Monday, April 22, 2013

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

0 comments
বিশ্ব ধরিত্রী দিবস (Earth Day) আজ। প্রতি বছর ২২ এপ্রিল বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা ও ভালোবাসা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত এই দিবস আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয়।

বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্রমসই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে, এই ভাবনা থেকে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন এই বিষয়টি নিয়ে ভাবা শুরু করেন।


পরে তিনি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে এ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির কাছে এই বিষয়টি আলাপ করার জন্য ওয়াশিংটন যান।

এই বিষয়টি বেশ পছন্দ করেন কেনেডি। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর একাদশ-রাষ্ট্র সংলাপ ভ্রমণে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ফলপ্রসু কোনো আলোচনা হয় নি। কিন্তু নেলসন এর প্রচারণা অব্যাহত রাখেন।
তখন বেশিরভাগ মানুষ প্রথম দিকে বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করলেও প্রচারণার মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে এই বিষয়টি বহু মানুষকে সচেতন করে তোলে।

অবশেষে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষ এবং সরকারি মহলে বিশেষভাবে গুরুত্ব আদায় করে নিতে সক্ষম হয়।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ধরিত্রী দিবস পালিত হয়।
নেলসন প্রথমে এই দিবসটির নাম দিয়েছিলেন এনভায়রনমেন্টাল টিচ-ইন। বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারিভাবে এই পালন করা হয়। উত্তর গোলার্ধের দেশগুলিতে এই দিবস পালিত হয় বসন্তকালে আর দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলিতে পালিত হয় শরৎকালে।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ, তাদের বাৎসরিক পঞ্জিকায় স্থান দেয় এবং জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহে তা প্রতিপালনের জন্য উৎসাহ দান করা শুরু করে। ফলে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই দিবসটি ‘বিশ্ব ধরিত্রী দিবস’ নামে আন্তর্জাতিক ভাবে পালিত হচ্ছে।

মিয়ানমার ট্র্যাজেডি

0 comments

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গার চালচিত্র


দিনটি ছিল এ বছরের ২১ মার্চ। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর ওই এলাকায় ২৫ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। মৃতদেহগুলোকে একটি পাহাড়ের ওপর তুলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কয়েকটি দেহ কুপিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়। রয়টার্সের এক ক্যামেরাম্যান পুড়ে অঙ্গার হওয়া দেহগুলোর ছবি তুলেছেন। তিনি জানান, মৃতদের অনেকেই ছিল শিশু, যাদের বয়স ১০ বছরের কম।

২০১১ সালের মার্চে ৪৯ বছরের সামরিক শাসনের অবসান হতে না-হতে শুরু হয় বৌদ্ধ-মুসলমান দাঙ্গা। গত মার্চের চার দিনের দাঙ্গায় মিকিতলা শহরটিতে মারা যায় ৪৩ জন। বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে পালায় প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। তাদের বেশির ভাগই মুসলমান। এ ঘটনার পর দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে আরও ১৪টি গ্রামে। দাঙ্গায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সশস্ত্র আক্রমণ খুবই লক্ষণীয়।

মিয়ানমারের মিকিতলা শহরের পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক মুসলিম নারী। হঠাৎ এক বৌদ্ধ ভিক্ষু নারীটিকে পাকরাও করে গলায় ছুরি চেপে ধরে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একদল পুলিশ। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পুলিশ এগোতে উদ্যত হলেই ভিক্ষুটি চিত্কার করে বলে, ‘এগোলেই মেরে ফেলব।’ কিন্তু তখনো পুলিশেরা অতটা বিস্মিত হয়নি। কয়েক মুহূর্ত পর পুলিশ বুঝতে পারে, এসব ভিক্ষু আসলে দাঙ্গাকারী।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদেনে এমনই তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মেয়েটির গলায় ছুরি চেপে ধরা ভিক্ষুটি ছিল একটি বড় দলের সঙ্গে। ভিক্ষু দলটির প্রত্যেকের হাতে ছিল রামদা বা তলোয়ার। মুসলমানদের নিধনে ব্যবহূত হতে অস্ত্রগুলো যেন চকচক করছিল।



ধর্ম, ভিক্ষু ও দাঙ্গা
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সংগ্রামে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মিকিতলা দাঙ্গায় ভিক্ষুরা যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, তাতে তাঁদের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান এখন প্রশ্নের মুখোমুখি।
হত্যা ও লুটপাট যখন চলছিল, শহরের পুলিশ তখন ঠায় দাঁড়িয়েছিল। এমন অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। দাঙ্গার শিকার অসহায় লোকেদের রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অবস্থানের পেছনে কাদের হাত ছিল, তা অনুসন্ধানের বিষয়। তবে মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ ছিল আরও অনেক। ওই এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে লেখা ছিল, ‘চাই মুসলমান নিধন’।
তবে দাঙ্গার দায় কেবল বৌদ্ধদের নয়। দাঙ্গার শুরুটি হয়েছিল এক বৌদ্ধকে হত্যার মধ্য দিয়ে। মুসলমানেরা ওই বৌদ্ধকে হত্যা করেছিল। দাঙ্গার জন্য দায়ী সন্দেহে ৪২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু এতে দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যাবে, তা নয়। কারণ নতুন দাঙ্গার লু-হাওয়া ছড়াচ্ছে ‘৯৬৯’ আন্দোলন।

অর্থনৈতিক কারণ
ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের দাঙ্গা চলছে, বিষয়টি এমন নয়। সব সময়ই দেখা যায়, এ ধরনের দাঙ্গাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা হয়। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাঙ্গার কারণ যত না ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক। এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র দেশটিতে মেখতিলা প্রদেশে ও দেশটির কেন্দ্রস্থলে অবস্থানকারী মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা বৌদ্ধদের চেয়ে ভালো।
দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। মেখতিলায় তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। মুসলমানদের হাতে আছে আবাসন ব্যবসা, ইলেকট্রনিকস পণ্যের ব্যবসা, কাপড়ের দোকান, রেস্তোরাঁ ও মোটরসাইকেলের ডিলারশিপ। শহরটির বৌদ্ধদের মোট আয়ের বহু গুণ বেশি আয় করে মুসলমানেরা। বৌদ্ধরা মুসলমানদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক বা মুসলমানদের উত্পাদিত পণ্যের বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে থাকে।
মিয়ানমারে সামরিক শাসনের অবসানের পর নতুন বাণিজ্য ও বাজার প্রসারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিরাট এ বাজারে দখল কায়েম করা ও জারি রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক দাঙ্গা চলতে থাকলে নতুন মিয়ানমারের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে ধনী মুসলমানেরা। তাই তাদের টিকে থাকার লড়াইও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দোকান থেকে দাঙ্গা
২০ মার্চ মেখতিলার নিউ উইন্ট সেইন এলাকায় এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দোকান থেকে দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে ক্রেতা বৌদ্ধ দম্পতির কথা-কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি হয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, ওই ঘটনার জন্য মুসলমান ব্যবসায়ীটিই দায়ী। এমনিতেই এলাকায় উগ্র ও একরোখা হিসেবে ওই ব্যবসায়ীর কুখ্যাতি ছিল। তাই ক্রেতাকে বিক্রেতার চড় মারার ঘটনাটি ছিল ‘বারুদের গুদামে ম্যাচের কাঠি ছুড়ে’ দেওয়ারই নামান্তর।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্বোধন করে প্রচার করা একটি লিফলেট মুসলিমবিরোধী ক্ষোভ উসকে দেয়। লিফলেটটি ছেড়েছিল ‘অসহায় বুদ্ধরা’ নামের একটি সংগঠন। সেটিতে যা লেখা ছিল তার মূল কথা হলো, মুসলমানেরা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তাদের অর্থ জোগাচ্ছে সৌদি আরব এবং তারা মসজিদে মসজিদে গোপন সভা করছে।


বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে শুরু হয় দাঙ্গা। চার মুসলমান এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে। মোটরসাইকেলের আরোহী বৌদ্ধ ভিক্ষুটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর মুসলমানেরা তাঁর গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনা সো থেইন নামের এক মেকানিক দেখে ফেলে। সে দ্রুত এক বাজারে ছুটে গিয়ে চিত্কার করে বলতে থাকে ‘ভিক্ষুকে মেরে ফেলেছ! ভিক্ষুকে মেরে ফেলেছ!!’ সঙ্গে সঙ্গে শত শত বৌদ্ধ অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে এবং মুসলমানদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রমণ করে।
এ দাঙ্গায় ওই ভিক্ষুটি ছাড়া আর কেউ মারা যায়নি, তবে হাজার হাজার মুসলমান গৃহহীন হয়েছে। পুরো এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

৯৬৯ আন্দোলন
মিয়ানমারের বর্মিদের বিশ্বাস, দাঙ্গার জন্য এমন এক প্রতিষ্ঠান দায়ী, যেটি চোর-বাটপারে পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু দাঙ্গা যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে সংঘটিতে হচ্ছে, তা তারা বিশ্বাস করতে নারাজ।
মেখতিলার দাঙ্গা দেখেছেন এমন এক ব্যক্তি জানান, দাঙ্গায় অংশ নেওয়া ভিক্ষুরা এসেছেন আশপাশের সুপরিচিত মঠগুলো থেকে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালেই থেকেও অনেকে এসেছিলেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন উইরাথু।
নয় বছর জেল খেটে মুক্তি পেয়েছেন উইরাথু। সামরিক শাসন অবসানের পর যে কয়েক শ রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়, তাঁদের অন্যতম ছিলেন উইরাথু। ২০০৩ সালে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল।


উইরাথু মান্দালেইয়ের বিরাট মেসোইয়েন মঠে ৬০ জন ভিক্ষু ও আড়াই হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে অবস্থান করেন। এ মঠে বসে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘৯৬৯’ আন্দোলনের। মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামাজিক অবস্থান এ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯৬৯ সংখ্যাটি তিনটি বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম ৯ দিয়ে বোঝানো হয় বুদ্ধের নয়টি বিশেষ ক্ষমতা, ৬ দিয়ে বোঝানো হয় বুদ্ধের ছয়টি শিক্ষা এবং শেষ ৯ দিয়ে বোঝানো হয় সংঘ বা বৌদ্ধ মতবাদের নয়টি বিশেষ প্রতীক। আন্দোলনের নেতার বলছেন, তাঁদের লক্ষ্য হলো মিয়ানমারে বৌদ্ধ আধিপত্য বজায় রাখা। তাঁরা মনে করছেন, মুসলমানেরা পরজীবীর মতো টিকে থেকে বৌদ্ধদের আধিপত্য নস্যাত্ করছেন।

৯৬৯ আন্দোলনের প্রভাব
তবে ৯৬৯ সংখ্যাটি এখন মুসলমানবিরোধী জাতীয়তাবাদের ব্রান্ডে পরিণত হয়েছে। উইরাথু এক সাক্ষাত্কারে রয়টার্সকে বলেন, ‘আমাদের একটি স্লোগান আছে: খেতে হলে ৯৬৯ খাও, যেতে হলে ৯৬৯-এ যাও, কিনতে হলে ৯৬৯-এ কেনো।’ এর অর্থ হলো, যদি আপনি খেতে, কোথাও যেতে বা কিছু কিনতে চান, তবে তা করুন একজন বৌদ্ধের সঙ্গে। ‘মৌলবাদী’ পরিচয়কে সানন্দে গ্রহণ করে উইরাথু নিজেকে ‘বর্মি বিন লাদেন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
চার মাস আগে উইরাথু তাঁর ৯৬৯ মতবাদ ছড়াতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কাজ হলো, এ অভিযান ছড়িয়ে দেওয়া।’ তবে ৯৬৯ স্টিকার ও প্রতীক কাজে লাগতে শুরু করেছে। সহিংসতা যত বাড়ছে, ৯৬৯ প্রতীকের ব্যবহারও তত বাড়ছে।


মিকিতলার দেয়ালে দেয়ালে দাঙ্গাকারীরা ৯৬৯ এঁকে রেখেছে। রেঙ্গুনের বাগো এলাকায় ৯৬৯ দলের ভিক্ষুরা গণসংযোগ চালানোর পরপরই সেখানে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়। ৯৬৯ লেখা স্টিকারে ছেয়ে যাচ্ছে দেশটির দোকানপাট, মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি স-ব।


মিনলা শহরের এক কমিউনিটি সেন্টারে গত ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারিতে এক বৌদ্ধসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন উইমালা বিওয়ানথা। তিনি শ্রোতাদের মধ্যে মুসলমানবিরোধী চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, তাঁর নিজের প্রদেশ ‘মন’-এ মুসলমানদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। সেখানে ৯৬৯ আন্দোলনের কর্মীরা এক মুসলমানের মালিকানাধীন একটি জনপ্রিয় বাস সার্ভিসকে বয়কট করেছে। এসব ভাষণে বৌদ্ধরা উজ্জীবিত হয়, মুসলমানেরা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এর মাস খানেক পর প্রায় ৮০০ বৌদ্ধ লোহার পাইপ ও হাতুড়ি হাতে পথে নেমে আসে। তারা তিনটি মসজিদ ও ১৭টি বাড়ি ভেঙে ফেলে। অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও তারা গুঁড়িয়ে দেয়।
উইরাথু বলছেন, তিনি ভিক্ষুদের সংঘাতে ঠেলে দেওয়ার জন্য দায়ী নন। তবে তিনি বলেছেন, মুসলমানেরা বৌদ্ধদের পরিচয়কে নষ্ট করছে। তিনি বলেন, ‘অর্থ আয় করে ওরা (মুসলমানেরা) বড়লোক হয়ে গেছে। ওরা এখন বৌদ্ধদের মেয়েদের বিয়ে করে, ধর্মান্তরিত করে আর ধর্মবিস্তার ঘটায়। ওদের ব্যবসা-বাণিজ্য দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। ওরা জমি ও বাড়িঘর কিনছে। এর অর্থ হলো বৌদ্ধদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’
উইরাথু বলেন, ‘ওরা যখন বেশি কামাবে, তখন বেশি মসজিদ বানাবে। ... এগুলো হলো শত্রুদের থাকার জায়গা। তাই আমরা অবশ্যই এগুলো ঠেকাব।’

রক্ষকেই ভক্ষক
‘উইরাথুকে গ্রেপ্তার করা উচিত,’ বলছিলেন গণতন্ত্রের দাবিতে ২০০৭ সালের বিক্ষোভের প্রধান নেতা ও জনপ্রিয় ভিক্ষু নেই নেই লুইন। ওই আন্দোলনকে সামরিক বাহিনী কঠোর হাতে দমন করেছিল। নেই নেই বলেন, ‘সে (উইরাথু) যা বলছে, তা বুদ্ধের শিক্ষা নয়। তিনি একজন ভিক্ষু, তিনি মঠের অধ্যক্ষ। কিন্তু তিনি ভয়ংকর। ক্রমে তিনি ভীতিকর ও করুণ হয়ে উঠছেন।’


নেই নেই বলেন, কেবল সরকারই এসব মুসলমানবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে পারে। তিনি বলেন, ‘অতীতে গণতন্ত্র ও রাজনীতির কথা বললে ওরা (সরকার) বাধা দিত। আর এখন এসব জ্বালাময়ী ভাষণকে তারা বাধা দিচ্ছে না। উইরাথু একটি প্রভাবশালী মঠের অধ্যক্ষ বলে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। তাই সরকারের উচিত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’


ব্যাংকক পোস্টোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা এখনো জানা যায়নি যে ৯৬৯ আন্দোলন ও আশিন উইরাথুর পেছনে করা আছেন। ধারণা করা হয়, উইরাথুর পেছনে আছেন অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি। কেউ কেউ মনে করেন, সেনাবাহিনীর একটি কট্টর অংশ এদের পেছনে আছে। সেনাবাহিনীর এ অংশটি হারানো ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় এবং দাঙ্গা বাধিয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরি করে রাখতে চাইছে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হলো, দেশের সরকার উইরাথুকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং সে দাঙ্গা উসকে দেওয়ার মতো ভাষণ চালিয়ে গেলেও সরকার তাঁকে কিছু বলছে না।


পিস কালটিভেশন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও ৫৬ বছর বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন পাম না ওনথা এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘উইরাথু হলো হাতের পুতুল। ও আভিজাত্য ও খ্যাতির লোভে নাচছে।’ আশিন থাম ১৯৮৮ সাল থেকে দেশের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এখন তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মধ্য সদ্ভাব বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করছেন।
আশিন থাম আরও বলেন, ‘উইরাথু ও তার ৯৬৯ আন্দোলন ঘনিষ্ঠজনদের থেকে সহায়তা পাচ্ছেন।’ ‘ঘনিষ্ঠজন’ বলতে তিনি সামরিক বাহিনীর খুব কাছের ৩০ জন ব্যবসায়ীর একটি সংগঠনকে নির্দেশ করেছেন। এই সংগঠনটিই দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি বলেন, মুসলমানদের হাতে আছে বিপুল সম্পদ এবং এই ঘনিষ্ঠজনেরা সেটি লুট করতে চায়।
আশিন থাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, দাঙ্গার পেছনে সেনাবাহিনীর হাত আছে।

বাণিজ্যিক দখল
সংস্কারকরা দাঙ্গা বাধাচ্ছেন, এমন গুজবও আছে বেশ জোরেশোরে। অনেকেই বলছেন, সাবেক সামরিক শাসকের ঘনিষ্ঠজনেরা দাঙ্গা বাধাচ্ছেন। এত দিন তাঁরা ছিলেন ক্ষমতায়, তাই বাণিজ্যের দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেননি। এখন ক্ষমতা ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে, তাই ব্যবসার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করার প্রয়োজন পড়ছে। তাঁরা চাইছেন, মুসলমান ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিয়ে এক অর্থনৈতিক শূন্যস্থান তৈরি করতে। তাহলে ওই শূন্যস্থানে তাঁরা জেঁকে বসতে পরবেন। মেখতিলার ৬৭ বছর বয়সী মুসলমান ব্যবসায়ী ওন থুইনও এমনটাই মনে করেন।
দাঙ্গায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া তাঁর মেটাল ওয়ার্কশপে হাঁটাহাঁটি করতে করতে ওন থুইন বলেন, ‘এর (দাঙ্গার) পেছনে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক উভয় কারণই আছে।’ তিনি বলেন, তাঁরা কয়েক পুরুষ ধরে ওই লাভজনক ব্যবসা করে আসছেন। তাঁর নিজের অনেক বৌদ্ধ বন্ধু আছেন। তাঁদেরই একজন দাঙ্গার সময় তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন।

রোহিঙ্গা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী


জাহেদ খান
২০১২ সালে আরাকানে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধন এখন মিয়ানমারের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেশটির গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। ২০১৩ সালের ২১ মার্চ। তরুণী মুসলিম মেয়েটিকে ধরে ফেলল এক বৌদ্ধ ভিক্ষু, ধরেই তার গলায় একটি ধারালো ছুরি ঠেকালো। "যদি তোমরা আমাদের পিছু পিছু আসো, তাহলে ওকে মেরে ফেলবো"। পেছনে ফিরে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বললো ওই ভিক্ষু। একদল উত্তেজিত বৌদ্ধ কর্তৃক মিয়ানকারের মধ্যাঞ্চলীয় মিখতিলা থেকে মুসলমানদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ের ঘটনা এটি। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ২৫ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয় এদিন। বৌদ্ধ দাঙ্গাবাজরা নিহতদের রক্তাক্ত লাশগুলো পাশের এক পাহাড়ে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। নিহতদের মাঝে দু'টি শিশুও ছিল। তাদের পোড়া লাশ পরে উদ্ধার করা হয়। নাইপপিতাও থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরে এক লাখ বাসিন্দার এক শহরে মাত্র চারদিকে ৪৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। শহরের প্রায় ১৩ হাজার মুসলিম বাসিন্দাকে তাদের বাসস্থান ও ব্যবসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এ দু'টি ঘটনাই মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খণ্ড চিত্র। এসব দাঙ্গার ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে এটি বোঝা যায়, মুসলমানদের হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই। এসব দাঙ্গার ঘটনা প্রতিরোধে পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেত্রী শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চিও দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারেননি। দাঙ্গার বিষয়ে মৃদুভাবে সতর্ক করা ছাড়া ধর্মপ্রাণ সু চির কোনো জোরালো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বৌদ্ধ মিয়ানমারে ২০১২ সালের দাঙ্গার কারণ অস্পষ্ট তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন এক রাখাইন তরুণীকে কয়েকজন মুসলিম কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার গুজব এবং এর ফলে ১০ জন মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যাই দাঙ্গার প্রধান কারণ। দাঙ্গায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একতরফাভাবে রোহিঙ্গাদের ধর-পাকড়ের অভিযোগ ওঠে।

এই একবিংশ শতাব্দীতেও পৃথিবীতে এমন লাখো লাখো মানুষ আছে যারা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে পারে না, আর হাসপাতালে গেলেও তাদের চিকিত্সা দেয়া হয় না। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তরুণ-তরুণীদের বিয়ে ও সন্তান ধারণে বাধা দেয়া হয়। শত শত বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করলেও তাদের নাগরিকত্ব নেই। এই মানুষগুলোর বাস আমাদের খুব নিকটে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাথে অনেক মিল রয়েছে তাদের ভাষার। জাতিসংঘের বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সেই জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা।

বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নানাভাবে সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫ লাখ। জাতিসংঘ ও ওআইসি মিয়ানমার সরকারকে এই সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানালেও প্রকৃতপক্ষে সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে এবং তাদের নেতৃত্বেই চলছে হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ। প্রাণ বাঁচাতে ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধরা ছোট ছোট নৌকায় করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোও তাদের প্রত্যাখ্যান করছে। মিয়ানমারের বক্তব্য- রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও তাদের নেই নাগরিকত্ব। সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতায় রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের পরেও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিশ্ব বিবেক এখানে যেন বধির।

১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ মিয়ানমারের মিনরিফ এবং ম্রক ইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং কারেইনপন্থিরা প্রায় ৫ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল জাপানীরা। এসময় প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে গিয়েছিল। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নাগামান অভিযানের ফলে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই সেনাঅভিযান সরাসরি বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলেছিল। এসময় ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। ১৯৯১-৯২ সালে একটি নতুন দাঙ্গায় প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসে। তারা জানায়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। রাস্তার কাজে ও সেনাক্যাম্পে তাদের বাধ্যতামূলক বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়।

নাগরিকত্ব বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ১৯৮৯ সালে মিয়ানমার তিন ধরনের নাগরিক কার্ডের প্রচলন করে। পূর্ণাঙ্গ নাগরিকদের জন্য গোলাপী সহযোগী নাগরিকদের জন্য নীল এবং অভিযোজিত নাগরিকদের জন্য সবুজ রঙের কার্ড দেয়া হয়। চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্য, পড়াশোনা, চিকিত্সা সেবাসহ সব ধরনের কাজকর্মে এই কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কোন ধরনের কার্ড দেয়া হয়নি। এর ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারে টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে। ১৯৯৪ সাল থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্ম নিবন্ধন বন্ধ করে দেয় সরকার। পরে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনারের চাপে রোহিঙ্গাদের তালিকাযুক্ত করার উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। এ সময় রোহিঙ্গাদের দেয়া হয় সাদা কার্ড যেখানে জন্মস্থান ও তারিখ লেখা হয় না। এরফলে এই কার্ড মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান করে না এবং রোহিঙ্গাদের কোন কাজেও আসে না। কয়েক বছর পর এই কার্ডও বন্ধ করে দেয় সরকার। রোহিঙ্গাদের নাম শুধু তালিকাভুক্ত করে রাখা হয় নাসাকা বাহিনীর খাতায়।

এক একটি গ্রাম এক একটি কারাগার: নিজ গ্রামের বাইরে যেতে হলে রোহিঙ্গাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নাসাকার কাছ থেকে ট্রাভেল পাস নিতে হয়। এই ট্রাভেল পাস নিয়েই তারা গ্রামের বাইরে যেতে পারে। ট্রাভেল পাস পাওয়া সহজ নয়। সেজন্য নাসাকাকে দিতে হয় ঘুষ। নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামে ফিরে না এলে রোহিঙ্গাদের নাম কাটা যায় তালিকা থেকে। তখন তাদের স্থান হয় কারাগারে।

বিয়ে ও সন্তান ধারণে বাধা: বিয়ে করতে হলে রোহিঙ্গাদের নাসাকাকে অনেক টাকা ঘুষ দিতে হয় এবং বছরের পর বছর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া অনেকেই ধর্মমতে বিয়ে করে ফেলে। সেসব দম্পতির সন্তানদের কোন পরিচয় থাকে না।

নেই শিক্ষা, চিকিত্সা ও সরকারি চাকরির অধিকার: রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি চাকরি নিষিদ্ধ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে তাদের প্রবেশ পদ্ধতিগতভাবে নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকেও রোহিঙ্গাদের জন্য কোন স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নিতে দেয়া হয় না। কিছু কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্যসেবার অনুমতি আছে। গুরুতর অসুস্থ হলেও রোগীকে গ্রামের বাইরে নিতে হলে আগে নাসাকার কাছ থেকে ট্রাভেল পাস নিতে হয়। এ কারণে অনেক অসুস্থ রোহিঙ্গা মুসলিম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চিকিত্সা নিতে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে ঢুকতে পারলে এদের অধিকাংশই আর ফিরে যায় না। ২০০১ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। খুব কম রোহিঙ্গা গ্রামেই মাধ্যমিক স্কুল আছে। আশেপাশের গ্রামের স্কুলে যেতে হলে নাসাকার ট্রাভেল পাস যোগাড় করতে হয়। ফলে রোহিঙ্গা শিশুদের আর মাধ্যমিক স্কুলে পড়া হয় না।

সংকট শরণার্থী শিবিরেও: মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছে বহু মানুষকে। তারা আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। রোহিঙ্গারা সেখানেও পড়েছে চরম সংকটে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের কাছে খাবার, ওষুধপত্র নিয়ে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে জীবন-যাপনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই পাচ্ছেন না তারা। এ পরিস্থিতিতে অনেক মানবাধিকার সংস্থা তাদের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে আসছে বাধা। সাহায্য নিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না কাউকেই। দীর্ঘ এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভবিষ্যত্ নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের হামলায় নিহত হওয়ার পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরেও মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।

টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা

0 comments
"...আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশী অনুষ্ঠানও প্রচারিত হচ্ছে। সংবাদ ও নানা অনুষ্ঠানে হিন্দি ও ইংরেজী নতুন সিনেমার প্রমোশন দেখানো হচ্ছে যা দেশীয় সিনেমার চেয়ে কম নয়, কখনো কখনো বরং বেশী। কেউ কেউ বলছেন এটি বিশ্বায়নের অংশ। তবে কৌতুক করে বলা যায়, বিশ্বায়ন শুধু কী গরীব দেশের জন্য প্রযোজ্য? আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেখানে পাশ্ববর্তী দেশে সম্প্রচারের সুযোগ নেই, সেদেশে আমাদের নাটক, সিনেমা, গান জনপ্রিয় হবার সুযোগই বা কোথায়? সেক্ষেত্রে আমাদের টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমে তাদের সিনেমার ঢাউস প্রমোশন ও শিল্পীদের অংশগ্রহন, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে পাবলিসিটি কতটা যৌক্তিক?..."(চ্যানেল আইয়ের ১৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সেমিনার ২০১২ - এর মূল প্রবন্ধ "টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা"-এর অংশবিশেষ/প্রবন্ধ উপস্থাপন :সৈকত সালাহউদ্দিন)


প্রথমেই একটি সুসংবাদ দিতে চাই। নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা বলছে, দেশে পনের বছর উর্ধ্ব প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন দেখেন। এদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষের কাছে টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদ, পর্যালোচনা বিশ্বাসযোগ্য। সংযোগ সুবিধার কারণে এখনো তৃর্ণমূল বেশীরভাগ মানুষ বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখেন। তবে দিনে দিনে স্যাটেলাইট চ্যানেলের দর্শক বাড়ছেই।

বাংলাদেশ টেলিভিশন যাত্রা শুরু করে ১৯৬৫ সালে। ১৯৯৭ সালে স্যাটেলাইট চ্যানেলের পদযাত্রা শুরু হয় এটিএন বাংলা দিয়ে। সে হিসেবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বয়স ৪৭ বছর। আর স্যাটেলাইট টেলিভিশন-এর যাত্রা ১৫ বছর।

বিটিভি ছাড়াও এদেশে বর্তমানে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মধ্যে বেশীর ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলই হচ্ছে জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেল (জি ই সি)। এসব চ্যানেল সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, নাটক, চলচ্চিত্র, রিয়েলিটি শো, তথ্য ও বিনোদনমূলকসহ নানামুখী অনুষ্ঠান প্রচার করে। এগুলো হলো- এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, একুশে টেলিভিশন, এনটিভি, আরটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড, বাংলাভিশন, দিগন্ত টেলিভিশন, দেশটিভি, বৈশাখী টেলিভিশন, মাই টিভি, মাছরাঙা টেলিভিশন, মোহনা টেলিভিশন,চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর, ইসলামিক টেলিভিশন ও গাজী টিভি। আর বিশেষায়িত টেলিভিশন যারা শুধু অনুষ্ঠান প্রচার করছে তাদের মধ্যে আছে চ্যানেল নাইন, চ্যানেল সিক্সটিন, সংসদ টেলিভিশন ও বিজয় টিভি। শুধুমাত্র সংবাদ ও সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান ও টক শো প্রচার করে এটিএন নিউজ, সময় টিভি, ইনডিপেডেন্ট ও ৭১ টিভি। সম্প্রচারের অপেক্ষায় আরো আছে এশিয়ান টিভি, এস এ টেলিভিশন, গান বাংলা ও দীপ্ত বাংলা।



অন্যদিকে দেশে ১০০ এর অধিক ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং ২৮০ টি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন প্রকাশ হচ্ছে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন মিলিয়ে রেজিষ্টার্ড সংবাদপত্র প্রকাশনা বর্তমানে পাঁচ শো ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে বগুড়া থেকে প্রকাশিত প্রয়াত ফজলুল হক সম্পাদিত মাসিক সিনেমাকে সূচনা ধরলে বিনোদন সাংবাদিকতার বয়স এখন ৬২। তবে সূচনালগ্নে বিনোদন সাংবাদিকতা ছিলো চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত নির্ভর। এর পরে বেতার ও মঞ্চ। সত্তর দশকের শেষভাগে বিনোদন সাংবাদিকতায় যোগ হয় টেলিভিশন। মিলেনিয়াম যুগে পদ্ার্পণের প্রত্যুষ থেকেই টেলিভিশনে বিনোদন সাংবাদিকতার এক বৈপ্লবিক সূচনা হয়। টেলিভিশনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ মাধ্যমের প্রসারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত।



টেলিভিশনের সবচেয়ে বড় শক্তি কোথায়? টেলিভিশন যে কোন ঘটনা, বিষয়, ব্যক্তি, ইন্ডাষ্ট্রির ইমেজ নির্মাণ করে। সে ক্ষেত্রে আলোচনায় এসে যায় টেলিভিশন বিশেষ করে আমাদের বিনোদন ইন্ডাষ্ট্রির কী ধরণের ইমেজ নির্মাণ করছে?

টেলিভিশন বিনোদনের মধ্যে আছে নাটক, ম্যাগাজিন, টক শো, রিয়েলিটি শো, সিনেমা, সঙ্গীত প্রভৃতি। এ সময়ে খেলাধুলাও বিনোদন। সারা বছর বিটিভিসহ দেশের সবকয়টি টিভি চ্যানেলে পুর্ণাঙ্গ নাটক, খন্ডনাটক, ধারাবাহিক নাটক মিলিয়ে গড়ে প্রায় তিন হাজার নাটক প্রচার হয়। সেক্ষেত্রে শুধু নাটকের বিনিয়োগ ও বিজ্ঞাপন বিবেচনা করলে টেলিভিশন নাটককে ঘিরেও ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠেছে। এই অবস্থায় অন্যান্য অনুষ্ঠান যোগ করলে টেলিভিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্প ঘোষণা করে সুযোগ সুবিধা দেওয়া এখন সময়ের দাবি মাত্র।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নানা রকম রিয়েলিটি শো করছে। বিতর্ক থাকলেও এর মাধ্যমে যারা বেরিয়ে আসছেন তারাই বর্তমান সময়ে অভিনয়, সঙ্গীত, উপস্থাপনা ও বিজ্ঞাপনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। সংবাদ মাধ্যমও তাদের হাইলাইটস করছে।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কী ধরণের নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে? সে সব অনুষ্ঠানের মান কেমন? বিটিভিতে একটি কার্যকরী প্রিভিউ কমিটি আছে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর প্রিভিউ দৃশ্যমান নয়। ঠিক এ জায়গাটিতে কার্যকর শক্তিশালী ভুমিকা পালন করতে পারে বিনোদন পত্রিকা ও সাংবাদিকরা। টেলিভিশন কী মানুষকে সত্যিকার বিনোদন দিতে পারছে- তা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের।

দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিনোদন সাংবাদিকতা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এক সঙ্গে এতো চ্যানেল দেখা ও যথাযথ পর্যালোচনা করা খুবই কঠিন ও সময় সাপেক্ষ কাজ। চ্যানেলগুলোর পি আর সেকশন থাকায় কাজটা একটু সহজ হয়ে যায় । সাধারণভাবে প্রতিদিন পত্রিকার বিনোদন সংবাদ ও ম্যাগাজিনে থাকে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সময়সুচি, হাইলাইটস, তারকার খবর, নাটক, নতুন বিজ্ঞাপন, টক শোর খবর।



এগুলো হলো টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতার ভালো দিক, অর্থাৎ মুদ্রার এক পিঠ।



মুদ্রার অপর পিঠে আছে নানারকম অভিযোগ অনুযোগ। যেমন এই মুহুুর্তে সংবাদ মাধ্যমে প্রোমোশন সাংবাদিকতা, প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতা বেশী দেখা যায়। এর ফলে অনুসন্ধানী ও বৈচিত্রময় বিনোদন সাংবাদিকতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাঠক সেই সঙ্গে টেলিভিশন। টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতা নিয়ে বড়ো অভিযোগ হলো ‘তারকা’, ‘জনপ্রিয়’,‘আলোচিত’, ‘নন্দিত’, ‘কিংবদন্তি বিশেষণগুলোর যত্রতত্র ব্যবহার। এছাড়া পত্রিকার পাতায় নাটক কিংবা অনুষ্ঠানের নিয়মিত সমালোচনা অনুপস্থিত। একটি উদাহরণ দেই - বছরে যদি দেশে টেলিভিশনগুলো তিন হাজার নাটক প্রচার করে এর মধ্যে ৩০টি নাটকের মান ভালো হলে অনুপাতিক হারে নাটকের মান আসলেই ভালো কী মন্দ, এই নিয়ে গবেষণা নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সংবাদ মাধ্যম বলে চলেছেন নাটকের মান ভালো! অন্যদিকে গত তিন বছর গড়ে ষাটটি সিনেমার মাঝে ১০টি সিনেমার মান ভালো হলেও বলা হয়ে থাকে সিনেমার মান খারাপ।

টিভি ইন্ডাষ্ট্রি ও সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত সে কারণে বিজ্ঞাপনের মান নিয়ে দুই মাধ্যমই নীরব। সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায় একটি ছেলে একাধিক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে, এরপর ঝামেলা মনে করে কলার টিউন সেট করে রেখেছে। আরেকটি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় , তরুণ ছেলেটি ভয়েস অপশনে গিয়ে বান্ধবী সেজে মেয়ের বাবাকে ধোঁকা দিচ্ছে। এমনকী মিডিয়ায় ভাষা বিকৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও এক শ্রেণীর বিজ্ঞাপনদাতাকে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে। এর কোন সমালোচনা কী আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি? স্মরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশের একটি ফোন কোম্পানী প্রথম ‘খাইছি’ ‘ধরছি’ ভাষা সহযোগে বিলবোর্ড স্থাপন করে সমালোচিত হয়। কিছুদিন পরই নাটকের ভাষা বিকৃতি প্রকোপ হয়, এমন কী টক শো, অনুষ্ঠানেও স্মার্টনেসের নামে এই ধরণের ভাষা ব্যাধি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এসব নাটক ও অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দৃশ্যমান হয়নি। এমনকী কোন কোন সংবাদপত্রকে এই ধরণের ভাষার নাটক, নির্মাতা ও কলাকুশলীকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা গেছে। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মিডিয়ায় ভাষা ব্যবহারে স্বস্তি ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। অথচ বিনোদন সাংবাদিকরা তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে বিষয়টি হয়ত আদালত পর্যন্ত গড়াতো না।

এ কারণে প্রশ্ন উঠে, বিজ্ঞাপনদাতা+টেলিভিশন+সংবাদ মাধ্যম এক হয়ে কখনো কখনো ভূল জিনিসের জনপ্রিয়তা তৈরি করেন কী-না? যাকে বলে ম্যানুফ্যাকচারড হাইপ।

আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন হলো- টেলিভিশন আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির সত্যিকার ইমেজ তৈরি করতে পারছে কী-না? বাংলাদেশের মহিলা টিভি দর্শকের প্রায় অধিকাংশই কোলকাতার ষ্টার জলসা দেখেন। লক্ষ্যনীয়, তাদের নাটকের মান ও বিষয় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থাকলেও সে নাটকগুলোয় তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, পোষাক সুনির্দিষ্ট ও সুদুরপ্রসারী। বিনোদনের সঙ্গে এইসব নাটকগুলো তাদের পোষাক, অলংকার, সংস্কৃতি, মূল্যবোধও যেন পাচার করে দিচ্ছে এদেশে। অন্যদিকে আমাদের বেশীরভাগ নাটক দেখলে বোঝা মুশকিল এটা কোন দেশের,কোন সময়ের নাটক।



টেলিভিশন ও বিনোদন সাংবাদিকতায় আরেকটি বিষয় আলোচনা জরুরী। বর্তমান সময়ে বাইরের দেশের শিল্পীরা দেশীয় চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় অংশ নিয়ে চলছেন। ধীরে ধীরে এই হার বাড়ছে। আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশী অনুষ্ঠানও প্রচারিত হচ্ছে। সংবাদ ও নানা অনুষ্ঠানে হিন্দি ও ইংরেজী নতুন সিনেমার প্রমোশন দেখানো হচ্ছে যা দেশীয় সিনেমার চেয়ে কম নয়, কখনো কখনো বরং বেশী। কেউ কেউ বলছেন এটি বিশ্বায়নের অংশ। তবে কৌতুক করে বলা যায়, বিশ্বায়ন শুধু কী গরীব দেশের জন্য প্রযোজ্য? আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যেখানে পাশ্ববর্তী দেশে সম্প্রচারের সুযোগ নেই, সেদেশে আমাদের নাটক, সিনেমা, গান জনপ্রিয় হবার সুযোগই বা কোথায়? সেক্ষেত্রে আমাদের টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমে তাদের সিনেমার ঢাউস প্রমোশন ও শিল্পীদের অংশগ্রহন, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে পাবলিসিটি কতটা যৌক্তিক?



পরিশেষে বলতে চাই, টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমের ক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা এখন জাতীয়ভাবে ছায়া পার্লামেন্টের মতোই। কাজেই অদৃশ্য বা দৃশ্যমান চাপকে মোকাবিলা করে টেলিভিশনকে আমাদের জনগোষ্ঠিকে সুস্থ বিনোদন দিতে হবে। বিনোদন সাংবাদিকদের কখনো সহযোগী, কখনো কঠিন সমালোচক হিসেবে টেলিভিশনের মান নির্ণায়কের দায়িত্ব পালন করতে হবে।





লেখক পরিচিতি : সৈকত সালাহউদ্দিন, সাংবাদিক ও মিডিয়া কনসালটেন্ট।

ক) সাংবাদিকতা : নির্বাহী সম্পাদক আনন্দভুবন / আনন্দ আলো খ) এন্টারটেইনমেন্ট নিউজ এডিটর, এশিয়ান টিভি। গ) ওয়ার্কশপ : ওয়ার্ল্ডভিউ টেলিভিশন ট্রেনিং কোর্স ২০০২; মুভিজ টুডে ২০০৭

Wednesday, April 17, 2013

সপ্তর্ষি মণ্ডল

0 comments
সপ্তর্ষিমন্ডল সাতটি তারার সমন্বয়ে গঠিত নক্ষত্রপুঞ্জ। উপমাহাদেশের জ্যোতির্বিদগণ সাত জন ঋষির নামে এই সাতটি তারার নাম করণ করেন তাই এই নক্ষত্রপুঞ্জ সপ্তর্ষিমন্ডল নামে পরিচিত হয়। সাতটি ঋষির নাম:
ক্রতু
পুলহ
পুলস্ত্য
অত্রি
অঙ্গিরা
বশিষ্ঠ
মরীচি

সপ্তর্ষিমন্ডল সারা বছর ধ্রুবতারার চারদিকে ঘোরে। সপ্তর্ষিমন্ডলের প্রথম দু'টি (পুলহ -->ক্রতু) তারাকে যোগ করে সরলরেখা কল্পনা করলে ঐ সরল রেখা ধ্রুবতারার দিকে নির্দেশ করে, এবং রেখাটিকে বিপরীতে চালিত করলে সিংহ রাশিতে নির্দেশ করে।

Tuesday, April 16, 2013

নারী স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তি - এবনে গোলাম সামাদ

0 comments
বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বের বই লিখে যারা খ্যাত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ড. অতুল সুর। অতুল সুর তার লেখা একটি বইতে বিবাহ প্রথার ইতিহাস সম্পর্কে বলতে যেয়ে লিখেছেন : ‘‘প্রাণিজগতে মানুষই বোধহয় একমাত্র জীব, যার যৌনক্ষুধা সীমিত নয়। অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের জন্য যৌন মিলনের একটা বিশেষ ঋতু আছে। মাত্র সেই ঋতুতেই তাদের মধ্যে যৌন মিলনের আকাক্সা জাগে এবং স্ত্রী-পুরুষ একত্রে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদনে প্রবৃত্ত হয়। একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই এরূপ কোনো নির্দিষ্ট ঋতু নেই। মানুষের মধ্যে যৌন মিলনের বাসনা সব ঋতুতেই জাগ্রত থাকে। এ জন্য মানুষের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষকে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে দেখা যায়। বস্তুত মানুষের মধ্যে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকা স্ত্রী-পুরুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই মানুষের মধ্যে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে। পরিবার গঠন করে স্ত্রী-পুরুষের একত্র থাকার অবশ্য আরো কারণ আছে। সেটা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল জীববিজ্ঞানজনিত কারণ। শিশুকে লালন-পালন করে স্বাবলম্বী করে তুলতে অন্য প্রাণীর তুলনায় মানুষের অনেক বেশি সময় লাগে। এ সময় প্রতিপালন ও প্রতিরক্ষণের জন্য নারীকে পুরুষের আশ্রয়ে থাকতে হয়। মনে করুন অন্য প্রাণীর মতো যৌন মিলনের অব্যবহিত পরেই স্ত্রী-পুরুষ যদি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতো, তাহলে মা ও সন্তানকে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো।…. সন্তানকে লালন-পালন ও স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য মানুষের যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, একমাত্র এই জীবনজনিত কারণেই এ কথা প্রমাণ করার পক্ষে যথেষ্ট।’’

মানুষের মধ্যে সেই আদিম যুগ থেকেই গড়ে উঠেছে বিশেষ শ্রমবিভাজন, সন্তান প্রতিপালনকে নির্ভর করে। মেয়েরা সন্তান প্রতিপালনের জন্য করেছে ঘরের কাজ। অন্য দিকে পুরুষেরা করেছে বাইরের কাজ। এই শ্রমবিভাজনকে এখন আমাদের দেশে বিশেষভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলেছে নারী স্বাধীনতার নামে। মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে ঘরের কাজ ছোট আর বাইরের কাজ সম্মানজনক। কিন্তু সন্তান প্রতিপালনে অবহেলা হলে মানব অস্তিত্ব হয়ে উঠবে বিপন্ন। যে সম্বন্ধে বলা হচ্ছে না কিছু। আর এখান থেকে সৃষ্টি হতে পারছে নারী স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা। ঘরের কাজ পুরুষের ইচ্ছায় চলে না। ঘরের কাজ মেয়েরা করে আপন ইচ্ছায়, সন্তান প্রতিপালনের অভিলাষ নিয়ে। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানবশিশু বাঁচে মাতৃদুগ্ধ পান করে। কিন্তু অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে মানুষের মতো বিবাহ প্রথা গড়ে ওঠেনি। মানুষের ক্ষেত্রে সন্তান প্রতিপালনে পিতাকে নিতে দেখা যায় বিশেষ দায়িত্ব। জনক-জননীর যুগ্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমে সন্তানের প্রাণ ধারণ অনেক বেশি নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। কিন্তু এখন আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী বোঝাতে চাচ্ছেন, সন্তান প্রতিপালন যেন একটা হেয় কর্ম। নারীকে স্বাধীন হতে হলে সন্তান প্রতিপালন পরিত্যাগ করে তাকে কাজে নিযুক্ত হতে হবে গৃহের বাইরে। এই দৃষ্টিকোণ নারী স্বাধীনতার ধারণাকে করে তুলছে বিভ্রান্তিকর। যেটার অপনয়ন প্রয়োজন।

স্ত্রী-পুরুষের শারীরিক পার্থক্যকে নির্ভর করে সৃষ্টি হতে পেরেছে আদিম শ্রমবিভাজন। পুরুষ বাইরে কাজ করে আর নারী নিযুক্ত থেকেছে গৃহকর্মে। ক’দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম ৪০ হাজার নারী শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে হংকংয়ে। এই নারী শ্রমিকেরা আসলে সে দেশে যেয়ে করবে ঝিয়ের কাজ। নিযুক্ত হবে অন্য দেশের মানুষের গৃহকর্মে। কিন্তু এদের ভবিষ্যৎ কী হবে? কারণ, এসব মেয়ে নিজেদের ঘর-সংসার পাবে না। দেশে ফিরে তারা যাপন করবে কেমন জীবন, সেটা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এভাবে নারী শ্রমিক বাইরে পাঠাতে থাকলে আমাদের সমাজ জীবন কি টিকবে? বাইরের বিশ্বে নারী শ্রমিকেরা জড়িয়ে পড়তে পারে যৌন বিশৃঙ্খলায়। দেশে ফিরে তাদের পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব হবে না সুখী পরিবার। মানুষের জীবনের লক্ষ্য যদি হয় সুখী হওয়া, তবে এদের জীবন ভরে উঠবে শূন্যতায়। আপাতত কিছু টাকা হয়তো এদের জুটবে। কিন্তু সেই অর্থের বিনিময়ে কতটা সুখী হতে পারবে এসব মেয়ে, সে প্রশ্ন না উঠেই পারে না।

সংসারটা শেষ পর্যন্ত মেয়েরাই ধরে রাখে। সুমাতা ও সুগৃহিণী পারিবারিক জীবনে রচনা করে সুখী জীবনের ভিত্তি। কিন্তু সেই বুনিয়াদকে নারী স্বাধীনতার নামে যেন দেয়া হচ্ছে বিশেষভাবে অনিশ্চিত করে। নারীকে স্বাধীন করতে হলে তাকে বাইরের কাজে টেনে আনতে হবে, এ কথা বিশেষভাবে বলেন কমিউনিস্ট দর্শনের অন্যতম স্থপতি ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস। প্রায় সব বাম চিন্তার ব্যক্তি হয়েছেন তার দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের দেশে বামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নন। কুরআন শরিফে মেয়েদের ওপর পুরুষকে স্থান প্রদান করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুরুষ নারীর তুলনায় কায়িক শক্তির দিক থেকে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন। পরিবারকে রক্ষার ভার নিতে হবে তাকে। নারীকে তাই মেনে নিতে হবে পুরুষের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণকে ইসলামে সেভাবে বাড়িয়ে তোলার কথা বলা হয়নি (আল-কুরআন, সূরা ৪ : ৩৪)। কুরআন শরিফে এ ক্ষেত্রে একটা বাস্তব সত্যকেই বিশেষভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই বলা হয়নি, নারীকে পুরুষের দ্বারা সর্ববিষয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। গৃহকর্মে থেকেছে নারীর যথেষ্ট স্বাধীনতা। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, নারীসন্তানকে হেয় না করতে ( সূরা-১৬ : ৫৮-৫৯)। হাদিসে বলা হয়েছে, জননীর পদতলে সন্তানের বেহেশত। অর্থাৎ ইসলাম মেয়েদের মাতৃরূপে দিয়েছে বিশেষ প্রাধান্য। একটি হাদিসে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন, ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দিলে। আর তীব্রভাবে দুঃখিত হন, স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে। তালাক প্রদান আইনসম্মত হলেও তাকে উত্তমকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি ইসলামে।

কিছু দিন আগে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল যে, সে দেশের হিন্দু মায়েরা কন্যাসন্তান গর্ভে এলে ঘটাচ্ছে গর্ভপাত। এর ফলে ভারতে কন্যাসন্তান কমে যাওয়ার ক্ষতিকর সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতের অনেক অঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে বিয়ের জন্য কন্যার বিশেষ অভাব। আর এর ফলে থাকছে সমাজ জীবনে গুরুতর অশান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু মুসলমান নারীরা কন্যাসন্তানকে এভাবে হত্যা করছেন না। কারণ তাদের ধর্মে বলে, কন্যাসন্তান অবাঞ্ছিত নয়। তবে হিন্দু সমাজের প্রভাব তাদের ওপরেও অচিরেই এসে পড়তে পারে।

হিন্দু সমাজের প্রভাব এই উপমহাদেশে নানাভাবেই পড়তে আরম্ভ করেছে। এক সময় বাঙালি মুসলমান সমাজে কন্যার কাছ থেকে পণ নেয়া হতো না। কিন্তু এখন বহু ক্ষেত্রেই পণ ছাড়া মুসলমান মেয়েদেরও বিয়ে হতে পারছে না। পণপ্রথা সমাজ জীবনে বিষময় হয়ে উঠেছে। ইসলামের প্রভাব কমে যাওয়ার কারণে এটা ঘটা সম্ভবপর হচ্ছে। সনাতনী ইসলামি মূল্যবোধ টিকে থাকলে এটা হতে পারত না। সমাজ জীবন হতে পারত যৌতুকের দায়ভারমুক্ত।

ইসলামে পর্দাপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে। যুদ্ধের সময় মেয়েদের পর্দা করতে বলা হয়েছে, শত্রুর নজর থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য (সূরা-৩৩ : ৫৯)। কিন্তু তাই বলে সব সময় সব ক্ষেত্রে যে পর্দা করতে বলা হয়েছে এমন নয়। হজব্রত পালনের সময় মেয়েদের মুখমণ্ডল রাখতে হয় অনাবৃত। নারীকে পুরুষের সাথেই একত্র হয়ে কাবাগৃহ সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়। তিনবার দ্রুত পদক্ষেপে আর চারবার মৃদু পদক্ষেপে হজের সময় নারী-পুরুষ একত্রেই করেন কাবাগৃহ প্রদক্ষিণ। অর্থাৎ ইসলামে সব ক্ষেত্রে সব সময়ই পর্দা করতে বলা হয়নি। হজের পদ্ধতি থেকে এটা উপলব্দি করা চলে। এসব কথা বলতে হচ্ছে কারণ, এ দেশে ইসলাম নিয়ে তোলা হচ্ছে নানা প্রশ্ন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা হচ্ছে, ইসলাম সম্পর্কে যথাযথভাবে না জানার কারণে। ক’দিন আগে শুনলাম হেফাজতে ইসলাম যা দাবি করছে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে মধ্যযুগে। কিছু অধ্যাপককেও একই রকম কথা বলতে শোনা গেল। ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগ বলতে বোঝায় ৪০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কে। এ সময় ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা পায় বিশেষ প্রাধান্য। ইউরোপের মধ্যযুগ আর ইসলামের মধ্যযুগকে কোনোভাবেই সমার্থক করে তোলা যায় না। কিন্তু ইউরোপের ইতিহাসের ছকে ফেলে আমরা যেন এখন চর্চা করতে চাচ্ছি মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসকে। যেটা হয়ে উঠছে খুবই বিভ্রান্তিকর।

রোমান সভ্যতার ইতিহাসে অবক্ষয় নেমে আসার একটা কারণ ছিল, পর্নোক্র্যাসি (Pornocracy)। পর্নোক্র্যাসি বলতে বোঝায়, রাজনীতিতে গণিকাদের বিশেষ প্রভাব। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী থেকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র পরিচালকদের ওপর পড়ে গণিকাদের বিশেষ প্রভাব, যা হয়ে ওঠে রোমান সাম্র্রাজ্যের অবক্ষয়ের একটা উল্লেখযোগ্য কারণ। আমাদের দেশের ইসলামপন্থীরা চাচ্ছেন না রাজনীতিতে ঘটুক পর্নোক্র্যাসির উদ্ভব। আমরা আলোচনা করছিলাম নারী স্বাধীনতা নিয়ে। ইসলাম নারী স্বাধীনতার পরিপন্থী কোনো ধর্ম নয়। কিন্তু ইসলাম চায় না সমাজ জীবনে নেমে আসুক যৌন বিশৃঙ্খলা। আমাদের দেশের বামচিন্তকেরা ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞাত নন। অথবা জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও অনেকে বিশেষ স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে করছেন ইসলামের অপব্যাখ্যা। যদিও ইসলামে বলা হয়েছে, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগে তার ন্যায্য মজুরি শোধ করে দিতে। কুরআন শরিফে ধন বণ্টন করতে বলা হয়েছে অনেক সুষমভাবে (সূরা-৫৯ : ৭)। কুরআন শরিফে অভাগা অভাজনদের সাহায্য করার কথা একাধিকবার বলা হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্র এক অর্থে আসলে হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কারণ ইসলামে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে কোনো জবরদস্তি নেই (সূরা-২ : ২৫৬)। ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে ধরনের পাণ্ডিত্য থাকা প্রয়োজন, বর্তমান লেখকের তা নেই। কিন্তু বর্তমান লেখকের কাছে মনে হচ্ছে যে, ইসলামকে দেখানো হচ্ছে খুবই বিভ্রান্তিকরভাবে। তাই ইসলাম নিয়ে এই আলোচনা করা। ইসলামে কোনো ক্ষেত্রেই বলা হয়নি, মেয়েদের জ্ঞান চর্চা করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা। নবীজীর স্ত্রী হাফসা লিখতে, পড়তে ও গুনতে জানতেন। কুরআন শরিফ তার কাছে সংরক্ষিত ছিল, কোনো পুরুষ মানুষের কাছে নয়। বিবি হাফসাকে দেয়া হয়েছিল কুরআন সংরক্ষণের ভার। হিন্দুধর্মে ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউ বেদ পড়তে পারে না। ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার কেবল পুরুষেরাই হলেন বেদ পড়ার অধিকারী। কিন্তু ইসলামে কুরআন শরিফ হলো খোলা কিতাব। সবাই কুরআন শরিফ পড়ার অধিকারী। মুসলমান মেয়েদের কুরআন শরিফ পড়তে কোনো বাধা নেই। বাধা নেই মেয়েদের জ্ঞানচর্চার অধিকারে। কিন্তু এখন অনেকেই যেন প্রচার করতে চাচ্ছেন, মুসলমান মেয়েদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো অধিকার ইসলামে স্বীকার করা হয় না। কিন্তু এই ধারণা সর্বৈব মিথ্যা। আমরা আলোচনা করছিলাম নারীর স্বাধীনতা নিয়ে। ইসলামে নারীকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু গৃহকর্মের দায়িত্বকে অস্বীকার করতে বলা হয়নি। ইসলামে মেয়েদের উৎসাহিত করা হয়েছে সুমাতা ও সুগৃহিণী হতে।

লেখক : এবনে গোলাম সামাদ; প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

Wednesday, April 3, 2013

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

0 comments
২ এপ্রিল সারাবিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস।

শিশুর ব্যাপক বিকাশের সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম। অটিজম আছে এমন শিশু অন্যের সঙ্গে সঠিকভাবে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। তার আচরণের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ছেলেশিশুদের মধ্যে অটিজম হওয়ার হার মেয়েশিশুদের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা, অপরের চোখে চোখ না রাখা, অন্যের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া, অন্যের বলা কথা বারবার বলা, একই কাজ বারবার করা, নিজের শরীরে নিজে আঘাত করা, নিজস্ব রুটিন মেনে চলা, শব্দ বা আলোর প্রতি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৮৮ জন শিশুর মধ্যে একজনের অটিজমের লক্ষণ রয়েছে এবং ছেলেদের মধ্যে প্রতি ৫৪ জনে একজনের এ লক্ষণ আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ রয়েছে অর্থাত্ প্রতি ৩৮ জন শিশুর একজনের এ সমস্যা রয়েছে। ২০১২ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অটিজম আক্রান্তদের চিকিত্সা ও জীবনযাপনের জন্য বছরে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় এবং অটিজম আক্রান্ত একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবনের জন্য এ ব্যয়ের পরিমাণ ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ২০০৯ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, কেবল ঢাকা বিভাগে প্রতি হাজারে আটজন শিশুর মধ্যে অটিজম রয়েছে। অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি আছে পৃথিবীর সর্বত্রই। অটিজম আছে এমন শিশুদের প্রতি রয়েছে বৈষম্য। এ জন্যই ২ এপ্রিল সারা পৃথিবীতে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

আজকে অটিজম বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি হুমকি। এটা এতো ব্যাপক মাত্রায় পৌঁছেছে যে, অটিজম আক্রান্তদের প্রয়োজনকে বিবেচনায় আনতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রথম প্রস্তাব পাস হয় ২০০৭ সালে, যাতে ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবে অনুসমর্থন আসে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর, যাতে প্রথমবারের মতো অটিস্টিক ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়কে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এছাড়া ২০১২ সালে সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিওনাল অফিসের (এসইএআরও)মাধ্যমে অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে অটিজমকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইয়োগজাকার্তায় এর ৬৭তম আঞ্চলিক পর্ষদের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অটিজমকে আলাদা হিসাবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

অটিজম নিয়ে আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও রয়েছে কিছু বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা। কোনো ‘বিশেষজ্ঞ’ মহল বলে, অটিজম কোনোভাবেই মানসিক সমস্যা নয়; এটা স্নায়ুগত সমস্যা ও এর চিকিৎসা করবেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা। আবার কারও মতে, এটা কেবল মানসিক বিকাশের সমস্যা। তাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই পারেন এর উপযুক্ত চিকিৎসা করতে। কেউ বলেন, এটা শিশুদের সমস্যা; তাই এর জন্য দরকার শুধু শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। আর অন্য মহল দাবি করে, অটিজম কোনো রোগ বা সমস্যাই নয়। এটা চিকির‌্যাসক ও এনজিওগুলোর বাণিজ্যিক ও পেশাগত স্বার্থ হাসিল করার একটি ইস্যু।
কেবল একজন স্নায়ুরোগবিদ, মনোরোগবিদ বা একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষে অটিজমের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। আবার কোনো চিকির‌্যাসকের সাহায্য ছাড়াই কেবল সভা-সেমিনার করে অটিস্টিক শিশুদের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা অসম্ভব। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী ও সমন্বিত চিকিৎসাসেবা।

অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি
অটিজম নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়। যদি কেউ মনে করে থাকেন, কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞ চিকির‌্যাসকের শরণাপন্ন হয়ে দেখতে হবে সত্যিই তার অটিজম আছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ’, যা চিকির‌্যাসাবিজ্ঞানের সব রোগের পূর্ণাঙ্গ তালিকাগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত, সেখানে সুস্পষ্টভাবে শিশুর অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সাংকেতিক নম্বর ‘এফ ৮৪.০’। তাই ‘অটিজম কোনো রোগ নয়’ বা ‘অটিজম আছে এমন শিশুর জন্য কিছুই করার নেই’—এমন কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না।

অটিজমের কারণ
অটিজম কেন হয়, তার সুস্পষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে জেনেটিক প্রভাব এ রোগের ওপর আছে। সাধারণ যেকোনো শিশুর চেয়ে যাদের ভাই বা বোনের অটিজম আছে, তাদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ধারণা করা হয়, ক্রোমোসোম নম্বর 7q-এর অস্বাভাবিকতার সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক আছে। অটিজম আছে এমন শিশুর মধ্যে ২৫ শতাংশের খিঁচুনি থাকতে পারে।

অটিস্টিক শিশুর সমস্যা সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা
 অটিজম আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাভাবিক একটি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, যেভাবে সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি করে, সে তা করতে পারে না।
 বাবা-মা বা প্রিয়জনের চোখে চোখ রাখতে, মুখভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের চাওয়া বা না-চাওয়া বোঝাতে সে অপারগ হয়।
 সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। অমিশুক প্রবণতা থাকে।
 কোনো ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না। যেমন—স্বাভাবিক একটি শিশু কোনো খেলনা হাতে পেলে তার দিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো খেলনার প্রতি তার নিজের কিছু আগ্রহ থাকলেও সেটা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না।
 শারীরিক আদর, চুমু দেওয়া এবং চেপে ধরে কোলে নেওয়া তারা মোটেই পছন্দ করে না।

যোগাযোগের সমস্যা
 আশপাশের পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল কথা শিখতে দেরি হওয়া মানেই অটিজম নয়।
 কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে হয়তো পারে, কিন্তু একটি বাক্য শুরু করতে তার অস্বাভাবিক দেরি হয়। অথবা বাক্য শুরু করার পর তা শেষ করতে পারে না।
 কখনো দেখা যায়, একই শব্দ বারবার সে উচ্চারণ করে যাচ্ছে।
 তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা তার বয়সের উপযোগী নানা রকমের খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই তৈরি করে খেলে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এ রকম করে না।

আচরণের অস্বাভাবিকতা
 একই আচরণ বারবার করতে থাকে।
 আওয়াজ পছন্দ করে না।
 তারা রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন কোনো রুটিনের হেরফের হলে তারা মন খারাপ করে।
 কোনো কারণ ছাড়াই দেখা যায় তারা হঠার‌্যা রেগে ওঠে বা ভয়ার্ত হয়ে যায়।

পরিচর্যা ও চিকির‌্যাসাসেবা
অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে। আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে না। তারা বাসায় থাকে বা তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিক্ষণের। বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে, ভাষাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সমাজে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থান করে নেয়। কিন্তু বাদবাকি প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু যাদের অটিজম আছে, তারা সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন বা এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। তাদের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘদিন; প্রায় সারা জীবনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরতা। তা ছাড়া বিশেষ আবাসন, নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন হয় তাদের।

তিনটি বিষয়ের ওপর খেয়াল রেখে শিশুর অটিজমের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়:
এক: অস্ব্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য শিশুর বাবা-মাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তাঁরা বাড়িতে শিশুর আচরণগত পরিবর্তন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের দিকে মনোযোগ দেবেন না, কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য তাকে উর‌্যাসাহিত করুন।
দুই: বিশেষায়িত স্কুলের মাধ্যমে এ ধরনের শিশুকে একদিকে যেমন প্রথাগত শিক্ষা দেওয়া হয়, তেমনি ভবিষ্যতে তার জন্য উপযোগী যেকোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিশেষায়িত স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতেও শিশুকে সামাজিক রীতিনীতি শেখানোর চেষ্টা করুন, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। শিশুর সঙ্গে নিজেরা সময় কাটান, খেলা করুন এবং সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহিত করুন।
তিন: শিশুর ভাষা শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিন। ছোট ছোট শব্দ দিয়ে তার ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে এবং স্পষ্ট করে কথা বলুন। প্রয়োজনে তাকে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন এবং ইশারার তার‌্যাপর্য বোঝানোর চেষ্টা করুন।
প্রয়োজন ও রোগের লক্ষণ অনুযায়ী কিছু ওষুধ দেওয়া ও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
বিশ্ব অটিজম দিবসে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক, সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমন্বিত সেবা দিয়ে আমরা যেন অটিজম-আক্রান্ত শিশুদের যথাসম্ভব স্বাভাবিক কর্মক্ষম করে গড়ে তুলে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অটিজম নিয়ে সচেতনতা এবং কোনো বিভ্রান্তি থাকলে তা নিরসন করা।

Reference: আহমেদ হেলালসায়মা হোসেন পুতুল'র প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে

Picture or Video Ratings

0 comments

A G rated gravatar is suitable for display on all websites with any audience type.



PG rated gravatars may contain rude gestures, provocatively dressed individuals, the lesser swear words, or mild violence.



R rated gravatars may contain such things as harsh profanity, intense violence, nudity, or hard drug use.



X rated gravatars may contain hardcore sexual imagery or extremely disturbing violence.

Monday, April 1, 2013

যোগ ব্যায়াম

0 comments

পদ্মাসন


পদ্মাসন বা যেকোনো ধ্যানাসনে বসুন। বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে একটানা সাধ্যমতো শ্বাস নিন। কোনো সময় শ্বাস বন্ধ না করে বাঁ নাক আঙুল দিয়ে চেপে ডান নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। আবার ডান নাক দিয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণভাবে শ্বাস নিয়ে বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন ও গ্রহণ করুন। বারবার এ রকম করবেন, এই পদ্ধতির নাম নাড়িশোধন। প্রথমে চার-পাঁচবার, পরে মাত্রা বাড়িয়ে ১০-১৫ বার করবেন। এ রকম অন্তত দুই থেকে তিন মাস না করলে নাড়িশোধন হয় না। মোটা মানুষদের আরো বেশি সময় লাগে। নাড়িশোধন করার সময় শ্বাস কখনো বন্ধ করবেন না। নাড়িশোধন ঠিকভাবে অভ্যাস না করে প্রাণায়াম করতে নেই।

উত্থানপদাসন


চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। দুই হাত শরীরের দুদিকে রাখুন। পা দুটি সোজা রেখে মেঝে থেকে এক ফুট উঁচুতে তুলে যতক্ষণ পারেন থাকুন। যখন এভাবে পা তুলে রাখতে কষ্ট হবে, তখন পা নামিয়ে ফেলুন। ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড শবাসনে বিশ্রাম করুন। আবার করুন। পর পর তিনবার এভাবে করবেন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। এ আসন সবাই সকাল বা সন্ধ্যায় বা অন্য যেকোনো সময়ই করতে পারেন।
এ ছাড়া কপালভাতি, সূর্যপ্রণাম, পবনমুক্তাসন, ভুজঙ্গাসন, মৎস্যাসন, ধনুরাসন করতে পারেন।

সূত্র: কালের কন্ঠ

সভ্যতার বিবর্তন - রণক ইকরাম

0 comments
মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্ট বলেছেন, 'সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনি শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।' আর তাই মানব ইতিহাস বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ মানা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার উদ্ভব। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষের জীবনধারা পাল্টেছে। হিংস্রতা থেকে মানুষের জীবন পেয়েছে সুসভ্য রূপ। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে। এলাকাভেদে ও সংঘবদ্ধ দলভেদে এই পরিবর্তন একেক জায়গায় একক রকম। আর এই পরিবর্তনের শুরুর দিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সভ্যতা গড়ে ওঠে। এই সভ্যতাগুলোর ক্রমাগত বিবর্তনের ফলেই আমরা আজকের আধুনিক পৃথিবী পেয়েছি। চলুন জেনে নেওয়া যাক আলোচিত কিছু সভ্যতার গল্প।


সব মানুষের পূর্বপুরুষ আফ্রিকান


পৃথিবীতে প্রথম মানবসমাজের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশে, প্রায় ২ লাখ বছর আগে। আফ্রিকাকে বলা চলে আদি মানুষের নিবাস। এরও প্রায় ৭০ হাজার বছর পরে, তার মানে আজ থেকে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বছর আগে তারা ছড়িয়ে পড়তে লাগল আফ্রিকার বাইরে, পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায়। প্রায় ৯০ হাজার বছর আগে তারা ইউরোপে আর মধ্যপ্রাচ্যে পেঁৗছায়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত আমেরিকা মহাদেশেই মানুষ পৌঁছায় সবার শেষে। সেখানে মানুষ পেঁৗছায় আজ থেকে মাত্র ১৫ হাজার বছর আগে!

আজকের সভ্য পৃথিবীর শুরুটা হয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশ থেকে। এশিয়ার আরব, পারস্য, ভারত, চীন ছিল সমৃদ্ধশালী এলাকা। আর ইউরোপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ছিল উন্নত দেশ। আফ্রিকার মিসরও কিন্তু এক সময় অনেক উন্নত ছিল। জলপথ আবিষ্কারের মাধ্যমেই কিন্তু শুরু হয়েছিল ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য। এই জলপথ ব্যবহার করেই ইউরোপীয় বণিকরা আসা শুরু করে ভারতে। শুরু করে তাদের বসতি স্থাপন। একে একে আসে স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বণিকরা। এই জলপথ আবিষ্কারের সঙ্গে সূচনা হয় এই অঞ্চলের নতুন ইতিহাসের।

ইনকা সভ্যতা


যুগের পর যুগ ধরে প্রত্নতাত্তি্বকরা নানা প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ করছেন। এর মধ্যে কোনোটি সমৃদ্ধ কোনোটিবা একেবারে অগোছাল। কোনোটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আবার কোনোটি এখনো রয়ে গেছে অদ্ভুত রহস্যময়তার বেড়াজালে বন্দী। নেটিভ আমেরিকানদের ইনকা সভ্যতা এমনই এক রহস্যময় সাম্রাজ্য। তাদের সম্বন্ধে লিখিত কোনো তথ্য আজও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে নানা প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন থেকে এ সভ্যতা সম্পর্কে অনুমান করা হয়। তাদের স্থাপত্যশৈলী ছিল অসাধারণ। মিসরের পিরামিডের নির্মাণশৈলী যেমন আধুনিক মানুষকে বিস্মিত করে, ঠিক তেমনি নান্দনিক ছিল ইনকাদের স্থাপত্যশৈলী। ইনকা সাম্রাজ্য 'কেচুয়া' নামক নেটিভ আমেরিকানদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করে গেছে। কেচুয়া জাতির শাসকদের মর্যাদা দেবতাতুল্য বলে তাদের ইনকা বলা হতো। সূর্যদেবকে তারা ইনতি বলে ডাকত এবং সেই নামের প্রতিনিধিত্ব করত ইনকা শাসকরা। একটি উপজাতি হিসেবে বর্তমান পেরুর কুস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। ইনকা সাম্রাজ্য একসময় বিস্তৃত ছিল বর্তমান পেরুর কুস্কো ভ্যালি থেকে উত্তরে ইকোয়েডর এবং সুদূর দক্ষিণে বলিভিয়া, চিলি এবং আর্জেন্টিনা পর্যন্ত। পেরুর কুস্কো ভ্যালিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হচ্ছে বর্তমান প্রত্নতাত্তি্বক অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে। ইনকাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টেট অব দ্য আর্ট নিদর্শন যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত_ তা হলো মাচুপিচু। সমতল থেকে প্রায় এক হাজার ৮০০ ফুট উপরে এক দুর্গ শহর।

পেরুর কুস্কো অঞ্চলেই উপকথার প্রথম সাপা ইনকা মাংকো কাপাক ১২০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কুস্কো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে মাংকো কাপাকের উত্তরসূরিদের অধীনে আন্দিজ পর্বতমালার অন্যসব জাতিগোষ্ঠীকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে এ রাজ্যটি বিস্তার লাভ করে। ১৪৪২ সালের মধ্যেই রাজা পাচকুতিকের অধীনে ইনকারা তাদের সাম্রাজ্য দূর-দূরান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করে। পাচকুতিক নামের অর্থই হচ্ছে- পৃথিবী কাঁপানো মানুষ। তিনিই ইনকা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে দুই আমেরিকা মহাদেশের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল।

ইনকাদের নির্মাণশৈলী খুবই নিখুঁত এবং সাদামাঠা। মিসরীয় ফারাওদের মতো তাদের সম্রাটরাও ডেমিগড মর্যাদার অধিকারী ছিল। স্পেনীয় দখলদারদের আক্রমণে ১৫৩২ সালে ক্ষমতাধর ইনকা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক পরে তাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিহাসের পাতায় তুলে আনেন একজন উত্তর আমেরিকান এঙ্প্লোরার হায়ার্যাম বিংগাম। ১৯১১ সালে হায়ার্যাম বিংগাম তার ব্যক্তিগত ভ্রমণ অনুসন্ধিৎসা থেকে চলতে চলতে মাচুপিচু দুর্গনগরী, ইনকাদের শেষ আশ্চর্য নিদর্শন আবিষ্কার করেন। যখন তিনি প্রথম সে জায়গাটি খুঁজে পান তখন তিনি অনুমান করতে পারেননি, তিনি একটি মূল্যবান প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার সহজাত অনুসন্ধিৎসা তাকে আবার সেখানে ফিরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে পেশাদার প্রত্নতাত্তি্বকদের সহায়তায় তিনি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এই সভ্যতাকে আবিষ্কার করেন।

বিধ্বংসী স্পেনিশ অভিযাত্রীরা বারবার আঘাত হেনেছিল ইনকাদের প্রাচুর্যে। তারা লুটপাট, হত্যাসহ আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে ইনকা সভ্যতার সমৃদ্ধ শহরগুলো। মূলত সেই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ইনকা সম্পর্কে খুব অল্পই তথ্য-প্রমাণ মিলেছে।

ইনকাদের স্মৃতি ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শনগুলো রহস্য হয়ে থাকার কারণ তাদের অধিক পরিমাণে স্বর্ণ ও রৌপ্যের ব্যবহার। স্পেনীয় দখলদাররা নেটিভ আমেরিকানদের আক্রমণ ও তাদের দেশ দখল করার কারণ ছিল, স্বর্ণ ও রৌপ্যের লোভ। সেজন্য মনে করা হয় ইনকাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যের ঐতিহ্যই তাদের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। একই কারণে তাদের বিভিন্ন নিদর্শন স্পেনীয়দের দ্বারা লুট হয়ে যাওয়া ও সেগুলোর স্বর্ণ ও রৌপ্য গলিয়ে ফেলার কারণে ইনকাদের সম্বন্ধে অনুমান করা আরও দূরূহ হয়ে পড়ে।

স্বর্ণের প্রতি ছিল ইনকাদের অন্যরকম আগ্রহ। এর পেছনে কারণ ছিল তারা স্বর্ণকে সূর্য দেবের প্রতীক ভাবত। তাদের মন্দিরগুলোতে তাই স্বর্ণের ব্যাপক ব্যবহার ছিল।


মুসলিম সভ্যতা


বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে মুসলিম সভ্যতা। এই সভ্যতার উৎপত্তি মূলত ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মাধ্যমে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়_ এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো হল, কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বাইরে থাকা। আধুনিক জীবনধারার নতুন ধারণার বিবর্তনে এই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতি কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ বর্বর ছিল। তাদের মধ্যে কোনো জ্ঞানের আলো ছিল না। ইসলাম তাদের জীবনে আলোকবার্তকা হয়ে ধরা দেয়। জ্ঞান ও প্রজ্ঞাভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম বর্বর আরবদের জীবনের গতিধারাই পাল্টে দেয়। প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জল হয়ে ওঠে মুসলিম সভ্যতা।

