Thursday, October 11, 2012

মানসিক চাপ

0 comments

মানসিক চাপ কী ও কেন?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হূদেরাগ, ক্যানসার, স্ট্রোক, মানসিক রোগ ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে সারা পৃথিবীতে। এই বৃদ্ধির হার আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক বেশি। এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। স্ট্রেস হচ্ছে, বিজ্ঞানীদের ভাষায়, যেকোনো চ্যালেঞ্জের বিপরীতে মানুষের এক স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া। আমাদের মস্তিষ্ক যে মুহূর্তে কোনো বিপদ বা দুশ্চিন্তার কারণ টের পায়, অমনি তার বিশেষ এলাকাসমূহ সচল হয়ে ওঠে, নানা ধরনের হরমোন ও রাসায়নিক পদার্থ দ্রুত নিঃসৃত হয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে সচকিত করে দিতে থাকে। একটা সীমারেখা পর্যন্ত এই জিনিসটা মন্দ নয়, বরং নিত্যনতুন সমস্যা মোকাবিলায় এই ব্যাপারটা আপনাকে সামনে এগোনোর প্রেরণা জুগিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সীমা অতিক্রম করলেই বিপদ। চিকিৎসকেরা বলেন, অত্যধিক ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ মানুষের শরীর, মন এবং আচরণ—এই তিনটি জায়গায় আঘাত করতে পারে। শারীরিক যেসব সমস্যা আপনি অনুভব করতে পারেন সেগুলো হচ্ছে—মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা বা মাংসপেশিতে ব্যথা, ক্লান্তি বোধ করা, বুকে ব্যথা বা চাপ বোধ, বদ হজম, ঘুমের সমস্যা ও যৌন জীবনে সমস্যা। মুড বা চিন্তার যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তার মধ্যে দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, ক্রোধ, অস্থিরতা, প্রেষণার অভাব, বিষাদ ইত্যাদি অন্যতম। বিভিন্ন আচরণগত সমস্যাও দেখা দেয় এই স্ট্রেসের কারণে, যেমন—বেশি খাওয়া বা খুব কম খাওয়া, স্বাদহীনতা, যখন তখন রাগে ফেটে পড়া, অমনোযোগ, ধূমপান, অ্যালকোহল বা ড্রাগে আসক্তি, ঘুমের বড়ি খাওয়ার অভ্যাস ইত্যাদি।

চাপ মোকাবিলার উপায়

আজকের এই দুনিয়ায় মানসিক চাপ বা স্ট্রেসকে এড়িয়ে চলার উপায় নেই। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে জানা থাকতে হবে কীভাবে এই নিত্যদিনের চাপ মোকাবিলা করবেন। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ওয়াজিউল আলম চৌধুরীর পরামর্শ হলো—মানসিক চাপ মোকাবিলায় এবং মানিয়ে নিতে যেকোনো মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতা বা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা জরুরি। সমস্যা বা চাপের কারণকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবুন, ইতিবাচকভাবে ভাবা যায় কি না দেখুন, অষ্টপ্রহর এসব নিয়ে না ভেবে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকুন, আশাব্যঞ্জক চিন্তা বা উইশফুল থিংকিং করুন যে এই পরিস্থিতি নিশ্চয় চিরকাল থাকবে না। সমস্যা যদি খুব গুরুতর হয়, তবে পরিস্থিতি বদলে ফেলার চেষ্টা করুন; যেমন—কাজের পরিবেশের সঙ্গে একটুও মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে অগত্যা অফিসটাই পাল্টে ফেলতে হবে, সম্পর্ক নিয়ে চাপের সৃষ্টি হলে কাউন্সেলরের পরামর্শ নিতে পারেন, কাছের বন্ধু বা পরিবারের কারও সাহায্য নিন। মানসিক চাপ মানিয়ে নিতে সামাজিক যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমাজে অনেকের সঙ্গে মেশার অভ্যাস, নিত্যনতুন বন্ধু গড়ে তোলা, বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটানো ইত্যাদি অনেকটাই সাহায্য করবে। একা একা সমস্যা বা চাপ মোকাবিলা করার চেয়ে কারও সঙ্গে ভাগ করা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ। এমনকি, অনেক সমাজে, আপনজনের অভাবে পোষা প্রাণীও চাপ কমাতে অনেক সাহায্য করে বলে দেখা গেছে।
মানসিক চাপ যাতে স্বাস্থ্যের ওপর মন্দ প্রভাব না ফেলতে পারে, সে জন্য ইদানীং বায়োফিডব্যাক নামের একটি বিষয় প্রায়ই উচ্চারিত হয়—বলেন অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম। এ পদ্ধতিতে একজন মানুষ কীভাবে আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও নিজের রক্তচাপ, নাড়ির গতি, দেহের তাপমাত্রা বা পেশি সংকোচন নিজের আয়ত্তে রাখতে পারেন তা শেখানো হয়। বিভিন্ন শিথিল হওয়ার পদ্ধতি, ধ্যান, যোগব্যায়াম, অ্যারোবিক এক্সারসাইজ যেমন—জগিং, হাঁটা, সাইকেল চালনা ইত্যাদি এই আত্মনিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে।

