Tuesday, December 31, 2013

দেওয়ানি মামলা

0 comments
সম্পত্তির উপর স্বত্ব ও দখলের ‍অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে যে ‍মামলার মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করা হয় তাকে দেওয়ানি মামলা বলা হয়। দেওয়ানি মামলাকেই আদালতের ভাষায় মোকদ্দমা বলা হয়।

সব ধরনের দৃশ্যমান স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অদৃশ্য সব ধরনের অধিকার সংক্রান্ত মোকদ্দমা হচ্ছে দেওয়ানি আদালতের বিচার্য বিষয়।

সাধারণভাবে দেওয়ানি মামলার বিষয়বস্তু:

- যেকোনো ধরনের সম্পত্তি বা স্বত্ব নিয়ে যে মামলা হয় মূলত তাই দেওয়ানি আদালতের বিচার্য বিষয়।

- কোনো মানবিক সম্পর্ক (পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক) নিয়ে যদি বিরোধ দেখা যায় তবে তা দেওয়ানি আদালতের বিচার্য বিষয়।

- মসজিদের নামাজ পড়া বা মন্দিরে পূজা করার অধিকার নিয়ে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা হয়।

- ভোটাধিকার নিয়েও দেওয়ানি আদালতে মামলা করা হয়।

সাধারণভাবে বলা যায়, সব ধরনের স্বত্ব, অধিকার, দাবি প্রভৃতির মামলা দেওয়ানি আদালতের আওতাভুক্ত।

সুপ্রিম কোর্ট (আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) ছাড়াও আমাদের দেশে পাঁচ ধরনের দেওয়ানি আদালত আছে।

জেলা জজ আদালত:

হাইকোর্ট বিভাগের পরেই জেলা জজের স্থান। জেলার সর্বোচ্চ আদালতই জেলা জজ আদালত। এ আদালত যখন দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা করে তখন তাকে দেওয়ানি আদালত বলা হয়।আবার যখন ফৌজদারী মামলার বিচার করলে তাকে ফৌজদারী আদালত বলে।

- ১ লাখ হতে ৫ লাখ পর্যন্ত মূল্যমানের মামলার আপীল জেলা জজ আদালতে করতে হয়।

- সাকসেশন সার্টিফিকেট, লেটার অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইত্যাদি জেলা জজ ইস্যু করতে পারেন।

- জেলা জজ আদালত তার নিম্ন আদালতের মোকদ্দমা স্থানান্তর সম্পর্কিত দরখাস্ত, রিভিশন শুনানী গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করতে পারেন।

- পারিবারিক আদালতের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজ আপীল গ্রহণ ও ও নিষ্পত্তি করে থাকেন।

অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত:

অতিরিক্ত জেলা জজের বিচারিক ক্ষমতা জেলা জজের সমান। তবে কোনো মোকদ্দমা বা আপীল এই আদালতে সরাসরি দায়ের করা যায় না।

- জেলা জজ আদালতে দাখিলকরা দরখাস্ত নিষ্পত্তির জন্য এ আদালতে প্রেরণ করা হলে তা শুনানী শেষে নিষ্পত্তি করা হয়।

- অতিরিক্ত জেলা জজের কোনো প্রশাসনিক ক্ষমত‍া নেই।

যুগ্ম জেলা জজ:

প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক যুগ্ম জেলা জজ থাকেন। তিনি দেওয়ানি মোকদ্দমার সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচারক।

এ ‍আদালত ৪ লক্ষ ১ টাকা হতে ‍অসীম মূল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মোকদ্দমা গ্রহণ ও বিচার নিষ্পত্তি করতে পারেন।

সিনিয়র সহকারি জজ:

প্রত্যেক জেলায় সাধারণত এক বা একাধিক সিনিয়র সহকারি জজ আদালত থাকে। সম্পত্তি, অফিস, ব্যক্তিগত অপকার, ক্ষতিপূরণ ও ধর্মীয় অধিকার-সংক্রান্ত যাবতীয় মোকদ্দমা সিনিয়র সহকারি জজ ও সহকারি জজ আদালতে দায়ের করা হয়।

এ আদালত দুই লক্ষ ১ টাকা হতে ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের মূল মোকদ্দমা গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করতে পারে।

সহকারি জজ আদালত:

এ আদালত সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যমানের বিষয়বস্তুর মূল মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করতে পারে। এ আদালতের কোনো আপিল এখতিয়‍ার নেই।

সিনিয়র সহকারি জজ ও সহকারি জজ আদালতে কী কী মামরা করা যায়:

- স্বত্ব ঘোষণার মোকদ্দমা৻

- স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার মোকদ্দমা।

- চুক্তি কার্যকরের মোকদ্দমা।

- দলিল, চুক্তিপত্র, লিখিত ‍অঙ্গীকারপত্র ইত্যাদি রদ ও রহিতের জন্য মোকদ্দমা।

- যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ আদেশ রদ ও রহিতের মোকদ্দমা।

- দখল পাওয়ার মোকদ্দমা।

- সম্পত্তি বা অফিস সংক্রান্ত কোনো অধিকার সম্পর্কে ঘোষণা পাওয়ার মোকদ্দমা।

- টাকা পাওয়ার মোকদ্দমা।

- সম্পত্তি অগ্রক্রয়ের মোকদ্দমা।

-নির্বাচনসংক্রান্ত মোকদ্দমা।

পুলিশ চাইলেই কি গ্রেফতার করতে পারে

0 comments
প্রত্যেক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারীভাবে আটক ও গ্রেফতার থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এটা সর্বজনবিদিত যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে একজন ব্যক্তির অন্য সকল অধিকার ক্রমবর্ধমানহারে অরক্ষিত এবং প্রায় অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণাপত্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কনভেনশন এবং রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও প্রচলিত আইনে সুনির্দিষ্টভাবে একজন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাচারীভাবে আটক ও গ্রেফতার থেকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। তাছাড়া, বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা আটক করতে সুনির্দিষ্ট যুক্তিসংগত কারণ বিদ্যমান থাকতে হয়।

জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৯ ধারা অনুযায়ী কাউকে খেয়াল খুশি মত গ্রেফতার বা নির্যাতন করা যায় না। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ৯(১) ধারা অনুযায়ী প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে এবং কাউকে খেয়াল খুশি মত আটক অথবা গ্রেফতার করা যায় না। এমন কি আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট কারণ ও আইনানুগ পদ্ধতি ব্যতীত কাউকে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যায় না।

