৬টি স্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ট্রেঞ্চ স্বাভাবিক মাটির স্তর পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ তাম্র-প্রস্তর যুগীয় প্রত্নস্থলের মতো এখানেও দুটি প্রধান পর্ব বা স্তর রয়েছে : (ক) তাম্র-প্রস্তর যুগের পর্ব (খ) লৌগযুগের পর্ব। তাম্র-প্রস্তর যুগের পর্ব আবার মোটামুটিভাবে দু'ভাগে বিভক্ত। একটি ধাতুযুগের পূর্ববর্তী পর্ব এবং অপরটি লৌহযুগের পর্ব। পশ্চিমবঙ্গে তাম্র-প্রস্তর যুগ অব্যাহত ছিল সম্ভবত ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দপূর্ব পর্যন্ত। পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রত্নস্থলের গোচরে আসার ৬টি স্তরের প্রথম দুটি তাম্রপ্রস্তর যুগীয়। প্রথম পর্বের একেবারে নিচ থেকে অভ্যন্তরে তুষের দাগ বিশিষ্ট হাতে তৈরি ধূসর ও ফ্যাকাসে লাল রঙের মৃৎ শিল্পের টুকরো এবং মানুষের সমাধিস্থলের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ওপরের দিকে পাওয়া গেছে সাধারণ কালো, লাল ধূসর এবং অনুজ্জ্বল সিরামিক। এ স্তর থেকে মধ্যযুগীয় কিছু ছুরি ও ফলা পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনো প্রকার তাম্র সামগ্রী পাওয়া যায়নি। তাই প্রথম পর্বের এ অংশটুকু ধাতু যুগের পূর্ববর্তী পর্যায়ের। দ্বিতীয় পর্বটি সম্পূর্ণভাবে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির নির্দেশক। এ স্তরে লাল, কালো ছোপাঙ্কিত লাল, সাদা ছোপাঙ্কিত লাল, কালো ও লাল মেশানো (ভেতর দিক সাদামাটা কিংবা ক্রিম অথবা সাদা রঙে রঞ্জিত) ক্রিম রঙের কাদামাটির প্রলেপযুক্ত এবং ধূসর মৃৎ পাত্রের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সিরামিক পাওয়া গেছে। 

0 comments:

Post a Comment