Thursday, October 27, 2016

স্ক্রীপ্ট রাইটিং পর্ব-এক

0 comments

ক্রিয়েটিভ রাইটিং নিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছি। ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স এ আসলে লেখালেখির সবকিছু সম্পর্কেই ধারনা দেয়া হয়। সেটা হতে পারে ছোটগল্প, বা উপন্যাস কিবা নিছক ফিচার কিবা স্ক্রীপ্ট রাইটিং। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি লেখালেখির গুন আসলে ট্রেনিং এর মাধ্যমে পাওয়া যায় না। কিন্তু তবুও ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর কোন কোর্স এ অংশ নিলে যেটা হয় তা হলে লেখালেখিটা এসাইনমেন্ট হিসেবে করতে হয় এবং তাতে করে অনেক উপকার হয়। আর যে লেখাগুলোতে কিছুটা কাঠামোগত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন যেমন স্ক্রীপ্ট রাইটিং, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন ট্রেনিং কোর্স বা গাইড আর্টিকেল কিছুটা কাজে লাগে। 
আমাদের দেশে তো এখন মনে হয় ছোটগল্প বা উপন্যাস লেখার চেয়ে নাটক লেখার দিকে লিখিয়েদের ঝোক বেশী থাকার কথা। কেননা সেইটার বাজারই ভাল। 
যাহোক, আমার পড়াশোনা বিষয়ের মাঝে ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিশেষ করে স্ক্রীন রাইটিং (স্ক্রীপ্ট রাইটিং) টা বেশ গুরুত্বপুর্ন। আমারও ওইটার উপরে বিশেষ আগ্রহ, তাই নিয়মিত সিলেবাসের বাইরে আলাদা করে ক্রিয়েটিভ রাইটিং এ নজর দিয়েছি। ব্লগে চেষ্টা করব সেই সম্পর্কে কিছু লিখতে, গুছিয়ে যদি লিখতে পারি তাতে আমার নিজেরও সুবিধে, একসাথে পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে পাওয়া যাবে। 

(আমি নিজে কোন জাতের লেখক নই, শুধু যা পড়েছি বা শিখেছি তা কপি পেষ্ট করব। দয়াকরে ভূল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি নিয়ে দেখবেন আশা করি।)

তো, নিচে যে লেখাটি শুরু হচ্ছে সেটি প্রধানত স্ক্রীপ্ট রাইটিং নিয়ে, কিন্তু তাতে গল্প বা উপন্যাসের ব্যাপারেও ধারনা পাবার কথা। লেখাটি প্রধানত ইউকে বা ইউএসএ'র টেলিভিশন বা ফিল্ম স্ক্রীপ্টিং এর উপরে বেইজড করে তৈরি তাই উদাহরন ও সেই প্রেক্ষাপটেই হবে, তবে আমাদের দেশের টেলিভিশন বা ফিল্মের সাথে খুব বেশী তফাত থাকার কথা না। 

শুরু করা যাক তাহলে। 

কোন স্ক্রীনপ্লে লেখার আগে যা প্রথমেই মনে রাখা উচিত :

ডিরেক্টর, প্রডিউসার বা প্রডাকশন হাউজের কাছে স্ক্রীপ্ট দেবার আগে কয়েকটা কথা ভেবে নেয়া দরকার। নামী প্রডাকশন হাউজ সাধারন নামী স্ক্রীপ্ট রাইটারদের স্ক্রীপ্ট নিয়েই কাজ করেন, তারা নতুনদের নিয়ে কোন ঝুকিতে সচরাচর যেতে চান না। তাই নতুনদের সুযোগ পেতে হলে অনেক বেশী ভাল হতে হয়। কেননা পান থেকে চুল খসা ধরনের দুর্বলতা পেলেই বেশীরভাগ স্ক্রীপ্ট ডাস্টবিনে চলে যায়। কথাগুলো খারাপ শোনালেও সত্য হলিউডে বিভিন্ন ডিরেক্টর, প্রডাকশন হাউজে বা ইউকের টেলিভিশন বা ইউএসএ'র টেলিপ্লে'র জন্য জমা দেয়া নতুনদের স্ক্রীপ্টের মাধে ৯০ ভাগই অখ্যাদ্য হিসেবে গন্য করা হয় না পড়েই। শতকরা মোটে টেনেটুনে ১০ ভাগ স্ক্রীপ্ট শেষপর্যন্ত পড়া হয়, তাদের থেকে ২ ভাগের লেখককে কথা বলার জন্য ডাকা হয়, তার থেকে ১ ভাগকে নিয়ে ফিল্ম বানানো হয়। স্ক্রীপ্ট লেখার সময় আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত সেই ২ শতাংশের মধ্যে পড়া। আর সে জন্যে যেটা নিশ্চিত করা দরকার যাতে আমাদের স্ক্রীপ্ট যথেষ্ট আঠসাঠ হয়। ঝুলে পড়া স্ক্রীপ্ট বা ছোট্ট কাহিনী অতি বিশাল করে বলা গল্প তেমন কারও নজর কারে না। আপনার স্ক্রীপ্টের সামারী পড়ে কাহিনী সম্পর্কে ধারনা নিয়ে যদি দেখা যায় আপনার স্ক্রীপ্ট ১২ ফন্টে ১৪০ পৃষ্ঠারও বেশী তাহলে সে স্ক্রীপ্টের স্থান হবে বিন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই স্ক্রীপ্ট লেখার সময় জানা থাকতে হবে কি লিখছি। নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে। কাহিনী বিস্তারে স্যাকরিফাইস করা যাবে না আকার বাড়ানোর স্বার্থে। 
দ্যা নাইটমেয়ার বিফোর ক্রিসমাস , দ্যা সিক্রেট গার্ডেন , সিটি অফ এম্বার সহ বিখ্যাত কিছু মুভির স্ক্রীনপ্লে রাইটার ক্যারোলিন থমসন স্ক্রীপ্টকে সনেট কবিতার সাথে তুলনা করেন। তার মতে স্ক্রীপ্টেরও সনেটের মত নির্দিষ্ট সীমারেখা আর কাঠামো আছে যার বাইরে গেলে তা অসফল হবার সম্ভাবনাই বেশী। 

সেজন্যে এই জিনিসটা মাথায় রেখে স্ক্রীপ্ট লেখার কাজ শুরু করা উচিত। 
স্ক্রীপ্ট লেখা আর গল্প উপন্যাস লেখার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে, এই ব্যাপারটাও এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই। গল্প বা উপন্যাস লেখায় লেখক হন স্বাধীন, তিনি তার কল্পনার রঙ দিয়ে সবকিছু রাঙিয়ে দিতে পারেন। স্ক্রীনপ্লে'র ক্ষেত্রে সেটি একটি কমপ্লিট টিমওয়ার্ক। আপনাকে স্ক্রীপ্টের নমনীয়তার ব্যাপারে মাথায় রাখতে হবে। ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে স্ক্রীপ্টে চাহিদা মত পরিবর্তনও আনতে হতে পারে তা মাথায় রাখতে বেহবে এবং স্ক্রীপ্ট লেখার সময় সে সুযোগ রাখতে হবে। যদিও স্ক্রীপ্ট লেখকের কিন্তু সেটা দিয়ে যা তৈরি হবে তা কিন্তু ডিরেক্টরের। তাই আসলে এটি একটি টিমওয়ার্ক। এই ব্যাপারটা লেখকদের জন্য বিরক্তিকর এবং অস্বস্তিকর। কিন্তু এটি এড়ানোর উপায় নেই। 

সঠিক দৃশ্য ও আকার একটা বড় ব্যাপার:

একটা নাটক বা ফিল্মে আসলে ঠিক কত সময়ের হয়? এক ঘন্টা বা দুই বা বড়জোর তিনঘন্টা? কিন্তু সেখানে যে কাহিনীটা দেখানো হয় সেটি কি সবসময় দুই ঘন্টার হয়? 
একটা ফিল্মে আপনি কাহিনী বলতে পারেন সাতদিন বা সাতমাসের, কিন্তু তা আপনাকে বলতে হবে দুই ঘন্টায়। সাতমাসের কাহিনী দুই ঘন্টায় দেখিয়ে ফেলা সহজ কাজ নয় নিশ্চই? এটা যে শুধু স্ক্রীপ্ট লেখার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তাই নয় গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। সবখানেই নির্বাচন করতে হয় যে কোন বিষয়টা বলা হবে, কি বলা হবে না, কিভাবে দৃশ্য সাজানো হবে। দৃশ্য সাজানোর মধ্যে কুশলতা দেখাত হবে। সফলতার সাথে দৃশ্য সাজাতে পারলে পারফেক্ট আকারের স্ক্রীপ্ট পাওয়া যায়। 

কিন্তু কিভাবে নির্বাচন করবেন আপনি কিভাবে একটি দৃশ্য সাজাবেন? 
ধরা যাক, আকবর নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তার দোকানে দুপুরে বলল ক্ষুধার্ত এবং সে এখন সিঙ্গারা আর চা খেতে যাবে। এই দৃশ্যটি আসলে কেমন হতে পারে স্ক্রীপ্ট এ? 
১. দোকানের ভেতর, আকবর তার কর্মচারীকে বলল সে ক্ষুধার্ত তাই সিঙ্গারা, চা থেকে বাইরে যাচ্ছে। 
২. দোকানের ভেতর, আকবর চেয়ার থেকে উঠে দাড়াল এবং যাবার উপক্রম হল। 
৩. দোকানের বাইরে, আকবর দোকান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে রাস্তা ক্রস করছে। 
৪. রেস্টুরেন্টের সামনে, আকবর রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে সিঙ্গারার তাক এর দিকে তাকাল 
৫. রেষ্টুরেন্ট এর ভেতর, আকবর একটি টেবিলের সামনে চেয়ারে বসল। 
৬. রেস্টুরেন্ট, আকবর ওয়েটারকে ডেকে সিঙ্গারা আর চা অর্ডার দিল। 
৭. রেস্টুরেন্ট, আকবর টেবিলের সামনে বসা, ওয়েটার সিঙ্গারা আর চা এনে রাখল। 
৮. রেস্টুরেন্ট, আকবর সামনে রাখা সিঙ্গারা মুখে দিল, তার মুখে পরিতৃপ্তির ছায়া 
৯. রেস্টুরেন্ট, আকবর খেতে খেতে পত্রিকা পড়ছে 
১০. রেস্টুরেন্ট, আকবর খেয়ে কাউন্টারে বিল পরিশোধ করছে। 

এখন আমাদের ভাবতে হবে আমরা দৃশ্যটিকে কিভাবে দেখাব। উপরের দশরকম থেকে একরকম হতে পারে, আবার এরচেয়েও ভাল করে ভিন্নরকম হতে পারে। আবার দৃশ্যটি রাখব কিনা, এটা ওত জরুরী কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে। 


লেখা শুরু করা কিন্তু অনেক কঠিন :

