Thursday, September 21, 2023

একজন প্রেমিকের চোখে ঢাকা

 সময়টা ১৮৯৬ সাল। সাগর পাড়ি দিয়ে বঙ্গদেশে এসে পা রেখেছিলেন এক ব্রিটিশ যুবক। অন্যদের মতো তিনিও এদেশে এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করতে। রাজস্ব আদায় থেকে শুরু করে প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও সামরিক-বেসামরিক নানা দায়িত্ব অর্পিত ছিল তার ওপর। নাম তার ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি বি বার্ট।

The Romance of An Eastern Capital


জাতিতে ব্র্যাডলি ইংরেজ হলেও, মননে তিনি প্রাচ্যকেই লালন করতেন। তাই অন্য আর দশটা ইংরেজ কর্মকর্তাদের মতো এদেশেকে তার নোঙরা, বিশৃঙ্খল কিংবা অশেষ ধন্যভাণ্ডারের একটি কুলাঙ্গার জাতির দেশ বলে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে শস্য-শ্যামলা, উজলা এক দেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ঢাকার ইমারত, মসজিদ, মন্দির, নদ-নদী, অলিগলি এ সবকিছুর মধ্যে যেন তিনি অতীতের প্রতিধ্বনি শুনতে পেতেন। একারণেই হয়তো তার কাছে ঢাকা ছিল এক রহস্যময়ী নগরী।      

আর তার প্রমাণ 'দ্য রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল' বইটি। ঢাকা নগরীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে ব্র্যাডলি এ বই লেখেন। বইটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯০৬ সাল। যা লন্ডন থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়।

তবে বইটি কেন লেখা হলো এ নিয়ে আছে ভিন্ন মত। ঔপন্যাসিক হাবিব আনিসুর রহমানের সমকালে প্রকাশিত (১ এপ্রিল, ২০২২) 'প্রাচীন ঢাকা নিয়ে' শীর্ষক নিবন্ধে পাওয়া যায়, পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে ইংরেজরা নতুন একটি প্রদেশ গঠন করে ১৯০৫ সালে। এই প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় প্রাচীন নগরী ঢাকাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর সে কারণে ইংরেজ লেখক ব্র্যাডলি বার্টের ওপর দায়িত্ব বর্তায় মোগল রাজধানী ঢাকার প্রাচীন গৌরব নিয়ে একখানি গ্রন্থ রচনার। তাই ঢাকাকে নিয়ে তিনি লিখলেন ১৯০৬ সালে, 'দ্য রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল'।     

এদিকে গবেষক ও প্রকাশক ইরফান শেখ জানান, 'বইয়ের নাম এবং বইয়ের ভেতর যে বর্ণনাভঙ্গি তাতে ধারণা করা যায়, বইটি ব্র্যাডলি একটি ভ্রমণকাহিনী হিসেবেই লিখেছেন। তাছাড়া, সরকারিভাবে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বি সি অ্যালেনকে নিযুক্ত করেছিলেন। একই কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার দুজনকে নিযুক্ত করার কথা না।' 

তবে যে উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন, ঢাকার ওপর প্রকাশিত প্রথম ইতিহাসভিত্তিক বই এই  'দ্য রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল', জানান ইরফান শেখ।

ঢাকাকে ব্র্যাডলি দেখেছেন একজন প্রেমিকের চোখ দিয়ে  

ঢাকাকে কেন্দ্র করে ব্র্যাডলির বিমুগ্ধতার নিদর্শন এই বইটি। বেশিরভাগ ইংরেজ সাহেব-মেমসাহেবদের কাছে যেখানে অভিযোগ ছিল- ভারত হলো প্রচণ্ড গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়ার নোংরা ঘিঞ্জি একটি দেশ। সেখানে প্রাচীন ঢাকার অলিতে-গলিতে, মিনারে-গম্ভুজে এবং সেই হারানো অতীতের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি বাঁকে, ব্র্যাডলি বার্ট দেখতে পেয়েছেন মোহকর রহস্যময়তা।

যেমন তিনি লিখেছেন, 'এই নগরীরর আঁকাবাঁকা অলি-গলি দেখে মনে হবে যেন বাইরের দৃষ্টি থেকে রহস্য ঢেকে রাখার জন্যে বিশেষ এক আদর্শে এগুলো তৈরি করা হয়েছিল। মহানগরীর বুকের তলায় যতো রহস্য লুকিয়ে আছে, তার কতটুকুই বা মানুষ জানে!' (বাংলা অনুবাদ)

এই রহস্যময়তা তাকে যেমন করেছে বিমোহিত, তেমনি করেছে আবিষ্ট। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সোনারগাঁও- বইয়ে বর্ণিত প্রতিটি জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বিস্মিত হয়েছেন তিনি। একজন ইংরেজের চোখে ঢাকা নগরীর সে বিস্ময়তা বইটির পাতায় পাতায় ডুবে আছে। বইয়ের মলাট উল্টালেই দেখা যাবে, বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলটিতে কীভাবে একে একে বৌদ্ধরা, হিন্দুরা, মোগলরা, ইংরেজরা শাসন করে গেছে সে ইতিহাস যেমন রূপায়িত হয়েছে, তেমনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নগরীর বুকে ঊষালগ্নের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ার চিত্র আর রাতের নীরবতায় কালো চাদরে ঢেকে যাওয়া ঢাকা নগরীর রূপ…

ব্র্যাডলি বইটিতে সন্ধ্যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,

'উষার সূচনা থেকে এ শহরটির বুকে যে প্রাণের খেলা শুরু হয় তা চলতে থাকে সুর্যের পশ্চিম আকাশে ঢেলে পড়া পর্যন্ত। সূর্য ডুবতে থাকে, নামাজ, নদীর ওপারে শিয়ালের ডাক, কুকুরের আওয়াজ, কেবলামুলখী, আল্লাহকে ডাকা। সকল প্রাণচাঞ্চল্য অস্তমিত হয়ে যায় সূর্য ডুবতে শুরু করলে। নদীর মাঝে কালো উলঙ্গপ্রায় অবয়বগুলোকে দেখলে মনে হয় যেন পটে আঁকা ছবি।'
 
আবার ভোরের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-  

'ঊষার এই আধা-আলো আধা-অন্ধকারে জাহাজের বিরাট খোলগুলো কাল ভূতের মতো দেখায়। স্টিমারগুলোর চোখ ধাঁধানো আলো অকস্মাৎ নিভে যায়। আগুনের চোখগুলো যেন মন্ত্রবলে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলো। সমগ্র পৃথিবী ধূসর বর্ণ ধারণ করে। ধূসর বর্ণের ওপর এক ঝলক গোলাপী রক্তিমাভা। যেখানে আকাশ আর নদী এক হয়ে গেছে সেখানে ঝুলন্ত সাদা কুয়াশা গলে যেতে থাকে। সূর্যের আসন্ন আবির্ভাবে তারাগুলোর চোখ ঘুমে মিটমিট অরে। অকস্মাৎ পৃথিবী জেগে উঠেছে। সারারাত যেসব নৌকা বাঁধা ছিল, সেগুলোর যাত্রা শুরু হয়। কাপড়ে গা জড়িয়ে ধীবরগণ সারাদিনের মাছ শিকারের জন্যে তাদের জাল ঠিক করে নেয়। সকালের ঝিরঝিরে বাতাসে বাদামী রঙের পাল তোলা একটি ডিঙ্গি তরতর করে এগিয়ে চলে। নিস্তব্ধ জনহীন নদীতীরে আবার কর্মব্যস্ত জনতার ভিড় শুরু হয়। সূর্য ওঠে যেন ঘুম থেকে ওঠা দানবের মতো।'
 
আবার জন্মাষ্টমীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, আজও এই শহর বিভিন্ন উৎসবে সজ্জিত হয়। কিন্তু অতীতে মতো জৌলুস ও আড়ম্বর নেই। শুধু জন্মাষ্টমীই পালিত হয় অতীতের মতো বিরাট উদ্দীপনার সাথে। জন্মাষ্টমীর মিছিলের বর্ণনা নিয়ে লিখেছেন,  

'মিছিলের সময় যতই নিকটবর্তী হতে থাকে, ততোই মনে হবে শহরটি যেন মধ্যযুগে ফিরে গেছে। মনে হবে, এইতো শায়েস্তা খাঁর সেই রাজধানী। চারধারে শুধু উৎসবমুখর জনতার ভিড়। গৃহের জানালায়, ব্রান্দায় ও ছাদে দলে দলে লোক উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে। এক পাল হাতি মিছিলে যোগদানের জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যের প্রখর তেজ, বাতাসু নেই-তবু ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে উৎসুক জনতা অসহ্য গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে আনন্দ পায়। সে-কি উত্তেজনা আর উন্মত্ত আনন্দ!'
 
একবার আত্মরক্ষার জন্য সোনারগাঁওয়ে বাংলার হিন্দু রাজাদের শেষ বংশধরগণ বিজয়ী মুসলমানদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পালিয়ে আসেন। এরপর কীভাবে হিন্দুদের আধিপত্যের শেষ যবনিকা মুসলমানদের হাতে চলে আসে, হিন্দু মন্দির-সৌধগুলোর ওপরে বিজয়ী মুসলমানদের ইমারত গড়ে তোলার ইতিহাস, মগ ও আরাকানরা সহ অজ্ঞাত আরও উপজাতিদের  বর্বর আচরণ, একের পর এক শাসনকর্তার আগমন, নির্গমন আর ক্ষমতার প্রাণঘাতী লড়াই দেখে বলেছিলেন, 'সত্য বটে, প্রাচ্যবাসীদের চরিত্রে পরস্পর বিরোধী গুণের অদ্ভুত সমাবেশ দেখা যায়।'

যেখানে ইংরেজদের একটি বড় অংশের কাছে বাঙালিরা কল্পনাবিলাসী, বাস্তববিমুখী ও অলস বলে পরিচিত, সেখানে লেখক ঢাকাবাসীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গেছেন। ঢাকা এবং ঢাকাই  সংস্কৃতি সম্পর্কে তার আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস উপরের লেখাতেই স্পষ্ট।

'পূর্ববাংলার ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাসে ব্যাপক কোনো ধর্মীয় নির্যাতন নেই'…

বইটির মোট বারোটি অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে ঢাকার গোটা জীবনকে তুলে ধরেছে। একদম বিক্রমপুর থেকে সোনারগাঁও, শায়েস্তা খাঁয়ের হাত ধরে ঢাকা প্রতিষ্ঠা, মোগল সালতানাত, ইংরেজ আমল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এতে।   

ফলে যেমন আছে সম্রাট অশোকের হাত ধরে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়কাহিনী, যথাক্রমে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান ধর্মের বিকাশ। তেমনি আছে মোগলদের উত্থান- পতন, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য নিয়ে ইংরেজ এবং ফরাসিদের মাঝে শত্রুতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাগরণ এবং ব্রিটিশ আমলের ঢাকা নিয়ে অনেক সুগভীর বর্ণনা।      

তবে একটি বিষয়, গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন তিনি বইয়ে, যার প্রয়োজনীয়তা আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি। তা হলো-  'পূর্ববাংলার ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাসে ব্যাপক কোনো ধর্মীয় নির্যাতন নেই।'…

ঢাকাবাসীর অনেক পাওয়া না পাওয়া, আনন্দ-আশ্রুর গল্প

তাছাড়া, নিজে একজন ব্রিটিশ হয়েও ব্রিটিশ যুগের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চিত্র তুলে ধরেছেন পক্ষপাতিত্বহীন ভাবে। বণিকের তুলাদন্ড রাজদন্ডরূপে আত্মপ্রকাশ করার পর পূর্ব বাংলায় নেমে আসে এক চরম শিল্প ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এর অনিবার্য ফলশ্রুতিতে উপর্যুপরি তিনটি মহা মন্বন্তর ও মহামড়কে দেশ উৎসন্ন প্রায় হয়ে যায়। মসলিন শিল্পের মতো অন্যান্য শিল্পও ধ্বংস হলো। শিল্পচ্যুত ব্যবসাহারা লক্ষ লক্ষ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেল জীবিকার জন্য। যে হাত 'আর রোওরা', 'বেগমখাস' বুনতো, তাকে ধরতে হলো লাঙ্গলের মুঠো। কিন্তু ভাগ্য সেখানেও দেখা দেয়নি। মড়ক, মহামারী আর মহা মন্বন্তরের অভিঘাতে বিধ্বস্ত এ দেশের যে চিত্র ব্র্যাডলি এঁকেছেন, তাতে ক্ষমতাগর্বী দাম্ভিক বিদেশী সরকারের আসল চেহারাটির সন্ধান পাওয়া যাবে। পরবর্তীকালে মুসলিম গণ-মানসে যে স্বাতন্ত্র্য-বোধ ও চেতনার উদ্ভাসন ঘটে এবং যা পাকিস্তান আন্দোলনের রূপ নিয়ে দূর্বার তরঙ্গে ভেঙ্গে ফেটে পড়ে, তার দীর্ঘ-বিস্তৃত পটভূমির বিক্ষিপ্ত পরিচয় ছড়িয়ে আছে গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে।     

সমসাময়িক মুসলিম জাতীয় জীবনের অনেক পাওয়া না পাওয়া, আনন্দ-আশ্রুর গল্প রচিত আছে। উঠে এসেছে কুলীন প্রথা, জাতভেদ, বিয়ের বাজারে দর কষাকষির মতো ঘৃণিত সমাজব্যবস্থার নিন্দাও। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি তখনকার ঢাকাকে কখনো মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন, কখনো নিন্দিত সমাজব্যবস্থাগুলোর পরিণাম তুলে ধরেছেন।

আছে অজানা অনেক কিংবদন্তী

ইতিহাসভিত্তিক এই বইটি পরতে পরতে শুধু বিভিন্ন কিংবদন্তী কল্পকাহিনী। যা পড়তে গিয়ে পাঠক পাবে  ঢাকাবাসীর বিশ্বাস এবং সাধাসিধে জীবন যাপনের আঁচ। বইটির বিক্রমপুর অধ্যায়েই সবচেয়ে বেশি কিংবদন্তি তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে, রাজা বল্লাল সেনের সময়কার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে কিংবদন্তীগুলো লেখক তুলে ধরেছেন কোনো কার্পণ্য না করে। এই বল্লাল সেন আদিশূরের পুত্র না সেন বংশের শেষ রাজা বল্লাল সেন তা লেখক নিজেও জানিয়ে যেতে পারেন নি। তার ধারণামতে, বল্লাল সেন নামে ওই রাজবংশে দুজন রাজা ছিলেন। একজন সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আদিশূরের পুত্র, অপরজন বংশের শেষ রাজা। কিন্তু দুজনকে নিয়েই প্রচুর গল্প এবং কিংবদন্তী থাকায় কার আমলে কোন কাহিনী তা আলাদা করা যায়নি।

বল্লাল সেনের জন্ম মৃত্যুর উভয় নিয়েই লেখক কিংবদন্তী লিখেছেন-

কথিত আছে যে, জ্যোতিষীরা গণনা করে বলেছিল যে, বল্লাল সেনের মৃত্যু ঘটবে গলায় মাছের কাঁটা বেঁধে। এজন্য বল্লাল সেন, তার ভোজন-উপকরণ থেকে কাচকি(যেহেতে কাঁটা নেই) ছাড়া বাকি সব মাছ বর্জন করেন। পদ্মার এই কাচকি মাছ যেন সহজেই রাজপ্রাসাদে সরবরাহ করা যায়, তাই 'কাচকি দরওয়াজা' নামে এক সড়ক নির্মাণ করেন। যার বর্তমান ঠিকানা আসলে কোথায় তা জানা যায়নি। হয়তো নাম পরিবর্তিত হয়েছে, নয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা এটি শুধুই লোককাহিনী।   

একইভাবে আছে রামপাল দীঘিকে নিয়ে কল্পকাহিনী। রাজা বল্লাল সেনের হঠকারিতায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামপালের মৃত্যু হয় এই দিঘীতে। তাই তার নামকরণ রামপাল দীঘি। যা বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের গ্রামে রামপাল গ্রামে অবস্থিত।  
 
বাদ যায়নি ঢাকেশ্বরী মন্দির, ব্রক্ষ্মপুত্র নদের সাথে জড়িয়ে থাকা কিংবদন্তীও। এরকম নানা ইমারত, খাল, ঘটনা বা নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী সব গল্প। যা পাঠককে উপভোগ করাবে এবং সেই সাথে ইতিহাস সম্পর্কে করবে সচেতনও। এছাড়া লেখকের উদ্দেশ্য ছিল নতুন রাজধানীর অতীত ও সমসাময়িক কালের ইতিহাসের সাথে পাঠক সমাজের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের অনেক অজ্ঞাত, অনধিত ও বিস্মৃত অধ্যায়ের উন্মোচন করেছেন। সোনারগাঁও ও বিক্রমপুর সম্পর্কে লিখিত দুটি অধ্যায়ে বহু দূর্লভ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। 

তার তোলা ছবিতে উঠে এসেছে ঢাকার যৌবন

ইংরেজ রাজনীতির আগে যে বাংলার নাম শুনলে কেবল বন-বাঁদর, পোকামাকড়ের উপদ্রব, নদ_নর্দমার দেশ বোঝাতো, সেই বাংলাকে দেখেই ব্র্যাডলি বলেছেন, 'পূর্ব বাংলার মধ্যে এমন একটা মোহকর রূপ আছে যা প্রাচ্য ভূখণ্ডের সকল বিস্ময়কে হার মানায়।'

ব্র্যাডলি তাই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ব্রক্ষ্মপুত্র এই তিনটি নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই ঢাকাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে চেয়েছেন। জানতে চেয়েছেন ঢাকার অলিগলি। তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ক্যামেরা দিয়ে নিজেই ছবি ধারণ করেছেন তখনকার ঢাকার। সেই সব ছবি সংখ্যায় কত হবে তা জানা যায়নি, তবে বইটিতে প্রকাশ পেয়েছে তার ৩০ টি ছবি ও একটি মানচিত্র। যে ৩০টি ছবিতে আছে জন্মাষ্টমীর উৎসবে ঢাকায় মাহুতটুলির মেলা এবং হাতির শোভাযাত্রার ছবি, ব্রহ্মপুত্র নদে চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীতে পুণ্যস্নানের ছবি, ঢাকা জেলখানার কয়েদিদের ছবিসহ বিভিন্ন দূর্লভ ছবি।   

ঢাকার ইতিহাস নিয়ে বই অনেকই আছে। শুধু ঢাকাকে কেন্দ্র করেও এরপরে বহু বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেই ১৯০৬ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে ব্র্যাডলি যেভাবে পাঠকের সুবিধার জন্য ইতিহাসের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ছবিও যুক্ত করে দিয়েছেন, তা অতুলনীয়। হয়তো তিনি ছবি না তুললে সে সময়ের অনেক ছবিই আজ পাওয়া যেত না বা বিলুপ্ত হয়ে যেত।

আজও ঢাকার ইতিহাস সম্পর্কিত বইগুলোতে ব্র্যাডলির তোলা ছবিগুলোই ছবিসূত্র হিসেবে কাজ করে। পুরোনো ছবি ঘাঁটতে গেলে যেসকল ছবি পাওয়া যায় তারমধ্যে বেশিরভাগ ছবিই ব্র্যাডোলির তোলা ছবি।

পাকিস্তান আমলের পর আবার এই মুদ্রণ কপি পাওয়া যাচ্ছে  

ঢাকার ইতিহাস নিয়ে প্রথম বই হবার পরেও, ইতিহাসের চিরাচরিত কাঠখোট্টা, রসকসবর্জিত গুণাবলি পেরিয়ে এ বইটিকে একটি সার্থক ভ্রমণসাহিত্যের তকমা দেওয়া যায়। বইটির নামকরণ এবং লেখনী দুটোই ঢাকার প্রতি তার মুগ্ধতার সাক্ষ্য হয়ে আছে।    

এই ভ্রমণ লেখকের ভ্রমণ নয়, এ ভ্রমণ পাঠকেরও। ঢাকার একদম ভ্রুণ অবস্থা থেকে বঙ্গভঙ্গের সময় পর্যন্ত গোটা যুগকে পাঠকের সামনে জীবন্ত করে তুলবে এ বই। নিজস্ব আবেগ, মুগ্ধতা এবং অনবদ্য ভাষায় রচিত প্রচুর ইতিহাসমিশ্রিত কাহিনী ও কিংবদন্তী এটিকে করে তুলেছে আরও রসময়ী ও আকর্ষনীয়।

ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি বার্ট যে বইটি বের করেছিলেন সেটি ছিল চামড়ায় বাঁধানো।  ঢাকার ইতিহাসকেন্দ্রিক বই হলেও আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, ১৯০৬ সালে প্রকাশিত প্রথম মুদ্রণের কোনো বই বর্তমান বাংলাদেশের কোথাও আছে বলে জানা যায় না। মাঝে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালে রহীম উদ্দীন সিদ্দীক বইটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমলে নিয়ে বাংলা অনুবাদ করেন। অনূদিত বইটির নাম 'প্রাচ্যের রহস্য নগরী'। সেটিরও কোনো কপি বর্তমানে বাজারে নেই। পাকিস্তান আমলের পর আজ এতবছর বাদে এ বইটি আবারও মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।

এ বছর আগস্ট মাসে আদিত্য প্রকাশ বইটির মূল ইংরেজির পুণর্মুদ্রণ নিয়ে এসেছে। এতবছর ধরে মুদ্রণ না থাকায় এবার শুরুতে মাত্র এক হাজার কপি মুদ্রণ করেছে আদিত্য প্রকাশ। সাড়া পেলে বাড়ানো হবে কপিসংখ্যা। গবেষক ও আদিত্য প্রকাশের পরিচালক ইরফান শেখ বলেন, 'এ বইটির প্রথম মুদ্রণ কলকাতায়, দিল্লী, লন্ডনে আছে। কিন্তু আমাদের দেশে আছে কিনা জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থগারে থাকার সম্ভাবনাও অনেক ক্ষীণ। তবে তা সাধারণ মানুষের ধরাছোয়ার বাঁইরে। নর্থব্রুক হল পাঠাগারেও থাকতে পারে কিন্তু অনেক বছর যাবত সেটিও পড়ে আছে তালাবদ্ধ অবস্থায়। বইটি ঢাকা শহরকে নিয়ে কিন্তু এ বই পড়ার উপায় ঢাকাবাসীর কাছে নেই।'

'এই বইয়ের কিছু কপি আবার আমেরিকাতেও গিয়েছিল। এখনও মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন মিশিগান স্টেট, ইয়েল, কর্নেলের গ্রন্থাগারগুলোতে তার কপি পাওয়া যায়। আমরা বইটির সন্ধান পেয়েছি নিউ ইয়র্কের কর্ণেল ইউনিভার্সিটি থেকে', তিনি যোগ করেন।

কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে বিশেষত শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এই বই একাধিকবার মুদ্রিত হলেও বাংলাদেশে করা হয়নি একবারও। মুদ্রিত হয়েছে কি হয়নি তার চেয়েও দুঃখজনক হলো, ঢাকাবাসীর কাছে এই বই বিস্মৃত। ঢাকাবাসীর চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে 'দ্য রোমান্স অব অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল'...  


অনুবাদ: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত [দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডর্ড]

Wednesday, September 20, 2023

মানুষের মস্তিষ্কে চিপ স্থাপনের ট্রায়াল শুরু করবে নিউরালিংক

 বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের মালিকানাধীন ব্রেইন-চিপ স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান নিউরালিংক জানিয়েছে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের জন্য মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের চিপ স্থাপন (ইমপ্ল্যান্ট) করে পরীক্ষার জন্য অংশগ্রহণকারী নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে তারা। মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এ ধরনের প্রথম হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য একটি স্বাধীন রিভিউ বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছে তারা।

 


নিউরালিংক জানায়, সার্ভিকাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি বা অ্যামিওট্রফিক লেটারাল স্ক্লেরোসিসের কারণে যাদের পক্ষাঘাত রয়েছে, তারা এ গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এই হিউম্যান ট্রায়ালে কতজন অংশগ্রহণকারী নেওয়া হবে সেই তথ্য প্রকাশ করেনি ইলন মাস্কের এই প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, এই হিউম্যান ট্রায়াল শেষ হতে ছয় বছরের মতো সময় লাগবে।

নিউরালিংক জানায়, এ গবেষণায় মস্তিষ্কের যে অংশ দেহের অঙ্গের নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, রোবট ব্যবহার করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সেই অংশে একটি ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই) স্থাপন করা হবে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য হবে, মানুষকে তাদের চিন্তাশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি কম্পিউটার কার্সর বা কীবোর্ড নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম করে তোলা।

এর আগে ১০ জন রোগীর মধ্যে তাদের ডিভাইস স্থাপনের জন্য অনুমোদন পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল কোম্পানিটি। কিন্তু বর্তমান ও সাবেক কর্মীদের বরাতে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর আরও কম সংখ্যক রোগী নিয়ে পরীক্ষা চালানোর অনুমতি পাওয়ার চেষ্টা করে নিউরালিংক। তবে এফডিএ ঠিক কতজন রোগীর অনুমোদন দিয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।



নিজের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে ইলন মাস্কের। তিনি আশা করেন, মস্তিষ্কে যন্ত্র স্থাপনের ফলে স্থূলতা, অটিজম, বিষণ্নতা ও সিজোফ্রেনিয়ার মতো অনেক রোগ সারানো সম্ভব হবে।

গত মে মাসে নিউরালিংক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) তাদেরকে মানুষের মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন করে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। যদিও ওই সময় প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি নিয়ে ফেডারেল তদন্তের অধীনে ছিল প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বিসিআই ডিভাইসটি যদি মানুষের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণিতও হয়, তবুও বাণিজ্যিকভাবে এটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পেতে এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যাবে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানটির।

Tuesday, September 19, 2023

রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায় যেসব খাবার

 হিমোগ্লোবিন মূলত রক্তে অবস্থিত প্রোটিন। এটি রক্তের লোহিত রক্ত কণিকায় থাকে ও রক্তের মধ্যে প্রয়োজনীয় ঘনত্ব বজায় রাখে। এই হিমোগ্লোবিনের কারণেই রক্ত লাল হয়।

হিমোগ্লোবিনের মূল কাজ হলো দেহের প্রতিটি অংশে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে অ্যানিমিয়াসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, দুর্বলতা, খাবারে অরুচি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। একজন পুরুষের দেহে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ১৩.৫ থেকে ১৭.৫ গ্রাম। নারীদের রক্তে ১২-১৫.৫/১৬ গ্রাম। তবে অনেকেরই রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকে। চলুন জেনে নিই কী কী খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়বে।



প্রাণিজ খাদ্য

কলিজা, ডিম, দুধ, মাংসের মতো প্রাণিজ খাদ্য থেকে খুব সহজে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় ও তা শরীরে খুব দ্রুত শোষণ হয়। উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে সেই পরিমাণে হিমোগ্লোবিন তৈরি হতে পারে না বলে প্রাণিজ উৎসকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

ফল

অনেক খাবারেই আয়রন থাকে। কিন্তু শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি না থাকলে সেই আয়রন শরীর ঠিক মতো শোষণ করতে পারে না। আম, লেবু, আপেল ও পেয়ারায় রয়েছে ভরপুর মাত্রায় ভিটামিন সি। এই ভিটামিন শরীরে আয়রন শোষণ করতে সাহায্য করে। এছাড়া হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে বেদানাও খেতে পারেন। কারণ বেদানায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন।

শাকসবজি

শাকসবজি খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি অনেক কমে। বিট হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। টমেটো, কুমড়ো, ব্রোকোলি বা পালং শাকেও প্রচুর আয়রন থেকে। নিয়ম করে যদি এই সবজিগুলো খেতে পারেন, তা হলে রক্তস্বল্পতার সমস্যা কমতে পারে।

ডার্ক চকোলেট

হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি কমানোর প্রধান ওষুধ হতে পারে ডার্ক চকোলেট। মিল্ক চকোলেট ও শর্করার পরিমাণ বেশি, এমন চকোলেট বেশি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ডার্ক চকোলেটে সেই ঝুঁকি নেই। বরং এটা খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমবে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে আয়রন সমৃদ্ধ ডার্ক চকোলেট বেশি করে খান।

ড্রাই ফ্রুটস

হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে কিশমিশ, কাজু, খেজুরের মতো ড্রাই ফ্রুটস বেশি করে খেতে পারেন। এতে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় আয়রন। অ্যাপ্রিকটেও প্রচুর পরিমাণে আয়রন আছে। হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি কমাতে এগুলো খেলে উপকার পাবেন।

সামুদ্রিক মাছ

সামুদ্রিক মাছে আয়রন বেশি পরিমাণে থাকে। চিংড়ি, পমফ্রেটের মতো কিছু সামুদ্রিক মাছে ভাল মাত্রায় আয়রন থাকে। যারা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন, তারা এই মাছগুলো খেতে পারেন।

Saturday, September 16, 2023

ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব

 নাসা গত বছর জানায়, তারা আনআইডেন্টিফাইড অ্যানোমালাস ফেনোমেনা (ইউএপি) বা অজ্ঞাত অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ যাচাই-বাছাই করছে। একইসঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাষায় ইউএফও’র পরিবর্তে ইউএপি লেখার প্রচলন ঘটে।

অনেকদিন ধরেই পৃথিবীর আকাশে ভিনগ্রহের প্রাণীদের চালানো নভোযান বা আনআইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট (ইউএফও) উড়ে বেড়ানোর বিষয়ে গুজব ও জল্পনা কল্পনা চলছে। এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করার পর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। এতে প্রমাণ হতে পারে ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব। 



১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ এএফপির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে।

নাসা গত বছর জানায়, তারা আনআইডেন্টিফাইড অ্যানোমালাস ফেনোমেনা (ইউএপি) বা অজ্ঞাত অস্বাভাবিক ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ যাচাই-বাছাই করছে। একইসঙ্গে আনুষ্ঠানিক ভাষায় ইউএফও'র পরিবর্তে ইউএপি লেখার প্রচলন ঘটে।

সাধারণ মানুষের কাছে সব সময়ই শিহরণ-জাগানিয়া বিষয় হলেও মূলধারার বিজ্ঞানীদের কাছে ইউএফও ব্রাত্য বিষয় হিসেবেই পরিচিত ছিল এতকাল।

১৬ জন গবেষকের সমন্বয়ে গঠিত একটি নিরপেক্ষ দল মে মাসে তাদের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করে। তখন জানানো হয়, হাতে থাকা তথ্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ এ বিষয়ে কোন উপসংহার টানার জন্য যথেষ্ট নয়। তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আরও উচ্চমানের তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানান।

আজকে প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনে এই মতাদর্শ থেকে খুব একটা সরে আসার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই বলে ভাবছেন বেশিরভাগ বিশ্লেষক । যার ফলে, ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণের বদলে হয়তো নাসা নতুন করে ইউএপির অনুসন্ধানে আরেকটি অভিযান শুরু করতে পারে।

নাসার বিভিন্ন নভোযান ও রোভার সৌরজগতের অন্যান্য অংশে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার কাজে ব্যবহার হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূর-দূরান্তের গ্রহে বুদ্ধিদীপ্ত সভ্যতার নিদর্শন খোঁজার চেষ্টা করলেও ঐতিহাসিক ভাবে, পৃথিবীতে ভিনগ্রহের প্রাণীর উপস্থিতি নিয়ে 'গুজব' ভুল প্রমাণ করার পেছনেই এই সংস্থাটি অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে।

মে মাসে এই বিজ্ঞানীরা জানান, তারা ২৭ বছরে বর্ণিত ৮০০টি 'ঘটনা' নিয়ে কাজ করেছেন। যার মধ্যে ২ থেকে ৫ শতাংশকে তারা 'অস্বাভাবিক' বা অনিয়মিত বলে অভিহিত করেন।

এগুলোকে 'যেকোনো বস্তু যা সেন্সর বা সেন্সরের পরিচালক তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত বা অনুধাবন করতে পারেনি' অথবা 'উদ্ভট কোনো ঘটনা' হিসেবে বর্ণনা করেন বিজ্ঞানী দলের অন্যতম সদস্য নাদিয়া ড্রেক।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন সরকার ইউএপিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, কারণ তারা মনে করেন, এর সঙ্গে বিদেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রমের সংযোগ রয়েছে। অর্থাৎ, এমনও হতে পারে যে মানুষ যেগুলোকে ভিনগ্রহের প্রাণীর কাজ ভাবছে, সেগুলো হয়তো চীন বা উত্তর কোরিয়ার মতো বৈরি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা কার্যক্রম!



নাসার পাশাপাশি পেন্টাগনও এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত পরিচালনা করছে। তারা একে অপরের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক উপকরণের ব্যবহার ও প্রক্রিয়া নিয়ে সমন্বয় করলেও ২টি কার্যক্রম পুরোপুরি আলাদা।

জুলাই মাসে এক সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাড়া ফেলেন। কংগ্রেসের এক কমিটির কাছে দাবি করেন, তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে সরকারের কাছে ইউএপি ও ভিনগ্রহের প্রাণীর দেহাবশেষ আছে। 

এ সপ্তাহের শুরুতে 'নন-হিউম্যান' (মানুষ নয়) সন্দেহ করা হচ্ছে এমন ২ প্রাণীর দেহ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক শুনানিতে উপস্থাপন করা হয়। যার ফলে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্ময়, অবিশ্বাস ও হাস্যরস ছড়িয়ে পড়ে।

মমির মতো দেখতে এই দেহাবশেষের রঙ কিছুটা ধূসর আর এটি দেখতে মানবদেহের মতোই। জেমি মসেন নামে মেক্সিকোর এক বিতর্কিত সাংবাদিক এই মরদেহগুলো উপস্থাপন করেন। তিনি ২০১৭ সালে পেরুতে এই দুই 'এলিয়েনের' মরদেহ খুঁজে পাওয়ার দাবি জানান।

Friday, September 15, 2023

প্রাণীরাও কি স্বপ্ন দেখে?

 ঘুমের একটি পর্যায়ের সঙ্গে স্বপ্নের সম্পর্ক রয়েছে। ইংরেজিতে র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ বা সংক্ষেপে রেম (REM) ঘুম বলা হয় এটিকে। এ ধরনের ঘুমের সময় চোখ খুব দ্রুত নড়াচড়া করে। ঘুমের এ দশাতেই সাধারণত মানুষ সবচেয়ে স্পষ্ট স্বপ্নগুলো দেখে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অনেক প্রাণীই মানুষের মতো এ ধরনের রেম ঘুমের দশা প্রদর্শন করে। তার মানে কি প্রাণীরাও স্বপ্ন দেখে?

ছবি: টেরেসা ইগলেসিয়াস ভিয়া নোয়েবল ম্যাগাজিন


মানুষের ঘুমের একটি বিশেষ দশাকে ইংরেজিতে র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট স্লিপ বা সংক্ষেপে রেম (REM) ঘুম বলা হয়। এ ধরনের ঘুমের সময় চোখ খুব দ্রুত নড়াচড়া করে। ঘুমের এ দশাতেই সাধারণত মানুষ স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু প্রাণীরও কি রেম ঘুম আছে বা প্রাণীরা স্বপ্ন দেখে? বিজ্ঞানীরা এ প্রশ্নের উত্তর জানতে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাম্পিং স্পাইডার নামক এক জাতের মাকড়সা রেম ঘুমের মতো আচরণ প্রদর্শন করে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এটির পা কুঁচকে যায়, চোখের রেটিনা সামনে-পেছনে নড়াচড়া করে। মাকড়সার এ আচরণকে রেম ঘুমের খুবই অনুরূপ বলে মন্তব্য করেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অভ কন্সটানজের বাস্তুতন্ত্রবিদ ড্যানিয়েলা রসলার।

মানুষের ক্ষেত্রে রেম ঘুমের পর্যায়ে সবচেয়ে স্পষ্ট স্বপ্নগুলো তৈরি হয়। তাই বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন, যদি মাকড়সাও এ ধরনের ঘুমের নিদর্শন প্রদর্শন করে, তাহলে কি তারাও স্বপ্ন দেখে?

রসলার ও তার সহকর্মীরা ২০২২ সালে ৩৪টি সালে জাম্পিং স্পাইডারের ওপর গবেষণা করে দেখেন, প্রতি ১৭ মিনিট পরপর এ মাকড়সাগুলোর ভেতর রেম ঘুমের অনুরূপ পর্যায় তৈরি হয়। কিন্তু তারা অবশ্য এটা প্রমাণ করতে পারেননি, মাকড়সাগুলো আদতেই তখন ঘুমাচ্ছে কি না।

এখন পর্যন্ত জানা গেছে, প্রাণিকুলে কেবল মানুষেরই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যদি প্রমাণ করতে পারেন, জাম্পিং স্পাইডারও ঘুমায় এবং রেম ঘুমের সদৃশ যে দশা প্রদর্শন করে সেগুলো আদতেই রেম ঘুম, তাহলে মাকড়সারও স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যেই রেম ঘুমের অনুরূপ দশা পর্যবেক্ষণ করছেন। এ তালিকায় আছে স্থলের মাকড়সা, গিরগিটি থেকে শুরু করে সামুদ্রিক কাটলফিশ, জেব্রা ফিশ ইত্যাদি।

দ্রুত চোখ নড়াচড়ার পাশপাশি রেম ঘুমের আরও কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন, শরীরের ঐচ্ছিক পেশির কিছু সময়ের জন্য অচল হয়ে যাওয়া; মাঝেমধ্যে শরীর ঝাঁকি দেওয়া এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম, শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃৎকম্পের হার বেড়ে যাওয়া।

১৯৫৩ সালে ঘুমন্ত শিশুদের মাঝে প্রথম এ ধরনের ঘুমদশা প্রত্যক্ষ করা হয়। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্য বিড়াল, ইঁদুর, ঘোড়া, ভেড়া, আর্মাডিলো ইত্যাদির মাঝেও এ ধরনের ঘুমের অবস্থা দেখা গেছে।

স্বাভাবিক ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্রম ছন্দবদ্ধ থাকে। কিন্তু ঘুমের রেম দশায় মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালের তারতম্য দেখা যায়। আবার স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে রেম ঘুমের দশা সবার ক্ষেত্রে একই দেখায় না।

২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো কাটলফিশে রেম ঘুমের নমুনা লক্ষ করেন। প্রায় ৩০ মিনিট অন্তর মাছগুলো রেমদশা প্রদর্শন করে। এ ধরনের মাছ সজাগ অবস্থায় শত্রুর চোখ এড়াতে শরীরের রং বদল করে। কিন্তু গবেষকেরা দেখেন, রেম ঘুমের দশায়ও মাছের দেহের রং পরিবর্তন হচ্ছে। তারা সিদ্ধান্তে আসেন, ঘুমন্ত অবস্থায় মাছের মস্তিষ্কের সিগন্যালে কোনো কারণে মারাত্মক তারতম্য হচ্ছে বলেই মাছ ঘুমের মধ্যেও দেহের রং পরিবর্তন করছে।

এরপর অক্টোপাসেও একই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন বিজ্ঞানীরা। বেয়ার্ডেড ড্রাগনের মস্তিষ্কের ইলেকট্রোড থেকে আসা সিগন্যাল পরীক্ষা করেও রেম ঘুমের দশা পাওয়া গিয়েছে।

এ ধরনের দশায় প্রাণীগুলো ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো আচরণ করে। এ কারণেই এসব প্রাণীর স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিচ্ছেন গবেষকেরা।

কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে রেম ঘুমের সংযোগ পাওয়া গিয়েছে। কয়েকটি ইঁদুর গোলকধাঁধার ভেতর দৌড়ানোর পর ঘুমানোর সময় বিজ্ঞানীরা এগুলোর মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। তারা দেখেন, ইঁদুরগুলো ঘুমিয়ে থাকলেও এগুলোর মস্থিষ্কে দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী নিউরন সিগন্যাল দিচ্ছিল। এ থেকে ধারণা করা হয়, ওই ইঁদুরগুলো হয়তো ঘুমের মধ্যে কোনো স্বপ্ন দেখছিল এবং ওই স্বপ্নের পরিবেশ তাদের মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট নিউরনকে সচল করে তুলেছিল।

বিভিন্ন গবেষণায় এসব ইঙ্গিত পেয়ে বিজ্ঞানীরা তাই দৃঢ়ভাবেই মনে করেন, মানুষ ব্যতীত অন্য প্রাণীর স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে রেম ঘুম ও স্বপ্নের মধ্যকার স্পষ্ট কোনো সংযোগ এখনো পাওয়া যায়নি। মানুষ রেম ঘুম ছাড়াও স্বাভাবিক ঘুমেও স্বপ্ন দেখতে পারে।

মানুষ স্বপ্ন দেখলে তা পরে বলতে পারে। কিন্তু প্রাণীদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। আর প্রাণীরা স্বপ্ন দেখে কি না তা প্রমাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ এটাই।

এদিকে রেম আদতে কেন হয় তা নিয়েও কোনো অবিসংবাদিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। ‌এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটি তত্ত্বের মতে, রেম মস্তিষ্ক গঠনে ও মস্তিষ্ককে পুনরায় সংগঠিত করতে সহায়তা করে।

অন্য তত্ত্বগুলোর মতে রেম মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে, দেহের নড়নচড়ন ব্যবস্থার বিকাশে সাহায্য করে, জাগ্রত অবস্থায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় দরকারি মস্তিষ্কের বিভিন্ন নিউরনকে সচল রাখে বা মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বাড়ায়।

কিন্তু মানুষের সঙ্গে দূরবর্তী সম্পর্কের অন্য প্রাণীও যদি রেম ঘুম যায়, তাহলে তার অর্থ হচ্ছে এ ধরনের শারীরিক দশার প্রয়োজনীয়তা উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তবে সব বিজ্ঞানী আবার অন্য প্রাণীর রেম ঘুমের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া – লস অ্যাঞ্জেলেস-এর স্নায়ুবিদ জেরোম সিজেল মনে করেন, মাকড়সার মতো অনেক প্রাণী হয়তো ঘুমায়ই না। তিনি বলেন, 'প্রাণীরা হয়তো এমন সব কাজ করে যেগুলো দেখতে মানুষের কাজের মতো মনে হয়, কিন্তু প্রাণীর ওসব কাজের শারীরবৃত্ত মানুষের মতো নয়।'

প্রাণীরা যদি আদতেই স্বপ্ন দেখতে পারে, তাহলে সেক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি হয় — কী ধরনের স্বপ্ন দেখে তারা? স্বপ্ন তৈরি হয় স্বপ্নদ্রষ্টার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, তাই প্রাণী স্বপ্ন দেখলে এটি পৃথিবীকে তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সক্ষমতা পাবে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন দার্শনিক ডেভিড এম পেনা-গুজম্যান।

প্রাণী স্বপ্ন দেখতে পারলে তাদের কল্পনাশক্তিও থাকবে, বলেন তিনি। সেক্ষেত্রে এ ধরনের প্রাণী নিয়ে মানুষকে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে।

ক্যারোলিন উইলক, নোয়েবল ম্যাগাজিন [Daily Star]

Thursday, September 14, 2023

বিশ্বের নিষিদ্ধ ৬ স্থান

 নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতূহল সবসময়ই বেশি। এই কৌতূহলই পৃথিবীর দুর্গম স্থানগুলোতে অভিযানে মানুষকে উৎসাহিত করেছে। তারপরও এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।



এরিয়া ৫১, নেভাডা, যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় অবস্থিত 'এরিয়া ৫১' সামরিক ঘাঁটি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় জায়গা। সেখানে কী হয়, তা আজ পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করে বলেনি। ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত মার্কিন সরকার এই জায়গাটির অস্তিত্ব স্বীকারই করেনি।

মার্কিন সেনাবাহিনীর ১৯৯২ সালের কিছু নথি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং তখন এই সেনা ঘাঁটির কথা স্বীকার করা হয়। তারপরও এরিয়া ৫১ এ কী ধরণের কাজ বা গবেষণা হয়, তা মার্কিন সরকার নিশ্চিত করেনি। এটি মার্কিন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে চর্চিত এবং একই সঙ্গে সবচেয়ে গোপন ঘাঁটি।

বলা হয়, মার্কিন সেনাবাহিনী ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা যখন এই সেনাঘাঁটিতে যান, তখনও উড়োজাহাজ অবতরণের সময় জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে বাইরের কিছু দেখা না যায়।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের বক্তৃতায় এরিয়া ৫১ এর নাম উল্লেখ করেন বারাক ওবামা।

হিলারি ক্লিনটন ও বার্নি স্যান্ডার্সের মতো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরাও তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় অঙ্গীকার করেছিলেন, নির্বাচিত হলে তারা এরিয়া ৫১ এর রহস্য উৎঘাটন করবেন।

স্নেক আইল্যান্ড, ব্রাজিল

ব্রাজিলের ইলহা ডি কুইমাডা গ্র্যান্ডে দ্বীপকে স্নেক আইল্যান্ড বা সর্পদ্বীপ বলা হয়। কারণ, এটি প্রাণঘাতী সাপের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।

গোল্ডেন ল্যান্সহেড ভাইপার এতই বিষাক্ত যে এটি কামড়ালে আশেপাশের মাংস পর্যন্ত গলে যায়। বলা হয়, স্নেক আইল্যান্ডের কিছু জায়গায় প্রতি বর্গমিটারে একটি করে সাপ আছে। নিরাপত্তার স্বার্থে ব্রাজিল সরকার দ্বীপটিতে যেতে কোনো পর্যটককে অনুমতি দেয় না।

এমনকি, গবেষণার কাজে কেউ সেখানে গেলেও সঙ্গে একজন চিকিৎসক রাখা বাধ্যতামূলক।

লেসকো গুহা, ফ্রান্স

১৯৪০ সালে ফ্রান্সের লেসকো গুহায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের চিত্রকর্মের সন্ধান পাওয়া যায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি একটি পর্যটন স্থানে পরিণত হয়।

দর্শনার্থীদের নিঃশ্বাস থেকে উৎপন্ন কার্বন মনোক্সাইডের কারণে গুহাচিত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ফলে, গুহাটিতে ১৯৬৩ সালে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

এটি এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। আসল গুহাটি বন্ধ হলেও দর্শনার্থীদের জন্য অনুরূপ কৃত্রিম গুহা চালু করা হয়েছে। তবে, গবেষক ও সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষ এখনো আসল গুহাটিতে প্রবেশ করতে পারেন।

উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ, ভারত

বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ উত্তর সেন্টিনেল। এই দ্বীপ সম্পর্কে মানুষের কেবল ধারণাই রয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।

ধারণা করা হয়, এই দ্বীপের বাসিন্দারা ৬০ হাজার বছর ধরে সেখানে বসবাস করছে। তারা পুরো পৃথিবী থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

২০০৬ সালে ২ জেলে নৌকাডুবির কবলে পড়ে দ্বীপটিতে আশ্রয় নেয়। পরে দ্বীপের অধিবাসীরা তাদেরকে হত্যা করে। ওই দ্বীপের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার যাওয়ার সময়ও দ্বীপের বাসিন্দারা তীর ছুঁড়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

ভারত সরকার সেখানে বসবাসকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনোভাবেই সফল হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই দ্বীপটিতে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত সরকার।

চেরনোবিল, ইউক্রেন

১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ইউক্রেনের চেরনোবিলের কাছে (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত) একটি বিস্ফোরণ ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত পারমাণবিক দুর্ঘটনা।

বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, চেরনোবিল বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট বিকিরণের কারণে ক্যানসারে ৯ হাজার থেকে ১০ লাখ মানুষ মারা যাবে। এই ভয়াবহ ঘটনার পর থেকে ৩০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বিকিরণ বন্ধ করার প্রকল্পগুলো এখনো চলমান।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুসারে, অন্তত ২০ হাজার বছর এই অঞ্চলটি বসবাসের অযোগ্য থাকবে।

স্ভালবার্ড সীড ভল্ট

নরওয়ে এবং উত্তর মেরুর মাঝামাঝিতে অবস্থিত এই সীড ভল্টকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফ্রিজার বলা হয়। এই বিশাল শস্যাধারটিকে এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এটি অক্ষত থাকে।

পৃথিবীতে যদি কোনো ভয়াবহ দুর্যোগের ঘটনাও ঘটে, তবুও এখানে রক্ষিত ৮ লাখ ৯০ হাজার বীজ সুরক্ষিত থাকবে এবং দুর্যোগ পরবর্তী খাদ্যসংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশের শস্যবীজ সংরক্ষিত আছে এই ভল্টে। প্রতি বছর মাত্র কয়েকবার এই ভল্টের দরজা খোলা হয়। ভল্টে সীমিতসংখ্যক মানুষের প্রবেশাধিকার আছে।

সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট/ Daily star Bangla

Wednesday, September 13, 2023

বিমানবন্দর তো নয় যেন বিলাসবহুল আধুনিক শহর

 চাঙ্গি বিমানবন্দরকে শুধু সিঙ্গাপুরের বিস্ময় বললে কম বলা হবে। আধুনিকতা ও বিলাসিতার সমন্বয়ে তৈরি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই বিমানবন্দরটি সারা বিশ্বেই পরিচিত এর অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য। মানুষ কোনো গন্তব্যে যেতে বিমানবন্দর ব্যবহার করে। কিন্তু চাঙ্গি বিমানবন্দর নিজেই যেন একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।



সুযোগ-সুবিধা, আরাম, যাত্রীদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক ব্যবস্থার সমন্বয়ে তৈরি বিশ্বের সেরা এই বিমানবন্দরটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, এটি গতানুগতিক খোলসে আটকে না থেকে নিজেই একটি পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পার্ক, গার্ডেন, শপিং মল, বিয়ের আয়োজন থেকে শুরু করে কী নেই এতে! এ যেন বিমানবন্দর নয়, অত্যাধুনিক কোনো শহর।

যেন এক বিনোদনকেন্দ্র

অনেকেই ছুটির দিনে পরিবার পরিজন নিয়ে চাঙ্গির টার্মিনাল ১ এর সঙ্গে সংযুক্ত ১৫ লাখ বর্গফুট আয়তনের জুয়েল শপিং মলে ঘুরতে যান। দৃষ্টিনন্দন এই শপিং মলটির নকশা করেছেন বিখ্যাত কানাডীয় স্থপতি মোশে সাফদি ও তার দল। এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে ৭ তলা বিশিষ্ট কৃত্রিম ঝরনা, যা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইনডোর ঝরনার খেতাব পেয়েছে। শপিং মলটিতে ডিজনির আদলে তৈরি লাইট ও মিউজিক শোর ব্যবস্থাও আছে।

চাঙ্গিতে হয় বিয়ের অনুষ্ঠানও। ছবি: চাঙ্গি বিমানবন্দরের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া


অনেকেই সারাদিন কাটানোর জন্য চাঙ্গিতে যান। বিমানবন্দরটিতে পাতাল রেল ও বাসে করে খুব সহজেই যাওয়া যায়। সেখানে আপনি সিনেমা দেখতে পারেন, খাবার খেতে পারেন, মুদি কেনাকাটা করতে পারেন, এমনকি পড়াশোনার জন্য নিরিবিলি জায়গাও খুঁজে পেতে পারেন। বছরের পর বছর ধরে এটি বিয়ের শুটিং এবং পুনর্মিলনীর কাজেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।



মহামারির পর এখনো আগের মতো যাত্রী পরিবহন সক্ষমতায় পৌঁছাতে পারেনি বিমানবন্দরটি। তবে মানুষের কাছে এটি একটি নিছক ভ্রমণ কেন্দ্র না হয়ে আড্ডা ও বিনোদনের অন্যতম স্থান হয়ে উঠছে।

আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশেল

আধুনিকতা ও নান্দনিকতার মিশেলে তৈরি চাঙ্গিকে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের খেতাব দিয়েছে বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর র‌্যাংকিং ও রিভিউ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কাইট্র্যাক্স।

স্কাইট্র্যাক্স বিশ্বের বিমানবন্দরগুলোর গ্রাহক সন্তুষ্টির ওপর বৃহত্তম বার্ষিক জরিপ পরিচালনা করে, যেখানে ভ্রমণকারীরা ৫৫০টিরও বেশি বিমানবন্দরের পরিষেবা এবং সুবিধা মূল্যায়ন করে থাকেন। চাঙ্গি স্কাইট্র্যাক্সের র‌্যাংঙ্কিংয়ে ১২ বার শীর্ষস্থান দখল করেছে, যার মধ্যে গত এক দশকেই ৮ বার বিমানবন্দরটি র‌্যাংকিংয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে।



গত ২ বছর দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরের কাছে শীর্ষস্থান হারানোর পর গত মার্চে বিমানবন্দরটি আবারও তার মুকুট পুনরুদ্ধার করে। 'অতুলনীয় যাত্রী অভিজ্ঞতার' জন্য চাঙ্গির প্রশংসা করেছে স্কাইট্র্যাক্স।

২০১৯ সালে করোনা মহামারির আগে চাঙ্গি বিমানবন্দর উড্ডয়ন ও অবতরণ মিলিয়ে ৩ লাখ ৮২ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে, যেগুলো ৬ কোটি ৮০ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে।

গার্ডেন, পার্ক ও অন্যান্য

চাঙ্গির অন্যান্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেইনফরেস্ট, হেজ মেজ (গোলকধাঁধা) এবং একটি ১২ মিটার উঁচু স্লাইড। আপনি যদি কোথাও যাওয়ার সময় বিমানবন্দরটিতে একটু আগে চলে আসেন, তাহলে সময় কাটানোর বহু অনুষঙ্গ পাবেন। ট্রানজিট লাউঞ্জে স্পা, বিনামূল্যে সিনেমা দেখা, সুইমিং পুল, ম্যাসাজ চেয়ার এবং প্রজাপতি বাগানে সময় কাটাতে পারেন।



বিমানবন্দরটিতে আরও আছে ক্যাকটাস গার্ডেন, বাউন্সিং নেট, ক্যানোপি পার্ক, ক্যানোপি ব্রিজ, ক্রিস্টাল গার্ডেন, ডিসমকভারি স্লাইড, ডিসকভারি গার্ডেন, এনচান্ডেট গার্ডেন, হেরিটেজ জোন, মিরর মেজ, পেটাল গার্ডেন, ইমারসিভ ওয়াল, কাইনেটিক রেইন, সিঙ্গাপুর রোজাক, স্টিল ইন ব্লুম, সূর্যমুখী বাগান, শাপলার বিলসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।

২০১৯ সালে করোনা মহামারির আগে চাঙ্গি বিমানবন্দর উড্ডয়ন ও অবতরণ মিলিয়ে ৩ লাখ ৮২ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে, যেগুলো ৬ কোটি ৮০ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে।

গার্ডেন, পার্ক ও অন্যান্য

চাঙ্গির অন্যান্য আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেইনফরেস্ট, হেজ মেজ (গোলকধাঁধা) এবং একটি ১২ মিটার উঁচু স্লাইড। আপনি যদি কোথাও যাওয়ার সময় বিমানবন্দরটিতে একটু আগে চলে আসেন, তাহলে সময় কাটানোর বহু অনুষঙ্গ পাবেন। ট্রানজিট লাউঞ্জে স্পা, বিনামূল্যে সিনেমা দেখা, সুইমিং পুল, ম্যাসাজ চেয়ার এবং প্রজাপতি বাগানে সময় কাটাতে পারেন।

বিমানবন্দরটিতে আরও আছে ক্যাকটাস গার্ডেন, বাউন্সিং নেট, ক্যানোপি পার্ক, ক্যানোপি ব্রিজ, ক্রিস্টাল গার্ডেন, ডিসমকভারি স্লাইড, ডিসকভারি গার্ডেন, এনচান্ডেট গার্ডেন, হেরিটেজ জোন, মিরর মেজ, পেটাল গার্ডেন, ইমারসিভ ওয়াল, কাইনেটিক রেইন, সিঙ্গাপুর রোজাক, স্টিল ইন ব্লুম, সূর্যমুখী বাগান, শাপলার বিলসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান।

যাত্রী অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিমানবন্দরটির নিরাপত্তাও বিশ্বসেরা। ব্যস্ততম বিমানবন্দর হওয়া সত্ত্বেও যাত্রীদের লাগেজ হারানোর ঘটনা এখানে ঘটে না বললেই চলে। অনেক সময় যাত্রীরা কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করলেও চাঙ্গির দারুণ ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানে এটিও সাধারণত ঘটে না।

চাঙ্গি বিমানবন্দরের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া


বর্তমানে বিমানবন্দরের পঞ্চম টার্মিনালের নির্মাণ কাজ চলছে। আগামী দশকের মাঝামাঝিতে এটি চালু করার কথা রয়েছে।

দক্ষতা ও সৌজন্যতার দিক থেকে সিঙ্গাপুরের সুনাম আছে। চাঙ্গিতে তাদের সেই সুনামের প্রতিফলনই দেখা যায়।

তথ্যসূত্র: চাঙ্গিএয়ারপোর্ট.কম, বিবিসি/ ডেইলিস্টার বাংলা

Monday, September 11, 2023

ডেঙ্গুতে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি কতটা?

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায়। আর যদি ডেঙ্গু হেমোরেজিক হয়, সে ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যু হার বেড়ে যায় ৪৫০ গুণ। সময়মতো রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা পেলে এই মৃত্যুহার ২৭ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। সুতরাং গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

সিভিয়ার বা জটিল ডেঙ্গু জ্বর:

এখানে রোগীর লক্ষণীয় মাত্রায় রক্তপাত থাকতে পারে, শকে অজ্ঞান হতে পারে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। এই গ্রুপের রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসাব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে সেবা দিতে হবে।

এ সময়ে রোগীর জ্বর হলে, এমনকি শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা না হলেও রক্তের কিছু পরীক্ষা করতে হবে। রক্তে হেমাটোক্রিট ২০ শতাংশ বেড়ে গেলে, পালস প্রেশার (সিস্টোলিক ও ডায়াস্টলিকের পার্থক্য) ১০-২০ শতাংশ কমে এলে, শ্বেত রক্তকণিকা পাঁচ হাজারের নিচে নেমে এলে, রক্তের অণুচক্রিকা এক লাখের নিচে নামলে ধরে নিতে হবে তার ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হচ্ছে।

গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুর প্রভাব:

গর্ভধারণের প্রথম দিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে (৩ থেকে ১৩ শতাংশ), জন্মগত ত্রুটি কম হলেও মস্তিষ্কের গঠনগত সমস্যা হতে পারে। গর্ভের মধ্য বা শেষ দিকে হলে সময়ের আগে পানি ভাঙতে পারে, সময়ের আগে সন্তান প্রসব হতে পারে, বাচ্চার ওজন কম হতে পারে, এমনকি পেটে বাচ্চা মারা যেতে পারে। জন্মের সময় শিশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সন্তান প্রসবের আগে রক্তক্ষরণ বা প্রসব–পরবর্তী রক্তক্ষরণে শক এমনকি প্রসূতির মৃত্যু হতে পরে।

চিকিৎসাব্যবস্থা:

১) জ্বর ও ব্যথা প্রশমন করতে হবে। প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে। অ্যাসপিরিন বা কোনো ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়া যাবে না।

২) বেশি করে তরলজাতীয় খাবার (স্যালাইন, শরবত, ফলের রস, ভাতের মাড়, ডাবের পানি ইত্যাদি) খেতে হবে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।

৩) অবশ্যই গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, মৃদু জ্বর/উপসর্গ দেখা না দিলেও।

৪) বিপজ্জনক সময়ে সচেতন থাকতে হবে। সাধারণত জ্বরের পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিন যখন জ্বর ছাড়তে শুরু করে, তখন কাপিলারি লিকেজ হয় এবং ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময় শরীরে তরলের পরিমাণ যেন ঠিক থাকে, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।

৫) সপ্তম দিনের পরপরই আবার কোষে পানি আসা শুরু হয়। তখন কিন্তু ফ্লুইড অতিরিক্ত দেওয়া যাবে না, তাহলে ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

৬) রক্ত বা তাজা রক্ত দরকার হলে সংগ্রহের পাঁচ দিনের মধ্যে দিতে হবে। নরমাল ডেলিভারির সময় প্লাটিলেট ৫০ হাজার আর অস্ত্রোপচারের সময় ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার থাকলেও চলে। তবে মনে রাখতে হবে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া অস্ত্রোপচারে যাওয়া উচিত নয়।



লিখেছেনঃ 

ডা. আরিফা শারমিন মায়া, কনসালট্যান্ট

গাইনি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

Sunday, September 10, 2023

১১০ ট্রিলিয়ন মশকবাহিনীর আক্রমন ৮ বিলিয়ন মানুষের ওপর

 মশার ইতিহাস ও মানবজাতির সংকট নিয়ে টিমথি ওয়াইনগার্ডের বিখ্যাত গ্রন্থ 'দ্য মসকুইটো: আ হিউম্যান হিস্টরি অব আওয়ার ডেডলিয়েস্ট প্রিডেটর'-এর শুরুটাই যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আহ্বান—'উই আর অ্যাট ওয়ার উইথ মসকুইটো' (আমরা মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি)। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। কিন্তু বিজয়ের লক্ষণ যে দেখা যাচ্ছে না। ২২ আগস্ট ২০২৩ বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মশার ভয় তার বক্তব্যের একাংশ ভুলিয়ে দিয়েছে বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তার সঙ্গী একজন মশা মারার বৈদ্যুতিক ব্যাট নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন, তবুও ভুলে যাওয়া কথা আর স্মৃতিতে জেগে ওঠেনি। মশা মারতে কামান দাগা—এ নিয়ে বিস্তর হাসিঠাট্টা হলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কামানই যথেষ্ট নয়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক মিসাইলও মশার বিরুদ্ধে তুচ্ছ অস্ত্র।



অবিশ্বাস্য মনে হওয়ারই কথা, কিন্তু গবেষকেরা হিসাব করেই দেখিয়েছেন, গত ২ লক্ষ বছরে পৃথিবীতে যত মানুষ সৃষ্টি হয়েছে, তার অর্ধেকের মৃত্যু ঘটেছে মশার আক্রমণে, মশার কামড়জনিত ব্যাধিতে।

২.৫ মিলিগ্রাম ওজনের মশার কামড়ে পৃথিবীতে গড়পড়তা এক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা অন্তত ৭ লক্ষ মৃত্যুর প্রত্যয়ন তো করছেনই। বাকি ৩ লক্ষ দরিদ্র দেশগুলোতে, যা সম্ভবত শনাক্তই হয়নি।

মশকসৃষ্ট যে রোগগুলো মানুষের পাইকারি হারে মৃত্যু ঘটাচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে ম্যালেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস (আফ্রিকাতে নীলনদ অঞ্চলে এর প্রকোপ), ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাস, ইয়েলো ফিভার এবং চিকুনগুনিয়া।

টিমথি ওয়াইনগার্ড বলছেন, অ্যান্টার্কটিকা, আইসল্যান্ড, সিসিলিজ ও ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ান কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ বাদ দিয়ে গোটা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে ১১০ ট্রিলিয়ন মশকবাহিনীর অবিশ্বাস্য রকম বৃহৎ একটি দল, তাদের দৃষ্টি পৃথিবীর ৮ বিলিয়ন মানুষের ওপর।

গত ২ লক্ষ বছরে পৃথিবীতে বিরাজ করেছে ১০৮ বিলিয়ন মানুষ আর মশা হরণ করেছে তাদের মধ্যে ৫২ বিলিয়ন মানুষের জীবন। এর চেয়ে বড় ঘাতক দুর্বৃত্তের দেখা মেলেনি, দুই মহাযুদ্ধের মোট মৃত্যু মশকমৃত্যুর তুলনায় নস্যিমাত্র।

মশকমৃত্যু: সেলিব্রিটি

২০ মে ১৪৯৮ পর্তুগিজ অভিযাত্রী নির্মম নাবিক ভাস্কো দা গামা সদম্ভে ভারতবর্ষের কালিকটে পা রাখলেন। মরিচ আর দারুচিনির ঘ্রাণে উতলা এই অভিযাত্রী যদি কেবল লুণ্ঠনমূলক মসলা-বাণিজ্যে নিবেদিত না হয়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতেন, দক্ষিণ এশীয় এই পুরো অঞ্চলটিই হতো পর্তুগিজ উপনিবেশ। আমাদের পড়তে হতো ভিন্ন এক ঔপনিবেশিক ইতিহাস। ভাস্কো দা গামার হত্যাযজ্ঞ আর লুণ্ঠনের প্রতিশোধ নেওয়ার সক্ষমতা ভারতবর্ষের ছিল না। ১৫২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে পর্তুগিজ রাজকীয় নির্দেশে ভারতের ভাইসরয় হয়ে ১৪টি জাহাজের বহর নিয়ে হিজ এক্সিলেন্সি ভাস্কো দা গামা এপ্রিল মাসে তার তৃতীয় ভারতবর্ষ অভিযানে সমুদ্রযাত্রা করলেন। সেপ্টেম্বরে এসে পৌঁছলেন, নতজানু ভারতীয়দের তাকে স্বাগত জানানো ছাড়া ভিন্ন কোনো কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। ভাইসরয় পৌঁছেই টের পাইয়ে দিলেন তিনি কত প্রতাপশালী। কিন্তু তার প্রতাপকে মোটেও পাত্তা দেয়নি একটি ক্ষীণদেহী ভারতীয় এনোফিলিশ মশা। কখন যে হুল ফুটিয়ে ম্যালেরিয়ার জীবাণুু ঢুকিয়ে দিল পর্তুগিজ বীরপুরুষ, নবনিযুক্ত ভাইসরয় ভাস্কো দা গামা বুঝতেও পারেননি। বুঝলেন যখন প্রচণ্ড জ¦রে তাকে শয্যা নিতে হলো। ওদিকে বড়দিন উদ্যাপনের আয়োজনও চলছিল। ঠিক তার আগের দিন ২৪ ডিসেম্বর ১৫২৪ ক্রিসমাস ইভে ভারতবর্ষেই প্রাণ হারালেন ভাস্কো দা গামা। ফোর্ট কোচির সেইন্ট ফ্রান্সেস চার্চ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়। ১৫ বছর পর ১৫৩৯ সালে জাতীয় বীর খেতাব দিয়ে ভাস্কো দা গামার দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে সোনার কাসকেটে ভরে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে এনে জেরিনোমোস চার্চে পুনরায় সমাহিত করা হলো।

মশাটা জানলও না ভারতীয়দের পক্ষে তার কাজ বড় প্রতিশোধ নিয়েছে। জানলেও এনোফিলিস ও তার স্বজাতির মশাদের বীরের মর্যাদা দেওয়া দূরে থাক, তাদের চিহ্নিত করা হলো ঘাতক হিসেবে দ্য ডেডলিয়েস্ট অ্যানিমেল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। টিমথি ওয়াইনগার্ড এই মশাকে বলেছেন জেনারেল এনোফিলিস। এই জেনারেল মানে সাধারণ নয়, সামরিক পদবি জেনারেল।

বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর ৩২ বছর বয়সে রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ এখনো সুনিশ্চিতভাবে অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। তবে ম্যালেরিয়া কিংবা টাইফয়েড—এ দুটোকে সন্দেহ করা হচ্ছে, টাইফয়েডের পক্ষে সমর্থন বেশি।

২১ সেপ্টেম্বর ১৫৫৮ স্পেন ও হলি রোমান এম্পায়ারের রাজা পঞ্চম চার্লস যে ৫৮ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। রাজপ্রাসাদের দেয়াল বাঘ আর সিংহের জন্য দুর্ভেদ্য হতে পারে, কিন্তু মশার জন্য নয়। মশাদের প্রবেশাধিকার সেকালেও ছিল, একালেও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টের কন্যা এবং পরবর্তী একজন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী সারাহ নক্স টেয়লর মাত্র ২১ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারান ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৩৫। বিখ্যাত স্কটিশ অভিযাত্রী ডেভিড লিডিংস্টোন মশার কামড় খেয়েই ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা গেছেন। সেকালের ক্ষমতাবান চেঙ্গিস খান এবং একালের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয়নি সত্য কিন্তু দুজনেই বেশ ভুগেছেন।

হলিউড স্বর্ণযুগের নায়ক এরোল ফ্লিন (১৯০৯-১৯৫৯) কুড়ি বছর বয়সে নিউ গিনিতে তামাক চাষের খামারে গিয়ে মশার দংশনে ম্যালেরিয়ায় শয্যা নিয়েছিলেন। উঠে দাঁড়িয়েছেন, হলিউডে রাজত্ব করেছেন, কিন্তু শরীরের ভাঙন ঠেকাতে পারেননি। পঞ্চাশ বছর বয়সেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।

১২২৭-এ রণাঙ্গনের ক্ষত সারাতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন চেঙ্গিস খান, সে সময় দুর্বৃত্ত মশক তার মধ্যে ম্যালেরিয়া সংক্রমিত করে। বেশ কয়েক মাস তিনি শয্যাশায়ী থাকেন। শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও এরপর আর বেশি দিন বাঁচেননি।

ট্রাফালগার যুদ্ধের বিজয়ী বীর হোরাশিও নেলসন (১৭৫৮-১৮৫৫) তার নৌসেনা জীবনের শুরুতে ম্যালেরিয়ায় খুব ভুগেছেন। একালের পরিবেশবিদ ডেভিড অ্যাটেনবরা (জন্ম ১৯২৬) তার বিশ্ব-পর্যটনের কোনো একপর্যায়ে মশক দংশনে কাবু হয়ে শয্যা নেন এবং দীর্ঘদিন ভোগেন। মাইকেল কেইন (১৯৩৩) সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসের (১৪৫১-১৫০৬) চতুর্থ সমুদ্রযাত্রায় ১৫০৩ সালে এশীয় সামুদ্রিক রুটে আসার কথা ছিল। কিন্তু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছিল। 

মশার আক্রমণ ও ম্যালেরিয়ায় বিপুলসংখ্যক সৈন্যের মৃত্যু বহু যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছে। 



মশক বিচিত্রা

আপনার আশপাশে কোথাও মিষ্টি চকোলেট, ক্যারামেল কিংবা অন্য চকোলেটজাতীয় কোনো খাবার রেখে দেখুন কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে টার্গেট করে এগিয়ে আসা মশাগুলোর মাথা গুলিয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। এই খাবারের ঘ্রাণ এবং মানুষের নিশ্বাস নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘ্রাণের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য করতে না পারাই মশার এই সিদ্ধান্তহীনতার কারণ। মশা তার টার্গেট ঠিক করে ঘ্রাণ দিয়ে। মশা কি জন্মান্ধ? মোটেও না; মশা দেখতে পায় এবং অত্যন্ত কম আলোতে মানুষ যেখানে দেখতে ব্যর্থ, মশা সাফল্যের সাথে তার কাছে যা দর্শনীয় তা দেখে থাকে। তবে মানুষের মতো করে বস্তুর স্পষ্ট ইমেজ দেখতে পায় না। মশার টার্গেট শনাক্তকরণ পদ্ধতিটি বেশ জটিল; এতে দৃষ্টির ভূমিকা সামান্যই। যদি মানুষকে টার্গেট করে থাকে, তাহলে প্রধান আকৃষ্টকারী উপাদান হচ্ছে মানুষের নিশ্বাস, আরও সুনির্দিষ্টভাবে নিঃসৃত কার্বন ডাই-অক্সাইড। গুরুত্বপূর্ণ হলেও শনাক্তকরণের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডের পাশাপাশি মানুষের শরীরের উত্তাপ, ঘাম ও ত্বকের ঘ্রাণ উল্লেখযোগ্য আকর্ষক হিসেবে কাজ করে থাকে। ৫০ গজ দূর থেকে মশা কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘ্রাণ শনাক্ত করতে পারে। মশার কার্বন ডাই-অক্সাইড আসক্তির প্রমাণ মশা মানুষের মুখমণ্ডলের চারপাশে ঘুরঘুর করতে ভালোবাসে। কারণ, এই অঞ্চলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি ও ঘনীভবনের মাত্রা বেশি।

মানুষের অজ্ঞতার কারণে মশার চৌদ্দগুষ্টি আমাদের গালমন্দের শিকার। বাস্তবে ৩০০০ প্রজাতির মশা থাকলেও ১০০ প্রজাতি কামড়ে থাকে। আর মানুষের সামনে এসে কামড়ানো সাধারণ মশা ৮-১০ প্রজাতির বেশি নয়। আবার স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে সকল মশার মুণ্ডুপাত কতটা সমীচীন, ভেবে দেখা দরকার। পুরুষ মশা আপনার আমার ধারেকাছেও আসে না। তাদের আহার্য মানবরক্ত নয়, অন্য কোনো প্রাণীর রক্তও নয়। পুরুষ মশা ফুলের মধু আহরণ করে এবং তা খেয়ে একজীবন (প্রায় ছয় মাস) বেঁচে থাকে। মানবজাতির সাথে মশকজাতির পূর্বে শত্রুতার একটি মিথ আমাজন অঞ্চলে প্রচলিত থাকলেও বাস্তবে শত্রুতার যুক্তিসংগত কোনো কারণ নেই। স্ত্রী মশাকে ডিম পাড়তে হয়, শারীরিক চাহিদার কারণে তাকে প্রোটিন গ্রহণ করতে হয়। আর মশার জন্য তা সহজলভ্য মানুষের শরীরে। মানুষের নিশ্বাস ও শরীরের ঘ্রাণ সহজেই স্ত্রী মশাকে আকৃষ্ট করে, তার রক্ত সেবন করতে প্রলুব্ধ করে। স্ত্রী মশা সাধারণভাবে আগ্রাসী আচরণের হয়ে থাকে। স্ত্রী মশা মানুষের ঘামে আকৃষ্ট। ঘাম ও ব্যাকটেরিয়া মিলে শরীরে লেপ্টে থাকা শুকনো ঘাম মানুষের অজান্তে মশাকে আমন্ত্রণ জানায়।

মশা কামড়ায় বেশ তো; কিন্তু আপনি চুলকান কেন? 

মশা প্রাকৃতিকভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষের শরীর থেকে যে রক্ত টেনে নেয়, অল্পক্ষণের মধ্যেই তো সেই রক্ত জমাট বেঁধে মশার মরে যাবার কথা। কিন্তু তা তো ঘটছে না। মশার থুতু ও স্যালাইভায় রয়েছে অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট অর্থাৎ রক্ত জমাটবিরোধী উপাদান। প্রথমেই এই তরল ঢেলে দিয়ে রক্তের জমাট বাঁধা ঠেকাবার আয়োজন করে। সুতরাং রক্ত সেবনের পরপরই জমাট রক্তে তার পেট কঠিন পদার্থে পরিণত হয় না। স্যালাইভার আর একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে অ্যানেসথেটিক শরীরের নির্দিষ্ট জায়গা কিছু সময়ের জন্য অসাড় করে রাখে, আপনি তাৎক্ষণিকভাবে টের পান না আপনার শরীর 'ব্লাড সাকার' আক্রান্ত হয়েছে। এটি লোকাল অ্যানেসথেশিয়া। ভরপেট লাঞ্চ কিংবা ডিনার করে মশা উড়ে গেল। অ্যানেসথেশিয়ার প্রভাবও কেটে গেল, অমনি আপনি চুলকাতে শুরু করলেন। অর্থাৎ মশা থুতু-স্যালাইভার সাথে কিছুটা চুলকানির উপাদানও ঢেলে দিয়ে যায়। যতক্ষণ না তা শেষ হচ্ছে, চুলকানোর তাড়না দূর হচ্ছে না। পাখাওয়ালা প্রাণীদের মধ্যে কম গতিশীল একটি হচ্ছে মশা। যেখানে একটি মৌমাছি ঘণ্টায় ১৫ মাইল পথ অতিক্রম করতে পারে, একই সময়ে মশা যেতে পারে সর্বোচ্চ ১.৫ মাইল। সে কারণেই মানুষের হাতে মশা সহজে মারা পড়ে।

গুনগুন গুন গান গাহিয়া কোন ভ্রমরা এল—ভ্রমরা ভাগ্যবান। রোমান্টিক একটি পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু একই কায়দায় ডানার সঞ্চরণে মশাও গান গেয়ে থাকে—সে গান শুনে মানুষের রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের কথা মনে পড়ে। মানুষ আকৃষ্ট না হোক, যখন স্ত্রী মশার গান শুরু হয়, ফুলবনে ঘুরে বেড়ানো পুরুষ মশার আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়। রোমান্টিক আবহে মশক জোড়ের মিলন ঘটে।

মশা লাল ও কমলা রঙে আকৃষ্ট, কালোতেও। তবে মশার অপ্রিয় চারটি রং হচ্ছে—সাদা, বেগুনি, সবুজ আর নীল।

মানুষ তার নিজের ওজনের কত শতাংশের সমপরিমাণ খাবার খেতে পারে? স্ত্রী মশার সক্ষমতা স্মরণ রাখুন: নিজের ওজনের তিন গুণ রক্ত শুষে সঞ্চয় করে সানন্দে উড়ে যেতে পারে।

বোমারু বিমান মসকুইটো

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৩ নাৎসিদের ক্ষমতায় আরোহণ ও হিটলারের জার্মান চ্যান্সেলর হবার দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রপাগান্ডা মন্ত্রী হারমান গোয়েরিং বার্লিনে জার্মানির প্রধান বেতারকেন্দ্রে এসেছেন। তিনি এই দিনটিকে স্মরণ করে বেতার ভাষণ দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বেতারকেন্দ্র মসকুইটোর (মশা!) আক্রমণের শিকার হলো। গোয়েরিং প্রাণে বাঁচলেও অনেক কিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল।

এই মসকুইটো আসলে দুই ইঞ্জিনের বোমারু বিমান। জাহাজের পুরো পরিচিতি ভি হ্যাভিল্যান্ড ডিএইচ ৯৮ মসকুইটো। জিওফ্রে ডি হ্যাভিল্যান্ডের বোমারু বিমান বানাবার প্রকল্পটি বাতিল হয়েই যাচ্ছিল, কিন্তু বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল স্যার উইলফ্রিড ফ্রিম্যান কড়াভাবে এই মশা প্রকল্প সমর্থন করেন। এ জন্য তখনকার বিমান উৎপাদন ও পরিবহনমন্ত্রী লর্ড বিভারব্রুক এই মশার ভিন্ন একটি নাম দিলেন 'ফ্রিম্যানস ফোলি'। এই বোমারু মশার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দিনের বেলায় নিচু ও মাঝারি উচ্চতায় উড্ডয়ন করে বোমা ফেলতে পারে, রাতে হাই অলটিচিউড বোম্বার: এটি পাথফাইন্ডার, ফাইটার বোম্বার, চোরাগোপ্তা আক্রমণে দক্ষ, গোয়েন্দাবৃত্তির উপযোগী এবং শত্রুপক্ষের আকাশসীমা দিয়ে দ্রুতগামী কার্গো পরিবহনের কাজ করতে পারে। একজন পাইলট ও একজন নেভিগেটর সামনে পাশাপাশি বসেন এবং পেছনে বোম্বার বেতে থাকেন একজন। ১৯৫০-এর দশকে রয়াল এয়ারফোর্স থেকে মসকুইটি অপসারণ করে জেট ইঞ্জিনের আধুনিক যুদ্ধবিমান বহরে সংযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই যান্ত্রিক মশা অক্ষশক্তির অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল।

লেখক: এম এ মোমেন, দ্যা বিজনেস স্টান্ডার্ড