Tuesday, December 31, 2013

ফৌজদারী অপরাধ তদন্তে স্বাধীন তদন্ত সংস্থার প্রস্তাব ও প্রাসঙ্গিক কথা

0 comments
বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিরূপণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইনি প্রতিকার দেয়া। আদালত নাগরিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এ কাজ করে না বরং কারো অধিকার হরণ হলে তাকেই আদালতের দ্বারে ধরনা দিতে হয়। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, ন্যায় বিচারের মূল ভিত্তি। তদন্তে গাফিলতি বা অনিয়ম হলে বিচারে বিভ্রাট হয়, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন ব্যাহত হয়। দোষী ব্যক্তি ছাড়া পায়, নির্দোষ ব্যক্তি সাজা পায়। সেই সাথে বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ফলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা দরকার। ভূমিকার শুরুতে দুটি বাক্যে যা বললাম তার বিস্তৃত পরিকল্পনা দেয়ার জন্য একটি কিংবা একাধিক প্রবন্ধ যথেষ্ট নয়। একটি বই লেখা জরুরী।
১২ এপ্রিল’২০১১ হন্তদন্ত হয়ে গ্রামের পরিপাটি চেহারার এক কৃষক দ্বারস্থ হলেন আদালতের একজন আইনজীবীর কাছে। বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার জাগলবা গ্রামে। নাম মনসের আলী। বেচারীর অভিযোগ, তার ছেলে রাজু আহমেদ নিজ স্ত্রীকে আনতে গেলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে রক্তাক্ত জখম করেছে। মাথায় ও কপালে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করায় ৮টি সেলাই করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসা শেষে থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নেয়নি। কারন আসামীরা সরকারদলীয় গ্রাম্য প্রভাবশালী চক্র। উল্টো করে থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে বাদী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বেচারী ভদ্রলোক নিতান্তই বিপদে পড়ে ছেলে নির্যাতনকারীদের বিচার দিতে আদালতে এসেছে। কারণ মানুষের সর্বশেষ বিচারের আশ্রয়স্থল আদালত। আইনজীবী মহোদয় হাসপাতালের চিকিৎসাপত্র, জখমী ভর্তি, ছাড়পত্র, ভিকটিমের নির্যাতনের চিহ্ন পর্যালোচনা করে একটি নালিশি দরখাস্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে দাখিল করলেন। ভিকটিম রাজু আহমেদও মাথায় ক্ষত চিহ্ন নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারক মহোদয়কে নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেন। বাদী হলফান্তে সমস্ত ঘটনা বর্ণণা করলেন। থানা মামলা নেয়নি এ বিষয়টিও আইনজীবী মহোদয় হুজুরাদালতে বয়ান করলেন। মামলাটি সরাসরি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য থানা কর্তৃপক্ষের উপর আদেশ দানের জন্য আইনজীবী মহোদয় হুজুরাদালতে সাবমিশন জানালেন। এটাও জানালেন, থানার উপর তদন্ত প্রতিবেদন চাইলে থানা কর্তৃপক্ষ সঠিক প্রতিবেদন দিবেন না। তার কারন ইতোপূর্বে বর্ণণা করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই শুনলেন না ওই বিচারক মহোদয়। তিনি যথারীতি থানার উপর তদন্ত প্রতিবেদন চাইলেন। মামলাটি মিস ৭/২০১১ নং মামলা হিসেবে কজ লিষ্টে অন্তর্ভূক্ত হলো। প্রতিবেদন থানাতে পাঠাতে শুরুতেই বাদীকে পেশকার সাহেবের প্রতি দুশ টাকা গুনতে হলো। এরপর ৬ মাসে প্রায় ১০টি ধার্য্য তারিখে বাদী আদালতে হাজির হলেন বিচারের জন্য কিন্তু থানা ওই মামলায় কোন প্রতিবেদন পাঠালেন না। অবশেষে বাদী নিরুপায় ও ধৈর্য্যচ্যূত হয়ে বিচারের ভার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়ে তিনি আদালত ত্যাগ করলেন। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে এখনও বিলম্বের ভূত লুকিয়ে আছে।

আমাদের চাই গণমুখী বিচার ব্যবস্থা। সেটা এমন হবে যেন কেউ মিথ্যা কিংবা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা করতে সাহস না পায় এবং বিচার কাজটি একক ব্যক্তির হাতে না রেখে জুরি পদ্ধতি গ্রহণ করলে সামাজিক দায়বদ্ধতা দৃঢ় হবে।