চাপ কমানোর স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি

 প্রতিদিন নিয়মিত খোলা আকাশের নিচে সবুজ পরিবেশে হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন
 প্রকৃতির মাঝে রোজ কিছু সময় কাটান
 স্বাস্থ্যকর খাদ্য খান, অহিতকর খাবার এড়িয়ে চলুন
 ভালো বন্ধু গড়ে তুলুন এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান
 কাজের বাইরে কিছু ভালো বিনোদনমূলক কাজের অভ্যাস গড়ে তুলুন; যেমন—বাগান করুন, পাখি পুষতে পারেন বা নাটক দেখতে যেতে পারেন।
 উত্তম বই ও সংগীত, হালকা সুগন্ধিযুক্ত মোম, চমৎকার একটি লম্বা গোসল—এসবই চাপ কমাতে সহায়ক, তা পরীক্ষিত সত্য
 ভালো ঘুম নিশ্চিত করুন, যত কাজের চাপই থাকুক, পর্যাপ্ত ঘুমের বিষয়ে আপস করবেন না।

এই অভ্যাস বাদ দিন
 ঘন ঘন চা, কফি বা অ্যালকোহলে আসক্তি
 ধূমপান
 রাত জেগে টেলিভিশন দেখা
 অকারণে সবার সঙ্গে মেজাজ করা ও রাগ দেখানো
 ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমানোর অভ্যাস
 নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া

চাপের মধ্যেও ভালো থাকুন

প্রতিদিন নানা রকম টেনশন আর মানসিক চাপ আমাদের পর্যুদস্ত করে রাখে। এই চাপের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমরা আমাদের দেহ ও মনের ক্ষয়সাধন করি, পরিণামে পঁয়ত্রিশেই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস, চল্লিশ পেরোতেই দুম করে হয়ে যায় হার্ট অ্যাটাক, দেখা দেয় নানা মানসিক ভারসাম্যহীনতা, মনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে সম্পর্কগুলো আরও বেশি করে নষ্ট হয়, আরও বেশি একাকিত্ব ও অসহায়ত্ব জেঁকে ধরে। কিন্তু আমরা তা হতে দেব কেন? এই হাঁসফাঁস জীবনের বাইরে আরও জীবন আছে; আছে প্রজাপতি ও পাখিদের ওড়াউড়ি, বুড়ো বটগাছ আর শরতের সাদা কাশফুল, বন্ধুদের সঙ্গে হা হা হাসি, সন্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সুখময় সময়, জীবনসঙ্গীকে নিয়ে মাঝে মাঝে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার দারুণ রোমাঞ্চ, আছে চৌরাসিয়ার বাঁশি বা ভীমসেন যোশী, আছে একটি ভালো কবিতা বুঁদ হয়ে পড়ার চমৎকার অভিজ্ঞতা। জীবন থেকে এই জিনিসগুলোকে হারিয়ে যেতে দেবেন না কখনো। কেননা, এই ভালো সময় আর ভালো স্মৃতিগুলোই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে মানসিক চাপ নামের দৈত্যের হাত থেকে, জিতিয়ে দেবে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে। তাই সব চাপের মধ্যেও ভালো থাকুন, ভালো থাকার চেষ্টাটা রাখুন।

তানজিনা হোসেন | প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment