Wednesday, April 3, 2013

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

0 comments
২ এপ্রিল সারাবিশ্ব জুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস।

শিশুর ব্যাপক বিকাশের সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম। অটিজম আছে এমন শিশু অন্যের সঙ্গে সঠিকভাবে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। তার আচরণের মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। সাধারণত শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই অটিজমের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ছেলেশিশুদের মধ্যে অটিজম হওয়ার হার মেয়েশিশুদের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি। অটিজমের সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা, অপরের চোখে চোখ না রাখা, অন্যের সঙ্গে মিশতে না চাওয়া, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া, অন্যের বলা কথা বারবার বলা, একই কাজ বারবার করা, নিজের শরীরে নিজে আঘাত করা, নিজস্ব রুটিন মেনে চলা, শব্দ বা আলোর প্রতি অস্বাভাবিক সংবেদনশীলতা, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা ইত্যাদি।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৮৮ জন শিশুর মধ্যে একজনের অটিজমের লক্ষণ রয়েছে এবং ছেলেদের মধ্যে প্রতি ৫৪ জনে একজনের এ লক্ষণ আছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ রয়েছে অর্থাত্ প্রতি ৩৮ জন শিশুর একজনের এ সমস্যা রয়েছে। ২০১২ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অটিজম আক্রান্তদের চিকিত্সা ও জীবনযাপনের জন্য বছরে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় এবং অটিজম আক্রান্ত একজন ব্যক্তির সমগ্র জীবনের জন্য এ ব্যয়ের পরিমাণ ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ২০০৯ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, কেবল ঢাকা বিভাগে প্রতি হাজারে আটজন শিশুর মধ্যে অটিজম রয়েছে। অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি আছে পৃথিবীর সর্বত্রই। অটিজম আছে এমন শিশুদের প্রতি রয়েছে বৈষম্য। এ জন্যই ২ এপ্রিল সারা পৃথিবীতে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।

আজকে অটিজম বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি হুমকি। এটা এতো ব্যাপক মাত্রায় পৌঁছেছে যে, অটিজম আক্রান্তদের প্রয়োজনকে বিবেচনায় আনতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে দুটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রথম প্রস্তাব পাস হয় ২০০৭ সালে, যাতে ২ এপ্রিলকে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবে অনুসমর্থন আসে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর, যাতে প্রথমবারের মতো অটিস্টিক ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও সম্প্রদায়কে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সেগুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এছাড়া ২০১২ সালে সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিওনাল অফিসের (এসইএআরও)মাধ্যমে অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে অটিজমকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইয়োগজাকার্তায় এর ৬৭তম আঞ্চলিক পর্ষদের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে অটিজমকে আলাদা হিসাবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

অটিজম নিয়ে আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও রয়েছে কিছু বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণা। কোনো ‘বিশেষজ্ঞ’ মহল বলে, অটিজম কোনোভাবেই মানসিক সমস্যা নয়; এটা স্নায়ুগত সমস্যা ও এর চিকিৎসা করবেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞরা। আবার কারও মতে, এটা কেবল মানসিক বিকাশের সমস্যা। তাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই পারেন এর উপযুক্ত চিকিৎসা করতে। কেউ বলেন, এটা শিশুদের সমস্যা; তাই এর জন্য দরকার শুধু শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। আর অন্য মহল দাবি করে, অটিজম কোনো রোগ বা সমস্যাই নয়। এটা চিকির‌্যাসক ও এনজিওগুলোর বাণিজ্যিক ও পেশাগত স্বার্থ হাসিল করার একটি ইস্যু।
কেবল একজন স্নায়ুরোগবিদ, মনোরোগবিদ বা একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষে অটিজমের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। আবার কোনো চিকির‌্যাসকের সাহায্য ছাড়াই কেবল সভা-সেমিনার করে অটিস্টিক শিশুদের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা অসম্ভব। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী ও সমন্বিত চিকিৎসাসেবা।

অটিজম নিয়ে বিভ্রান্তি
অটিজম নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিতে থাকা উচিত নয়। যদি কেউ মনে করে থাকেন, কোনো শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞ চিকির‌্যাসকের শরণাপন্ন হয়ে দেখতে হবে সত্যিই তার অটিজম আছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ’, যা চিকির‌্যাসাবিজ্ঞানের সব রোগের পূর্ণাঙ্গ তালিকাগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত, সেখানে সুস্পষ্টভাবে শিশুর অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সাংকেতিক নম্বর ‘এফ ৮৪.০’। তাই ‘অটিজম কোনো রোগ নয়’ বা ‘অটিজম আছে এমন শিশুর জন্য কিছুই করার নেই’—এমন কোনো প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না।