তাছাড়া, এ কনভেনশনের ৯(২) ধারা অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতারের সময় কারণ জ্ঞাপন করতে হয় এবং তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে তাকে অবিলম্বে অবহিত করতে হয়। আবার, ৯(৩) ধারা অনুযায়ী ফৌজদারী অপরাধের দায়ে গ্রেফতারকৃত অথবা আটক ব্যক্তিকে অবিলম্বে কোন বিচারক কিংবা আইনের দ্বারা বিচার ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্বপ্রাপ্ত অন্য কোন কর্মকর্তার সম্মুখে হাজির করতে হয় এবং অনুরূপ ব্যক্তি যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে বিচার অথবা মুক্তি পাওয়ার অধিকারী।

উক্ত কনভেনশনের ৯(৪) ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার অথবা আটকের ফলে কেউ স্বাধীনতা বঞ্চিত হতে আদালতের কার্যধারা গ্রহনের অধিকার তার থাকবে, যাতে অবিলম্বে তার আটকের বৈধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে পারে এবং উক্ত আটক আইন বিরুদ্ধ হলে তার মুক্তির আদেশ দিতে পারে। সর্বোপরি, ৯(৫) ধারা কেউ অবৈধভাবে গ্রেফতার অথবা আটকের শিকার হলে ক্ষতিপূরণ লাভের বলবৎযোগ্য অধিকার তার থাকবে বলে ঘোষনা করেছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, রুয়ান্ডা, তানজানিয়া, জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশে পুলিশের কাউকে গ্রেফতার করতে হলে কিছু সাংবিধানিক ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে গ্রেফতার করার বিধান রয়েছে।

কম্বোডিয়া: কম্বোডিয়া সিসিপি’র ৯৬ ধারা অনুযায়ী যদি সরকারী আইনজীবী (প্রসিকিউটের) লিখিত অনুমতি প্রদান করেন অথবা যদি কোন ব্যক্তি প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান না করে অথবা যদি কোন ব্যক্তি অপরাধ সংগঠনে যুক্ত মর্মে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ বিদ্যমান থাকে তবে একজন বিচারিক পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করতে পারেন।

চীন: চায়না সিপিএল এর ধারা ৫৯ অনুযায়ী জন নিরাপত্তা সংস্থা পিপল'স প্রকিউরেটোরেট এর অবশ্য অনুমোদন সাপেক্ষে অথবা পিপল'স কোর্ট এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপরাধে অভিযুক্ত অথবা সন্দেহযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন।

তাছাড়া, চায়না সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পিপল'স প্রকিউরেটর এর অনুমোদন বা সিদ্ধান্ত অথবা পিপল'স কোর্ট এর সিদ্ধান্ত ব্যতীত কোন নাগরিককে গ্রেফতার করা যায় না এবং গ্রেফতার অবশ্য জন নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক কার্যকর করতে হয়।

ভারত: ভারতীয় ফৌজদারী কার্যবিধির ৪১ ধারা অনুযায়ী পুলিশ অফিসার যুক্তিসংগত সম্ভাব্য কারনের ভিত্তিতে আমল আযোগ্য অপরাধ ব্যতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে গ্রেফতারের সময় উক্ত ব্যক্তি কোন অপরাধ সংগঠিত করেছে বা করছে বলে পর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান থাকে হয়।

রুয়ান্ডা: রুয়ান্ডা ফৌজদারী কার্যবিধি কোডের ৩৭ ধারা অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি এমন কোন অপরাধ সংগঠিত করেছে যার শাস্তির মেয়াদ কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ড মর্মে গুরুত্বর সন্দেহ বিদ্যমান থাকে অথবা যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি পলায়ন করতে পারে বলে যুক্তিসংগত সন্দেহ বিদ্যমান থাকে অথবা যদি তার পরিচয় অজানা বা সন্দেহজনক মনে হয়, তবে একজন বিচারিক পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তের স্বার্থে তার অফিসিয়াল সক্ষমতায় তাকে গ্রেফতার বা আটক করে থানা হেফাজতে আবদ্ধ রাখতে পারেন।

তানজানিয়া: তানজানিয়া ফৌজদারী আইন, ১৯৮৫ এর ১৪ ধারা অনুযায়ী একজন পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতার করতে পারেন- (এ) যদি কোন ব্যক্তি তার উপস্থিতিতে শান্তি ভঙ্গ করে; (বি) যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশ কর্মকর্তার আইনগত কার্যসম্পাদনে বাঁধা প্রদান করেন এবং আইনগত হেফাজত থেকে পলায়ন করে বা পলায়নের চেষ্টা করে; এবং (সি) যদি কোন ব্যক্তির নিকট যুক্তিসংগত সন্দেহযুক্ত চুরির দ্রব্যাদি পাওয়া যায়।

জিম্বাবুয়ে: জিম্বাবুয়ে সংবিধানের ১৩(২)(ই) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছাচারীভাবে গ্রেফতার করা যায় না, গ্রেফতার করতে হলে উক্ত ব্যক্তি কোন ফৌজদারি অপরাধ করেছে মর্মে যুক্তিসংগত সন্দেহ বিদ্যমান থাকতে হয়।

তাছাড়া, জিম্বাবুয়ে সিপিইএর অধ্যায় ৫, বিভাগ এ, ধারা এ-সি অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি একজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে কোন অপরাধ করতে থাকে অথবা কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ সংগঠিত করেছে মর্মে একজন পুলিশ অফিসার যুক্তিসংগতভাবে সন্দেহ করে অথবা কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ সংগঠনের চেষ্ঠা করে অথবা তা সংগঠন করতে স্পষ্টভাবে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে তবে একজন পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করতে পারেন।

সর্বোপরি, জিম্বাবুয়ে সংবিধানের ১৩(২)(ই) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতারের কারণ জানাতে হয় এবং কোন প্রকার বিলম্ব ব্যতীত তার পছন্দ মত আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি প্রদান করতে হয়।

বাংলাদেশ: বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না, যাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম, বা সম্পত্তির হানি ঘটে। আবার ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যায় না।

সর্বোপরি, সংবিধানের ৩৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যায় না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যায় না।

তাছাড়া, সংবিধানের ৩৩ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদতিরিক্ত কাল প্রহরায় আটক রাখা যায় না।

বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী নয়টি ক্ষেত্রে যথাঃ (১) কোন আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত অথবা জড়িত বলে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে; (২) আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত ঘর ভাংগার সরঞ্জাম রয়েছে; (৩) আইনানুযায়ী যাকে অপরাধী বলে ঘোষনা করা হয়েছে; (৪) চোড়াই মাল রয়েছে বা চুরি কার্য সংঘটিত করেছে বলে সন্দেহ হয়; (৫) পুলিশের কাজে বাঁধা দানকারী বা পুলিশের হেফাজত থেকে পলায়নকারী বা পলায়নের চেষ্টাকারী; (৬) প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে পলায়নকারী; (৭) দেশের বাইরে এমন কোন অপরাধ সংগঠন করী যা বাংলাদেশে সংগঠন করলে অপরাধ বলে গন্য হত; (৮) কোন মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী মুক্তির শর্ত বা প্রচলিত নিয়ম লঙ্ঘনকারী; এবং (৯) আইনসঙ্গত ভাবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের কারণ রয়েছে এমন কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য অন্য কোন পুলিশ অফিসারের নিকট থেকে প্রাপ্ত অনুরোধক্রমে কোন ব্যক্তিকে বিনা গ্রেফতারী পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারে।

তবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সন্দেহ সুনির্দিষ্ট, যুক্তিসংগত, দৃঢ় ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হয়। খামখেয়ালীভাবে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না। কোন অপরাধ সংগঠিত করেছে, করছে অথবা করতে যাচ্ছে এরূপ বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত সম্ভাব্য কারণ বিদ্যমান থাকলেই শুধুমাত্র পুলিশ অফিসার একজন ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করতে পারে। যুক্তিসংগত বিশ্বাসযোগ্য কারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনা করতে হয়। পুলিশ অফিসারের স্বেচ্ছাচারী দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে চলবে না।

ব্যাংক চেক ডিস্অনার হয় কেন

0 comments
নগদ টাকায় লেনদেনের চেয়ে চেকের মাধ্যমে লেনদেনে রয়েছে বেশকিছু সুবিধা। তবে সঠিকভাবে চেক প্রদান করা না হলে ব্যাংক সে চেক প্রত্যাখ্যানও করতে পারে।

যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি তার কোনো ব্যাংক একাউন্ট থেকে অন্য কাউকে অর্থ পরিশোধের জন্য চেক প্রদান করে এবং উক্ত একাউন্টে যদি চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমানের চেয়ে কম টাকা থাকে এবং চেকটি যদি ব্যাংক অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত দেয় তাহলে চেকদাতা একটি অপরাধ করেছে বলে গণ্য হবে।

এ অপরাধে তিনি এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত দণ্ডে দণ্ডিত অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুন পরিমাণ অর্থ দণ্ডেত দণ্ডিত হতে পারে অথবা উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে।

তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের (এনআই অ্যাক্ট) ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারায় তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধের জন্য আইনি প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে।

নগদ টাকার পরিবর্তে চেকের মাধ্যমে ঋণ অথবা অন্য কোনো দায় পরিশোধকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ আইন করা হয়েছে।

নগদ লেনদেনে রয়েছে ঝুঁকি। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের নগদ লেনদেনের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। চেকের মাধ্যমে লেনদেনে ঝুঁকি কম। তবে চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি আছে। বিদেশে চেক অথবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেনা পরিশোধ করা হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চেকের মাধ্যমে লেনদেন এখনো আমাদের দেশে ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে ক্রমান্বয়ে চেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ধরা যাক `ক` এর কাছে `খ` দুই লাখ টাকা পাবে। `ক` টাকা পরিশোধের উদ্দেশে `খ` কে জনতা ব্যাংকের একটি চেক দিল। চেকে টাকার পরিমাণও ছিল দুই লাখ। `খ` টাকা উত্তোলনের জন্য যথাসময়ে চেকটি জনতা ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর জনতা ব্যাংক জানিয়ে দিল `ক` এর ব্যাংক হিসেবে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে `ক` অপরাধ করেছে।

তবে আইনের এ বিধানাবলী কার্যকর করতে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।

চেক প্রাপকের কর্তব্য:

১. চেকটি প্রস্তুত হওয়ার তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অথবা চেকটি বৈধ থাকাকালীন সময়ের মধ্যে যেটি আগে হয় সেই সময়সীমার মধ্যে ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে।
২. চেকটির প্রাপক অথবা যথা নিয়মে ধারক যেই হোন না কেন ব্যাংক কর্তৃক চেকটি ফেরত কিংবা ডিস্অনার হয়েছে তা অবগত হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের দাবি জানিয়ে চেক প্রদানকারীকে লিখিত নোটিশ প্রদান করবেন।
৩. উক্ত নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী চেকের প্রাপককে অথবা যথা নিয়মে ধারকের বরাবর উল্লিখিত পরিমাণ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে মামলার কারণ উদ্ভব হবে।
৪. মামলার কারণ উদ্ভব হওয়ার তারিখ থেকে এক মাসের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

চেকটির প্রেরক যদি কোন রেজিষ্টার কোম্পানী হয়
কোম্পানির ক্ষেত্রেও এ আইন প্রযোজ্য হবে। এনআই অ্যাক্টের ধারা ১৩৮-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটনকারী যদি একটি কোম্পানি হয় এবং ওই কোম্পানি যদি সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই অপরাধ সংঘটনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী হবেন এবং আইন অনুযায়ী দণ্ডিত হবেন।

নোটিশ জারীর নিয়মাবলী
চেক ইস্যুকারীকে তিনভাবে উপরোক্ত নোটিশ প্রদান করা যায়। প্রথমত, নোটিশ গ্রহীতার হাতে নোটিশ পৌঁছে দেয়া, অথবা প্রাপ্ত স্বীকারপত্রসহ রেজিস্টার্ড ডাকযোগে বাংলাদেশে তার জ্ঞাত ঠিকানায় নোটিশ প্রেরণ করা; অথবা বহুল প্রচারিত কোনো বাংলা জাতীয় দৈনিকে নোটিশ প্রকাশ করে।

যে সব কারণে চেক ডিসঅনার হতে পারে:
১. চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে
২. যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে
৩. চেকে ড্রয়ারের স্বাক্ষর না হলে
৪. চেক পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের হলে
৫. চেকে স্বাক্ষরের সঙ্গে ব্যাংকে রক্ষিত গ্রাহকের নমুনা স্বাক্ষরের অমিল হলে
৬. চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ অংকে ও কথায় অমিল হলে
৭. হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি না থাকলে
৮. চেকে ঘষামাজা থাকলে
৯. চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ না করা হলে
১০. ব্যাংকিং সময়ের পর চেক উপস্থাপন করা হলে

এ ছাড়া আরো অনেক কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত (বাউন্স) হতে পারে। যে সব কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত হতে পারে তার একটি ছাপানো রশিদ প্রতিটি ব্যাংকে থাকে। যে কারণে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হলো তা চিহ্নিত করে ওই স্লিপসহ চেকটি প্রাপকের কাছে ব্যাংক ফেরত পাঠায়।

উল্লেখ্য, শুধু তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত হলে তা এই আইনের আওতায় পড়ে।

আপীল দায়ের

তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংক চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধে আদালত কাউকে কারাদণ্ড প্রদান করলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে প্রত্যাখ্যাত চেকের মূল্যের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অর্থ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে হবে।

অপরাধের শাস্তি

এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুন পরিমান অর্থদণ্ডত অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এনআই অ্যাক্টের এই সংশোধনীর ফলে ব্যাংকগুলো ঋণের জামানত হিসেবে পণ্য বন্ধকীর পরিবর্তে পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের চেক গ্রহণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে।

তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেকের অমর্যাদা করা হলে ব্যাংক আইনি প্রতিকার চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হয়েছে। জেল-জরিমানার ভয়ে ঋণগ্রহীতারা অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসছেন।

কাজেই ঋণ অথবা অন্য কোনো দায় পরিশোধের জন্য চেক ইস্যু করার আগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে, ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি রয়েছে।

ফৌজদারী অপরাধ তদন্তে স্বাধীন তদন্ত সংস্থার প্রস্তাব ও প্রাসঙ্গিক কথা

0 comments
বিচার ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিরূপণ করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইনি প্রতিকার দেয়া। আদালত নাগরিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এ কাজ করে না বরং কারো অধিকার হরণ হলে তাকেই আদালতের দ্বারে ধরনা দিতে হয়। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, ন্যায় বিচারের মূল ভিত্তি। তদন্তে গাফিলতি বা অনিয়ম হলে বিচারে বিভ্রাট হয়, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন ব্যাহত হয়। দোষী ব্যক্তি ছাড়া পায়, নির্দোষ ব্যক্তি সাজা পায়। সেই সাথে বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ফলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতি রেখে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠন করা দরকার। ভূমিকার শুরুতে দুটি বাক্যে যা বললাম তার বিস্তৃত পরিকল্পনা দেয়ার জন্য একটি কিংবা একাধিক প্রবন্ধ যথেষ্ট নয়। একটি বই লেখা জরুরী।
১২ এপ্রিল’২০১১ হন্তদন্ত হয়ে গ্রামের পরিপাটি চেহারার এক কৃষক দ্বারস্থ হলেন আদালতের একজন আইনজীবীর কাছে। বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার জাগলবা গ্রামে। নাম মনসের আলী। বেচারীর অভিযোগ, তার ছেলে রাজু আহমেদ নিজ স্ত্রীকে আনতে গেলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে রক্তাক্ত জখম করেছে। মাথায় ও কপালে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করায় ৮টি সেলাই করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসা শেষে থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ মামলা নেয়নি। কারন আসামীরা সরকারদলীয় গ্রাম্য প্রভাবশালী চক্র। উল্টো করে থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে বাদী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বেচারী ভদ্রলোক নিতান্তই বিপদে পড়ে ছেলে নির্যাতনকারীদের বিচার দিতে আদালতে এসেছে। কারণ মানুষের সর্বশেষ বিচারের আশ্রয়স্থল আদালত। আইনজীবী মহোদয় হাসপাতালের চিকিৎসাপত্র, জখমী ভর্তি, ছাড়পত্র, ভিকটিমের নির্যাতনের চিহ্ন পর্যালোচনা করে একটি নালিশি দরখাস্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে দাখিল করলেন। ভিকটিম রাজু আহমেদও মাথায় ক্ষত চিহ্ন নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারক মহোদয়কে নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেন। বাদী হলফান্তে সমস্ত ঘটনা বর্ণণা করলেন। থানা মামলা নেয়নি এ বিষয়টিও আইনজীবী মহোদয় হুজুরাদালতে বয়ান করলেন। মামলাটি সরাসরি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য থানা কর্তৃপক্ষের উপর আদেশ দানের জন্য আইনজীবী মহোদয় হুজুরাদালতে সাবমিশন জানালেন। এটাও জানালেন, থানার উপর তদন্ত প্রতিবেদন চাইলে থানা কর্তৃপক্ষ সঠিক প্রতিবেদন দিবেন না। তার কারন ইতোপূর্বে বর্ণণা করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই শুনলেন না ওই বিচারক মহোদয়। তিনি যথারীতি থানার উপর তদন্ত প্রতিবেদন চাইলেন। মামলাটি মিস ৭/২০১১ নং মামলা হিসেবে কজ লিষ্টে অন্তর্ভূক্ত হলো। প্রতিবেদন থানাতে পাঠাতে শুরুতেই বাদীকে পেশকার সাহেবের প্রতি দুশ টাকা গুনতে হলো। এরপর ৬ মাসে প্রায় ১০টি ধার্য্য তারিখে বাদী আদালতে হাজির হলেন বিচারের জন্য কিন্তু থানা ওই মামলায় কোন প্রতিবেদন পাঠালেন না। অবশেষে বাদী নিরুপায় ও ধৈর্য্যচ্যূত হয়ে বিচারের ভার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়ে তিনি আদালত ত্যাগ করলেন। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে এখনও বিলম্বের ভূত লুকিয়ে আছে।

আমাদের চাই গণমুখী বিচার ব্যবস্থা। সেটা এমন হবে যেন কেউ মিথ্যা কিংবা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা করতে সাহস না পায় এবং বিচার কাজটি একক ব্যক্তির হাতে না রেখে জুরি পদ্ধতি গ্রহণ করলে সামাজিক দায়বদ্ধতা দৃঢ় হবে।

আইন পেশায় থাকার সুবাদে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের আইনী সমস্যার সাথে আমাকে পরিচিত হতে হয়। এইতো সেদিন চেম্বারে এসেছিল একজন সরকারী কর্মকর্তা। থাকেন খোদ রাজধানী কর্মস্থল ঢাকায়। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। গ্রামের কিছু সন্ত্রাসী জনৈক ব্যক্তিকে খুন করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ওই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সরকারী কর্মকর্তার নামও মামলায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সাক্ষীরা সুপরিকল্পিতভাবে খুনের ঘটনার সঙ্গে অন্য খুনিদের সাথে ওই কর্মকর্তাকে জড়িয়ে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। রায়ে আদালত ওই কর্মকর্তাসহ অন্য আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। সাক্ষ্য-প্রমাণের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আদালতের নেই। ফলে আইনি বিচার হলো ঠিকই; কিন্তু ওই কর্মকর্তা ন্যায়বিচার পেলেন না। এখন তিনি কারাগারে। চাকরি নেই। ওই কর্মকর্তার স্বজনদের দাবি, তিনি ওই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এবং ওই সময় তিনি ঢাকায় কর্মস্থলে ছিলেন। তা সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করে বাদীপক্ষ ওই কর্মকর্তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। তদন্তকালে তদন্ত কর্মকর্তা ওই কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। যোগাযোগ করলে হয়তো তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হতো না। এ ধরনের ঘটনার অনেক নজির এ দেশে রয়ে গেছে।