উইল ডোরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতার মতো এত বিস্ময়কর সভ্যতা আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাত তাহলে মুসলিম সভ্যতা আরব ভূখণ্ডের গণ্ডি পেরোতে সক্ষম হতো না। এসব গুণাবলীর কারণেই ইসলাম এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিল ।

সিন্ধু সভ্যতা


উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সভ্যাটির নাম হলো সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। ইতিহাসে ব্রোঞ্জ যুগ ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০- ১৩০০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়কালকে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদের অববাহিকা। এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামেও পরিচিত। তবে আলোচিত এই সভ্যতার আবিষ্কার খুব বেশিদিন আগের নয়।

১৯২২-২৩ সালের কথা। ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শালের ভারতীয় সহকারী রাখালদাস অধুনা পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদাড়ো এলাকায় বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। তার ক'দিন আগেই মহেঞ্জোদাড়োর কয়েকশ' মাইল উত্তরে পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলার হরপ্পায় একটি প্রাচীন শহরের চার-পাঁচটি স্তরবিশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল। আর এতেই নড়েচড়ে বসেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। আশেপাশের এলাকাজুড়ে শুরু হয় ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান। ভারত ও পাকিস্তানের নানা জায়গায় এরকম আরো শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কার সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতাত্তি্বক আবিষ্কারের সমস্ত অতীত রেকর্ড ভেঙে ফেলে। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্তি্বকরা মনে করেন, এই সব শহর একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। এই সভ্যতাই সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ান সাহিত্যে সম্ভবত যার নাম মেলুহা। ভৌগোলিক বিস্তারের দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা। এই সভ্যতার ব্যাপক বিস্তৃতি বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতা থেকে এই সভ্যতাকে একদমই আলাদা করে তুলেছে।

এই সভ্যতা ছিল তাম্র-ব্রোঞ্জ [ক্যালকোলিথিক] যুগের সভ্যতা। কারণ, লোহার ব্যবহার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অজ্ঞাতই ছিল। এই সভ্যতার সামগ্রিক সময়কাল ধরা হয় ৫৫০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সিন্ধুবাসীদের প্রধান কৃষিজ ফসল ছিল গম, যব, মটর, খেজুর, তিল ও সরষে। সভ্যতার অনেক আগেই কৃষির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল।

প্রস্তর যুগ


ভারতে প্রথম কবে মানুষ বসবাস শুরু করে, সঠিকভাবে তা বলা যায় না । মধ্যপ্রদেশের হোসংগাবাদ শহরের নিকটবর্তী হাথনোরা গ্রামের কাছে ভারতের প্রাচীনতম মানুষের নিদর্শনটি পাওয়া গেছে । এর সময় সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। অনুমান করা হয়েছে এর বয়স বড়োজোর ৫ লক্ষ বছর হবে । প্রাক্‌ঐতিহাসিক যুগের কোনো লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না । কারণ তখন মানুষ লিখতে পড়তে জানত না । একমাত্র তাদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র থেকে তাদের কথা জানতে পারা যায় । তখন মানুষ পাথরের সাহায্যে যন্ত্রপাতি তৈরি করত বলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই যুগকে ‘প্রস্তর যুগ’ [Stone Age] বলে অভিহিত করেছেন । প্রস্তর যুগকে আবার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ,যথা- (১) পুরাপ্রস্তর যুগ [Palaeolithic Age বা Old Stone Age], (২) মধ্যপ্রস্তর যুগ [Mesolithic Age বা Middle Stone Age], ও (৩) নব্য প্রস্তর যুগ [Neolithic Age বা New Stone Age] ।

(১) পুরাপ্রস্তর যুগ [Palaeolithic Age বা Old Stone Age] : পুরাপ্রস্তর যুগের বিবর্তন দীর্ঘকাল জুড়ে চলেছিল । আনুমানিক ১০,০০০ বছর আগে, অর্থাৎ, ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পুরাপ্রস্তর যুগ শেষ হয় । এ সময় মানুষ চাষাবাদ করতে জানত না । তারা ছিল যাযাবর; ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত । গাছের ফল ও পশুর মাংস ছিল তাদের প্রধান খাদ্য । এ সময় মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী । চাষবাস করে ফসল ফলাতে বা উৎপাদন করতে জানত না । পশু শিকারের জন্য তারা নানা ধরনের পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত । গঙ্গা, যমুনা ও সিন্ধু উপত্যকার সমভূমি বাদ দিলে সারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে এগুলির নিদর্শন পাওয়া গেছে । এগুলির মধ্যে হাত কুঠার ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ । পশ্চিম পাঞ্জাবের সোয়ান নদীর অববাহিকায় হাত কুঠারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

(২) মধ্যপ্রস্তর যুগ [Mesolithic Age বা Middle Stone Age]: ভারতে মধ্যপ্রস্তর যুগ আনুমানিক ৮০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল । তবে ভারতের বাইরে অন্য অনেক জায়গায় এই যুগ অনুপস্থিত । সেইসব জায়গায় পুরাপ্রস্তরের পর সরাসরি নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । এই সময়ও মানুষ ছিল খাদ্য সংগ্রহকারী, খাদ্য উৎপাদক নয় । কারণ তখনও পর্যন্ত মানুষ চাষ-আবাদ করতে শেখেনি । তবে পাথরের অস্ত্রগুলি এই সময় আয়তনে ছোটো হয়ে যায় । এই সময়ের অস্ত্রগুলিকে মাইক্রোলিথ (Microlith) বলা হয়; অর্থাৎ, ছোটো, শক্ত ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ত্রিকোণাকার । মৃৎশিল্পে ও চিত্রশিল্পেও মানুষ বেশ পটু হয়ে উঠে । মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকার গুহাচিত্র এ সময়ের উল্লেখ্য চিত্রশিল্পের নিদর্শন।

(৩) নব্যপ্রস্তর যুগ [Neolithic Age বা New Stone Age] :
আঞ্চলিক বৈষম্যগুলি ধরে মোটামুটিভাবে বলা যায়, খ্রি.পূ.৪০০০ অব্দ থেকে ভারতে নব্যপ্রস্তর যুগ শুরু হয় । মানুষ এ সময় কৃষিকাজ ও পশুপালন আয়ত্তে আনে এবং খাদ্য উৎপাদক হয়ে ওঠে । কাজেই মানুষ ক্রমশ: যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে । মাটি ও বাঁশ দিয়ে ঘর তৈরি করা শিখে নেয় । বস্ত্রবয়ন শিল্প বিকশিত হয় । মৃতশিল্পের উন্নতি হয় । অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিও আগের তুলনায় অনেক উন্নত, মসৃণ ও মজবুত হয় । আগুনের ব্যবহারেও মানুষ সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে । মেহেরগড় এ যুগের সভ্যতা ।

মেহেরগড় সভ্যতা


মেহেরগড় সভ্যতা [Mehrgarh Civilisation]: হরপ্পা সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগের যে সব কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মেহেরগড় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু লক্ষণ এই সভ্যতার মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বলে অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।



(১) অবস্থান [Location of Mehrgarh Civilisation]: বালুচিস্তানের কাচ্চি সমতলভূমিতে বোলান নদীর পাড়ে কোয়েটা শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে মেহেরগড়ের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে । জ্যাঁ ফ্রাসোয়া জারিজ -এর নেতৃত্বে ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন । এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রগুলি হল কিলে গুল মহম্মদ, কোট ডিজি, গুমলা, মুন্ডিগাক, রানা ঘুনডাই, আনজিরা এবং মেহেরগড়।



(২) সময়কাল: প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূবাব্দে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । এই সভ্যতা বহু বছর স্থায়ী হয়েছিল বলে মনে করা হয় ।



(৩) সভ্যতার বৈশিষ্ঠ:[Characteristics of Mehrgarh Civilisation] : মেহেরগড়ের খনন কার্যের ফলে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে চাষবাসের কিছু প্রমাণ মিলেছে এবং বহু দূর দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্কের প্রমাণও পাওয়া যায় । এখানকার মানুষ যে ঘরবাড়ি তৈরি করে গ্রাম স্থাপন করেছিল, প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে তার প্রমাণ মেলে ।



(ক) প্রাচীনতর পর্যায়ে একাধিক ঘর নিয়ে বাড়ি তৈরি করা হত । এইসব বাড়ি তৈরি হত রোদে শুকানো ইটের সাহায্যে । এই সময় তারা চাষবাস, পশুপালন ও শিকার করত । মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হত এবং কোঁকড়ানো অবস্থায় সমাধিস্থ মৃতদেহ পাওয়া গেছে ।



(খ) পরের দিকে কৃষিকার্য ও পশুপালনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় । এই সময় তারা মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার করতে শুরু করেছিল । বাড়িগুলিও আকারে বড়ো হয়েছিল । এইসব বাড়ি থেকে ছোটো শিলনোড়ার পাথর, উনুন, হাড় দিয়ে তৈরি হাতিয়ার ইত্যাদি জিনিস পাওয়া গেছে । সমাধির মধ্যে যে সব জিনিস পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ঝিনুকের তৈরি লকেট, পুঁতি ও ঝিনুক জাতীয় জিনিসের মালা, পাথরের লকেট, হাড়ের আংটি, পালিশ করা পাথরের কুডুল ইত্যাদি প্রধান । তখনকার মানুষ যব, গম, কুল, খেজুর ইত্যাদি চাষ করত । জন্তুজানোয়ারের মধ্যে হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া ও ছাগল, শুয়োর, গোরু ইত্যাদির হাড় পাওয়া গেছে । গরু, ভেড়া, ছাগল এবং সম্ভবত কুকুরও পোষ মানানো হত । শুধু চাষবাস বা পশুপালন এখানকার মানুষের উপজীবিকা ছিল না । ব্যবসা বাণিজ্যও করত । এখানে পাওয়া সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে মনে হয় সমুদ্র উপকূলবর্তী স্থানের সঙ্গে এদের ব্যাবসাবাণিজ্য চলত । মেহেরগড়ে যে সব পাথর পাওয়া গেছে তা থেকে মনে হয়, তাদের বাণিজ্য অন্তত তুর্কমেনিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । পাথর দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বা জিনিসপত্র তৈরি হত । ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত হলেও, সমাধি থেকে তামার তৈরি একটি পুঁতি পাওয়া গেছে । এখানে পাথরের তৈরি কুড়ুল পাওয়া গেছে ।


(৪) মেহেরগড় সভ্যতার গুরুত্ব [Importance of Mehrgarh Civilisation]: মেহেরগড় সভ্যতার আবিষ্কার কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ । প্রথমত, এখানে গম ও যব চাষের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, এই দুটি শস্যের সূত্রপাত পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে আমদানি করা হয়নি । দ্বিতীয়ত, এই সভ্যতা নব্যপ্রস্তর যুগের হলেও তামা, সিসা প্রভৃতি ধাতুও পুরোপুরি অজ্ঞাত ছিল না । তৃতীয়ত, এখানকার মানুষ দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করত । চতুর্থত, এখানে কাঁচা মাটি দিয়ে পুরুষমূর্তি ও পোড়া মাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে । তবে এই সব মূর্তির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কতটুকু ছিল, তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । পরিশেষে, এই সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার আগে নব্যপ্রস্তর যুগে বালুচিস্তান অঞ্চলে একটি মোটের উপর উন্নত গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতা ছিল। এই জন্য অনেকে এই সভ্যতাকে আদি সিন্ধু সভ্যতা বলে অভিহিত করেছেন ।

তাম্রযুগ


নব্য প্রস্তর যুগের অবসান হওয়ার পর ধাতুর ব্যবহার শুরু হয় । তবে কোথায় নব্যপ্রস্তর যুগের অবসান আর কোথায় ধাতব যুগের সূত্রপাত তা সঠিক ভাবে বলা যায় না । নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের উত্তরণ হয়েছিল খুব ধীরে ধীরে । ধাতুর ব্যবহার ভারতের সর্বত্র একসঙ্গে হয়নি । উত্তর ভারতে প্রস্তর যুগের শেষ দিকে মানুষ তামার ব্যবহার শিখেছিল । তবে পাথরের ব্যবহার ও গুরুত্ব তখনও অব্যাহত ছিল । তাই এই যুগকে তাম্র-প্রস্তর যুগ বা (Chalcolithic Age) বলে । সিন্ধু সভ্যতা এই যুগের সভ্যতা । তামার পর ধীরে ধীরে লোহার প্রচলন শুরু হয় । অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের পরেই লৌহ যুগ শুরু হয় । ভারতে কোথাও ব্রোঞ্জযুগের কোনো উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না ।