আইন পেশায় থাকার সুবাদে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আইনী সমস্যার সাথে আমাকে পরিচিত হতে হয়। এইতো সেদিন চেম্বারে এসেছিল একজন সরকারী কর্মকর্তা। থাকেন খোদ রাজধানী কর্মস্থল ঢাকায়। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। গ্রামের কিছু সন্ত্রাসী জনৈক ব্যক্তিকে খুন করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ওই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সরকারী কর্মকর্তার নামও মামলায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সাক্ষীরা সুপরিকল্পিতভাবে খুনের ঘটনার সঙ্গে অন্য খুনিদের সাথে ওই কর্মকর্তাকে জড়িয়ে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। রায়ে আদালত ওই কর্মকর্তাসহ অন্য আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। সাক্ষ্য-প্রমাণের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আদালতের নেই। ফলে আইনি বিচার হলো ঠিকই; কিন্তু ওই কর্মকর্তা ন্যায়বিচার পেলেন না। এখন তিনি কারাগারে। চাকরি নেই। ওই কর্মকর্তার স্বজনদের দাবি, তিনি ওই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এবং ওই সময় তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে ছিলেন। তা সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করে বাদীপক্ষ ওই কর্মকর্তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা ওই কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। যোগাযোগ করলে হয়তো তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হতো না। এ ধরনের ঘটনার অনেক নজির এ দেশে রয়ে গেছে।

আইনি গ্রক্রিয়া, বিচার এমনভাবে হওয়া দরকার, যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। এর পেছনে আছে অনেক কারণ। সম্প্রতি মূসক আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। আর এটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাঁদের ওপর এটা প্রয়োগ হবে, তাঁদের সঙ্গে চলছে দফায় দফায় আলোচনা। আলোচনা হতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তিটা হলো তাঁদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে একটি দুর্বল আইন করা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে যাঁদের ওপর আইনটি প্রয়োগ হবে, তাঁরা কঠোর আইন করতে বাধা দেবে। কিন্তু তাই বলে এমন আইন করা সংগত হবে না, যাতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। যেমনটি হয়েছিল মোটরযান আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে। ড্রাইভারদের আন্দোলনের মুখে আইনই বদলে গেল, যার ফলে মিরসরাই ট্র্যাজেডির বিচার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলো। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, সনদবিহীন বা ভুয়া সনদধারী ড্রাইভার নিয়োগের জন্য মালিকদের তো আইনের আওতাই আনা যাচ্ছে না। কারণ ওই মালিকদের কেউ কেউ আবার আইনপ্রণেতা আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতা।