আইনি গ্রক্রিয়া, বিচার এমনভাবে হওয়া দরকার, যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু অনেক সময় তা সম্ভব হয় না। এর পেছনে আছে অনেক কারণ। সম্প্রতি মূসক আইন প্রণয়নের কাজ চলছে। আর এটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাঁদের ওপর এটা প্রয়োগ হবে, তাঁদের সঙ্গে চলছে দফায় দফায় আলোচনা। আলোচনা হতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আপত্তিটা হলো তাঁদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে একটি দুর্বল আইন করা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে যাঁদের ওপর আইনটি প্রয়োগ হবে, তাঁরা কঠোর আইন করতে বাধা দেবে। কিন্তু তাই বলে এমন আইন করা সংগত হবে না, যাতে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। যেমনটি হয়েছিল মোটরযান আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে। ড্রাইভারদের আন্দোলনের মুখে আইনই বদলে গেল, যার ফলে মিরসরাই ট্র্যাজেডির বিচার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলো। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, সনদবিহীন বা ভুয়া সনদধারী ড্রাইভার নিয়োগের জন্য মালিকদের তো আইনের আওতাই আনা যাচ্ছে না। কারণ ওই মালিকদের কেউ কেউ আবার আইনপ্রণেতা আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতা।

পাঠক! নিশ্চয়ই মনে আছে চট্রগ্রামে সেই আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের কথা। ওই মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রয়ারি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২৬ জুন ২০১১ সালে আরো ১১ জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এবং বলা হয় আগের অভিযোগপত্র বা আগের তদন্ত সঠিক ছিল না। পরবর্তীকালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আবার যদি তদন্তে দেওয়া হয়, তাহলে বর্তমান অভিযোগপত্র ঠিক থাকবে না এটা সহজেই অনুমান করা যায়।
উপরোক্ত তিনটি ঘটনায় উদাহরণের মধ্যে দিয়ে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে না। তদন্ত প্রক্রিয়াটা তদন্তকারী কর্মকর্তা সঠিকভাবে সম্পাদন করেন না বা করতে পারেন না। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। ফলে সময়ের পরিবর্তনের বা তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তনের কারণে তদন্ত প্রতিবেদনও একেক সময় একেক রকম হয়। অথচ তদন্ত প্রতিবেদনই ফৌজদারি মামলার মূল ভিত্তি। তদন্ত কর্মকর্তার হাতেই কাউকে বিচারের মুখোমুখি করার বা কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মূল চাবিকাঠি। অপরাধ করেও তদন্ত কর্মকর্তার মর্জিতে কেউ চার্জশিট থেকে বাদ পড়তে পারেন, আবার অপরাধ না করেও চার্জশিটভুক্ত হতে পারেন। অর্থাৎ কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা না করার এখতিয়ার তদন্তকারী কর্মকর্তার। ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তা সৎ, সাহসী ও দক্ষ হলে সঠিক অপরাধী বিচারের সম্মুখীন হন আর তদন্তকারী কর্মকর্তা অসৎ, অদক্ষ আর চাপে বা তদবিরে প্রভাবিত হলে যাকে খুশি তাকেই বিচারে সোপর্দ করতে পারেন। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় তদন্ত কর্মকর্তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতের অধীন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। ফলে তদন্তে কোনো গাফিলতি হলে আদালত সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না।
বর্তমানে পুলিশের নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারা মূলত মামলার তদন্তকাজ করে থাকেন। তাঁদের তদন্তের কী হাল তা মামলায় যাঁরা পড়েছেন সেসব ভুক্তভোগী ভালো জানেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা আরো ভালো জানেন, কারণ তাঁরাও এর ভুক্তভোগী। অন্যদিকে থানায় বেশিরভাগ মামলার অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারে না পুলিশ। এতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচার প্রার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এজন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রভাবশালীদের চাপ, পুলিশের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা এবং মামলা তদন্তে পুলিশের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের নিম্ন আদালতে ২০১০ সালে নিষ্পত্তি হওয়া ৭০ শতাংশের বেশি ফৌজদারি মামলা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে টেকেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর অপরাধ করেও আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মামলায় সাজা হলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে লঘু শাস্তি হচ্ছে আসামিদের। খালাস পেয়ে আরও বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
২০১১ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ সদর দফতর মিলনায়তনে অপরাধবিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বিভিন্ন মামলার তদন্তের এ উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ২০১০ সালে দেশে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে; তবে সিআইডি তদন্ত করছে এমন মামলায় সাজার হার ৩৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে ২০০৯ সালের হিসাবে দেখানো হয়, সারাদেশে বিভিন্ন মামলায় মাত্র ২৩ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে। ৭৭ শতাংশ আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। থানায় দায়ের মামলার মধ্যে তদন্ত করে ৬৬ শতাংশের অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। আদালতে ফৌজদারি মামলার অভিযোগ প্রমাণ না করতে পারার ব্যাপারে সরকারি কৌঁসুলিদের বক্তব্য হচ্ছে, পুলিশ ইচ্ছা করে মামলা দুর্বল করে দেয়। আবার পুলিশ বলছে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সদিচ্ছার অভাব এবং সাক্ষী না পাওয়া অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার বড় কারণ। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলা দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সমস্যা আছে। যেমন মামলার বিবরণ তৈরি করা হয় মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে। তদন্তও হয় সেভাবেই। খুব কম ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়। এক্ষেত্রে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতাও একটা বড় ব্যাপার। কারণ বিচার দীর্ঘায়িত হলে সাক্ষীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া মামলার তদন্তে দক্ষতা আনতে পুলিশের জনশক্তি বাড়ানোসহ উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই সাথে, আসামি খালাস পাওয়ার প্রধান কারণ সাক্ষী না পাওয়া। দেখা গেছে, ঘটনা সঠিক, কিন্তু সাক্ষী না পাওয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। মামলা করার সময় সাক্ষী যা বলে, বিচারের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উল্টো বলে। আবার যারা সাক্ষী হন, তাদের বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাই প্রভাবশালী আসামিরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে তাদের কিনে নেয়। ভয়ভীতি দেখায়। আবার কোনো কোনো সময় সাক্ষী আসতেই চায় না।
এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক চাপ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত নির্ভর করে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। শুধু সরকার বা ক্ষমতাসীনরা যেসব মামলার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে, সেসব মামলার তদন্ত যতেœর সঙ্গে হচ্ছে। অন্য সব মামলার তদন্ত হয় গতানুগতিক ধারায়। এতে দেশের মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ঢাকায় জামায়াত কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার ক্ষেত্রে ভিডিও ফুটেজ দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। এছাড়া কোনো প্রমাণের তোয়াক্কা না করেই নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হত্যার অভিযোগে বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও যুবলীগের বিভিন্ন সংঘর্ষের সরকারদলীয় ক্যাডারদের অস্ত্রহাতে ছবি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও এবং টিভি চ্যানেলগুলোর কাছে ভিডিও ফুটেজ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও পুলিশের কাছে গুরুত্ব পায়নি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুরের হত্যাকাণ্ডের ভিডিওচিত্র। কারণ আসামিরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। পাঠক! নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনায় কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের তান্ডবের কথা। আলোচিত এ ঘটনায় মামলা হয়েছিল। কিন্তু হামলাকালে জড়িতদের স্থিরছবি ও ভিডিও ফুটেজ থাকলেও ৩১ আসামির সবাই খালাস পেয়ে যায়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও আজ অবধি একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। সম্প্রতি পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন নামে একটি সংস্থা গঠনের প্রক্রিয়ার কথা শোনা গেলেও তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেই। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে তদন্ত সংস্থা হলে তদন্তের হাল বর্তমানে যেরূপ আছে তা থেকে উন্নত হবে না। ফলে পেশাদারি, দক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে পৃথক নতুন একটি সংস্থা করা হোক, যেখানে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যদের স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের জন্য যেমন পৃথক ও স্বাধীন একটি তদন্ত টিম রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা তদন্তের জন্য যেমন কমিশনের আলাদা তদন্ত টিম রয়েছে, তেমনি ফৌজদারি আদালতের মামলা তদন্তের জন্য পৃথক একটি পেশাদারি তদন্ত সংস্থা গঠন করা হলে তদন্তের গুণগতমান বৃদ্ধি পাবে। সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সে জন্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা ডিপার্টমেন্ট অব ইনভেস্টিগেশন নামে একটি পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের তদন্ত সংস্থা রয়েছে, যারা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে সফল হচ্ছে।
আমাদের চাই গণমুখী বিচার ব্যবস্থা। সেটা এমন হবে যেন কেউ মিথ্যা কিংবা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা করতে সাহস না পায় এবং বিচার কাজটি একক ব্যক্তির হাতে না রেখে জুরি পদ্ধতি গ্রহণ করলে সামাজিক দায়বদ্ধতা দৃঢ় হবে।