অটিজমের কারণ
অটিজম কেন হয়, তার সুস্পষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে জেনেটিক প্রভাব এ রোগের ওপর আছে। সাধারণ যেকোনো শিশুর চেয়ে যাদের ভাই বা বোনের অটিজম আছে, তাদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ধারণা করা হয়, ক্রোমোসোম নম্বর 7q-এর অস্বাভাবিকতার সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক আছে। অটিজম আছে এমন শিশুর মধ্যে ২৫ শতাংশের খিঁচুনি থাকতে পারে।

অটিস্টিক শিশুর সমস্যা সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা
 অটিজম আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বাভাবিক একটি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, যেভাবে সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি করে, সে তা করতে পারে না।
 বাবা-মা বা প্রিয়জনের চোখে চোখ রাখতে, মুখভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের চাওয়া বা না-চাওয়া বোঝাতে সে অপারগ হয়।
 সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। অমিশুক প্রবণতা থাকে।
 কোনো ধরনের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেয় না। যেমন—স্বাভাবিক একটি শিশু কোনো খেলনা হাতে পেলে তার দিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো খেলনার প্রতি তার নিজের কিছু আগ্রহ থাকলেও সেটা নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না।
 শারীরিক আদর, চুমু দেওয়া এবং চেপে ধরে কোলে নেওয়া তারা মোটেই পছন্দ করে না।

যোগাযোগের সমস্যা
 আশপাশের পরিবেশ ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা কমে যায়। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল কথা শিখতে দেরি হওয়া মানেই অটিজম নয়।
 কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে হয়তো পারে, কিন্তু একটি বাক্য শুরু করতে তার অস্বাভাবিক দেরি হয়। অথবা বাক্য শুরু করার পর তা শেষ করতে পারে না।
 কখনো দেখা যায়, একই শব্দ বারবার সে উচ্চারণ করে যাচ্ছে।
 তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা তার বয়সের উপযোগী নানা রকমের খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই তৈরি করে খেলে। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এ রকম করে না।

আচরণের অস্বাভাবিকতা
 একই আচরণ বারবার করতে থাকে।
 আওয়াজ পছন্দ করে না।
 তারা রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন কোনো রুটিনের হেরফের হলে তারা মন খারাপ করে।
 কোনো কারণ ছাড়াই দেখা যায় তারা হঠার‌্যা রেগে ওঠে বা ভয়ার্ত হয়ে যায়।

পরিচর্যা ও চিকির‌্যাসাসেবা
অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে। আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে না। তারা বাসায় থাকে বা তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিক্ষণের। বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে, ভাষাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা সমাজে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থান করে নেয়। কিন্তু বাদবাকি প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু যাদের অটিজম আছে, তারা সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন বা এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। তাদের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘদিন; প্রায় সারা জীবনের জন্য অন্যের ওপর নির্ভরতা। তা ছাড়া বিশেষ আবাসন, নার্সিং কেয়ারের প্রয়োজন হয় তাদের।

তিনটি বিষয়ের ওপর খেয়াল রেখে শিশুর অটিজমের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়:
এক: অস্ব্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য শিশুর বাবা-মাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে তাঁরা বাড়িতে শিশুর আচরণগত পরিবর্তন করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের দিকে মনোযোগ দেবেন না, কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য তাকে উর‌্যাসাহিত করুন।
দুই: বিশেষায়িত স্কুলের মাধ্যমে এ ধরনের শিশুকে একদিকে যেমন প্রথাগত শিক্ষা দেওয়া হয়, তেমনি ভবিষ্যতে তার জন্য উপযোগী যেকোনো পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিশেষায়িত স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতেও শিশুকে সামাজিক রীতিনীতি শেখানোর চেষ্টা করুন, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। শিশুর সঙ্গে নিজেরা সময় কাটান, খেলা করুন এবং সমবয়সীদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহিত করুন।
তিন: শিশুর ভাষা শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিন। ছোট ছোট শব্দ দিয়ে তার ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে এবং স্পষ্ট করে কথা বলুন। প্রয়োজনে তাকে ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করুন এবং ইশারার তার‌্যাপর্য বোঝানোর চেষ্টা করুন।
প্রয়োজন ও রোগের লক্ষণ অনুযায়ী কিছু ওষুধ দেওয়া ও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
বিশ্ব অটিজম দিবসে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক, সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমন্বিত সেবা দিয়ে আমরা যেন অটিজম-আক্রান্ত শিশুদের যথাসম্ভব স্বাভাবিক কর্মক্ষম করে গড়ে তুলে সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অটিজম নিয়ে সচেতনতা এবং কোনো বিভ্রান্তি থাকলে তা নিরসন করা।

Reference: আহমেদ হেলালসায়মা হোসেন পুতুল'র প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে

0 comments:

Post a Comment