সান সিং তুন সভ্যতা


সান সিং তুন বিশ্বের আরেকটি প্রাচীন সভ্যতা যেটির উৎপত্তি ও বিকাশ এশিয়ায়। আর স্পষ্ট করে বললে চীনে। এই সভ্যতার আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত এখানকার সভ্যতা ও জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণাটা তেমন একটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু সান সিং তুন সভ্যতার আবিষ্কার সবকিছু আমূল বদলে দেয়। মজার ব্যাপার হলো এ সভ্যতার আবিষ্কারের গল্পটিও খুব অবাক করার মতো। এই সভ্যতার নামকরণ করা হয়েছে মূলত একটি গ্রামের নামে। সান সিং নামের একটি গ্রাম থেকে এই নামের উৎপত্তি। একজন সাধারণ কৃষকের কল্যাণে গোচা একটি সভ্যতা আবিষ্কৃত হবে, এমনটি কখনো কেউ ভাবেনি।

অথচ সান সিং তুন সভ্যতার আবিষ্কারের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন ইয়ে নামের একজন গরিব কৃষক। গরিব ইয়ে জমি চাষ করার সময় এমন বিস্ময়কর আবিষ্কার করবেন ভাবেননি তিনি নিজেও। জমি চাষ করতে গিয়ে আবিষ্কার হওয়া এখানকার প্রত্নতত্ত্ব ও আশপাশের এলাকা নিয়ে এরপর গবেষণা চলেছে একটানা কয়েক দশক। আর এ গবেষণা থেকেই উঠে এসেছে দারুণ এক ইতিহাস। পাঁচ থেকে তিন হাজার বছর আগে এখানে প্রাচীন শু রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। সুউজ্জ্বল এই সভ্যতা এখানে ২০০০ বছর স্থায়ী ছিল। সান সিং তুন ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের ফলে শু রাষ্ট্রের ইতিহাস আর ২০০০ বছর এগিয়েছে। এ আবিষ্কার চীনের সভ্যতার ইতিহাসকে আর সুসম্পন্ন করেছে। সান সিং তুন সভ্যতা আর ছুয়াং চিয়াং নদীর সভ্যতা ও হোয়াংহো নদীর সভ্যতার মতো সবই চীনের সভ্যতার মূল ভিত্তি। সান সিং গ্রাম চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত। রাজধানী চেন তুং থেকে গাড়িতে যেতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে। আবিষ্কারের পর থেকেই আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকে এই গ্রামটি। বছর দশেক আগে এখানে সান সিং তুন নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রায় ৫০০০ বছর আগের পুরনো এই প্রাচীন নগরের অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। ধারণা করা হয় ৩০০০ বছর আগে শহরটিকে আকস্মিকভাবে বাতিল করা হয়।

ফলে খুব উন্নত মানের সান সিং তুন সভ্যতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ বছর আগে চেন তুং শহরের উপকণ্ঠে আবিষ্কৃত কিনশা ধ্বংসাবশেষ এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারও কারও মতে সান সিং তুন বর্তমান কিনশা ধ্বংসাবশেষের জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ বছর স্থায়ী এমন একটি প্রাচীন নগরকে বাতিল করার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ ছিল? অবশ্যই ছিল। কারও মতে বন্যার জন্য আবার কারও মতে যুদ্ধের জন্য।

আবার একদল বলেন, মহামারী রোগের জন্য শহরটি বিলীন হয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই, সেই জন্য আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এক গোলক ধাঁধা রয়েছে। 

ওলমেক সভ্যতা


খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ঘটনাটা ১৮৬২ সালের। মেক্সিকো তখনো জঙ্গল আর জলাভূমিতে ভরা এক নির্জন দেশ। এরকমই একটা অরণ্যঘেরা জলাভূমিতে চাষের জন্য মাটি খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। হঠাৎ করেই পাথর বা ধাতুর একটি বিরাট বস্তু বেরিয়ে এলো। মাটির নিচে পুঁতে রাখা জিনিসটা দেখে চাষিদের মনে হলো এটা একটি লোহার কেতলি। গুপ্তধনের লোভে ওদের চোখ চকচক করে উঠল। দ্বিগুণ উদ্যমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গাটা খুঁড়ে পাথরের একটি ভাস্কর্যের ভাঙা মাথার সন্ধান মিলল। গুপ্তধনের দেখা না পেয়ে চাষিরা ভীষণ হতাশ হলো। কিন্তু আগ্রহী হয়ে ওঠলেন প্রত্নতাত্তি্বকরা। কারণ এই ভাঙা মাথাটিই যে প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার প্রথম নিদর্শন।

সেই শুরু। তবে ওমলেক সভ্যতা বলে আদৌ কিছু ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্কের কমতি ছিল না। ১৯৪২ সালে মেক্সিকো তে এক আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্তি্বক সম্মেলনে অজস্র নমুনা ও প্রমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওলমেক সভ্যতার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সবাইকে নিশ্চিত করা হয়। নতুন সন্ধান পাওয়া এই সভ্যতার প্রাচুর্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন প্রত্নতাত্তি্বকরা।

'ওলমেক' শব্দটি এসেছে অ্যাজটেক সভ্যতার 'নাহুতল' ভাষা থেকে। শব্দটির অর্থ হচ্ছে 'রাবার পিপল'। ১৫-১৬ শতকে উপসাগরীয় এলাকার নাব্যদেশে যারা বসবাস করত তাদের এই নামে ডাকা হতো। ওলমেকদের আদিনিবাস ধরা হয় আফ্রিকাকে। সেখান থেকে বহুদূরের পথ পেরিয়ে ওলমেকরা এসেছিল আমেরিকায়। ওলমেকদের অনেকে বলে থাকেন 'নওবান'। এটাই নাকি ওদের আসল নাম। আজ থেকে তিন হাজারেরও বেশি সময় আগে গড়ে উঠেছিল প্রাচুর্যে ভরা এই ওমলেক সভ্যতা। এটি ছিল প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মেসো আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। মেসো আমেরিকা অর্থ মধ্য আমেরিকা। আর ওলমেকরাই মেসো আমেরিকার প্রাচীন বাসিন্দা। ওলমেক সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মেঙ্েিকার ইউকান উপদ্বীপ। মেঙ্েিকা উপসাগরের উপকূলে টুঙ্টিলা পাহাড়ের পাদদেশের জলাভূমিময় জঙ্গলে, সে জঙ্গলের পাশে গ্রামে এবং নগরে বাস করত ওলমেকরা। বর্তমান মেঙ্েিকার ভেরাকুজ ও তাবাসকো প্রদেশই প্রথম নগর ও গ্রাম গড়ে তুলেছিল ওলমেকরা। প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে মায়ান ও অ্যাজটেক সভ্যতার কথা খুব শোনা গেলেও ওলমেক সভ্যতা এই দুই সভ্যতা থেকেও বুড়ো এবং সমৃদ্ধিশালী। ওলমেক সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করছেন, অ্যাজটেক ও মায়ান বিখ্যাত সভ্যতার অনেক কিছুই মায়ানদের দান করা। আর তাছাড়া ওমলেকদের সূক্ষ্ম খোদাইয়ের কাজ, বিরাট ভাস্কর্য, ভাষার ব্যবহার, গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য এবং বর্ষপঞ্জি প্রত্নতাত্তি্বকদের চমক লাগিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী বিখ্যাত সভ্যতাগুলোর মতোই তারা পুরো ৩৬৫ দিনের এক দিনপঞ্জিকা মেনে চলত। তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওলমেকরাও পিরামিড বানাতে জানত। আর পশ্চিমা দুনিয়ায় ওলমেকরাই সম্ভবত প্রথম জাতি, যারা নিজেদের একটি লিখন-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। আর মায়ান সভ্যতার বর্ণমালা ওলমেক সভ্যতার প্রভাবেই গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। ওলমেকদের জীবনে ধর্ম ছিল কেন্দ্রজুড়ে, ছিল তাদের শাসকরা। আর সেই শাসকরা ছিলেন শামান। তাই যারা শাসক তারাই ছিলেন ওমলেকদের ধর্মীয় নেতা। সেই শামানরা নাকি রূপান্তরিত হতে পারত! বেশির ভাগ ওলমেকই গ্রামে বসবাস করত। আর এরা অরণ্য ও ঝোপঝাড় পুড়িয়ে ভুট্টা ও সূর্যমুখীর চাষ করত। বন্যার সময় ছাড়া তারা নদীর ধারেও চাষ করত। ভুট্টা ছাড়াও বুনত শিম, লাউ ও মিষ্টি আলু। সবজি ছাড়া তারা খেত মাছ, কাছিম, সাপ, ভোঁদড়, কাঁকড়া, হরিণ, খরগোশ ও পাখি। আর তারা খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে রাখার কৌশল জানত। পরবর্তী সময়ে যা খুঁজে পাওয়া গেছে অ্যাজটেকদের মধ্যে। ওলমেকদের চারটি শহরকে চিহ্নিত করা গেছে। লাগুনা দো লোজ সেরম, সান লোরেনজো, তে জাপাও আর লা তোনও।

এগুলো প্রতিটিই উন্নত স্থাপনায় ও শৈলীতে সমৃদ্ধ। ওলমেক সভ্যতার প্রাচুর্য আর অগ্রগতি প্রত্নতাত্তি্বকদের অবাক করেছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর আজো মেলেনি। ওলমেকরা কিভাবে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় এলো? তারা কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে ফেলল? তাদের এই বিচিত্র ভাস্কর্যবিদ্যার উৎস কি? আবার রাতারাতি এ সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল কিভাবে! আর এ সভ্যতার প্রাণরস কিভাবে পৌছে গেল মায়ান আর অ্যাজটেক সভ্যতার মধ্যে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজো মেলেনি।

বৈদিক সভ্যতা


উদ্ভব ও বিবর্তন: আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও আর্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু উভয় সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, কোনটি আগে, কোনটি পরে বা আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কিনা, আর্যদের আদি বাসস্থান ভারতে, না তারা বহিরাগত— এইসব প্রশ্ন নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার অন্ত নেই। এসব প্রশ্নের সর্বজনগ্রাহ্য কোনো উত্তর হয় না । বেদ ছিল আর্য মনীষার প্রধান ফসল এবং বেদ থেকেই আমরা আর্যসভ্যতার পরিচয় পাই। তাই এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয় । ঋক্‌বেদের সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। ঋক্‌বেদ কবে রচিত হয়েছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায় না । ম্যাক্সমুলারের মতে, এর রচনা কাল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে। বালগঙ্গাধর তিলকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ । দ্বিতীয় মতটি কেউই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। যাই হোক, সাধারণভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋক্‌বেদ রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই যুগকে তাই ঋক্‌বৈদিক যুগ বলা হয়। ঋক্‌বৈদিক যুগের পরবর্তী যুগকে পরবর্তী-বৈদিক যুগ বলা হয়।

বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য [Features of vedic civilisation]:


সাধারণভাবে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছরকে আমরা বৈদিক যুগ বলে থাকি। এই যুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সহজেই চোখে পড়ে । প্রথমত,এই সময় থেকেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয় । অর্থাৎ এই সময় থেকেই আমরা সাহিত্যিক উপাদানের উপর নির্ভর করতে পারি । বেদ থেকে আমরা সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের বহু মূল্যবান তথ্য জানতে পারি । দ্বিতীয়ত, এই সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের কাছে অস্পষ্ট ও অনেকাংশে অজ্ঞাত । তৃতীয়ত, বৈদিক সাহিত্যের উৎকর্ষতা ও উন্নত মান যেকোনো দেশের গর্বের বস্তু । এই সময়ে এত উন্নত মানের সাহিত্য পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি। চতুর্থত, বৈদিক সভ্যতাই উত্তর ভারতের গঙ্গা-যমুনা বিধৌত বিস্তীর্ণ সমভুমির প্রথম সভ্যতা । সিন্ধু সভ্যতার পূর্বতম সীমানা ছিল মিরাট জেলার আলমগিরপুর । পঞ্চমত, বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। প্রথমে তারা যাযাবর জীবন যাপন করত । পশুপালন ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা । পরে তারা কৃষিকাজ শুরু করে ও গ্রাম গড়ে তোলে। পরিশেষে, মনে রাখা দরকার যে,আর্যরা যে উন্নত মানের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল,তা যুগে যুগে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং আজ আমরা সেই ঐতিহ্য ও পরম্পরার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি।

প্রকাশিত হয়েছে: বাংলাদেশ প্রতিদিন