লেখকঃ অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

Saturday, December 14, 2013

ম্যান্ডেলার তিন স্ত্রীর কথা

0 comments
নেলসন ম্যান্ডেলা। বহু বিশেষণে বিশেষিত সদ্যই অন্য ভুবনে পাড়ি জমানো এই মানুষটির পরিচয় নতুন করে দেয়ার কিছু নেই। ম্যান্ডেলার রাজনীতিবিদ আর সাম্যবাদীর পরিচয়ের আড়ালে অনেকটাই হারিয়ে গেছে তার পারিবারিক জীবন। মানুষ ভুলেই গেছে সাদা-কালো আন্দোলন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ম্যান্ডেলাকে মানসিক সমর্থন যুগিয়ে যাওয়া তার তিন স্ত্রীর কথা। যদিও ম্যান্ডেলা নিজে সবসময়ই স্মরণ করেছেন জীবনে তাদের অবদান। তাদের কঠিন সময়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন বন্ধুত্বের হাত। 'মাদিবা'র স্ত্রীদের নিয়েই এই লেখা।
ছাত্রজীবনে তার জন্য পারিবারিকভাবে আয়োজিত এক বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে যাওয়া ম্যান্ডেলা যে পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় আরো তিনবার বিয়ে করবেন সেটা হয়তো ভাবতে পারেননি কেউই। ১৯১৮ সালে মেভেজোতে জন্ম নেয়া বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের এই পুরোধা ব্যক্তি ১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন তার মতোই গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুণী এভলিন ওয়েসকে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ম্যান্ডেলার সহকর্মী ওয়াল্টার সিসুলুর মাধ্যমে এভলিনের সাথে পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তাকে বিয়ে করেন ম্যান্ডেলা। সংসার জীবনের শুরুটা দারুণ মধুময় হলেও অল্পদিনের ব্যবধানেই ম্যান্ডেলা ব্যস্ত হয়ে পড়েন তার হাতেই সদ্য গঠিত এএনসি'র তরুণ দল নিয়ে। এর কয়েক বছর পরই বিদ্রোহের অভিযোগে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করতে হয় ম্যান্ডেলাকে।

জামিনে বেরিয়ে এসে এভলিনকে আর দেখা হয়নি ম্যান্ডেলার। তার অনুপস্থিতিতে তিন সন্তানকে রেখে এভলিন ততদিনে চলে গেছেন তার নিজ গ্রামে। ১৩ বছরের দাম্পত্য জীবনের শেষটাও রচিত হলো সেখানেই। দ্বিতীয় দফায় জেলে এসে অভিযোগের শুনানি চলাকালে ম্যান্ডেলার সাথে পরিচয় হয় উইনির। ১৯৫৮ সালের জুনে বিয়ে করেন তারা। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে ম্যান্ডেলা তার জীবনের সেরা সময়টা কাটান উইনির সাথেই। যদিও দ্বিতীয় দাম্পত্য জীবনের বেশিরভাগটাই এই অবিসংবাদিত নেতাকে কাটাতে হয় কারাগারের সেই বিখ্যাত ৪৬৬৬৪ নম্বর রুমে। তবে দু'জনের মানসিক নৈকট্যে এই জেল জীবনে কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ম্যান্ডেলার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শীঘ্রই কারাভ্যন্তরে যেতে হয় উইনিকেও। প্রথম দফায় জেল থেকে বেরিয়ে আসার কয়েক বছর পর থেকে বিদ্রোহের অভিযোগে নিয়মিতই জেলে যেতে বাধ্য হন উইনি। তবে কালো মানুষের মুক্তির জন্য উইনির এই কারাবরণকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন ম্যান্ডেলা। গর্বের সাথেই তিনি উচ্চারণ করেন, 'মনে হয় বুঝে শুনে আমি একটা ঝামেলাকেই বিয়ে করেছি।'
১৯৯০ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও উইনি ম্যান্ডেলার বাহুলগ্না ছিলেন। যদিও ততদিনে বয়সে অনেক ছোট একজনের সাথে মন দেয়া-নেয়া চলছে তার। তবে তাই বলে দু'জনের সম্পর্ক সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৯২ সালে দুজনের বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও অপহরণের দায়ে যখন উইনির ছয় বছরের জেল হয়, তখনও তার পাশে ছিলেন ম্যান্ডেলা। এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ম্যান্ডেলার পাশে ছিলেন তার তৃতীয় স্ত্রী গ্রাসা ম্যাচেল।
মোজাম্বিকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সামোরা ম্যাচেলের সহযোদ্ধা এবং পরবর্তীতে তার সরকারের মন্ত্রী গ্রাসার কাছে অবশ্য প্রেসিডেন্টের স্ত্রী পরিচয়টা নতুন ছিল না। ১৯৮৬ সালে এক বিমান দুর্ঘটনায় সামোরা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার স্ত্রী ছিলেন গ্রাসা। তখন জেলে বসেই গ্রাসাকে সমবেদনা পত্র পাঠান ম্যান্ডেলা। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় গ্রাসার সাথে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয় এবং প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের বিয়ের অনুষ্ঠানে দুজনকে প্রথমে একসাথে দেখা যায়। দুজনের সম্পর্কের বিষয়ে কোন লুকোছাপা না করে ম্যান্ডেলা সাংবাদিকদের জানান, 'জীবনের এই শেষ পর্যায়ে এসেও মনে হচ্ছে আমি এখনো ফুলের মতোই ফুটছি। তার (গ্রাসা) সমর্থন এবং ভালবাসাই আমাকে এমনটা ভাবাচ্ছে।' এরপর ১৯৯৮'র ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার আশিতম জন্মদিনে 'জীবনে আর কখনো কোন প্রেসিডেন্টকে বিয়ে করবেন না' এই শপথ ভেঙ্গে ম্যান্ডেলাকে বিয়ে করেন গ্রাসা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ম্যান্ডেলার সাথেই ছিলেন গ্রাসা।