যারা জীবনে কিছু হলেও লেখালেখি করেছেন তারা নিশ্চই জানেন একটা লেখা শুরু করা কতটা কঠিন। আপনার মাথায় হয়ত পুরোটা কাহিনী এসে বসে আছে, অথচ প্রথম লাইনটা কলমের আগায় আসছেই না। এবং এতে করে দেখা যায়, সময় যায়, দিন মাস যায় ওটা আর লেখাই হয় না। 
আসলে লিখতে শুরু না করে লিখব, লিখব চিন্তা করে বা বলে বলে সময় কাটানো অনেক সহজ। লিখার উদ্দ্যেশ নিয়ে লেখার খাতা বা ল্যাপটপ সামনে নিয়েও লিখা না শুরু করার হাজারটা কারন আছে, যেমন এক কাপ চা খেয়ে লিখি, ব্লগে একটু ঢু মেরে দেখি কি চলছে তারপর মন ফ্রেস করে লিখব, ফেইসবুকে একটু দেখি কোন নোটিফিকেশন আসল কিনা, ভাল একটু মুভি ডাউনলোড করা আছে ওটার কিছুটা অংশ দেখে নেই অন্তত, খেলার খবরটা অন্তত দেখে নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কোনটাই খারাপ কিছু না, কিন্তু তাতে করে অন্তত লেখাটা হবে না। তাই এই কথাটা মনে রাখতে হবে 
WRITE/ Or Be Written Off
এটা ছাড়া উপায় নেই। ঠাটবাটে চলার জন্যে মাসলম্যান হতে গেলে যেমন প্রতিদিন অন্তত আধা ঘন্টা হলেও ব্যায়াম করতে হয়, কটা বুকডন দিতে হয়, পুশব্যাক, পুশআপ করতে হয়, লেখালেখির ব্যাপারটাকেও তেমনি ভাবতে হবে। শরীরকে সুন্দর শেপে নিয়ে আসার জন্যে যেমন দরকার নিয়মিত ব্যায়াম, দশপনের দিন পর পর একবার নয়, তেমনি লেখাকে সাবলীল করতেও দরকার নিয়মিত লেখা, তা সে যত ছাইপাশই হোক। 

প্রতিদিন অন্তত পাচশ শব্দও লিখতে চেষ্টা করতে হবে। সেগুলো হতে পারে অখাদ্য কুখাদ্য। লিখলেই যে সব নোবেল প্রাইজ উইনিং বা অস্কার উইনিং লেখা আসবে সে চিন্তা বাদ দিতে হবে। লিখতে হবে অবিরত। কোন কাহিনী মাথায় না থাকলে যা খুশি লিখা যেতে পারে, পাশের বাসার মেয়েটা সম্পর্কে, শহরের নতুন শপিং মলটা নিয়ে কিবা মাথার উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানটা নিয়েও। রাবিশ লিখতে লিখতে একসময় লেখার হাত ভাল হয়ে যাবে। তৈরি হবে নিজস্ব সতন্ত্রতা। এসময়ে পড়তেও হবে অনেকের লেখা। লিখার সময় হয়ত তাদের ছাপ আসবে, কিন্তু তাতে কোন চিন্তা নেই, লিখতে লিখতে একসময় নিজস্বতা আসবেই।  

মোটকথা প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতে হবে। এবং সেটা যেমন মানেরই হোক। কথা হচ্ছে 
Don't Get it Right - Get it Written


স্ক্রীপ্ট লিখার সময় দৃশ্যকে তুলে আনতে হবে। তাই একজন লেখকে সবসময় সাধারন মানুষের চেয়ে অন্যরকম ভাবে দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করতে হবে। যখন চলাফেরা করবেন তখন আশপাশ দেখবেন সেগুলোকে চিত্রায়ন করলে কিভাবে করা হবে, কিভাবে বর্ননা করা হবে, স্ক্রীপ্ট কিভাবে লিখা হবে। তাই চিন্তা করুন সবসময় একটি ভিডিও ক্যামেরার মত। যখন কাহিনী বা দৃশ্য নিয়ে ভাববেন তখন ক্যামেরা মত চিন্তা করবেন এবং সেটাকে কাগজে তুলে আনবেন। এবং সেটা এমন ভাবে আনতে হবে যাতে কেউ পড়লে যন্ত্রনা না হয়ে সহজে ওই দৃশ্যগুলো রিডারের চোখে ভাসে। মনে রাখতে হবে আপনার স্ক্রীপ্টে ফিল্ম বা নাটক তৈরি হয়ে দর্শক দেখার আগেই কিন্তু এটি পরিচালক বা প্রযোজক পড়বেন, তাই স্ক্রীপ্টরিডার, সে যেই হোক আপনার স্ক্রীপ্ট তার মনে ইমেইজ তৈরি করতে পারছে কিনা সেটা জরুরী। সেটা যত সহজ হবে, স্ক্রীপ্টকে ফিল্মিং করাও ততই সহজ হবে। 



রন্টি চৌধুরী

0 comments:

Post a Comment