পাঠক! নিশ্চয়ই মনে আছে চট্রগ্রামে সেই আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের কথা। ওই মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রয়ারি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২৬ জুন ২০১১ সালে আরো ১১ জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এবং বলা হয় আগের অভিযোগপত্র বা আগের তদন্ত সঠিক ছিল না। পরবর্তীকালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আবার যদি তদন্তে দেওয়া হয়, তাহলে বর্তমান অভিযোগপত্র ঠিক থাকবে না এটা সহজেই অনুমান করা যায়।
উপরোক্ত তিনটি ঘটনায় উদাহরণের মধ্যে দিয়ে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে না। তদন্ত প্রক্রিয়াটা তদন্তকারী কর্মকর্তা সঠিকভাবে সম্পাদন করেন না বা করতে পারেন না। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ফলে সময়ের পরিবর্তনের বা তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তনের কারণে তদন্ত প্রতিবেদনও একেক সময় একেক রকম হয়। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনই ফৌজদারি মামলার মূল ভিত্তি। তদন্ত কর্মকর্তার হাতেই কাউকে বিচারের মুখোমুখি করার বা কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মূল চাবিকাঠি। অপরাধ করেও তদন্ত কর্মকর্তার মর্জিতে কেউ চার্জশিট থেকে বাদ পড়তে পারেন, আবার অপরাধ না করেও চার্জশিটভুক্ত হতে পারেন। অর্থাৎ কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা না করার এখতিয়ার তদন্তকারী কর্মকর্তার। ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সৎ, সাহসী ও দক্ষ হলে সঠিক অপরাধী বিচারের সম্মুখীন হন আর তদন্তকারী কর্মকর্তা অসৎ, অদক্ষ আর চাপে বা তদবিরে প্রভাবিত হলে যাকে খুশি তাকেই বিচারে সোপর্দ করতে পারেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত কর্মকর্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতের অধীন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। ফলে তদন্তে কোনো গাফিলতি হলে আদালত সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
বর্তমানে পুলিশের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা মূলত মামলার তদন্তকাজ করে থাকেন। তাঁদের তদন্তের কী হাল তা মামলায় যাঁরা পড়েছেন সেসব ভুক্তভোগী ভালো জানেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা আরো ভালো জানেন, কারণ তাঁরাও এর ভুক্তভোগী। অন্যদিকে থানায় বেশিরভাগ মামলার অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারে না পুলিশ। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচার প্রার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এজন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের চাপ, পুলিশের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং মামলা তদন্তে পুলিশের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের নিম্ন আদালতে ২০১০ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ৭০ শতাংশের বেশি ফৌজদারি মামলা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে টেকেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর অপরাধ করেও আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মামলায় সাজা হলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে লঘু শাস্তি হচ্ছে আসামিদের। খালাস পেয়ে আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ সদর দফতর মিলনায়তনে অপরাধবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বিভিন্ন মামলার তদন্তের এ উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ২০১০ সালে দেশে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে; তবে সিআইডি তদন্ত করছে এমন মামলায় সাজার হার ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের হিসাবে দেখানো হয়, সারাদেশে বিভিন্ন মামলায় মাত্র ২৩ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে। ৭৭ শতাংশ আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। থানায় দায়ের মামলার মধ্যে তদন্ত করে ৬৬ শতাংশের অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। আদালতে ফৌজদারি মামলার অভিযোগ প্রমাণ না করতে পারার ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলিদের বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ ইচ্ছা করে মামলা দুর্বল করে দেয়। আবার পুলিশ বলছে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সদিচ্ছার অভাব এবং সাক্ষী না পাওয়া অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার বড় কারণ। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা আছে। যেমন মামলার বিবরণ তৈরি করা হয় মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে। তদন্তও হয় সেভাবেই। খুব কম ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাও একটা বড় ব্যাপার। কারণ বিচার দীর্ঘায়িত হলে সাক্ষীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া মামলার তদন্তে দক্ষতা আনতে পুলিশের জনশক্তি বাড়ানোসহ উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই সাথে, আসামি খালাস পাওয়ার প্রধান কারণ সাক্ষী না পাওয়া। দেখা গেছে, ঘটনা সঠিক, কিন্তু সাক্ষী না পাওয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মামলা করার সময় সাক্ষী যা বলে, বিচারের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উল্টো বলে। আবার যারা সাক্ষী হন, তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাই প্রভাবশালী আসামিরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে তাদের কিনে নেয়। ভয়ভীতি দেখায়। আবার কোনো কোনো সময় সাক্ষী আসতেই চায় না।
এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক চাপ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। শুধু সরকার বা ক্ষমতাসীনরা যেসব মামলার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে, সেসব মামলার তদন্ত যতেœর সঙ্গে হচ্ছে। অন্য সব মামলার তদন্ত হয় গতানুগতিক ধারায়। এতে দেশের মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকায় জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে ভিডিও ফুটেজ দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। এছাড়া কোনো প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হত্যার অভিযোগে বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও যুবলীগের বিভিন্ন সংঘর্ষের সরকারদলীয় ক্যাডারদের অস্ত্রহাতে ছবি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও এবং টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে ভিডিও ফুটেজ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও পুলিশের কাছে গুরুত্ব পায়নি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুরের হত্যাকাণ্ডের ভিডিওচিত্র। কারণ আসামিরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। পাঠক! নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের তান্ডবের কথা। আলোচিত এ ঘটনায় মামলা হয়েছিল। কিন্তু হামলাকালে জড়িতদের স্থিরছবি ও ভিডিও ফুটেজ থাকলেও ৩১ আসামির সবাই খালাস পেয়ে যায়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ অবধি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সম্প্রতি পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন নামে একটি সংস্থা গঠনের প্রক্রিয়ার কথা শোনা গেলেও তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেই। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে তদন্ত সংস্থা হলে তদন্তের হাল বর্তমানে যেরূপ আছে তা থেকে উন্নত হবে না। ফলে পেশাদারি, দক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে পৃথক নতুন একটি সংস্থা করা হোক, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যদের স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের জন্য যেমন পৃথক ও স্বাধীন একটি তদন্ত টিম রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা তদন্তের জন্য যেমন কমিশনের আলাদা তদন্ত টিম রয়েছে, তেমনি ফৌজদারি আদালতের মামলা তদন্তের জন্য পৃথক একটি পেশাদারি তদন্ত সংস্থা গঠন করা হলে তদন্তের গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে। সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সে জন্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা ডিপার্টমেন্ট অব ইনভেস্টিগেশন নামে একটি পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের তদন্ত সংস্থা রয়েছে, যারা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে সফল হচ্ছে।
আমাদের চাই গণমুখী বিচার ব্যবস্থা। সেটা এমন হবে যেন কেউ মিথ্যা কিংবা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা করতে সাহস না পায় এবং বিচার কাজটি একক ব্যক্তির হাতে না রেখে জুরি পদ্ধতি গ্রহণ করলে সামাজিক দায়বদ্ধতা দৃঢ় হবে।


লেখকঃ অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

0 comments:

Post a Comment