আবিদ শাহরিয়র

Tuesday, December 3, 2013

ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করতে

1 comments
সুন্দর গোলাপি ঠোঁট মুখের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যকর গোলাপি ঠোঁটের জন্য বাড়তি কোন কিছুর দরকার পরে না। লিপস্টিক কিংবা লিপবাম ছাড়াই অনেক সুন্দর দেখায়। তাই সুন্দর, স্বাস্থ্যকর একজোড়া গোলাপি ঠোঁট কমবেশি সবারই কাম্য।
কিন্তু সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি, ধূমপান, চা/কফি পান এবং বয়স ইত্যাদি বিভিন্ন কারণের আমাদের ঠোঁটে কালচে ভাব চলে আসে। যা খুবই অস্বস্তিকর। কিন্তু এই সমস্যারও সমাধান রয়েছে। ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করে ঠোঁটে পুনরায় গোলাপি আভা আনতে আছে কিছু প্রাকৃতিক ও সহজ পদ্ধতি। ঘরের কিছু টুকিটাকি ব্যবহার করে ফিরে পেতে পারেন স্বাস্থ্যকর গোলাপি ঠোঁট।

মধু

মধু একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা ত্বককে উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে। ঠোঁটের ত্বকও এর ব্যতিক্রম নয়। মধু আপনার ঠোঁট থেকে কালচে ভাব দূর করার সাথে সাথে আপনার ঠোঁটকে কোমল করে তুলবে।

রাতে ঘুমানোর আগে সামান্য একটু মধু নিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন সারারাত। কয়েক সপ্তাহ এভাবে প্রতিদিন শোবার পূর্বে ঠোঁটে মধু লাগান। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঠোঁটের কালচে ভাব দূর হতে দেখবেন।

লেবুর রস

লেবুর রস খুব ভালো একটি ব্লিচিং উপাদান হিসেবে পরিচিত। ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করতে এটি খুবই কার্যকরী একটি উপকরণ। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সামান্য লেবু চিপে তাজা রসটি দিয়ে ঠোঁট খুব ভালো ভাবে ম্যাসাজ করুন। নিয়ম মেনে প্রতিদিন এই কাজটি করুন। কয়েকদিনের মধ্যেই ঠোঁটের রঙের পার্থক্য দেখতে পাবেন।

চিনি

প্রাকৃতিক স্ক্রাবার হিসেবে চিনি ব্যবহার করা হয় অনেক কাজেই। চিনি দিয়ে ঠোঁট স্ক্রাব করলে ঠোঁটের কালচে ভাব দূর হওয়ার সাথে সাথে ঠোঁটের মরা চামড়াও দূর হয়। ত্বকের জন্য স্ক্রাবিং যতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠোঁটের জন্যও ঠিক তাই। ৩ চামচ চিনি ও ২ চামচ বাটার একসাথে মিসিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। সপ্তাহে অন্তত ২ বার এই পেস্টটি দিয়ে ঠোঁট স্ক্রাব করুন। এতে আপনার ঠোঁটের মরা চামড়া দূর হবে এবং কালচে ভাব দূর হয়ে ঠোঁটে গোলাপি আভা আসবে।

বীটরুট

বীটরুট ঠোঁটের রঙ হালকা করা ও উজ্জলতা বাড়াতে বেশ কার্যকরী একটি উপাদান। বীটরুটের রস ঠোঁটে রক্তিম আভা নিয়ে আসে। তাই তাজা বীটরুটের রস ঠোঁটে লাগিয়ে ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করতে পারেন।

বরফ

অনেকেই বরফের এই গুনটি সম্পর্কে ধারনা রাখেন না। যে কোন দাগের ওপর বরফ ঘষলে দাগ হালকা হয়ে যায়। ঠোঁটে এক টুকরো বরফ ঘষুন প্রতিদিন। এতে আপনার ঠোঁটের কালচে ভাব দূর হবে। বরফ ঠোঁটের আদ্রর্তার পরিমান ঠিক রেখে ঠোঁটকে রুক্ষতার হাত থেকেও পরিত্রান দেবে।

দুধের সর

দুধের সরের মাধ্যমে ঠোঁটের গোলাপি আভা ধরে রাখার এই পদ্ধতিটি প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন যুগে রানীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আপনিও এই পদ্ধতির মাধ্যমে আপনার ঠোঁটের হারানো দ্যুতি ফিরে পেতে পারেন। দুধের সরে মধু মিশিয়ে ঠোঁটে লাগান। দিনে বেশ কয়েকবার ব্যবহারে কিছুদিনের মধ্যেই আপনার ঠোঁটে ফিরবে গোলাপি আভা।

Sunday, December 1, 2013

টিকফা

0 comments
টিকফা কী?
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে দশক কালেরও আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এখনো সম্ভব হয়নি। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।

চুক্তিটি কার জন্য?
চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও। চুক্তিটির ধারা উপধারা ও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী।


টিকফা চুক্তিতে কী আছে?
‘টিকফা’ চুক্তিতে কি কি ধারা রয়েছে তা দেশবাসী জানে না। এই চুক্তি নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে টিফার চুক্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাস হয়ে যায়, যেটাতে দেখা যায় অন্যান্য দেশে যে সমস্ত টিফা চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ধারা উপধারা গুলো মিলে যায়। এই আলোচনা সেই ফাস হওয়া ড্রাফটের উপর করা হয়েছে। যদিও সেই ড্রাফ্ট পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে তবে মুল ভাবনা এই আলোচনার বাইরে যাবেনা বলেই মনে হচ্ছে। এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায় এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাসমুহ দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষন নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন।

চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সমস্যা কী?
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতসমূহ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয় কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলো সেবা যেমন টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতি ও পণ্যের দাম বহুগুনে বৃদ্ধি করবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে সেবা দানের যেসব কর্মসূচী নিয়ে থাকে তা সঙ্কুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান থেকে বিরত থাকছে। দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি দিতে পারছে না, অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু বাণিজ্য সংরক্ষন নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।

মেধাস্বত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন হলে তা উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই কাজ করবে যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতির অধিকারী হবার পর তারা এই জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্ব প্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের উপর নির্ভরশীল থাকে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই মেধাস্বত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাস্বত্ব আইন মেনে চলতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে । দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রফতানি করতে পারছে। কিন্তু টিকফা এ সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যার সহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাবে। মেধাস্বত্ত্ব আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না, আমাদেরকে কয়েকগুন বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে । বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধংস হয়ে যাবে। আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে।

‘টিকফা’ চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানাস্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রম শক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রম শক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ যার রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। তারা তা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত কেবল পুঁজি এবং পণ্য-সেবা পণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে তার রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে, টিকফাতে ‘শুল্ক বহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে, গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২%, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯%।

পেটেন্ট আইন মানতে হলে সমস্যা কী?
পেটেন্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে মেধাসত্ত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাসত্ত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবী করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার তাই নিম গাছ থেকে উৎপাদিত যে কোন পণ্যে সে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবী করতে পারবে। বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্রের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। পেটেন্ট এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ গাছড়ার উপরও বিস্তৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, “কোন কিছুর পেটেন্টের বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই”। এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত উৎপাদন প্রনালী, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেটিক টেকনোলজির মাধ্যমে ডি এন এ ফিংগার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নেবে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের শস্য বীজ উৎপাদন, সংরক্ষন, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাস্বত্ব আইন অনুযায়ী রয়্যালটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশী প্রজাতি, পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এদেশের তৈরি এ্যাকসেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। বাসমতি চাল, চিরতার রস, নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়্যালটি প্রদানে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তি মাধ্যমে বাধ্য করতে চায়।

টিকফাতে শ্রমিকবান্ধব ধারাও কী আছে?
মোটেও না। টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ (অশুল্ক) বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মানবাধিকার, শ্রম পরিবেশের মান ইত্যাদি বিষয়কে অশুল্ক বাধা হিসাবে চিহ্নিত করে মার্কিনীরা ‘টিকফা’ চুক্তি দ্বারা বাংলাদেশকে উত্তরণ অসাধ্য প্রতিকূলতায় আটকে ফেলার ফন্দি করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরে তারা আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়ে, নিজ নিজ দেশে নির্মম ও অমানবিক শ্রম-শোষণ চালিয়ে, শ্রম পরিবেশের ক্ষেত্রে দাস সুলভ মান বজায় রেখে এখন উন্নত ধনী দেশে পরিণত হয়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের পথ গ্রহণ করা মাত্রই সমানে সমানে প্রতিযোগিতায় নামার কথা বলে আমাদের ওপরে তাদের মতো সমান মাত্রার শর্তাবলী চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এ যেন, হাত-পা খোলা মোটা তাজা মানুষ কর্তৃক পেছনে হাত বাঁধা অনাহারী মানুষকে সমানে সমানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো!

চুক্তির জন্য কেন এতো গোপনীয়তা?
বাংলাদেশের সংবিধানে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ‘বিদেশের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’ যেহেতু টিকফা কোন নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তি নয় তাই সে চুক্তির ধারা গুলো প্রকাশ না করাটা সংবিধান বিরোধী। ‘টিকফা’ চুক্তির ধারাসমূহ নিয়ে গোপনীয়তা ও রাখঢাক করার যে চেষ্টা চলছে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্শিক।

টিকফা চুক্তি কি বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়াবে? বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়াবে?
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রফতানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রফতানির যথাক্রমে ২১ এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করলেও তারা এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রফতানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩% । তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রফতানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা এগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই।

যুক্তরাষ্ট্র কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এতটা আগ্রহী?
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাইরে স্বল্পোন্নত দেশের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মত দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ফোরাম ডব্লিউ,টি,ও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্য নীতি বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই লক্ষ্যেই পাকিস্তান,সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের ৩০ টিরও বেশি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি সাক্ষর করেছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র কেননা টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব হবে না। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার প্রশ্নে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করে গণচীনের অব্যাহত উন্নয়ন ও পরাশক্তি হিসেবে চীনের অভাবনীয় অগ্রগতি ঠেকাতে এবং দক্ষিন এশিয়ার বিশাল বাজারের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারতমহাসাগরে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। আর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আঞ্চলিক পার্টনার বানাতে আগ্রহী। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকার কাছ থেকে অধিকতর সহযোগিতার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাচ্ছে কেননা এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বলয়ে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে যাবে।

উল্লেখ্য যে, দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলো হলো—অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারিকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিনের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে। অথচ ‘সোফা’ চুক্তির সুবাদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক ‘সোফা’ চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। একথা সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু টিফার মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তা স্বাধীন মতো করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বহুপক্ষীয়ভাবে যে কোনো বিরোধ নিরসনের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগ নিরঙ্কুশভাবে পাবে না। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। একপক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয় বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

জিএস পিসুবিধার পাবার প্রশ্নের সাথে কি টিকফা চুক্তি যুক্ত?
ঢাকায় নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা গত ২৮ জুলাই আবারো এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “টিকফা চুক্তি সই না করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না।“ টিকফা চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দরকষাকষিকে ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে তিনি জানতে চান, “এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না।” টিকফার সাথে জি এস পি সুবিধার কোন সম্পর্ক নেই। দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা যেটাকে সাধারণভাবে জি এস পি সুবিধা বলা হয়। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। সেই সব পণ্যের জন্য জি এস পি সুবিধা থাকা আর না সমান কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় তার ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগের মতো। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ। এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বিধিরও পরিপন্থী। এই শুল্ক এমনিতেই বাতিল হওয়া দরকার। এবছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।

তথ্যসূত্র: www.banglamail24.com